রফী হক
আমার স্কুল-কলেজের বন্ধুরা বেশিরভাগই মেধাবী ছিল। আমি ছাড়া সবাই তুখোড় ছাত্র ছিল। আমরা বেশির ভাগই ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি। একমাত্র আমারই শিল্পী হওয়ার ভূত চেপেছিল মাথায়। বাকিরা তাদের মেধা, নিষ্ঠা, সততা, পরিশ্রম দিয়ে আরদ্ধ জায়গায় পৌঁছে গেছে। কেউ সরকারের সচিব, কেউ অধ্যাপক, কেউ খ্যাতিমান নাট্যকার, কেউ মস্ত ডাক্তার, কেউ মস্ত ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিমানবাহিনীর, কেউ বা সেনাবাহিনীর ব্রিলিয়ান্ট অফিসার হয়েছে। কেউ কেউ বিরাট ব্যবসায়ীও হয়েছে। একজন তো আমেরিকায় পৃথিবী বিখ্যাত জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদের নির্বাহী কর্মকর্তা হয়েছিল। আমার বন্ধুরা ভালো করলে আমার খুব ভালো লাগে। নানা কারণে খুশি হই। সবচেয়ে বড় কারণ এদের কারও মনে কোনো হিংসা, অহংকার, ফুটানি বলে কিছু নেই। কারণ আমরা সবাই খুব মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হয়েছি। এখনকার মতো বিরাট সব নামকরা স্কুল–কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি। মফস্বলের খুব ছিমছাম স্কুল–কলেজে পড়েছি। কিন্তু সেসব স্কুলে কঠোর নিয়মের মধ্যে পড়ালেখা করেছি। কারণ আমাদের শিক্ষকেরা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই মানুষ গড়ার কারিগর।
আজ আমাদের বন্ধু সহপাঠী মকবুল হোসেন সরকারের সচিব হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছে মকবুল। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মকবুল তোমার জন্য অনেক শুভ কামনা। তুমি আগেও যেমন দেশের জন্য কাজ করেছো, আগামী দিনও তোমার নিষ্ঠা ও পরিশ্রম দিয়ে তাই করবে। পরমেশ্বর দয়াময় তোমার সহায় হোন এই প্রার্থনা করি।
আমি জানি বন্ধুরা কখনো বড় হয় না। বন্ধুতার বয়স উনিশ-কুড়িতে রয়ে যায় আজীবন। আমার স্কুলজীবনে অনেক রকমের স্বপ্ন ছিল। ছোট ছোট স্বপ্ন। যেমন, ডাকপিয়ন হব। নাবিক হব। সৈনিক হব, বড়জোর গ্রামের স্কুলের শিক্ষক–এই সব স্বপ্ন। এর বেশি ভাবিনি তো।
ভাবব কী? সপ্তাহে একদিন রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বিরাট লাইন। ওটা আমার জীবনের অংশ ছিল ক্লাস ফোর ফাইভ থেকে। চাল-ডাল-গম-চিনি-তেল। আমাদের বাড়িতে তখন কাজের লোক ছিল না। অতগুলো জিনিস রিকশায় আনা যায়! রেশনের দোকান ছিল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। সে সংগতিও ছিল না। ফলে মাথায় করেই আনতাম। তারপর আটার কলে গিয়ে সেই চাল ডাল ভাঙানো। সেসব হাঁড়ি পাতিলও মাথায় করে নিয়ে গিয়েছি। কলেজে যখন পড়ি তখনো। একদিন কলেজের সহপাঠী বন্যা দেখে ফেলেছিল! কী লজ্জা, কী লজ্জা!
তবে পড়তাম প্রচুর। পাঠ্যবই না। গল্প, উপন্যাস, কবিতা। লিখব তা–ও ভাবিনি। ছবি আঁকার কথা অমন করে ভাবিনি। বন্ধুদের মধ্যে লিখত সরওয়ার মুর্শেদ রতন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরের ছুটিতে চাইতাম লিখি। পারি না কিছুই। লেখা সহজ কাজ না। রতনের লেখা চুরি করে ঢাকার কিশোর বাংলা পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম সেই সময়। দেখি, বাহরে বাহ...! ছাপা হয়েছে। কিন্তু এত গ্লানি হলো যে, রতনের দিকে তাকাতে পারি না। চোর চোর লাগে নিজেকে। এর মধ্যে রতন আর আমি একদিন বিকেলে সাইকেলে বেড়াতে বেরিয়েছি রতন বলল, ‘রফিক, তোর লেখা পড়লাম! আমার যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। মনে হলো, নদীতে গিয়ে ঝাঁপ দিই। রতন আর একটি বাক্যও আমাকে বলল না! হেসে হেসে কথা বলল। সন্ধ্যারাত পর্যন্ত আড্ডা দিল। কিন্তু আমি জিদ করেছিলাম যে আমি লিখবই। নিজের লেখা লিখব। এবং ছবি আঁকব। সাদামাটা জেদ।
শিল্পী কি হয়েছি? যখন আমি শিল্পী হচ্ছি একটু একটু করে, দেশে-বিদেশে যখন অর্জন শুরু হয়েছে, তখনই জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, মানুষের হিংসা-প্রতিহিংসার হিংস্র ভয়ংকর নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। আর্ট কলেজেরই একাধিক সিনিয়রের কাছ থেকে, একাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে। আজ আমি তাঁদের বলবো, এই কাজ আপনারা কারো সঙ্গে করবেন না। যত বড় শিল্পী হোন না কেন, দিন শেষে একদিন দেখবেন আপনি একা হয়ে গেছেন। আপনার চারপাশে কোনো বন্ধু নেই। শিল্পী হিসেবে আপনার কোনো নামও নেই, ম্লান হয়ে মুছে যাবে সব। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো! মানুষ আপনাদের নাম উচ্চারণ করবে ঘৃণার সঙ্গে, থুতু ফেলে।
আবার উল্টোটিও সত্য। আমি মহান সব শিক্ষকের অধীনে পড়েছি। তাঁরা আমাকে স্নেহ করেছেন। আদর করেছেন। হাতে ধরে শিখিয়েছেন। ভালোবেসেছেন। সেই সব শিক্ষকদের ওই ভালোবাসাটাই আমার পাথেয়। যত দিন বাঁচি শিল্পচর্চা করব। খুব নীরবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে। অনেক বড় হব। অনেক নাম হবে। এ আমি যেমন ছোটবেলা থেকে চাইনি। আজও চাই না। এখনো মনে করি, আমি গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। এর বেশি কিছু না...
প্রিয় মকবুল, তোমাকে এবং আমার সকল স্কুল কলেজের বন্ধু সহপাঠীদের আবারও আমার ভালোবাসা।
লেখক: চিত্রশিল্পী
আমার স্কুল-কলেজের বন্ধুরা বেশিরভাগই মেধাবী ছিল। আমি ছাড়া সবাই তুখোড় ছাত্র ছিল। আমরা বেশির ভাগই ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি। একমাত্র আমারই শিল্পী হওয়ার ভূত চেপেছিল মাথায়। বাকিরা তাদের মেধা, নিষ্ঠা, সততা, পরিশ্রম দিয়ে আরদ্ধ জায়গায় পৌঁছে গেছে। কেউ সরকারের সচিব, কেউ অধ্যাপক, কেউ খ্যাতিমান নাট্যকার, কেউ মস্ত ডাক্তার, কেউ মস্ত ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিমানবাহিনীর, কেউ বা সেনাবাহিনীর ব্রিলিয়ান্ট অফিসার হয়েছে। কেউ কেউ বিরাট ব্যবসায়ীও হয়েছে। একজন তো আমেরিকায় পৃথিবী বিখ্যাত জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদের নির্বাহী কর্মকর্তা হয়েছিল। আমার বন্ধুরা ভালো করলে আমার খুব ভালো লাগে। নানা কারণে খুশি হই। সবচেয়ে বড় কারণ এদের কারও মনে কোনো হিংসা, অহংকার, ফুটানি বলে কিছু নেই। কারণ আমরা সবাই খুব মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হয়েছি। এখনকার মতো বিরাট সব নামকরা স্কুল–কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি। মফস্বলের খুব ছিমছাম স্কুল–কলেজে পড়েছি। কিন্তু সেসব স্কুলে কঠোর নিয়মের মধ্যে পড়ালেখা করেছি। কারণ আমাদের শিক্ষকেরা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই মানুষ গড়ার কারিগর।
আজ আমাদের বন্ধু সহপাঠী মকবুল হোসেন সরকারের সচিব হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছে মকবুল। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মকবুল তোমার জন্য অনেক শুভ কামনা। তুমি আগেও যেমন দেশের জন্য কাজ করেছো, আগামী দিনও তোমার নিষ্ঠা ও পরিশ্রম দিয়ে তাই করবে। পরমেশ্বর দয়াময় তোমার সহায় হোন এই প্রার্থনা করি।
আমি জানি বন্ধুরা কখনো বড় হয় না। বন্ধুতার বয়স উনিশ-কুড়িতে রয়ে যায় আজীবন। আমার স্কুলজীবনে অনেক রকমের স্বপ্ন ছিল। ছোট ছোট স্বপ্ন। যেমন, ডাকপিয়ন হব। নাবিক হব। সৈনিক হব, বড়জোর গ্রামের স্কুলের শিক্ষক–এই সব স্বপ্ন। এর বেশি ভাবিনি তো।
ভাবব কী? সপ্তাহে একদিন রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বিরাট লাইন। ওটা আমার জীবনের অংশ ছিল ক্লাস ফোর ফাইভ থেকে। চাল-ডাল-গম-চিনি-তেল। আমাদের বাড়িতে তখন কাজের লোক ছিল না। অতগুলো জিনিস রিকশায় আনা যায়! রেশনের দোকান ছিল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। সে সংগতিও ছিল না। ফলে মাথায় করেই আনতাম। তারপর আটার কলে গিয়ে সেই চাল ডাল ভাঙানো। সেসব হাঁড়ি পাতিলও মাথায় করে নিয়ে গিয়েছি। কলেজে যখন পড়ি তখনো। একদিন কলেজের সহপাঠী বন্যা দেখে ফেলেছিল! কী লজ্জা, কী লজ্জা!
