গৌতম রায়
প্রতিটি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। এসব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত শক্তিশালী হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তন তত দ্রুত ঘটে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আশাবাদের যথেষ্ট কারণ আছে এবং এই আশাবাদের ভিত্তি শিক্ষার্থীরা। দেশের শিক্ষার্থীরা বহির্বিশ্বে নানা প্রতিযোগিতায় নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈপুণ্যের ছাপ রাখছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা সেখানে নিজেদের যোগ্যতার জানান দিচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষায় অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা ও শিক্ষা-পরিকল্পনার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই আশাটুকু ধারণ করতে হবে, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সর্বোচ্চটুকু মেলে ধরতে সক্ষম। দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষার্থী। সুতরাং তাদের সার্বিক বিকাশের কথা মাথায় রেখে আমাদের ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা সাজাতে হবে।
অধিক জনসংখ্যা, সম্পদের অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত বাজেট, দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি কিংবা যথাযথ পরিকল্পনার অভাব—এসব বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট। বিভিন্ন সময়ে এসব সমস্যার অধিকাংশই চিহ্নিত করা হয়েছে। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষাকে আমরা অদূর ও দূর ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চাই, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব। আজ থেকে ২০, ৫০ বা ১০০ বছর পর আমরা নিজেদের কোথায় দেখতে চাই এবং এর আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা যথাযথভাবে সাজানো কি না, সেসব প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত কারোরই জানা নেই। যে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের সম্পদ, তাদের ভবিষ্যতে কীভাবে কাজে লাগানো হবে এবং সেই শিক্ষা আমরা দিতে পারছি কি না—এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে আমরা আসলে কতটা দূরদর্শী।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয় দুটি আলাদা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে—প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের শিক্ষার যে ব্যাপ্তি, তাতে দুটি আলাদা মন্ত্রণালয় যৌক্তিক হলেও দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার খবর মাঝেমধ্যেই নজরে আসে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা স্তর থাকলেও সেগুলো পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। প্রাথমিকের সঙ্গে মাধ্যমিক বা মাধ্যমিকের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সরাসরি সংযোগ রয়েছে; কিন্তু প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। প্রাথমিক শিক্ষা ভিত্তি গড়ে দেয় উচ্চশিক্ষার এবং উচ্চশিক্ষা ভবিষ্যতের প্রাথমিক শিক্ষার জনসম্পদ তৈরি করে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক বা শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নকারীদের উচ্চশিক্ষায় দক্ষতা বিকাশের সুযোগ না থাকলে নিজেদের কাজগুলো তাঁরা সুনিপুণভাবে করতে পারবেন না। সুতরাং শিক্ষার উন্নতি একদিকে যেমন সরলরৈখিক, তেমনি চক্রাকারও। শিক্ষার দুটি আলাদা মন্ত্রণালয় দৈনন্দিন পরিচালনার কাজকে সহজতর করলেও সার্বিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভাবতে হবে। একটি মন্ত্রণালয় থাকলে নীতিনির্ধারণে সুবিধা হলেও শিক্ষার নানা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সহজ সমন্বয়ের বিষয়টিতে জোর দেওয়া জরুরি। ভবিষ্যতের সাবলীল শিক্ষার কথা বিবেচনায় কীভাবে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমকে দুই মন্ত্রণালয় এগিয়ে নেবে, সেই কর্মকৌশলও তৈরি করা প্রয়োজন।
একই সঙ্গে প্রয়োজন বিচ্ছিন্নভাবে নানা উদ্যোগ না নিয়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমন্বিত অগ্রগতির বিষয়টিতে জোর দেওয়া। এর সমাধান হতে পারে একটি স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন। এই কমিশন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে গবেষণাভিত্তিক কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যে কাজ করবে, যাতে শিক্ষার্থীরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাধাহীনভাবে এগিয়ে যেতে পারে। শিক্ষা কমিশন সময়ে সময়ে নীতিগত বিষয়ে সুপারিশ করবে, যেগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে। বিশেষত, অন্যান্য দেশ যে গতিতে এগিয়ে চলছে, তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষা কমিশন প্রতিনিয়ত শিক্ষার নীতিগত বিষয় নির্ধারণ করবে, যাতে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সমযোগ্যতা ও সমমানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হচ্ছে গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা না থাকা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এ ক্ষেত্রে করুণ, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যথাযথভাবে সরকারি আর্থিক সহায়তা প্রদান করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে একাডেমিক স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে যথাযথ গবেষণা করতে পারে, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম বা শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময়ে সময়ে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হয়। দেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা যাতে তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করলে আমার ধারণা, দেশের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর বাস্তবভিত্তিক সমাধান বের করা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে কিছু অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও শিক্ষার যেকোনো ধরনের উদ্যোগের আগে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকদের যথাযথভাবে যুক্ত করা, তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে আরও দুটি বিষয়ে জোর দেওয়া জরুরি। একটি হচ্ছে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন, অন্যটি বিদ্যমান অবকাঠামোর উন্নয়ন। শিক্ষার্থীরা যাতে বিদ্যালয়েই তাদের লেখাপড়ার অধিকাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে এবং বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহী হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকেরা যেন তাঁদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন, সে জন্য তাঁদের দক্ষতা ও জীবনমান উন্নয়ন—দুটোই জরুরি। শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং শিক্ষকতা পেশায় আসার আগে তাঁরা যথাযথ ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছেন কি না, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষকেরা যাতে পেশা থেকেই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী থাকেন, সেটিও নিশ্চিত করা দরকার। সামগ্রিকভাবে শিক্ষকতা পেশাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে গড়ে তুলতে শিক্ষকেরা প্রতিনিয়ত সচেষ্ট থাকেন।
সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যমান অবকাঠামো নিয়েও কাজ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বর্তমান অনুপাত বহাল রেখে গুণগত শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়, তা শিক্ষক যতই আন্তরিক হোন না কেন। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার উপকরণ কিংবা বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা যেন মানানসই হয়, সে বিষয়েও বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।
যেকোনো সমস্যার সমাধানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে সমস্যাটি উপলব্ধি করা এবং সমস্যার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানা। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সমস্যা থাকলেও ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সমস্যাগুলো সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। অনেক ক্ষেত্রে এসব সমস্যার সমাধানে করণীয় সম্পর্কেও প্রচুর আলোচনা আছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সমস্যাগুলো কীভাবে স্বল্প মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অনেক সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা আছে। মাত্রাতিরিক্ত তরুণ জনসংখ্যার কারণে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হলেও তাদের ঠিকমতো তৈরি করতে পারলে এই তরুণেরাই দেশের সম্পদ হয়ে উঠবে এবং এর জন্য শিক্ষার ভূমিকা ব্যাপক। সে জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তৈরি করতে হবে গোড়া থেকেই। স্বল্পমেয়াদি নানা উদ্যোগে শিক্ষার অধিকাংশ সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়; কারণ, শিক্ষার কোনো সমস্যাই পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। ফলে সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে কোনো সমস্যার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়।
শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রত্যয়ের স্বপ্ন দেখতে হলে কীভাবে শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করা যায়, সেটিকে কেন্দ্রে রাখা জরুরি। শিক্ষার্থীরা যেমন পরিবারের অংশ, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রেরও অংশ। পরিবারের অংশ হিসেবে একজন শিক্ষার্থী যেভাবে প্রত্যেক সদস্যের সহায়তা পায়, শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে তেমনি বিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেও শিক্ষার্থী যাতে তার প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পেতে পারে, সেই কর্মকৌশল গ্রহণ করা জরুরি। সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রত্যেক মানুষই দেশের শিক্ষা নিয়ে আশাবাদী হয়, শিক্ষাকে তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কেন্দ্র বলে মনে করতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিটি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। এসব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত শক্তিশালী হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তন তত দ্রুত ঘটে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আশাবাদের যথেষ্ট কারণ আছে এবং এই আশাবাদের ভিত্তি শিক্ষার্থীরা। দেশের শিক্ষার্থীরা বহির্বিশ্বে নানা প্রতিযোগিতায় নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈপুণ্যের ছাপ রাখছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা সেখানে নিজেদের যোগ্যতার জানান দিচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষায় অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা ও শিক্ষা-পরিকল্পনার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই আশাটুকু ধারণ করতে হবে, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সর্বোচ্চটুকু মেলে ধরতে সক্ষম। দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষার্থী। সুতরাং তাদের সার্বিক বিকাশের কথা মাথায় রেখে আমাদের ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা সাজাতে হবে।
অধিক জনসংখ্যা, সম্পদের অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত বাজেট, দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি কিংবা যথাযথ পরিকল্পনার অভাব—এসব বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট। বিভিন্ন সময়ে এসব সমস্যার অধিকাংশই চিহ্নিত করা হয়েছে। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষাকে আমরা অদূর ও দূর ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চাই, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব। আজ থেকে ২০, ৫০ বা ১০০ বছর পর আমরা নিজেদের কোথায় দেখতে চাই এবং এর আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা যথাযথভাবে সাজানো কি না, সেসব প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত কারোরই জানা নেই। যে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের সম্পদ, তাদের ভবিষ্যতে কীভাবে কাজে লাগানো হবে এবং সেই শিক্ষা আমরা দিতে পারছি কি না—এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে আমরা আসলে কতটা দূরদর্শী।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয় দুটি আলাদা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে—প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের শিক্ষার যে ব্যাপ্তি, তাতে দুটি আলাদা মন্ত্রণালয় যৌক্তিক হলেও দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার খবর মাঝেমধ্যেই নজরে আসে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা স্তর থাকলেও সেগুলো পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। প্রাথমিকের সঙ্গে মাধ্যমিক বা মাধ্যমিকের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সরাসরি সংযোগ রয়েছে; কিন্তু প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। প্রাথমিক শিক্ষা ভিত্তি গড়ে দেয় উচ্চশিক্ষার এবং উচ্চশিক্ষা ভবিষ্যতের প্রাথমিক শিক্ষার জনসম্পদ তৈরি করে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক বা শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নকারীদের উচ্চশিক্ষায় দক্ষতা বিকাশের সুযোগ না থাকলে নিজেদের কাজগুলো তাঁরা সুনিপুণভাবে করতে পারবেন না। সুতরাং শিক্ষার উন্নতি একদিকে যেমন সরলরৈখিক, তেমনি চক্রাকারও। শিক্ষার দুটি আলাদা মন্ত্রণালয় দৈনন্দিন পরিচালনার কাজকে সহজতর করলেও সার্বিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভাবতে হবে। একটি মন্ত্রণালয় থাকলে নীতিনির্ধারণে সুবিধা হলেও শিক্ষার নানা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সহজ সমন্বয়ের বিষয়টিতে জোর দেওয়া জরুরি। ভবিষ্যতের সাবলীল শিক্ষার কথা বিবেচনায় কীভাবে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমকে দুই মন্ত্রণালয় এগিয়ে নেবে, সেই কর্মকৌশলও তৈরি করা প্রয়োজন।
একই সঙ্গে প্রয়োজন বিচ্ছিন্নভাবে নানা উদ্যোগ না নিয়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমন্বিত অগ্রগতির বিষয়টিতে জোর দেওয়া। এর সমাধান হতে পারে একটি স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন। এই কমিশন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে গবেষণাভিত্তিক কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যে কাজ করবে, যাতে শিক্ষার্থীরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাধাহীনভাবে এগিয়ে যেতে পারে। শিক্ষা কমিশন সময়ে সময়ে নীতিগত বিষয়ে সুপারিশ করবে, যেগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে। বিশেষত, অন্যান্য দেশ যে গতিতে এগিয়ে চলছে, তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষা কমিশন প্রতিনিয়ত শিক্ষার নীতিগত বিষয় নির্ধারণ করবে, যাতে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সমযোগ্যতা ও সমমানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হচ্ছে গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা না থাকা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এ ক্ষেত্রে করুণ, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যথাযথভাবে সরকারি আর্থিক সহায়তা প্রদান করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে একাডেমিক স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে যথাযথ গবেষণা করতে পারে, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম বা শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময়ে সময়ে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হয়। দেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা যাতে তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করলে আমার ধারণা, দেশের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর বাস্তবভিত্তিক সমাধান বের করা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে কিছু অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও শিক্ষার যেকোনো ধরনের উদ্যোগের আগে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকদের যথাযথভাবে যুক্ত করা, তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে আরও দুটি বিষয়ে জোর দেওয়া জরুরি। একটি হচ্ছে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন, অন্যটি বিদ্যমান অবকাঠামোর উন্নয়ন। শিক্ষার্থীরা যাতে বিদ্যালয়েই তাদের লেখাপড়ার অধিকাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে এবং বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহী হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকেরা যেন তাঁদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন, সে জন্য তাঁদের দক্ষতা ও জীবনমান উন্নয়ন—দুটোই জরুরি। শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং শিক্ষকতা পেশায় আসার আগে তাঁরা যথাযথ ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছেন কি না, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষকেরা যাতে পেশা থেকেই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী থাকেন, সেটিও নিশ্চিত করা দরকার। সামগ্রিকভাবে শিক্ষকতা পেশাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে গড়ে তুলতে শিক্ষকেরা প্রতিনিয়ত সচেষ্ট থাকেন।
সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যমান অবকাঠামো নিয়েও কাজ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বর্তমান অনুপাত বহাল রেখে গুণগত শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়, তা শিক্ষক যতই আন্তরিক হোন না কেন। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার উপকরণ কিংবা বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা যেন মানানসই হয়, সে বিষয়েও বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।
যেকোনো সমস্যার সমাধানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে সমস্যাটি উপলব্ধি করা এবং সমস্যার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানা। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সমস্যা থাকলেও ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সমস্যাগুলো সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। অনেক ক্ষেত্রে এসব সমস্যার সমাধানে করণীয় সম্পর্কেও প্রচুর আলোচনা আছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সমস্যাগুলো কীভাবে স্বল্প মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অনেক সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা আছে। মাত্রাতিরিক্ত তরুণ জনসংখ্যার কারণে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হলেও তাদের ঠিকমতো তৈরি করতে পারলে এই তরুণেরাই দেশের সম্পদ হয়ে উঠবে এবং এর জন্য শিক্ষার ভূমিকা ব্যাপক। সে জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তৈরি করতে হবে গোড়া থেকেই। স্বল্পমেয়াদি নানা উদ্যোগে শিক্ষার অধিকাংশ সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়; কারণ, শিক্ষার কোনো সমস্যাই পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। ফলে সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে কোনো সমস্যার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়।
শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রত্যয়ের স্বপ্ন দেখতে হলে কীভাবে শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করা যায়, সেটিকে কেন্দ্রে রাখা জরুরি। শিক্ষার্থীরা যেমন পরিবারের অংশ, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রেরও অংশ। পরিবারের অংশ হিসেবে একজন শিক্ষার্থী যেভাবে প্রত্যেক সদস্যের সহায়তা পায়, শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে তেমনি বিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেও শিক্ষার্থী যাতে তার প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পেতে পারে, সেই কর্মকৌশল গ্রহণ করা জরুরি। সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রত্যেক মানুষই দেশের শিক্ষা নিয়ে আশাবাদী হয়, শিক্ষাকে তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কেন্দ্র বলে মনে করতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