শাহানা হুদা রঞ্জনা
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আব্বা-আম্মার সঙ্গে দৌড়ে গেলাম পাড়ার মোড়ে। দৌড়াতে দৌড়াতেই আব্বা শুধু বলতে লাগলেন: ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি, আমরা স্বাধীন হয়েছি।’ শুনলাম, গ্রিনরোডের সেই রাস্তা দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যাবেন। পাড়ার বহু মানুষ দুই পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলাম, শিউলি আপাও সেই মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেদিন জানতাম না, শিউলি আপা একটি শক্তির নাম, যার স্পর্শে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর লাইন ধরে ট্রাক ঢুকতে লাগল, ট্রাকে করে অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধা ও সৈনিকেরা আসতে লাগলেন। সবার হাতে স্বাধীন দেশের পতাকা আর অস্ত্র। তাঁদের কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলোও একই সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হচ্ছে। কেউ কেউ অঝোরে কাঁদছিলেন। স্বাধীনতা পাওয়া তো আনন্দের বিষয়, তাহলে মানুষ কাঁদছে কেন? তাই মানুষের কান্না দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই দিনটি ছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এর চেয়ে বেশি কিছু মনে নেই আমার।
আমি তখন ছোট। থাকতাম ঢাকার ভূতের গলিতে। আমাদের, মানে বাচ্চাদের সারা দিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর খেলা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। স্কুলও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিন ধরেই লক্ষ করছি টুংটাং বেল বাজানো বেবি আইসক্রিমওয়ালা আর আসছেন না। প্রতি সপ্তাহে পাড়ায় একটা ভাল্লুকওয়ালা আসত খেলা দেখাতে, একটা বাঁদর নাচওয়ালা ও একজন সাপুড়েও বাঁশি বাজিয়ে খেলা দেখাত। কিন্তু পরিস্থিতি থমথমে হয়ে যাওয়ায় সবাই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বাতাসে আনন্দ মুছে গিয়ে শুধু গুমোট একটা অনুভূতি। ছোট্ট হলেও বুঝতে পারছিলাম, কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।
দেশ, রাজনীতি, সমাজনীতি, মানুষের দুঃখ-কষ্ট কী এবং কেন, তা-ও জানতাম না। শুধু লক্ষ করতাম, সন্ধ্যা নামার পরপরই কেমন যেন একটা সুনসান নীরবতা চারদিকে। আব্বাসহ পাড়ার মুরব্বিরা ফিসফিস করে কথা বলতেন। আব্বা সাংবাদিক ছিলেন বলে সবাই আব্বার কাছে এসে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইতেন। মাঝেমধ্যে আব্বারা সবাই মিলে শরীফ চাচা ও জাহানারা চাচির (জাহানারা ইমাম) বাসায় যেতেন আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য। মনে আছে, সকাল-সন্ধ্যা শুধু বিবিসি শুনতেন সবাই।
তবে আমি সে সময় এসব ঘটনার খুব একটা গুরুত্ব বুঝতাম না, বোঝার কথাও নয়। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো কোনো প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘটনা, যা মনে দাগ কেটে যায়, তা শিশুরা মনে রাখতে পারে। হয়তো সেই মুক্তিযুদ্ধ আমাকে অনেকটাই পরিণত করে তুলেছিল।
২৫ মার্চের কালরাত ঠিক সে রকমই একটি রাত, যা আমি কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। রাতের খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ চারদিক থেকে গুলি, মেশিনগান এবং আরও অনেক শব্দ ভেসে আসতে থাকল। আব্বা, আম্মা, আমি লাইট নিভিয়ে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের কাছে ছিল কিছু শুকনো বিস্কুট আর একটা ছোট্ট হারিকেন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি আমার ছোট দুটি পুতুল নিয়ে খাটের নিচে ঢুকেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, যদি দুষ্ট লোকেরা আসে, তাহলে তো আমার পুতুল দুটি নিয়ে যাবে। সেদিন ভাবিনি, ওই হায়েনারা আমার দেশকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য ওই রাতে বর্বর হামলা চালিয়েছিল। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ওরা নির্বিচারে। অগণিত নারী-শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
