টাইম ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার

হত্যা ও নির্যাতনের বিচার শেষে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসার সুযোগ পাবে: ড. ইউনূস

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০: ৩২
আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১: ৪২

আওয়ামী লীগের শাসনামলে হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার শেষ না হলে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে না বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘যারা হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য দায়ী, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আসতে হবে। বিচার শেষ হওয়ার পর তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। আমরা তাদের রাজনৈতিক ময়দানে মোকাবিলা করব।’

টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূসের এই মন্তব্য উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারে তিনি বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন। এক নিবন্ধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের সেই পরিকল্পনার তুলে ধরেছে টাইম।

একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যের কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা চাই, প্রতিটি রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। কিন্তু যারা দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে, তাদের বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।’

তিনি বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হতে পারে না। আইনের শাসন সবার জন্য সমান। কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা বিদ্বেষ থাকবে না। আমাদের লক্ষ্য হলো— একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে কেউ সহিংসতা বা অনাচারের আশ্রয় নিতে পারবে না।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘আওয়ামী লীগও অন্য যে কোনো দলের মতো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। আমরা তাঁদের রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত। তবে এর আগে তাদের আচরণ এবং অতীতে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায় মেনে নিতে হবে। একবার তাঁরা আইনি বাধাগুলো কাটিয়ে উঠলে নির্বাচনে তাদের স্বাগত জানানো হবে।’

টাইমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অতীতের হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনার ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা নিরাময় করতে হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। বিচার ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আমরা কোনো অন্যায়কারীকে ছাড় দেব না। তবে এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বরং আইনের মাধ্যমে দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা।’

টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল ও বিপুল জনসমর্থনের দল আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ দেশে অবস্থারত আওয়ামী লীগের সদস্যরা বলছেন, তাঁরা কোনো বাছবিচার ছাড়াই নির্বিচার হামলার শিকার হচ্ছেন।

গত জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন জাহিদ মালেক। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি টাইমকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলা করা হলেও তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারছেন না। কারণ, আত্মসমর্পন করলে তিনি জামিন পাবেন না বলে মনে করছেন।

জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। আমার পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। আমি অসুস্থ, হৃদ্‌রোগে ভুগছি। চার মাস ধরে আমি পরিবারের সদস্যদের দেখি না।’

টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ বড় করে তুলে ধরতেন, তাঁরা এখন দলটির সঙ্গে সম্পর্ক গুটিয়ে আনছেন। ভয় পাচ্ছেন, এই সম্পর্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁদের ওপর চড়াও হতে পারেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, শেখ হাসিনার প্রতি সহানুভূতিশীল সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং অন্তত ২৫ জনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সহিংসতার মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

তবে রাজনৈতিক সহিংসতার অবসানের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রস্তাব রেখে ড. ইউনূস বলেন, ‘দেশের জনগণ শান্তি চায়। তারা সহিংসতা ও বিশৃঙ্খল পরিবেশে থাকতে চায় না। আমাদের রাজনীতি হবে জনগণের কল্যাণকেন্দ্রিক, ক্ষমতাকেন্দ্রিক নয়।’

ভবিষ্যৎ নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়ার গণতান্ত্রিক রূপায়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি উন্নত, গণতান্ত্রিক এবং স্বচ্ছ বাংলাদেশ গড়তে চাই। যেসব দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা একসঙ্গে কাজ করতে পারে। কিন্তু এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নৈতিকতা এবং জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।’

সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা চাই, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করুক। এটি আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবে এবং সবার কাছে প্রতিশ্রুতি প্রমাণ করবে।’

ড. ইউনূসের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তিনি রাজনীতিতে প্রবেশের মাধ্যমে তাঁর নিরপেক্ষ অবস্থান হারাতে পারেন। এসবের জবাবে টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। আমি জনগণের স্বার্থে কাজ করছি। আমার লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।’

সাক্ষাৎকারে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ পরিবর্তন চায়। তারা একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের প্রত্যাশা করে। আমরা যদি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি, তাহলে দেশকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত