জাহীদ রেজা নূর
আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার লেখা ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ বইটি আমাদের যুদ্ধ-সাহিত্যে এক মাইলফলক। মুক্তিযুদ্ধটা যে শুধু সেনাসদস্যদের বীরোচিত সংগ্রামের ইতিহাস নয়; বরং এই যুদ্ধ মূলত জনযুদ্ধ, সেটা আপনার বইয়ে বিবৃত হয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে। বইটি পড়তে গিয়ে কখনো মনে হচ্ছে কোনো ছোটগল্প পড়ছি, কখনো মনে হয়েছে ঢুকে গেছি কোনো উপন্যাসের পাতায়, কখনো যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনায় শরীর-মন শিহরিত হয়েছে। আপনাকে মনে হয়েছে একটি যুদ্ধের ভাষ্যকার। পরিণত লেখার হাত আপনি কী করে পেলেন?
মাহবুব আলম: আমি আসলে সাহিত্যের মানুষ। পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে ছোটবেলা থেকেই। পাবলিক লাইব্রেরির মেম্বার হয়েও প্রচুর পড়াশোনা করেছি। নিজে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে চাকরি করেছি। বইয়ের জগতের মধ্যেই ছিলাম। লাইব্রেরি সায়েন্সে এমএ করেছি। বই নিয়েই আমার জীবন কেটে যাচ্ছে। এখনো অনেক বই পড়ি, যদিও এই বয়সে চোখে সমস্যা হয়েছে। যে বইটির কথা বলছেন, সেটা ছাড়াও আরও অনেকগুলো বই আমি লিখেছি। সে বইগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ডও মুক্তিযুদ্ধ।
আজকের পত্রিকা: ছায়াছবির মতো মনে হয় আপনার এ বইটি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। এই বইয়ের প্রস্তুতিটা ছিল কত দিনের?
মাহবুব আলম: যুদ্ধের পর ১৯৭২ সাল থেকেই মনে হয়েছে, এ বিষয়ে লিখব। যা মনে এসেছে, লিখে রেখেছি। যেহেতু সরকারি চাকরিতে ছিলাম, বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং ছিল। একটু সুযোগ পেলেই লিখে রাখার চেষ্টা করেছি। আশির দশকে এসে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছিলাম। তখন সচিত্র সন্ধানী, বিচিত্রা আর রোববার বের হতো। ওই সব সাহিত্য পত্রিকায় লেখা পাঠালে ওরা ছাপত। আমাদের প্রিয় হাসনাত ভাই, সংবাদের, তিনিও প্রচুর লেখা ছাপিয়েছেন। প্রথম আলোও কিছু লেখা ছেপেছে।
আজকের পত্রিকা: আশির দশক থেকেই তাহলে আপনার লেখা ছাপা শুরু হয়েছে। সেগুলো এক করেই কি এই বই, নাকি সেগুলো আলাদা লেখা?
