নজরুল ইসলাম
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অতি দ্রুত বাংলাদেশের সমাজকাঠামো বদলে যেতে থাকে। গ্রামীণ সমাজ অবশ্য বেশ কিছুদিন অপরিবর্তনীয় থেকে যায়। গ্রামীণ অভিজাত ধনীরা ক্রমে শহরে অভিবাসী হয়, গ্রামের সম্পদ নিজ দখলে রেখেই। গ্রামে দারিদ্র্য প্রকটভাবেই বিদ্যমান থাকে। পরিবর্তন আসতে শুরু করে আশির দশকের পর মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যত্র প্রবাসী কর্মসংস্থানের সুযোগের হাত ধরে। গ্রামবাংলার প্রায় এক কোটি তরুণ গত চার দশকে প্রবাসী কর্মী হয়েছে এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ অনেকটাই বদলে দিয়েছে। ওরা বাংলাদেশের নতুন গ্রামীণ সমাজ। প্রায় একই কালপর্বে ঢাকা ও চট্টগ্রামে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প গড়ে ওঠায় লাখ লাখ গ্রামীণ তরুণী শহরে অভিবাসী হয়, তাদের অর্জিত আয়ে পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে। এতে দরিদ্র শ্রেণি নিম্নমধ্যবিত্ত হওয়ার সুযোগ পায়। তা ছাড়া, গত পাঁচ দশকে সরকারি উদ্যোগে গৃহীত নানা উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রামীণ সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি এনজিও উন্নয়ন তৎপরতা দেখায়, তারও যথেষ্ট প্রভাব ছিল সমাজ বদলে; বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণে।
সরকারি উদ্যোগ ও প্রণোদনায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, নানা রকম উৎপাদনশীল কর্মে বিনিয়োগ, শিক্ষা বিস্তারে দর্শনীয় বিনিয়োগ, নারীশিক্ষায় বিনিয়োগ, আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশে ব্যাপক সহায়তা ইত্যাদি গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে পরিবর্তন আনছে। শ্রেণিকাঠামো পরিবর্তন হচ্ছে, নতুন মধ্যবিত্ত গড়ে উঠছে। আগের বিত্তহীন দরিদ্ররাও এখন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অধিকতর সচেতন। অবশ্য এসব সত্ত্বেও ধর্মীয় শিক্ষা, মাদ্রাসা, মক্তব—এদের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎ-মুখিতা প্রবল শক্তি অর্জন করেছে। সাধারণ মানুষের পোশাকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের পোশাকে। ‘থ্রিপিস’, বোরকা ও হিজাবের ব্যবহার বেড়েছে। শহরের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষদের পোশাকে প্যান্ট-শার্টের প্রাধান্য, বাঙালিয়ানায় ভক্তদের পরিধেয় পাজামা-পাঞ্জাবি, ইসলামি ধর্মশিক্ষা অনুসারী পুরুষের পোশাকে পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপির প্রাধান্য। পোশাকে রাজনৈতিক আদর্শেরও প্রতিফলন দেখা যায়।
গ্রামের বিত্তবান ও প্রভাবশালী মহল মূলত এখনো ভূমিমালিক, কৃষি উপকরণের মালিক, গ্রামীণ ব্যবসা ও নানা রকম শিল্পকারখানার মালিক ও ঠিকাদার, পরিবহনমালিক, রাজনৈতিক দলের নেতা বা জ্যেষ্ঠ কর্মী। এরাই গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতারা সমাজপতি। উপজেলা পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সব সরকারি কর্মকর্তাও সমাজে প্রভাবশালী। স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদেরও কেউ কেউ সামাজিক সম্মান পেয়ে থাকেন।
গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে অতি দ্রুত নগরায়ণ ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ৭ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশের মতো। নগরীয় জনসংখ্যার আকার বেড়েছে ৫ মিলিয়ন থেকে ৬০ মিলিয়নে। শহরে সমাজকাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে। শুরুর অতি ক্ষুদ্র আকারের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন বেশ স্ফীত। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ নিম্নবিত্ত, ৫০ শতাংশ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের অংশও প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। এদের মধ্যে কিছু আবার অতি ধনী। বাংলাদেশের অতি ধনীরা কেউ কেউ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও অতি ধনী। এদের ধনসম্পদের হিসাব সরকারের কাছেও অজানা। তবে মধ্যবিত্তের আকার-আয়তন বৃদ্ধি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নমধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু উন্নতি হলেও নিম্নবিত্তদের জীবনমানে তুলনামূলক উন্নতি লক্ষ করা যায় না।
বাংলাদেশে নগরীয় সমাজকাঠামো বোঝার একটি উপায় রাজধানীর মানুষদের সমাজকাঠামো বোঝা, কেননা এদের সম্পর্কে কিছু না কিছু গবেষণা-সমীক্ষা-পর্যবেক্ষণ দেখা যায়। অবশ্য মহানগর ঢাকার সামাজিক কাঠামো দেশের অন্যান্য শহরের পরিস্থিতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। ঢাকার প্রভাবশালী উচ্চবিত্তরা অনেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক এবং তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক প্রজন্মেই সম্ভব হয়েছে। নানা সূত্রে, নানা মাধ্যমে, নানা উপায়ে এদের বিত্ত অর্জন। এরা নানাভাবে সরকারি সহযোগিতা কাজে লাগিয়েছে। এদের কেউ কেউ উচ্চশিক্ষিত, আবার অনেকেই তা নয়। তবে এরা অধিকাংশই খুব উদ্যোগী ও বুদ্ধিমান। এদের অনেকে শিল্পকারখানার মালিক, পাওয়ার প্ল্যান্টের উদ্যোক্তা, ব্যাংকের মালিক, ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক ও অন্যান্য সম্পদের মালিক। কেউ কেউ নানা কিছুর মালিকানার সঙ্গে টিভি, প্রিন্ট মিডিয়া ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মালিক, উদ্যোক্তা। এদের অনেকের রাজধানীর অদূরে বৃহৎ পরিসরে বাগানবাড়ি বা রিসোর্ট আছে। কারও কারও বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ আছে। কেউ কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে এরা প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। এদের সন্তানেরা অনেকেই প্রবাসী। মধ্যবিত্তরা, কিছু সম্পদের মালিক হলেও অনেকে যুগপৎ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও মূলত পেশাজীবী। উচ্চমধ্যবিত্তদের কারও কারও সন্তান পাশ্চাত্যমুখী, অনেকেই নিজ মেধায়। সাধারণ মধ্যবিত্তরা নিজেদের পারিবারিক সুখ-শাস্তি, সন্তানদের শিক্ষাদান ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার চিন্তায় সময় দিয়ে থাকে। বেশির ভাগ ভাড়া বাড়িতে থাকেন। দরিদ্র শ্রেণি নিজেদের সংসার পরিচালনায় সবটুকু সময় ব্যয় করে। অনেকেই খুব দরিদ্র। জীবিকা অর্জনের বাইরে অন্য চিন্তার সময় পায় না। বড় একটি পরিবার এক কক্ষের বস্তি বাড়িতে জীবন কাটায়।
বাংলাদেশের সমাজ উদার, পরধর্মসহিষ্ণু এমন মনে করা হতো। সম্ভবত এ ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ একাধারে পরমতসহিষ্ণু ও গণতান্ত্রিক, পাশাপাশি বিপুল সংখ্যায় মধ্যযুগীয় ধর্মাশ্রয়ী ও ধর্মান্ধ এবং অগণতান্ত্রিক। পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ধর্মাচারীগণ নিরীহ জীবনাচারী। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষিত তরুণেরা দেশপ্রেমিক, আধুনিক ও উদার। এরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার চেয়ে সাংস্কৃতিক বিকাশে অধিক উৎসাহী। ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিয়ে বাংলাদেশের সমাজ। এ দেশের আদিতম নৃগোষ্ঠীর কোনো কোনো গোষ্ঠী সাঁওতাল, শবর ইত্যাদি এখনো জীবন্ত মানবগোষ্ঠী। ভাষা বিচারে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় মূলত ভাষাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে, বর্তমানে ১৭ কোটি বাংলাদেশির ৯৯ শতাংশের মাতৃভাষা বাংলা, ভাষার কারণেই তারা বাঙালি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেশ কিছু ভাষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত ও সম্মানিত। রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে এ দেশের সব ভাষাভাষীরাই ‘বাংলাদেশি’। বৃহত্তর পরিসরে বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর আলোচনায় বলা যায়, বঙ্গবন্ধু-মানসপ্রসূত দেশের যে সংবিধান, তাতে অন্যতম মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশকে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় পুরোপুরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে এসেছে সমাজে প্রকট বৈষম্য, দুর্নীতিসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক গুণ। একাত্তর-পরবর্তী ‘সবাই গরিব’ পরিস্থিতি থেকে এখন অতি অল্প কিছু অতি ধনী, কিছু ধনী, একটি স্ফীতকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বিপুলসংখ্যক দরিদ্র। তবে এখনকার দরিদ্র আর একাত্তর-পরবর্তী দরিদ্রের আয় ও জীবন-মানে কিছুটা হলেও পার্থক্য রয়েছে, প্রায় প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের হাতে একটি মোবাইল ফোন আছে। এখন গ্রামীণ দরিদ্রের কন্যা-শিশুরা সবাই বিদ্যালয়ে যায়, বিশেষত সরকারি উপবৃত্তি পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে। নগর-দরিদ্র শিশুরা এতটা ভাগ্যবান নয়, তারা অনেকে শিশুশ্রম বিনিয়োগ করে, বাস করে বস্তিতে। ২০২০-২০২১-এ চলমান কোভিড মহামারি বাংলাদেশের বিরাজমান ধনী-গরিব বৈষম্য আরও প্রকট করে তুলেছে। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রদের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে নারীর অবস্থা ও অবস্থান সব ক্ষেত্রে একই মাত্রার না হলেও প্রশংসনীয়। নারী অধিকার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন এখনো অনেক বাকি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত নয়। তা সত্ত্বেও সামাজিকভাবে দেশে শিক্ষার হার ও নারীর কর্মসংস্থান সুযোগ বাড়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই কমেছে। তবে এই হার হ্রাস পাওয়া তুলনামূলকভাবে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেই অধিক বাস্তব।
বাংলাদেশের সমকালীন সমাজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ অবশ্যই এর যুবসমাজ। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে, সামাজিক ন্যায্যতা দাবির আন্দোলনে, কর্মক্ষেত্রে ও আয় উপার্জনে দেশের বস্ত্রশিল্প বা প্রবাসে শ্রম বিনিয়োগে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রেই যুবসমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য ইতিবাচক অবদানের পাশাপাশি যুব সম্প্রদায়ের এক অংশ সমাজ ও আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডেও জড়িত হয়ে পড়ে। এমনকি কিশোর শ্রেণির মধ্যেও অস্থিরতা ও সহিংসতার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের তরুণ ও যুবসমাজ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রকৌশল-প্রযুক্তি গ্রহণ করে নিজেদেরকে এবং সমাজ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা অনেকটাই বিশ্বায়িত।
বাংলাদেশের সমাজে খুব বড় মাপের যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যে শক্তি বা আদর্শ সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল অর্থাৎ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয়তাবাদ বলতে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদই’ বুঝতেন। এক অশুভ শক্তির হাতে তাঁর মৃত্যুর পর ফৌজি শাসনামলে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদ।
বর্তমান বাংলাদেশ আভিধানিক অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজ নয়, আবার একেবারে হৃদয়হীন সমাজও নয়।
বিশ্বের বৃহৎ উন্নয়নশীল ‘গণতান্ত্রিক’ সমাজে অথবা বৃহৎ উন্নত ‘গণতান্ত্রিক’ সমাজে যে ধরনের ধর্মীয় ও বর্ণবাদী উন্মত্ততা দেখা যায়, সে তুলনায় বাংলাদেশের সমাজ এখনো কিছুটা মানবিক, যদিও রাজনৈতিক স্বার্থে মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ পাশবিক আচরণ করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশে আদর্শের ভিত্তিতে নানা রাজনৈতিক দলের, বস্তুত অসংখ্য দলের অস্তিত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশে ৫২ বছরের ইতিহাসে রাজনৈতিক ধারা বেশ মিশ্র অভিজ্ঞতার। প্রথম সাড়ে তিন বছর ছিল নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শাসন, পরবর্তী পনেরো বছর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা সামরিক শাসকদের কর্তৃত্বাধীন, ১৯৯১ সাল থেকে আবার নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শক্তির শাসনাধীন, মাঝে দুই বছর (২০০৭-২০০৮) সামরিক পৃষ্ঠপোষকতার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ন্ত্রিত শাসন, ২০০৯-এর শুরু থেকে নির্বাচিত যথাযথ গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন, অতঃপর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা করায়ত্তে রাখা শাসন, যা বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং এক বিশেষ ঘরানার ‘বিশিষ্ট নাগরিকদের’ বিবেচনায় ‘কর্তৃত্ববাদী শাসন’, ক্ষমতাসীনদের ভাষায় ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিভিন্ন খাতের সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি অবশ্যই দৃশ্যমান ও আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চ প্রশংসিত, তবে প্রশ্ন থাকে সুশাসনের ঘাটতি নিয়ে, দুর্নীতির ব্যাপকতা নিয়ে, নৈতিকতা ও মানবিকতার অবক্ষয় নিয়ে, নাগরিক অধিকারের অভাব নিয়ে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; নগর-পরিকল্পনাবিদ
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অতি দ্রুত বাংলাদেশের সমাজকাঠামো বদলে যেতে থাকে। গ্রামীণ সমাজ অবশ্য বেশ কিছুদিন অপরিবর্তনীয় থেকে যায়। গ্রামীণ অভিজাত ধনীরা ক্রমে শহরে অভিবাসী হয়, গ্রামের সম্পদ নিজ দখলে রেখেই। গ্রামে দারিদ্র্য প্রকটভাবেই বিদ্যমান থাকে। পরিবর্তন আসতে শুরু করে আশির দশকের পর মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যত্র প্রবাসী কর্মসংস্থানের সুযোগের হাত ধরে। গ্রামবাংলার প্রায় এক কোটি তরুণ গত চার দশকে প্রবাসী কর্মী হয়েছে এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ অনেকটাই বদলে দিয়েছে। ওরা বাংলাদেশের নতুন গ্রামীণ সমাজ। প্রায় একই কালপর্বে ঢাকা ও চট্টগ্রামে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প গড়ে ওঠায় লাখ লাখ গ্রামীণ তরুণী শহরে অভিবাসী হয়, তাদের অর্জিত আয়ে পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে। এতে দরিদ্র শ্রেণি নিম্নমধ্যবিত্ত হওয়ার সুযোগ পায়। তা ছাড়া, গত পাঁচ দশকে সরকারি উদ্যোগে গৃহীত নানা উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রামীণ সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি এনজিও উন্নয়ন তৎপরতা দেখায়, তারও যথেষ্ট প্রভাব ছিল সমাজ বদলে; বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণে।
সরকারি উদ্যোগ ও প্রণোদনায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, নানা রকম উৎপাদনশীল কর্মে বিনিয়োগ, শিক্ষা বিস্তারে দর্শনীয় বিনিয়োগ, নারীশিক্ষায় বিনিয়োগ, আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশে ব্যাপক সহায়তা ইত্যাদি গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে পরিবর্তন আনছে। শ্রেণিকাঠামো পরিবর্তন হচ্ছে, নতুন মধ্যবিত্ত গড়ে উঠছে। আগের বিত্তহীন দরিদ্ররাও এখন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অধিকতর সচেতন। অবশ্য এসব সত্ত্বেও ধর্মীয় শিক্ষা, মাদ্রাসা, মক্তব—এদের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎ-মুখিতা প্রবল শক্তি অর্জন করেছে। সাধারণ মানুষের পোশাকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের পোশাকে। ‘থ্রিপিস’, বোরকা ও হিজাবের ব্যবহার বেড়েছে। শহরের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষদের পোশাকে প্যান্ট-শার্টের প্রাধান্য, বাঙালিয়ানায় ভক্তদের পরিধেয় পাজামা-পাঞ্জাবি, ইসলামি ধর্মশিক্ষা অনুসারী পুরুষের পোশাকে পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপির প্রাধান্য। পোশাকে রাজনৈতিক আদর্শেরও প্রতিফলন দেখা যায়।
গ্রামের বিত্তবান ও প্রভাবশালী মহল মূলত এখনো ভূমিমালিক, কৃষি উপকরণের মালিক, গ্রামীণ ব্যবসা ও নানা রকম শিল্পকারখানার মালিক ও ঠিকাদার, পরিবহনমালিক, রাজনৈতিক দলের নেতা বা জ্যেষ্ঠ কর্মী। এরাই গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতারা সমাজপতি। উপজেলা পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সব সরকারি কর্মকর্তাও সমাজে প্রভাবশালী। স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদেরও কেউ কেউ সামাজিক সম্মান পেয়ে থাকেন।
গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে অতি দ্রুত নগরায়ণ ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ৭ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশের মতো। নগরীয় জনসংখ্যার আকার বেড়েছে ৫ মিলিয়ন থেকে ৬০ মিলিয়নে। শহরে সমাজকাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে। শুরুর অতি ক্ষুদ্র আকারের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন বেশ স্ফীত। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ নিম্নবিত্ত, ৫০ শতাংশ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের অংশও প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। এদের মধ্যে কিছু আবার অতি ধনী। বাংলাদেশের অতি ধনীরা কেউ কেউ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও অতি ধনী। এদের ধনসম্পদের হিসাব সরকারের কাছেও অজানা। তবে মধ্যবিত্তের আকার-আয়তন বৃদ্ধি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নমধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু উন্নতি হলেও নিম্নবিত্তদের জীবনমানে তুলনামূলক উন্নতি লক্ষ করা যায় না।
বাংলাদেশে নগরীয় সমাজকাঠামো বোঝার একটি উপায় রাজধানীর মানুষদের সমাজকাঠামো বোঝা, কেননা এদের সম্পর্কে কিছু না কিছু গবেষণা-সমীক্ষা-পর্যবেক্ষণ দেখা যায়। অবশ্য মহানগর ঢাকার সামাজিক কাঠামো দেশের অন্যান্য শহরের পরিস্থিতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। ঢাকার প্রভাবশালী উচ্চবিত্তরা অনেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক এবং তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক প্রজন্মেই সম্ভব হয়েছে। নানা সূত্রে, নানা মাধ্যমে, নানা উপায়ে এদের বিত্ত অর্জন। এরা নানাভাবে সরকারি সহযোগিতা কাজে লাগিয়েছে। এদের কেউ কেউ উচ্চশিক্ষিত, আবার অনেকেই তা নয়। তবে এরা অধিকাংশই খুব উদ্যোগী ও বুদ্ধিমান। এদের অনেকে শিল্পকারখানার মালিক, পাওয়ার প্ল্যান্টের উদ্যোক্তা, ব্যাংকের মালিক, ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক ও অন্যান্য সম্পদের মালিক। কেউ কেউ নানা কিছুর মালিকানার সঙ্গে টিভি, প্রিন্ট মিডিয়া ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মালিক, উদ্যোক্তা। এদের অনেকের রাজধানীর অদূরে বৃহৎ পরিসরে বাগানবাড়ি বা রিসোর্ট আছে। কারও কারও বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ আছে। কেউ কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে এরা