তবে পড়তাম প্রচুর। পাঠ্যবই না। গল্প, উপন্যাস, কবিতা। লিখব তা–ও ভাবিনি। ছবি আঁকার কথা অমন করে ভাবিনি। বন্ধুদের মধ্যে লিখত সরওয়ার মুর্শেদ রতন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরের ছুটিতে চাইতাম লিখি। পারি না কিছুই। লেখা সহজ কাজ না। রতনের লেখা চুরি করে ঢাকার কিশোর বাংলা পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম সেই সময়। দেখি, বাহরে বাহ...! ছাপা হয়েছে। কিন্তু এত গ্লানি হলো যে, রতনের দিকে তাকাতে পারি না। চোর চোর লাগে নিজেকে। এর মধ্যে রতন আর আমি একদিন বিকেলে সাইকেলে বেড়াতে বেরিয়েছি রতন বলল, ‘রফিক, তোর লেখা পড়লাম! আমার যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। মনে হলো, নদীতে গিয়ে ঝাঁপ দিই। রতন আর একটি বাক্যও আমাকে বলল না! হেসে হেসে কথা বলল। সন্ধ্যারাত পর্যন্ত আড্ডা দিল। কিন্তু আমি জিদ করেছিলাম যে আমি লিখবই। নিজের লেখা লিখব। এবং ছবি আঁকব। সাদামাটা জেদ।
শিল্পী কি হয়েছি? যখন আমি শিল্পী হচ্ছি একটু একটু করে, দেশে-বিদেশে যখন অর্জন শুরু হয়েছে, তখনই জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, মানুষের হিংসা-প্রতিহিংসার হিংস্র ভয়ংকর নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। আর্ট কলেজেরই একাধিক সিনিয়রের কাছ থেকে, একাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে। আজ আমি তাঁদের বলবো, এই কাজ আপনারা কারো সঙ্গে করবেন না। যত বড় শিল্পী হোন না কেন, দিন শেষে একদিন দেখবেন আপনি একা হয়ে গেছেন। আপনার চারপাশে কোনো বন্ধু নেই। শিল্পী হিসেবে আপনার কোনো নামও নেই, ম্লান হয়ে মুছে যাবে সব। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো! মানুষ আপনাদের নাম উচ্চারণ করবে ঘৃণার সঙ্গে, থুতু ফেলে।
আবার উল্টোটিও সত্য। আমি মহান সব শিক্ষকের অধীনে পড়েছি। তাঁরা আমাকে স্নেহ করেছেন। আদর করেছেন। হাতে ধরে শিখিয়েছেন। ভালোবেসেছেন। সেই সব শিক্ষকদের ওই ভালোবাসাটাই আমার পাথেয়। যত দিন বাঁচি শিল্পচর্চা করব। খুব নীরবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে। অনেক বড় হব। অনেক নাম হবে। এ আমি যেমন ছোটবেলা থেকে চাইনি। আজও চাই না। এখনো মনে করি, আমি গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। এর বেশি কিছু না...
প্রিয় মকবুল, তোমাকে এবং আমার সকল স্কুল কলেজের বন্ধু সহপাঠীদের আবারও আমার ভালোবাসা।
লেখক: চিত্রশিল্পী
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
২০ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
২০ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২১ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে