রজত কান্তি রায়
গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের খাদ্যসংস্কৃতির যে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, সেটা বোঝা যায় স্পষ্টভাবে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে আমরা এই পরিবর্তনের কথা বলছি? এর সঠিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো আমাদের দেশের ইতিহাসবিদেরা লিখতে শুরু করেননি। হয়তো সময় হয়নি। হয়তো খাদ্যসংস্কৃতির বিবর্তনের কথা বলার এ কাজ বেশ শ্রমসাপেক্ষ, তাই এখনো শুরু হয়নি। আমরা জানি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কাজটি এখনো হয়নি।
একটু পেছনের কথা
যাহোক, আমরা একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের খাবার কিংবা বৃহৎ বঙ্গের খাবারের কোনো প্রমিত রূপ আছে কি? এককথায় ‘আছে’, আবার ‘নেই’। বৃহৎ এবং পুরোনো ‘মাল্টিকালচারাল’ দুটি শহর, ঢাকা ও কলকাতাকে কেন্দ্র করে খাবারের এই প্রমিতকরণ করা হয়েছে—ঠিক ভাষার মতোই। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ বঙ্গের খাবারকে কি আসলে প্রমিতকরণ করা যায়? বিষয়টি খটমট মনে হচ্ছে। একটু সহজ করে দিই।
প্রকৃতি ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রের সীমানা মানে না। এর প্রমাণ আমরা বারবার পাচ্ছি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। ভারতীয় অংশের পাহাড়ের ঢল নেমে জমা হতে থাকে হাওর অঞ্চলে। সেখান থেকে বিভিন্ন পথে তা যায় সমুদ্রে। এই হলো প্রকৃতির নিয়ম। অর্থাৎ, আমাদের দেশের হাওর আসলে আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলের পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক তেমনি সিলেট অঞ্চলের খাবারও শুধু সিলেটের নয়। এটি সিলেট বিভাগ এবং কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি নিয়ে যে বিশাল অঞ্চল, সেই অঞ্চলের খাবার। একইভাবে আমাদের রংপুর বিভাগ এবং শিলিগুড়ি থেকে আসামের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার খাবার একই। সে রকম মালদহ, মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী, নাটোরের একাংশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের খাবার প্রায় একই রকম। আমাদের যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরা এবং ভারতের চব্বিশ পরগনা মোটামুটি একই রকম। ঢাকা বিভাগের খাবার একই রকম। যদিও ঢাকা শহরের খাবার সবার থেকে কিছুটা আলাদা।
এই যে ‘একই রকম’ বা ‘প্রায় একই রকম’ খাবারের কথা বলা হচ্ছে, এর কারণ হলো সংস্কৃতি। ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অঞ্চলগুলো ভাগ হয়ে গেছে। ফলে ভাষা আর খাবার একই হলেও আদান-প্রদানে পাসপোর্ট আর ভিসার দরকার হয় এখন। এই ভিসাকেন্দ্রিক বিভাজনে গত ৭৫ বছরে ধীরে ধীরে জমেছে নতুন জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি আর ধর্মের ধুলো। সেই ধুলোর ওপর প্রাণসঞ্চার হয়েছে নতুন সংস্কৃতির, তাতে খাদ্যসংস্কৃতি পেয়েছে নতুন এক রূপ। তার মাত্রা কী হয়েছে, সেটা মাইক্রোস্কোপিক গবেষণার বিষয়। এই ছোট পরিসরে সেটা ধরতে যাওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতি
১৯৪৭ সালের বড় বড় সাংস্কৃতিক অঞ্চলের খণ্ডিত অংশ, মূলত ঢাকা বিভাগ এবং উপকূলীয় অঞ্চল—এই মিলে গড়ে উঠেছে আমাদের খাদ্যসংস্কৃতি। এ দেশে ঢাকার বাইরের খাবারের ইতিহাস সব সময় ‘ঢাকা’ থাকে রাজধানী ঢাকা নামের ছাতাটির তলে। ফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের যত আলোচনা, তা হয় ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু ঢাকায় প্রচলিত বিরিয়ানি, বোরহানি, বাকরখানির মতো অনেক খাবার যে ঢাকার বাইরে প্রায় অপ্রচলিত, সে ইতিহাস এখনো ঠিক লেখা হয়নি।
আমাদের রাজধানী ঢাকা বরাবরই একটি মাল্টিকালচারাল শহর। এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকে পর্তুগিজদের আনাগোনা ছিল। মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায় সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায় ঢাকা নামের জনপদটি। প্রশাসক হিসেবে মোগলদের স্থায়ী বসবাস শুরু হয় রাজধানীকে কেন্দ্র করে। রাজধানী তৈরি হলে তাতে মোগল, কাশ্মীরি, তুর্কি, আফগানি, ইংরেজ, পর্তুগিজ, আর্মেনীয়, চায়নিজ ইত্যাদি সংস্কৃতির মানুষেরা বসবাস শুরু করে। রাজধানী ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বাস্তবতায় মোগলাই খাবার ছড়িয়ে যেতে থাকে বাঙালি হেঁশেলে। মসলার বিশেষ ব্যবহার, মাংসের আধিক্য, পেস্তা-জাফরান-গোলাপজলের সুচারু প্রয়োগ অল্প দিনেই শিখে নেয় ঢাকাবাসী। কালক্রমে সেটাই হয়ে ওঠে ঢাকার খাবার। এ খাবার পুরো বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন, সেটা বলে দিতে হয় না। এখনো ঢাকার আইকনিক খাবার হলো এই মোগলাই খাবারের ভগ্নাবশেষ।
কিন্তু মোগলাই খাবারের পাশাপাশি এ শহরে প্রচলিত ছিল ব্রিটিশদের খাবার এবং বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগের ওপার থেকে রাজধানীতে বসবাস করতে আসা মানুষের খাবার। এ ছাড়া কাশ্মীরি, চায়নিজ ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর খাবারও প্রচলিত ছিল বা আছে রাজধানী ঢাকায়। এসব মিলেই আসলে ঢাকার খাবার।
বিবর্তনের ধারা
ঢাকা যেহেতু রাজধানী ছিল এবং আছে, তাই এ শহরে খাবারের বিবর্তন আগাগোড়াই একটি চলমান প্রক্রিয়া। মোগলসহ অন্যান্য সংস্কৃতির খাবার যেমন প্রচলিত ছিল বা আছে, তেমনি এখন এ শহরের খাবারে ঢুকে পড়েছে থাই ও ফিউশন খাবার। উপকরণ, রেসিপিসহ ফিউশন শব্দটি বহুবিধ অর্থে ব্যবহার করা যায় খাবারের ক্ষেত্রে এবং এখন এ-জাতীয় খাবারের চর্চা চলছে বেশ। সামনের দিনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিবর্তনের ধারায় আমাদের খাদ্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড় সাফল্য প্রান্তীয় খাবারের রাজধানীকরণ। বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা যায়।
২০১০ সালের আগে ঢাকা শহরে লাফা শাক পাওয়া যেত না। ব্যক্তিগতভাবে উত্তরবঙ্গের মানুষ হওয়ায় লাফা শাকের মৌসুমে সেই শাক খেতে না পারার দুঃখ পোহাতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু উল্লিখিত সময়ের পর উত্তরবঙ্গে অনায়াসে জন্মানো লাফা শাক ঢাকা শহরের বাজারগুলোতে পাওয়া যেতে শুরু করে। এখন শুধু রংপুর বা দিনাজপুরের মানুষ নয়, ঢাকা শহরে বসবাসকারী অনেক মানুষই লাফা শাক খান। একই রকমভাবে, যশোর-খুলনার চুই ঝাল কিংবা সিলেটের সাতকড়া ও চ্যাপা শুঁটকিও পাওয়া যায় এখন ঢাকা শহরের বাজার থেকে শুরু করে সুপারশপগুলোতে। যেহেতু খাবার তৈরির উপকরণগুলো সহজলভ্য হয়েছে, তাই এখন সেগুলো