প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। এদের সন্তানেরা অনেকেই প্রবাসী। মধ্যবিত্তরা, কিছু সম্পদের মালিক হলেও অনেকে যুগপৎ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও মূলত পেশাজীবী। উচ্চমধ্যবিত্তদের কারও কারও সন্তান পাশ্চাত্যমুখী, অনেকেই নিজ মেধায়। সাধারণ মধ্যবিত্তরা নিজেদের পারিবারিক সুখ-শাস্তি, সন্তানদের শিক্ষাদান ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার চিন্তায় সময় দিয়ে থাকে। বেশির ভাগ ভাড়া বাড়িতে থাকেন। দরিদ্র শ্রেণি নিজেদের সংসার পরিচালনায় সবটুকু সময় ব্যয় করে। অনেকেই খুব দরিদ্র। জীবিকা অর্জনের বাইরে অন্য চিন্তার সময় পায় না। বড় একটি পরিবার এক কক্ষের বস্তি বাড়িতে জীবন কাটায়।
বাংলাদেশের সমাজ উদার, পরধর্মসহিষ্ণু এমন মনে করা হতো। সম্ভবত এ ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ একাধারে পরমতসহিষ্ণু ও গণতান্ত্রিক, পাশাপাশি বিপুল সংখ্যায় মধ্যযুগীয় ধর্মাশ্রয়ী ও ধর্মান্ধ এবং অগণতান্ত্রিক। পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ধর্মাচারীগণ নিরীহ জীবনাচারী। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষিত তরুণেরা দেশপ্রেমিক, আধুনিক ও উদার। এরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার চেয়ে সাংস্কৃতিক বিকাশে অধিক উৎসাহী। ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিয়ে বাংলাদেশের সমাজ। এ দেশের আদিতম নৃগোষ্ঠীর কোনো কোনো গোষ্ঠী সাঁওতাল, শবর ইত্যাদি এখনো জীবন্ত মানবগোষ্ঠী। ভাষা বিচারে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় মূলত ভাষাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে, বর্তমানে ১৭ কোটি বাংলাদেশির ৯৯ শতাংশের মাতৃভাষা বাংলা, ভাষার কারণেই তারা বাঙালি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেশ কিছু ভাষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত ও সম্মানিত। রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে এ দেশের সব ভাষাভাষীরাই ‘বাংলাদেশি’। বৃহত্তর পরিসরে বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর আলোচনায় বলা যায়, বঙ্গবন্ধু-মানসপ্রসূত দেশের যে সংবিধান, তাতে অন্যতম মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশকে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় পুরোপুরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে এসেছে সমাজে প্রকট বৈষম্য, দুর্নীতিসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক গুণ। একাত্তর-পরবর্তী ‘সবাই গরিব’ পরিস্থিতি থেকে এখন অতি অল্প কিছু অতি ধনী, কিছু ধনী, একটি স্ফীতকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বিপুলসংখ্যক দরিদ্র। তবে এখনকার দরিদ্র আর একাত্তর-পরবর্তী দরিদ্রের আয় ও জীবন-মানে কিছুটা হলেও পার্থক্য রয়েছে, প্রায় প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের হাতে একটি মোবাইল ফোন আছে। এখন গ্রামীণ দরিদ্রের কন্যা-শিশুরা সবাই বিদ্যালয়ে যায়, বিশেষত সরকারি উপবৃত্তি পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে। নগর-দরিদ্র শিশুরা এতটা ভাগ্যবান নয়, তারা অনেকে শিশুশ্রম বিনিয়োগ করে, বাস করে বস্তিতে। ২০২০-২০২১-এ চলমান কোভিড মহামারি বাংলাদেশের বিরাজমান ধনী-গরিব বৈষম্য আরও প্রকট করে তুলেছে। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রদের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে নারীর অবস্থা ও অবস্থান সব ক্ষেত্রে একই মাত্রার না হলেও প্রশংসনীয়। নারী অধিকার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন এখনো অনেক বাকি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত নয়। তা সত্ত্বেও সামাজিকভাবে দেশে শিক্ষার হার ও নারীর কর্মসংস্থান সুযোগ বাড়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই কমেছে। তবে এই হার হ্রাস পাওয়া তুলনামূলকভাবে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেই অধিক বাস্তব।