আব্বা বলেছিলেন, ‘মা, পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটা শয়তান দেশ আছে। ওরা আমাদের দেশকে কেড়ে নিতে চায়। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। শুনিস নাই, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছেন—সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হও। যার যা কিছু আছে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ আমার মনে পড়ল আব্বার কাছে শোনা সেই বক্তৃতার কথা। আব্বা বলেছিলেন, ‘কাঁদিস না, মা। তুই তোর পুতুল সামলা, দেশের মানুষ দেশটাকে সামলাবে।’
এরপর যে কখন আম্মার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। ভোর হলো। আমরা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম। রাতের আঁধার কেটে যাওয়ায় আমি শান্তি পেলাম; কিন্তু তখনো জানি না, কেবল অশান্তির শুরু হলো। আব্বা কাজে বেরিয়ে গেলেন। আম্মাকে বলে গেলেন, আমাকে যেন কোথাও যেতে না দেয়। শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছু চাল, ডাল, আলু, তেল, লবণ, মোমবাতি আর ম্যাচ কিনে রাখতে বললেন পাড়ার দোকান থেকে।
২৬ মার্চ শুনলাম, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি। বুঝিনি ব্যাপারটা কী। পাকিস্তানিরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে—দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কেউ বাসা থেকে বের হবে না। আমরা আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম।
আব্বা সেদিন বাসায় এসে বললেন, ‘মা, আজ থেকে আমরা স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের নতুন দেশের নাম হবে “বাংলাদেশ”। আমরা আজ থেকে যে-যেভাবে পারি যুদ্ধ করব পাকিস্তানি দৈত্যদের বিরুদ্ধে।’ সেই বয়সে আমাকে বোঝানোর জন্য দৈত্যটাই সবচেয়ে সঠিক শব্দ ছিল। আব্বা সেদিন পাকিস্তানি পতাকায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই পতাকা আর আমাদের নয়, আমাদের নতুন পতাকা হবে, নতুন দেশ হবে।’
আমাদের পুরো পাড়া খালি হয়ে গেল। আমাদের বাড়িওয়ালা রাতের আঁধারে, চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে আব্বাকে ফিসফিস করে বলে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। রাতেই নাকি পাকিস্তানিরা হামলা করবে পাড়ায়। এভাবে পাড়া পুরো খালি হলো, শুধু আমরা তিন-চারটি পরিবার ঘর আটকে পড়ে থাকলাম।
আব্বা আম্মাকে বলে যেতেন: ‘অফিস থেকে আমি ফিরে না-এলে আসাদগেটে লিলি বুর ওখানে চলে যাবা। তারপর যুদ্ধ থামলে রংপুরে।’ আমি শুধু একা একা এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই। প্রতিদিন পাড়ার বন্ধুরা একে একে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এ যেন এক অঘোষিত মৃত্যুপুরী। আমরা এই পাড়া ছেড়ে পাশে নর্থ সার্কুলার রোডে আরেকটু লোকসমাগমওয়ালা পাড়ায় গেলাম।
ওই পাড়ায় আমাদের পাশের বাসায় একটি পরিবার থাকত, যাদের কথা বলে লেখাটি শেষ করব। সম্ভবত শিউলি ছিল সেই আপার নাম। শিউলি আপা একা বোন ছিলেন। তাঁর ভাই ছিল পাঁচজন। শিউলি আপাকে নিয়ে পাড়ায় একটা কানাঘুষা ছিল—উনি পাকিস্তানি আর্মিদের ক্লাবে গিয়ে গান শোনাতেন। আপা পাড়ায় কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না। পাঁচ ভাইকেও মাঝেমধ্যে পাড়ায় দেখা গেলেও শেষের দিকে আর দেখা যায়নি। তবে আমি দেখেছিলাম দু-এক দিন রাতে শিউলি আপা আব্বার কাছে আসতেন এবং খুব দ্রুত কথা বলে চলে যেতেন।
বড় হওয়ার পর আব্বার কাছ থেকে জেনেছিলাম, শিউলি আপা মুক্তিযোদ্ধাদের চর ছিলেন, মানে ওদের হয়ে কাজ করতেন। আর ওনার পাঁচ ভাই-ই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শিউলি আপা পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিশে, তাদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম তাঁর কথা। বড় হয়ে মনে মনে অনেক খুঁজেছি শিউলি আপাকে। আব্বা বেঁচে থাকলে সুবিধা হতো।
আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে শিউলি আপা এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর নাম কখনো ইতিহাসে লেখা হবে না। কিন্তু এই অকুতোভয় মানুষগুলোই আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল শহীদ স্বপ্নের কাছাকাছি।
লেখক: শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আব্বা-আম্মার সঙ্গে দৌড়ে গেলাম পাড়ার মোড়ে। দৌড়াতে দৌড়াতেই আব্বা শুধু বলতে লাগলেন: ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি, আমরা স্বাধীন হয়েছি।’ শুনলাম, গ্রিনরোডের সেই রাস্তা দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যাবেন। পাড়ার বহু মানুষ দুই পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলাম, শিউলি আপাও সেই মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেদিন জানতাম না, শিউলি আপা একটি শক্তির নাম, যার স্পর্শে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর লাইন ধরে ট্রাক ঢুকতে লাগল, ট্রাকে করে অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধা ও সৈনিকেরা আসতে লাগলেন। সবার হাতে স্বাধীন দেশের পতাকা আর অস্ত্র। তাঁদের কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলোও একই সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হচ্ছে। কেউ কেউ অঝোরে কাঁদছিলেন। স্বাধীনতা পাওয়া তো আনন্দের বিষয়, তাহলে মানুষ কাঁদছে কেন? তাই মানুষের কান্না দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই দিনটি ছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এর চেয়ে বেশি কিছু মনে নেই আমার।
আমি তখন ছোট। থাকতাম ঢাকার ভূতের গলিতে। আমাদের, মানে বাচ্চাদের সারা দিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর খেলা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। স্কুলও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিন ধরেই লক্ষ করছি টুংটাং বেল বাজানো বেবি আইসক্রিমওয়ালা আর আসছেন না। প্রতি সপ্তাহে পাড়ায় একটা ভাল্লুকওয়ালা আসত খেলা দেখাতে, একটা বাঁদর নাচওয়ালা ও একজন সাপুড়েও বাঁশি বাজিয়ে খেলা দেখাত। কিন্তু পরিস্থিতি থমথমে হয়ে যাওয়ায় সবাই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বাতাসে আনন্দ মুছে গিয়ে শুধু গুমোট একটা অনুভূতি। ছোট্ট হলেও বুঝতে পারছিলাম, কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।
দেশ, রাজনীতি, সমাজনীতি, মানুষের দুঃখ-কষ্ট কী এবং কেন, তা-ও জানতাম না। শুধু লক্ষ করতাম, সন্ধ্যা নামার পরপরই কেমন যেন একটা সুনসান নীরবতা চারদিকে। আব্বাসহ পাড়ার মুরব্বিরা ফিসফিস করে কথা বলতেন। আব্বা সাংবাদিক ছিলেন বলে সবাই আব্বার কাছে এসে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইতেন। মাঝেমধ্যে আব্বারা সবাই মিলে শরীফ চাচা ও জাহানারা চাচির (জাহানারা ইমাম) বাসায় যেতেন আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য। মনে আছে, সকাল-সন্ধ্যা শুধু বিবিসি শুনতেন সবাই।
তবে আমি সে সময় এসব ঘটনার খুব একটা গুরুত্ব বুঝতাম না, বোঝার কথাও নয়। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো কোনো প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘটনা, যা মনে দাগ কেটে যায়, তা শিশুরা মনে রাখতে পারে। হয়তো সেই মুক্তিযুদ্ধ আমাকে অনেকটাই পরিণত করে তুলেছিল।
২৫ মার্চের কালরাত ঠিক সে রকমই একটি রাত, যা আমি কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। রাতের খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ চারদিক থেকে গুলি, মেশিনগান এবং আরও অনেক শব্দ ভেসে আসতে থাকল। আব্বা, আম্মা, আমি লাইট নিভিয়ে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের কাছে ছিল কিছু শুকনো বিস্কুট আর একটা ছোট্ট হারিকেন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি আমার ছোট দুটি পুতুল নিয়ে খাটের নিচে ঢুকেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, যদি দুষ্ট লোকেরা আসে, তাহলে তো আমার পুতুল দুটি নিয়ে যাবে। সেদিন ভাবিনি, ওই হায়েনারা আমার দেশকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য ওই রাতে বর্বর হামলা চালিয়েছিল। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ওরা নির্বিচারে। অগণিত নারী-শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
আব্বা বলেছিলেন, ‘মা, পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটা শয়তান দেশ আছে। ওরা আমাদের দেশকে কেড়ে নিতে চায়। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। শুনিস নাই, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছেন—সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হও। যার যা কিছু আছে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ আমার মনে পড়ল আব্বার কাছে শোনা সেই বক্তৃতার কথা। আব্বা বলেছিলেন, ‘কাঁদিস না, মা। তুই তোর পুতুল সামলা, দেশের মানুষ দেশটাকে সামলাবে।’
এরপর যে কখন আম্মার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। ভোর হলো। আমরা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম। রাতের আঁধার কেটে যাওয়ায় আমি শান্তি পেলাম; কিন্তু তখনো জানি না, কেবল অশান্তির শুরু হলো। আব্বা কাজে বেরিয়ে গেলেন। আম্মাকে বলে গেলেন, আমাকে যেন কোথাও যেতে না দেয়। শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছু চাল, ডাল, আলু, তেল, লবণ, মোমবাতি আর ম্যাচ কিনে রাখতে বললেন পাড়ার দোকান থেকে।
২৬ মার্চ শুনলাম, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি। বুঝিনি ব্যাপারটা কী। পাকিস্তানিরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে—দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কেউ বাসা থেকে বের হবে না। আমরা আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম।
আব্বা সেদিন বাসায় এসে বললেন, ‘মা, আজ থেকে আমরা স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের নতুন দেশের নাম হবে “বাংলাদেশ”। আমরা আজ থেকে যে-যেভাবে পারি যুদ্ধ করব পাকিস্তানি দৈত্যদের বিরুদ্ধে।’ সেই বয়সে আমাকে বোঝানোর জন্য দৈত্যটাই সবচেয়ে সঠিক শব্দ ছিল। আব্বা সেদিন পাকিস্তানি পতাকায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই পতাকা আর আমাদের নয়, আমাদের নতুন পতাকা হবে, নতুন দেশ হবে।’
আমাদের পুরো পাড়া খালি হয়ে গেল। আমাদের বাড়িওয়ালা রাতের আঁধারে, চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে আব্বাকে ফিসফিস করে বলে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। রাতেই নাকি পাকিস্তানিরা হামলা করবে পাড়ায়। এভাবে পাড়া পুরো খালি হলো, শুধু আমরা তিন-চারটি পরিবার ঘর আটকে পড়ে থাকলাম।
আব্বা আম্মাকে বলে যেতেন: ‘অফিস থেকে আমি ফিরে না-এলে আসাদগেটে লিলি বুর ওখানে চলে যাবা। তারপর যুদ্ধ থামলে রংপুরে।’ আমি শুধু একা একা এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই। প্রতিদিন পাড়ার বন্ধুরা একে একে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এ যেন এক অঘোষিত মৃত্যুপুরী। আমরা এই পাড়া ছেড়ে পাশে নর্থ সার্কুলার রোডে আরেকটু লোকসমাগমওয়ালা পাড়ায় গেলাম।
ওই পাড়ায় আমাদের পাশের বাসায় একটি পরিবার থাকত, যাদের কথা বলে লেখাটি শেষ করব। সম্ভবত শিউলি ছিল সেই আপার নাম। শিউলি আপা একা বোন ছিলেন। তাঁর ভাই ছিল পাঁচজন। শিউলি আপাকে নিয়ে পাড়ায় একটা কানাঘুষা ছিল—উনি পাকিস্তানি আর্মিদের ক্লাবে গিয়ে গান শোনাতেন। আপা পাড়ায় কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না। পাঁচ ভাইকেও মাঝেমধ্যে পাড়ায় দেখা গেলেও শেষের দিকে আর দেখা যায়নি। তবে আমি দেখেছিলাম দু-এক দিন রাতে শিউলি আপা আব্বার কাছে আসতেন এবং খুব দ্রুত কথা বলে চলে যেতেন।
বড় হওয়ার পর আব্বার কাছ থেকে জেনেছিলাম, শিউলি আপা মুক্তিযোদ্ধাদের চর ছিলেন, মানে ওদের হয়ে কাজ করতেন। আর ওনার পাঁচ ভাই-ই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শিউলি আপা পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিশে, তাদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম তাঁর কথা। বড় হয়ে মনে মনে অনেক খুঁজেছি শিউলি আপাকে। আব্বা বেঁচে থাকলে সুবিধা হতো।
আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে শিউলি আপা এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর নাম কখনো ইতিহাসে লেখা হবে না। কিন্তু এই অকুতোভয় মানুষগুলোই আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল শহীদ স্বপ্নের কাছাকাছি।
লেখক: শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