মাহবুব আলম: সেগুলো আলাদা লেখা। বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা এখান থেকে, ওখান থেকে নেওয়া নয়। একেবারে কমপ্যাক্ট একটা কাজ।
আজকের পত্রিকা: একাত্তর সাল বা তার আগের বছরগুলো জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাধিকার ইত্যাদি দিয়ে আপনাদের ঋদ্ধ করেছে। সে সময় আপনার ভাবনার পরিমণ্ডলটা নিয়ে একটু বলুন।
মাহবুব আলম: সাতই মার্চের ভাষণের পরই তো আমি রংপুরে চলে গেলাম। ২৫ মার্চে ক্র্যাকডাউন হয়। জানালা দিয়েই দেখলাম, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই মিলিটারির গাড়ি যাচ্ছে। তাদের ভারী বুটের শব্দ শুনলাম। তারপর রংপুরে ৪ এপ্রিল ওরা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটাল। রংপুরের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের ক্যান্টনমেন্টে বন্দী রেখেছিল। ৪ এপ্রিল নিয়ে এসে ব্রাশফায়ারে হত্যা করল। এ ঘটনায় শহরে বিরাট এক প্যানিক সৃষ্টি হলো। শহরের মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে লাগল। যে যেভাবে পারে পালিয়ে যেতে থাকল। কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায়, কেউ গরুর গাড়িতে, কেউ হেঁটে শহর ছাড়ল। সে সময় রংপুরে যদি দু-তিন লাখ লোক থেকে থাকে, তাহলে তার অর্ধেক লোক চলে গেল। শহরটা ফাঁকা হয়ে গেল। তখন বিহারি ক্যাম্প ছিল আলমনগরে। তাদের যুবা শ্রেণি মুজাহিদ বাহিনীতে নাম লেখাল। পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে তারা বাসে চড়ে ক্যান্টনমেন্টে যেত। তখনো রাজাকার তৈরি হয়নি। এই মুজাহিদ বাহিনীর প্রশিক্ষণ চলছিল। এই মুজাহিদরা স্বল্পকালীন ট্রেনিং পেয়ে ফ্রন্টে চলে যেত।
রংপুর অঞ্চলে তখন তিস্তা রেলওয়ে ব্রিজের মাঝামাঝি ওয়াগনসহ নানা কিছু ফেলে সে সময় ইপিআর, আনসার সদস্য আর ছাত্রজনতা প্রতিরোধে অংশ নেয়। পাকিস্তানিরা যেন তিস্তা পার হতে না পারে। এই তিস্তায় প্রথম কাউন্টার-এনকাউন্টার শুরু হলো। তখনো মুক্তিবাহিনী তৈরি হয়নি।
আজকের পত্রিকা: ৪ এপ্রিলের হত্যাকাণ্ডের পর কি ভয় পেয়েছিলেন?
মাহবুব আলম: আমি ভয় পাইনি। এক সিনিয়র বন্ধুকে নিয়ে আমাদের বাড়ির মাইলখানেক পেছনের কিলিং স্পটে পরদিন সকালেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে লাশ। খুব খারাপ লাগল। লাইব্রেরিতে চাকরি করি তখন। একদিন লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, দেখি মুজাহিদ বাহিনী পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে চলেছে। হঠাৎ করে একটা পিকআপ ভর্তি মিলিটারি লাইব্রেরিতে ঢোকে। আমার সঙ্গে লাইব্রেরির একজন পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। একজন পিয়ন ছিলেন। তারা এখানে তাণ্ডব চালাবে বলেই আসে। তারপর এসে আমাকে বলে, ‘হিন্দু রাইটারকা কোই বই হ্যায়।’ আমি তো মনে মনে বলি, এখানে তো নব্বই ভাগ বই-ই হিন্দু লেখকদের। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত থেকে শরৎচন্দ্র, সমরেশ বসু—সবাই তো হিন্দু লেখক। বাংলা গবেষণারও কিছু বই ছিল, সেগুলোও তো হিন্দু লেখকদের লেখা। তখন কেবল মুসলমান লেখকদের বই আসছে। জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কিছু বই আছে।
রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর সিরিজের বইও ছিল। যাহোক, তারা আলমারি ভাঙেনি, আমি খুলে দিলাম। দেখলিজিয়ে বললাম। ওরা তো বাংলা পড়তে পারে না, ফলে বেঁচে গেলাম। নইলে ওই দিনই মৃত্যু অবধারিত ছিল। উর্দু সেকশনের বইগুলো দেখে খুব খুশি হলো। লাইব্রেরির কোনো ক্ষতি না করে চলে গেল। বাইরে এসে পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে গ্রানাইট পাথরের যে মূর্তিগুলো ছিল, সেগুলো শাবল দিয়ে নামানো শুরু করল।
আজকের পত্রিকা: এই ঘটনা কি আপনার মনে বড় রকমের প্রভাব ফেলেছিল?
মাহবুব আলম: এটাই পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে সরাসরি দেখা, ভয়াবহ সময় কাটানো। এরপরই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। লাইব্রেরি বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনে হলো, যদি আমার হাতে অস্ত্র থাকত, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারতাম। বুঝলাম, এভাবে তো হয় না, ট্রেনিং লাগবে, অস্ত্র লাগবে। তখন গুজব ছিল, ভারতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হচ্ছে। আমি বাড়িতে চলে গেলাম। বাড়িতে কেউ নেই। আমরা ঠিক করলাম, ভারতে চলে যাব। তখন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কেউ কেউ রাজি হলো, যাবে। কিন্তু যাওয়ার সময় কেউ গেল না। আমি চন্দন পাঠে আশ্রয় নিলাম। ওখানে কয়েক দিন থেকে সাথি জোগাড় করে চারজন আমরা সাইকেল নিয়ে সীমান্তের দিকে রওনা হলাম। সিতাই সীমান্ত দিয়ে কোচবিহার, মাথাভাঙ্গা হয়ে, জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়িতে দু-তিন দিন থাকার পর একদিন একজন এসে বলে, ভাই, আপনি তো মুক্তিবাহিনীতে যাবেন, মুক্তিবাহিনীতে তো লোক নিচ্ছে। তখন আমরা সাতজন বাংলাবান্ধার দিকে রওনা দিলাম। বিকেলের আগে। সেখানে রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই।
এরপর প্রশিক্ষণ হলো জলপাইগুড়ির মুরতি থানার মেটলি পাহাড়ের ওপর। কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য এটা ভারতের সেরা ক্যাম্প। এ বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আমার বইয়ে আছে।
আজকের পত্রিকা: হাইডআউটে যখন আছেন, ফিরবেন কি ফিরবেন না, জানেন না?
মাহবুব আলম: অপারেশনে যাওয়ার আগে তো আমরা দিনের বেলায়ই তা ঠিক করে ফেলি। একটা টার্গেট তো থাকেই। অধিকাংশই তো আমার নেতৃত্বে টার্গেটে গেছি, হিট করেছি। সন্ধ্যার পর, রাতে। সীমান্তবর্তী এলাকায় জনগণ সাধারণত কম। আমরা সব সময় বাড়িঘর, জনপদ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। প্রতিটি অপারেশনে টার্গেট ঠিক করা, তারপর তো আক্রমণে সফলতা আনার চেষ্টা করা। এতে যদি কেউ মারা যায়, আমি মারা যাই…যেমন প্রতিটা অপারেশনেই শত্রুর ঘাঁটির কাছাকাছি গেলে মনে হতো, এই বুঝি একটা গুলি এসে বুক ঝাঁঝরা করে দেবে। কিন্তু সেটা মনের ওপর খুব প্রভাব ফেলেনি।
আজকের পত্রিকা: সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা তো কোনো কিছুর আশা না করেই ফিরে গেলেন নিজেদের কাজে…
মাহবুব আলম: কাজে আর ফিরলেন কই? ফিরে গেলেন বাড়িতে। তাঁরা তো সাধারণ কৃষক পরিবার থেকেই এসেছিলেন। এসেছিলেন ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিক। তাঁরা অস্ত্র জমা দিলেন যুদ্ধ শেষে। কী পেয়েছেন তাঁরা? একটা সার্টিফিকেট আর এক শ টাকা দিয়ে বলা হলো, বাড়ি যাও। তাঁরা বাড়ি গিয়ে করবেনটা কী? স্বাধীনতাবিরোধীরা তো তখনো আছে, তাদের তাঁরা মোকাবিলা করবেন কীভাবে? তাঁদের শেল্টার বা প্রোটেকশন দেবে কে? এই মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর পরিবারের খাবারটা দেবে কে? এসব বিবেচনা না করেই মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এটা খুবই অমানবিক ব্যাপার ছিল। ছেলেরা যেভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ল, সেটা ভুলতে পারি না।
আজকের পত্রিকা: যুদ্ধটা তো ছিল জনযুদ্ধ। আপনার বইতেই এমন অসংখ্য সাধারণ যোদ্ধাকে পাওয়া যাবে, যাঁরা খেতাব পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু খেতাব মূলত দেওয়া হয়েছে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের। সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে উঠে আসা বীরদের তো এই সম্মান দেওয়া যেত?
মাহবুব আলম: অবশ্যই দেওয়া যেত। সেটাই সংগত ছিল। কিন্তু দেওয়া হয়নি।
আজকের পত্রিকা: আমরা বইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি কি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উচ্চাঙ্গের কোনো কাজ হয়েছে? না হলে কেন হয়নি?
মাহবুব আলম: আমরা পারিনি তুলে আনতে। যাঁরা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, তাঁরা তো কেউ যুদ্ধে যাননি। এটাই সহজ কথা। আপনি যুদ্ধেই যাননি, আপনি যুদ্ধের সাহিত্য রচনা করবেন কী করে? এ কারণেই আমাদের দেশে যুদ্ধ নিয়ে ভালো সাহিত্য নেই। শুধু বানিয়ে লিখে তো উচ্চাঙ্গের সাহিত্য রচনা করা যায়
না। মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের সেই প্রাণরসটা নিয়ে লেখা আর হবে বলে মনে করি না।
আজকের পত্রিকা: ‘জয় বাংলা কি হইবে কোনো দিন, কহেন দেখি’—এই প্রশ্নের উত্তর কী দেবেন?
মাহবুব আলম: হ্যাঁ, হওয়াই নাইগবে। যেখানেই গেছি তখন, সবখানেই আমাদের জিজ্ঞেস করেছে, কবে জয় বাংলা হবে। স্বাধীন হবে তো বলত না, বলত জয় বাংলা। সবখানে আমরা বলেছি, হবে। খুব তাড়াতাড়ি হবে। কখনো কখনো মনে হয়েছে, এই যে আমরা আশ্বাসটা দিচ্ছি, তা কি সঠিকভাবে দিচ্ছি?
আজকের পত্রিকা: বায়ান্ন বছর আগে তো একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। ওই জয় বাংলা কি হয়েছে?
মাহবুব আলম: জয় বাংলা হয়েছে। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। এখন এই জয় বাংলাকে নিয়ে নিজে কী করছেন, সেটা তো আপনার ওপর নির্ভর করবে। নিজেকেই তো প্রশ্ন করতে হবে, কী করছেন দেশকে নিয়ে?
আজকের পত্রিকা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহবুব: আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার লেখা ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ বইটি আমাদের যুদ্ধ-সাহিত্যে এক মাইলফলক। মুক্তিযুদ্ধটা যে শুধু সেনাসদস্যদের বীরোচিত সংগ্রামের ইতিহাস নয়; বরং এই যুদ্ধ মূলত জনযুদ্ধ, সেটা আপনার বইয়ে বিবৃত হয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে। বইটি পড়তে গিয়ে কখনো মনে হচ্ছে কোনো ছোটগল্প পড়ছি, কখনো মনে হয়েছে ঢুকে গেছি কোনো উপন্যাসের পাতায়, কখনো যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনায় শরীর-মন শিহরিত হয়েছে। আপনাকে মনে হয়েছে একটি যুদ্ধের ভাষ্যকার। পরিণত লেখার হাত আপনি কী করে পেলেন?
মাহবুব আলম: আমি আসলে সাহিত্যের মানুষ। পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে ছোটবেলা থেকেই। পাবলিক লাইব্রেরির মেম্বার হয়েও প্রচুর পড়াশোনা করেছি। নিজে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে চাকরি করেছি। বইয়ের জগতের মধ্যেই ছিলাম। লাইব্রেরি সায়েন্সে এমএ করেছি। বই নিয়েই আমার জীবন কেটে যাচ্ছে। এখনো অনেক বই পড়ি, যদিও এই বয়সে চোখে সমস্যা হয়েছে। যে বইটির কথা বলছেন, সেটা ছাড়াও আরও অনেকগুলো বই আমি লিখেছি। সে বইগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ডও মুক্তিযুদ্ধ।
আজকের পত্রিকা: ছায়াছবির মতো মনে হয় আপনার এ বইটি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। এই বইয়ের প্রস্তুতিটা ছিল কত দিনের?
মাহবুব আলম: যুদ্ধের পর ১৯৭২ সাল থেকেই মনে হয়েছে, এ বিষয়ে লিখব। যা মনে এসেছে, লিখে রেখেছি। যেহেতু সরকারি চাকরিতে ছিলাম, বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং ছিল। একটু সুযোগ পেলেই লিখে রাখার চেষ্টা করেছি। আশির দশকে এসে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছিলাম। তখন সচিত্র সন্ধানী, বিচিত্রা আর রোববার বের হতো। ওই সব সাহিত্য পত্রিকায় লেখা পাঠালে ওরা ছাপত। আমাদের প্রিয় হাসনাত ভাই, সংবাদের, তিনিও প্রচুর লেখা ছাপিয়েছেন। প্রথম আলোও কিছু লেখা ছেপেছে।
আজকের পত্রিকা: আশির দশক থেকেই তাহলে আপনার লেখা ছাপা শুরু হয়েছে। সেগুলো এক করেই কি এই বই, নাকি সেগুলো আলাদা লেখা?
মাহবুব আলম: সেগুলো আলাদা লেখা। বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা এখান থেকে, ওখান থেকে নেওয়া নয়। একেবারে কমপ্যাক্ট একটা কাজ।
আজকের পত্রিকা: একাত্তর সাল বা তার আগের বছরগুলো জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাধিকার ইত্যাদি দিয়ে আপনাদের ঋদ্ধ করেছে। সে সময় আপনার ভাবনার পরিমণ্ডলটা নিয়ে একটু বলুন।
মাহবুব আলম: সাতই মার্চের ভাষণের পরই তো আমি রংপুরে চলে গেলাম। ২৫ মার্চে ক্র্যাকডাউন হয়। জানালা দিয়েই দেখলাম, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই মিলিটারির গাড়ি যাচ্ছে। তাদের ভারী বুটের শব্দ শুনলাম। তারপর রংপুরে ৪ এপ্রিল ওরা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটাল। রংপুরের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের ক্যান্টনমেন্টে বন্দী রেখেছিল। ৪ এপ্রিল নিয়ে এসে ব্রাশফায়ারে হত্যা করল। এ ঘটনায় শহরে বিরাট এক প্যানিক সৃষ্টি হলো। শহরের মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে লাগল। যে যেভাবে পারে পালিয়ে যেতে থাকল। কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায়, কেউ গরুর গাড়িতে, কেউ হেঁটে শহর ছাড়ল। সে সময় রংপুরে যদি দু-তিন লাখ লোক থেকে থাকে, তাহলে তার অর্ধেক লোক চলে গেল। শহরটা ফাঁকা হয়ে গেল। তখন বিহারি ক্যাম্প ছিল আলমনগরে। তাদের যুবা শ্রেণি মুজাহিদ বাহিনীতে নাম লেখাল। পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে তারা বাসে চড়ে ক্যান্টনমেন্টে যেত। তখনো রাজাকার তৈরি হয়নি। এই মুজাহিদ বাহিনীর প্রশিক্ষণ চলছিল। এই মুজাহিদরা স্বল্পকালীন ট্রেনিং পেয়ে ফ্রন্টে চলে যেত।
রংপুর অঞ্চলে তখন তিস্তা রেলওয়ে ব্রিজের মাঝামাঝি ওয়াগনসহ নানা কিছু ফেলে সে সময় ইপিআর, আনসার সদস্য আর ছাত্রজনতা প্রতিরোধে অংশ নেয়। পাকিস্তানিরা যেন তিস্তা পার হতে না পারে। এই তিস্তায় প্রথম কাউন্টার-এনকাউন্টার শুরু হলো। তখনো মুক্তিবাহিনী তৈরি হয়নি।
আজকের পত্রিকা: ৪ এপ্রিলের হত্যাকাণ্ডের পর কি ভয় পেয়েছিলেন?
