অনুপম হায়াৎ
১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হলো। নানা কারণে উর্দুভাষী ও তথাকথিত ইসলামপন্থীদের দ্বারা রাজনীতি ও সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়া শুরু হলো। রাজনীতি, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে করাত চালাল পাকিস্তানিরা। রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করে দেওয়া হলো। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ১৯৬১ সালে আন্দোলনও হয়েছে। এই সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটালেন চিত্রপরিচালক সালাউদ্দিন।
তখন যাত্রায় ‘রূপবান’-এর জয়জয়কার চলছে। দল বেঁধে ‘রূপবান’ দেখত মানুষ। এই গল্প সিনেমার পর্দায় আনলেন সালাউদ্দিন। ছবিটি সুপারডুপার হিট হলো। এই অবস্থায় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হলো। এখানে ভারতীয় ছবি আসা বন্ধ হয়ে গেল।
১৯৬৫ সালে একদিকে ভারতীয় ছবি আমদানি বন্ধ হয়ে গেল, অন্যদিকে বাঙালি গ্রহণ করল ‘রূপবান’কে। গ্রামবাংলায় ব্যাপকভাবে হিট হলো এই ছবি। ছবিটি একদমই নন-সিনেমাটিক। এখানে চলচ্চিত্রের কোনো ভাষা নেই। যাত্রাপালার মতোই একটা ছবি ‘রূপবান’। এবার লোককথাভিত্তিক চলচ্চিত্রের হিড়িক উঠল। ‘আবার বনবাসে রূপবান’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’—এমন অনেক ছবি তৈরি হলো।
এই সময়ে জহির রায়হানও বানালেন ‘বেহুলা’। সিনেমায় একধরনের কল্পনা-ফ্যান্টাসি ঢুকল। বিষয়বস্তুর সঙ্গে গানের ভাষায়ও পরিবর্তন এল। ১২ বছরের যুবতী কন্যার সঙ্গে ১২ দিনের শিশুর বিয়ে—পৃথিবীতে এর চেয়ে অবাস্তব বিষয় আর কী হতে পারে! এটিই তখন ছবির ভাষা ছিল।
তবে এই পথটা তৈরি করে দিয়েছে ‘সুতরাং’। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় ‘সুতরাং’। এই ছবি বিদেশি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিট হয়ে গেল। এই ছবির মাধ্যমে বাঙালির জাগরণ তৈরি হলো। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে সবাই এই ছবি দেখতে গেল। গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীর প্রেমের মতো বিষয়বস্তুর কারণে ছবি হিট হলো। কবরী প্রথম সারির নায়িকা হয়ে গেলেন। এর আগে সুভাষ দত্ত বিভিন্ন ছবিতে কৌতুক অভিনয় করতেন। তিনি নায়ক হিসেবে হিট হয়ে গেলেন। বিদেশে পুরস্কৃত হলো এই ছবি। লন্ডনে প্রদর্শিত হওয়ার পর ছবিটির আবেগঘন দৃশ্য দেখে রাজা-রানি আপ্লুত হয়েছেন বলে শুনেছি।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করলেন, ব্যাপক অর্থে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো। বাঙালির মধ্যে একটা নবচেতনার সৃষ্টি হয়। এই অঞ্চলের নির্মাতারাও সেই চেতনায় ছবি নির্মাণ শুরু করলেন। খান আতাউর রহমান বানালেন ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’। এটা একটা নাটক; চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভাষাই এ ছবিতে নেই। ওই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অবরুদ্ধ পরিবেশে মানুষের ঐতিহাসিক চেতনার কারণে ছবিটি হিট হলো। লোকজন আনোয়ার হোসেনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেল। তার ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা’ সংলাপ মনে গেঁথে গেল। সোহরাব রুস্তম, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, ঈশা খাঁ নিয়ে ছবি তৈরি হলো। ঐতিহাসিক সংগ্রামী চরিত্রগুলো নিয়ে ছবি নির্মাণের একটা জোয়ার তৈরির চেষ্টা চলল।
সামাজিক ছবিগুলোতেও এ ধরনের কাহিনি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলল। ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে যখন তুমুল আন্দোলন চলছে, ছাত্র ও গণ-আন্দোলনের পটভূমিকায় জহির রায়হান আরেকটা মহৎ ও বিপ্লবী ছবি বানালেন—‘জীবন থেকে নেয়া’।
‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। অবরুদ্ধ এক পরিবারের মাধ্যমে পুরো পাকিস্তানের চিত্র ফুটিয়ে তুললেন জহির রায়হান। যেমন খান আতার চরিত্রটা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের। নতজানু হয়ে থাকেন, আবার চেতনাও থাকে বুকে। আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটা বঙ্গবন্ধুর। রওশন জামিল স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক। রাজ্জাক ছাত্রনেতার প্রতীক।
এই ছবির মাধ্যমে জহির রায়হান একটা নতুন ভাষা তৈরি করলেন। এই ছবির যে সাউন্ড, সংলাপ, মিউজিক—ওই সময়ের জন্য তা খুবই উঁচু মানের ছিল। বিশেষ করে সেট। প্রতিটি বিষয় ছিল রূপক। ব্যাপক অর্থে সময়টা তিনি তুলে ধরেছেন। বাঙালি কিন্তু ঠিকই বুঝেছে—জহির রায়হান কী বলেছেন।
আজকে যখন আমি ছাত্রদের পড়াই বা দেখাই এই ছবির ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, তখন ছাত্ররা অবাক হয়ে যায়, কীভাবে একটা ছবিতে তিনি এত কিছুর সমন্বয় ঘটিয়েছেন। জহির রায়হান ১৯৭০ সালেই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করেছেন তাঁর ছবিতে। কে জানত, এটাকেই বঙ্গবন্ধু ভালোবেসে জাতীয় সংগীত করবেন! ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ কিন্তু জহির রায়হান আগেই ব্যবহার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মুখবন্ধ হলো ‘জীবন থেকে নেয়া’।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় মানুষের সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই জহির রায়হানের নেতৃত্বে আলমগীর কবির, বাবুল চৌধুরীরা নির্মাণ করলেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের চারটি অনবদ্য দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, ‘স্টেট ইজ বর্ন’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’। এগুলোকে বলা হলো জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। নির্মাণে এগুলো যে কত উঁচুমানের ছিল, আজকের দিনে দেখলে শুধু বিস্ময়ই জাগে। শুধু প্রামাণ্যচিত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত গণহত্যার একটি অসামান্য দলিলও বটে। এই গণহত্যাকেই সেলুলয়েডের ফিতায় আবদ্ধ করে বিশ্ববাসীকে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন এই নির্মাতা।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলো। এই সময়ে চলচ্চিত্রে নতুন বিষয় যেমন এসেছে, তেমনি নতুন ভাষাও তৈরি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক বছরের মধ্যেই ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় চারটি চলচ্চিত্র। এগুলো হলো—চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’, সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দের ‘বাঘা বাঙ্গালী’। এরপর পঁচাত্তর পর্যন্ত তৈরি ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩), চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪), আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ (১৯৭৪)। এ সময় আরও কিছু ভালো ছবি নির্মাণ হয়েছে। সময়টাকে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার সময়ই বলা যায়।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের যে একটা গতি ছিল, সেটা থেমে গেল। পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের যে এলিমেন্টগুলো ছিল, পর্দা থেকে একে একে তা উপড়ে দেওয়া হলো। আমাদের চলচ্চিত্রের যে একটা ভাষা, নতুন নায়ক-নায়িকা, পরিচালক আত্মপ্রকাশ করছিলেন—সব যেন থমকে গেল। তবে এই সময়ে ‘মেঘের অনেক রং’ নামে মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি মুক্তি পেয়েছে। যদিও ছবিটি নির্মাণ হয়েছিল পঁচাত্তরের আগেই।
অনুপম হায়াৎ: চলচ্চিত্র গবেষক ও বিশ্লেষক। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাবেক সদস্য।
(অনুলিখন: মীর রাকিব হাসান)
১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হলো। নানা কারণে উর্দুভাষী ও তথাকথিত ইসলামপন্থীদের দ্বারা রাজনীতি ও সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়া শুরু হলো। রাজনীতি, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে করাত চালাল পাকিস্তানিরা। রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করে দেওয়া হলো। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ১৯৬১ সালে আন্দোলনও হয়েছে। এই সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটালেন চিত্রপরিচালক সালাউদ্দিন।
তখন যাত্রায় ‘রূপবান’-এর জয়জয়কার চলছে। দল বেঁধে ‘রূপবান’ দেখত মানুষ। এই গল্প সিনেমার পর্দায় আনলেন সালাউদ্দিন। ছবিটি সুপারডুপার হিট হলো। এই অবস্থায় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হলো। এখানে ভারতীয় ছবি আসা বন্ধ হয়ে গেল।
১৯৬৫ সালে একদিকে ভারতীয় ছবি আমদানি বন্ধ হয়ে গেল, অন্যদিকে বাঙালি গ্রহণ করল ‘রূপবান’কে। গ্রামবাংলায় ব্যাপকভাবে হিট হলো এই ছবি। ছবিটি একদমই নন-সিনেমাটিক। এখানে চলচ্চিত্রের কোনো ভাষা নেই। যাত্রাপালার মতোই একটা ছবি ‘রূপবান’। এবার লোককথাভিত্তিক চলচ্চিত্রের হিড়িক উঠল। ‘আবার বনবাসে রূপবান’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’—এমন অনেক ছবি তৈরি হলো।
এই সময়ে জহির রায়হানও বানালেন ‘বেহুলা’। সিনেমায় একধরনের কল্পনা-ফ্যান্টাসি ঢুকল। বিষয়বস্তুর সঙ্গে গানের ভাষায়ও পরিবর্তন এল। ১২ বছরের যুবতী কন্যার সঙ্গে ১২ দিনের শিশুর বিয়ে—পৃথিবীতে এর চেয়ে অবাস্তব বিষয় আর কী হতে পারে! এটিই তখন ছবির ভাষা ছিল।
তবে এই পথটা তৈরি করে দিয়েছে ‘সুতরাং’। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় ‘সুতরাং’। এই ছবি বিদেশি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিট হয়ে গেল। এই ছবির মাধ্যমে বাঙালির জাগরণ তৈরি হলো। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে সবাই এই ছবি দেখতে গেল। গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীর প্রেমের মতো বিষয়বস্তুর কারণে ছবি হিট হলো। কবরী প্রথম সারির নায়িকা হয়ে গেলেন। এর আগে সুভাষ দত্ত বিভিন্ন ছবিতে কৌতুক অভিনয় করতেন। তিনি নায়ক হিসেবে হিট হয়ে গেলেন। বিদেশে পুরস্কৃত হলো এই ছবি। লন্ডনে প্রদর্শিত হওয়ার পর ছবিটির আবেগঘন দৃশ্য দেখে রাজা-রানি আপ্লুত হয়েছেন বলে শুনেছি।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করলেন, ব্যাপক অর্থে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো। বাঙালির মধ্যে একটা নবচেতনার সৃষ্টি হয়। এই অঞ্চলের নির্মাতারাও সেই চেতনায় ছবি নির্মাণ শুরু করলেন। খান আতাউর রহমান বানালেন ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’। এটা একটা নাটক; চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভাষাই এ ছবিতে নেই। ওই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অবরুদ্ধ পরিবেশে মানুষের ঐতিহাসিক চেতনার কারণে ছবিটি হিট হলো। লোকজন আনোয়ার হোসেনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেল। তার ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা’ সংলাপ মনে গেঁথে গেল। সোহরাব রুস্তম, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, ঈশা খাঁ নিয়ে ছবি তৈরি হলো। ঐতিহাসিক সংগ্রামী চরিত্রগুলো নিয়ে ছবি নির্মাণের একটা জোয়ার তৈরির চেষ্টা চলল।
সামাজিক ছবিগুলোতেও এ ধরনের কাহিনি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলল। ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে যখন তুমুল আন্দোলন চলছে, ছাত্র ও গণ-আন্দোলনের পটভূমিকায় জহির রায়হান আরেকটা মহৎ ও বিপ্লবী ছবি বানালেন—‘জীবন থেকে নেয়া’।
‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। অবরুদ্ধ এক পরিবারের মাধ্যমে পুরো পাকিস্তানের চিত্র ফুটিয়ে তুললেন জহির রায়হান। যেমন খান আতার চরিত্রটা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের। নতজানু হয়ে থাকেন, আবার চেতনাও থাকে বুকে। আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটা বঙ্গবন্ধুর। রওশন জামিল স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক। রাজ্জাক ছাত্রনেতার প্রতীক।
এই ছবির মাধ্যমে জহির রায়হান একটা নতুন ভাষা তৈরি করলেন। এই ছবির যে সাউন্ড, সংলাপ, মিউজিক—ওই সময়ের জন্য তা খুবই উঁচু মানের ছিল। বিশেষ করে সেট। প্রতিটি বিষয় ছিল রূপক। ব্যাপক অর্থে সময়টা তিনি তুলে ধরেছেন। বাঙালি কিন্তু ঠিকই বুঝেছে—জহির রায়হান কী বলেছেন।
আজকে যখন আমি ছাত্রদের পড়াই বা দেখাই এই ছবির ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, তখন ছাত্ররা অবাক হয়ে যায়, কীভাবে একটা ছবিতে তিনি এত কিছুর সমন্বয় ঘটিয়েছেন। জহির রায়হান ১৯৭০ সালেই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করেছেন তাঁর ছবিতে। কে জানত, এটাকেই বঙ্গবন্ধু ভালোবেসে জাতীয় সংগীত করবেন! ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ কিন্তু জহির রায়হান আগেই ব্যবহার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মুখবন্ধ হলো ‘জীবন থেকে নেয়া’।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় মানুষের সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই জহির রায়হানের নেতৃত্বে আলমগীর কবির, বাবুল চৌধুরীরা নির্মাণ করলেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের চারটি অনবদ্য দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, ‘স্টেট ইজ বর্ন’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’। এগুলোকে বলা হলো জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। নির্মাণে এগুলো যে কত উঁচুমানের ছিল, আজকের দিনে দেখলে শুধু বিস্ময়ই জাগে। শুধু প্রামাণ্যচিত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত গণহত্যার একটি অসামান্য দলিলও বটে। এই গণহত্যাকেই সেলুলয়েডের ফিতায় আবদ্ধ করে বিশ্ববাসীকে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন এই নির্মাতা।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলো। এই সময়ে চলচ্চিত্রে নতুন বিষয় যেমন এসেছে, তেমনি নতুন ভাষাও তৈরি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক বছরের মধ্যেই ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় চারটি চলচ্চিত্র। এগুলো হলো—চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’, সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দের ‘বাঘা বাঙ্গালী’। এরপর পঁচাত্তর পর্যন্ত তৈরি ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩), চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪), আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ (১৯৭৪)। এ সময় আরও কিছু ভালো ছবি নির্মাণ হয়েছে। সময়টাকে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার সময়ই বলা যায়।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের যে একটা গতি ছিল, সেটা থেমে গেল। পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের যে এলিমেন্টগুলো ছিল, পর্দা থেকে একে একে তা উপড়ে দেওয়া হলো। আমাদের চলচ্চিত্রের যে একটা ভাষা, নতুন নায়ক-নায়িকা, পরিচালক আত্মপ্রকাশ করছিলেন—সব যেন থমকে গেল। তবে এই সময়ে ‘মেঘের অনেক রং’ নামে মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি মুক্তি পেয়েছে। যদিও ছবিটি নির্মাণ হয়েছিল পঁচাত্তরের আগেই।
অনুপম হায়াৎ: চলচ্চিত্র গবেষক ও বিশ্লেষক। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাবেক সদস্য।
(অনুলিখন: মীর রাকিব হাসান)
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