রান্নার রেসিপিও সহজলভ্য। সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে আসা মানুষেরা তো বটেই, রেসিপি সহজলভ্য হওয়ার পেছনে সংবাদমাধ্যম এবং ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন খাবারের গ্রুপ বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট তৈরি করতে গিয়ে আঞ্চলিক খাবারগুলো বেছে নিয়েছে। ফলে বরিশাল অঞ্চলের বিস্কি বা মলিদা নামের যে প্রাচীন খাবারগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখন ফিরে আসছে রেসিপিতে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে হলেও। তেমনি প্রচলিত খাবারগুলোরও অনেক নতুন রেসিপি তৈরি হয়েছে। যেহেতু এখন ইন্টারনেট প্রায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের রেসিপিসহ রান্নার বিস্তারিত পাওয়া যাচ্ছে সেসব অঞ্চলেও। সুবিধামতো সবাই সেসব রান্না করে নিচ্ছেন কিছু পরিবর্তন করে।
পুরোনো প্রথা
…বাড়ীতে গিয়া সোনেকা চড়াইল রান্ধন।
বন্ধু বান্ধব লইয়া করিল ভোজন।।
আমিষ নিরামিষ রান্ধে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন। …
(বিজয় গুপ্ত, পদ্মাপুরাণ, (সম্পা.) শ্রীবসন্ত কুমার ভট্টাচার্য, ১৩৪২ বঙ্গাব্দ, পৃ: ১০৬)
পরিবর্তন যা-ই হোক, প্রায় সোয়া পাঁচ শ বছর আগে বিজয় গুপ্তের লেখা এ পঙ্ক্তি ভোজনরসিক বাঙালি আজও ভোলেনি। এখনো অনুষ্ঠানে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন না হোক, পাঁচ থেকে আটটি ব্যঞ্জন বা তরকারি দরকার হয়। আর প্রতিদিনের খাবারে কমপক্ষে তিন পদ—সেটা মোগলাই হোক আর ফিউশনই হোক।
রজত কান্তি রায়, লেখক, সাংবাদিক ও কবি
গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের খাদ্যসংস্কৃতির যে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, সেটা বোঝা যায় স্পষ্টভাবে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে আমরা এই পরিবর্তনের কথা বলছি? এর সঠিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো আমাদের দেশের ইতিহাসবিদেরা লিখতে শুরু করেননি। হয়তো সময় হয়নি। হয়তো খাদ্যসংস্কৃতির বিবর্তনের কথা বলার এ কাজ বেশ শ্রমসাপেক্ষ, তাই এখনো শুরু হয়নি। আমরা জানি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কাজটি এখনো হয়নি।
একটু পেছনের কথা
যাহোক, আমরা একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের খাবার কিংবা বৃহৎ বঙ্গের খাবারের কোনো প্রমিত রূপ আছে কি? এককথায় ‘আছে’, আবার ‘নেই’। বৃহৎ এবং পুরোনো ‘মাল্টিকালচারাল’ দুটি শহর, ঢাকা ও কলকাতাকে কেন্দ্র করে খাবারের এই প্রমিতকরণ করা হয়েছে—ঠিক ভাষার মতোই। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ বঙ্গের খাবারকে কি আসলে প্রমিতকরণ করা যায়? বিষয়টি খটমট মনে হচ্ছে। একটু সহজ করে দিই।
প্রকৃতি ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রের সীমানা মানে না। এর প্রমাণ আমরা বারবার পাচ্ছি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। ভারতীয় অংশের পাহাড়ের ঢল নেমে জমা হতে থাকে হাওর অঞ্চলে। সেখান থেকে বিভিন্ন পথে তা যায় সমুদ্রে। এই হলো প্রকৃতির নিয়ম। অর্থাৎ, আমাদের দেশের হাওর আসলে আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলের পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক তেমনি সিলেট অঞ্চলের খাবারও শুধু সিলেটের নয়। এটি সিলেট বিভাগ এবং কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি নিয়ে যে বিশাল অঞ্চল, সেই অঞ্চলের খাবার। একইভাবে আমাদের রংপুর বিভাগ এবং শিলিগুড়ি থেকে আসামের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার খাবার একই। সে রকম মালদহ, মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী, নাটোরের একাংশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের খাবার প্রায় একই রকম। আমাদের যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরা এবং ভারতের চব্বিশ পরগনা মোটামুটি একই রকম। ঢাকা বিভাগের খাবার একই রকম। যদিও ঢাকা শহরের খাবার সবার থেকে কিছুটা আলাদা।
এই যে ‘একই রকম’ বা ‘প্রায় একই রকম’ খাবারের কথা বলা হচ্ছে, এর কারণ হলো সংস্কৃতি। ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অঞ্চলগুলো ভাগ হয়ে গেছে। ফলে ভাষা আর খাবার একই হলেও আদান-প্রদানে পাসপোর্ট আর ভিসার দরকার হয় এখন। এই ভিসাকেন্দ্রিক বিভাজনে গত ৭৫ বছরে ধীরে ধীরে জমেছে নতুন জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি আর ধর্মের ধুলো। সেই ধুলোর ওপর প্রাণসঞ্চার হয়েছে নতুন সংস্কৃতির, তাতে খাদ্যসংস্কৃতি পেয়েছে নতুন এক রূপ। তার মাত্রা কী হয়েছে, সেটা মাইক্রোস্কোপিক গবেষণার বিষয়। এই ছোট পরিসরে সেটা ধরতে যাওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতি
১৯৪৭ সালের বড় বড় সাংস্কৃতিক অঞ্চলের খণ্ডিত অংশ, মূলত ঢাকা বিভাগ এবং উপকূলীয় অঞ্চল—এই মিলে গড়ে উঠেছে আমাদের খাদ্যসংস্কৃতি। এ দেশে ঢাকার বাইরের খাবারের ইতিহাস সব সময় ‘ঢাকা’ থাকে রাজধানী ঢাকা নামের ছাতাটির তলে। ফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের যত আলোচনা, তা হয় ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু ঢাকায় প্রচলিত বিরিয়ানি, বোরহানি, বাকরখানির মতো অনেক খাবার যে ঢাকার বাইরে প্রায় অপ্রচলিত, সে ইতিহাস এখনো ঠিক লেখা হয়নি।
আমাদের রাজধানী ঢাকা বরাবরই একটি মাল্টিকালচারাল শহর। এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকে পর্তুগিজদের আনাগোনা ছিল। মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায় সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায় ঢাকা নামের জনপদটি। প্রশাসক হিসেবে মোগলদের স্থায়ী বসবাস শুরু হয় রাজধানীকে কেন্দ্র করে। রাজধানী তৈরি হলে তাতে মোগল, কাশ্মীরি, তুর্কি, আফগানি, ইংরেজ, পর্তুগিজ, আর্মেনীয়, চায়নিজ ইত্যাদি সংস্কৃতির মানুষেরা বসবাস শুরু করে। রাজধানী ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বাস্তবতায় মোগলাই খাবার ছড়িয়ে যেতে থাকে বাঙালি হেঁশেলে। মসলার বিশেষ ব্যবহার, মাংসের আধিক্য, পেস্তা-জাফরান-গোলাপজলের সুচারু প্রয়োগ অল্প দিনেই শিখে নেয় ঢাকাবাসী। কালক্রমে সেটাই হয়ে ওঠে ঢাকার খাবার। এ খাবার পুরো বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন, সেটা বলে দিতে হয় না। এখনো ঢাকার আইকনিক খাবার হলো এই মোগলাই খাবারের ভগ্নাবশেষ।