বাংলাদেশের সমকালীন সমাজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ অবশ্যই এর যুবসমাজ। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে, সামাজিক ন্যায্যতা দাবির আন্দোলনে, কর্মক্ষেত্রে ও আয় উপার্জনে দেশের বস্ত্রশিল্প বা প্রবাসে শ্রম বিনিয়োগে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রেই যুবসমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য ইতিবাচক অবদানের পাশাপাশি যুব সম্প্রদায়ের এক অংশ সমাজ ও আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডেও জড়িত হয়ে পড়ে। এমনকি কিশোর শ্রেণির মধ্যেও অস্থিরতা ও সহিংসতার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের তরুণ ও যুবসমাজ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রকৌশল-প্রযুক্তি গ্রহণ করে নিজেদেরকে এবং সমাজ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা অনেকটাই বিশ্বায়িত।
বাংলাদেশের সমাজে খুব বড় মাপের যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যে শক্তি বা আদর্শ সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল অর্থাৎ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয়তাবাদ বলতে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদই’ বুঝতেন। এক অশুভ শক্তির হাতে তাঁর মৃত্যুর পর ফৌজি শাসনামলে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদ।
বর্তমান বাংলাদেশ আভিধানিক অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজ নয়, আবার একেবারে হৃদয়হীন সমাজও নয়।
বিশ্বের বৃহৎ উন্নয়নশীল ‘গণতান্ত্রিক’ সমাজে অথবা বৃহৎ উন্নত ‘গণতান্ত্রিক’ সমাজে যে ধরনের ধর্মীয় ও বর্ণবাদী উন্মত্ততা দেখা যায়, সে তুলনায় বাংলাদেশের সমাজ এখনো কিছুটা মানবিক, যদিও রাজনৈতিক স্বার্থে মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ পাশবিক আচরণ করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশে আদর্শের ভিত্তিতে নানা রাজনৈতিক দলের, বস্তুত অসংখ্য দলের অস্তিত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশে ৫২ বছরের ইতিহাসে রাজনৈতিক ধারা বেশ মিশ্র অভিজ্ঞতার। প্রথম সাড়ে তিন বছর ছিল নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শাসন, পরবর্তী পনেরো বছর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা সামরিক শাসকদের কর্তৃত্বাধীন, ১৯৯১ সাল থেকে আবার নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শক্তির শাসনাধীন, মাঝে দুই বছর (২০০৭-২০০৮) সামরিক পৃষ্ঠপোষকতার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ন্ত্রিত শাসন, ২০০৯-এর শুরু থেকে নির্বাচিত যথাযথ গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন, অতঃপর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা করায়ত্তে রাখা শাসন, যা বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং এক বিশেষ ঘরানার ‘বিশিষ্ট নাগরিকদের’ বিবেচনায় ‘কর্তৃত্ববাদী শাসন’, ক্ষমতাসীনদের ভাষায় ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিভিন্ন খাতের সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি অবশ্যই দৃশ্যমান ও আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চ প্রশংসিত, তবে প্রশ্ন থাকে সুশাসনের ঘাটতি নিয়ে, দুর্নীতির ব্যাপকতা নিয়ে, নৈতিকতা ও মানবিকতার অবক্ষয় নিয়ে, নাগরিক অধিকারের অভাব নিয়ে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; নগর-পরিকল্পনাবিদ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