কিন্তু মোগলাই খাবারের পাশাপাশি এ শহরে প্রচলিত ছিল ব্রিটিশদের খাবার এবং বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগের ওপার থেকে রাজধানীতে বসবাস করতে আসা মানুষের খাবার। এ ছাড়া কাশ্মীরি, চায়নিজ ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর খাবারও প্রচলিত ছিল বা আছে রাজধানী ঢাকায়। এসব মিলেই আসলে ঢাকার খাবার।
বিবর্তনের ধারা
ঢাকা যেহেতু রাজধানী ছিল এবং আছে, তাই এ শহরে খাবারের বিবর্তন আগাগোড়াই একটি চলমান প্রক্রিয়া। মোগলসহ অন্যান্য সংস্কৃতির খাবার যেমন প্রচলিত ছিল বা আছে, তেমনি এখন এ শহরের খাবারে ঢুকে পড়েছে থাই ও ফিউশন খাবার। উপকরণ, রেসিপিসহ ফিউশন শব্দটি বহুবিধ অর্থে ব্যবহার করা যায় খাবারের ক্ষেত্রে এবং এখন এ-জাতীয় খাবারের চর্চা চলছে বেশ। সামনের দিনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিবর্তনের ধারায় আমাদের খাদ্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড় সাফল্য প্রান্তীয় খাবারের রাজধানীকরণ। বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা যায়।
২০১০ সালের আগে ঢাকা শহরে লাফা শাক পাওয়া যেত না। ব্যক্তিগতভাবে উত্তরবঙ্গের মানুষ হওয়ায় লাফা শাকের মৌসুমে সেই শাক খেতে না পারার দুঃখ পোহাতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু উল্লিখিত সময়ের পর উত্তরবঙ্গে অনায়াসে জন্মানো লাফা শাক ঢাকা শহরের বাজারগুলোতে পাওয়া যেতে শুরু করে। এখন শুধু রংপুর বা দিনাজপুরের মানুষ নয়, ঢাকা শহরে বসবাসকারী অনেক মানুষই লাফা শাক খান। একই রকমভাবে, যশোর-খুলনার চুই ঝাল কিংবা সিলেটের সাতকড়া ও চ্যাপা শুঁটকিও পাওয়া যায় এখন ঢাকা শহরের বাজার থেকে শুরু করে সুপারশপগুলোতে। যেহেতু খাবার তৈরির উপকরণগুলো সহজলভ্য হয়েছে, তাই এখন সেগুলো রান্নার রেসিপিও সহজলভ্য। সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে আসা মানুষেরা তো বটেই, রেসিপি সহজলভ্য হওয়ার পেছনে সংবাদমাধ্যম এবং ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন খাবারের গ্রুপ বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট তৈরি করতে গিয়ে আঞ্চলিক খাবারগুলো বেছে নিয়েছে। ফলে বরিশাল অঞ্চলের বিস্কি বা মলিদা নামের যে প্রাচীন খাবারগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখন ফিরে আসছে রেসিপিতে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে হলেও। তেমনি প্রচলিত খাবারগুলোরও অনেক নতুন রেসিপি তৈরি হয়েছে। যেহেতু এখন ইন্টারনেট প্রায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের রেসিপিসহ রান্নার বিস্তারিত পাওয়া যাচ্ছে সেসব অঞ্চলেও। সুবিধামতো সবাই সেসব রান্না করে নিচ্ছেন কিছু পরিবর্তন করে।
পুরোনো প্রথা
…বাড়ীতে গিয়া সোনেকা চড়াইল রান্ধন।
বন্ধু বান্ধব লইয়া করিল ভোজন।।
আমিষ নিরামিষ রান্ধে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন। …
(বিজয় গুপ্ত, পদ্মাপুরাণ, (সম্পা.) শ্রীবসন্ত কুমার ভট্টাচার্য, ১৩৪২ বঙ্গাব্দ, পৃ: ১০৬)
পরিবর্তন যা-ই হোক, প্রায় সোয়া পাঁচ শ বছর আগে বিজয় গুপ্তের লেখা এ পঙ্ক্তি ভোজনরসিক বাঙালি আজও ভোলেনি। এখনো অনুষ্ঠানে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন না হোক, পাঁচ থেকে আটটি ব্যঞ্জন বা তরকারি দরকার হয়। আর প্রতিদিনের খাবারে কমপক্ষে তিন পদ—সেটা মোগলাই হোক আর ফিউশনই হোক।
রজত কান্তি রায়, লেখক, সাংবাদিক ও কবি
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