মাহবুব আলম: আমি ভয় পাইনি। এক সিনিয়র বন্ধুকে নিয়ে আমাদের বাড়ির মাইলখানেক পেছনের কিলিং স্পটে পরদিন সকালেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে লাশ। খুব খারাপ লাগল। লাইব্রেরিতে চাকরি করি তখন। একদিন লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, দেখি মুজাহিদ বাহিনী পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে চলেছে। হঠাৎ করে একটা পিকআপ ভর্তি মিলিটারি লাইব্রেরিতে ঢোকে। আমার সঙ্গে লাইব্রেরির একজন পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। একজন পিয়ন ছিলেন। তারা এখানে তাণ্ডব চালাবে বলেই আসে। তারপর এসে আমাকে বলে, ‘হিন্দু রাইটারকা কোই বই হ্যায়।’ আমি তো মনে মনে বলি, এখানে তো নব্বই ভাগ বই-ই হিন্দু লেখকদের। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত থেকে শরৎচন্দ্র, সমরেশ বসু—সবাই তো হিন্দু লেখক। বাংলা গবেষণারও কিছু বই ছিল, সেগুলোও তো হিন্দু লেখকদের লেখা। তখন কেবল মুসলমান লেখকদের বই আসছে। জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কিছু বই আছে।
রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর সিরিজের বইও ছিল। যাহোক, তারা আলমারি ভাঙেনি, আমি খুলে দিলাম। দেখলিজিয়ে বললাম। ওরা তো বাংলা পড়তে পারে না, ফলে বেঁচে গেলাম। নইলে ওই দিনই মৃত্যু অবধারিত ছিল। উর্দু সেকশনের বইগুলো দেখে খুব খুশি হলো। লাইব্রেরির কোনো ক্ষতি না করে চলে গেল। বাইরে এসে পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে গ্রানাইট পাথরের যে মূর্তিগুলো ছিল, সেগুলো শাবল দিয়ে নামানো শুরু করল।
আজকের পত্রিকা: এই ঘটনা কি আপনার মনে বড় রকমের প্রভাব ফেলেছিল?
মাহবুব আলম: এটাই পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে সরাসরি দেখা, ভয়াবহ সময় কাটানো। এরপরই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। লাইব্রেরি বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনে হলো, যদি আমার হাতে অস্ত্র থাকত, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারতাম। বুঝলাম, এভাবে তো হয় না, ট্রেনিং লাগবে, অস্ত্র লাগবে। তখন গুজব ছিল, ভারতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হচ্ছে। আমি বাড়িতে চলে গেলাম। বাড়িতে কেউ নেই। আমরা ঠিক করলাম, ভারতে চলে যাব। তখন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কেউ কেউ রাজি হলো, যাবে। কিন্তু যাওয়ার সময় কেউ গেল না। আমি চন্দন পাঠে আশ্রয় নিলাম। ওখানে কয়েক দিন থেকে সাথি জোগাড় করে চারজন আমরা সাইকেল নিয়ে সীমান্তের দিকে রওনা হলাম। সিতাই সীমান্ত দিয়ে কোচবিহার, মাথাভাঙ্গা হয়ে, জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়িতে দু-তিন দিন থাকার পর একদিন একজন এসে বলে, ভাই, আপনি তো মুক্তিবাহিনীতে যাবেন, মুক্তিবাহিনীতে তো লোক নিচ্ছে। তখন আমরা সাতজন বাংলাবান্ধার দিকে রওনা দিলাম। বিকেলের আগে। সেখানে রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই।
এরপর প্রশিক্ষণ হলো জলপাইগুড়ির মুরতি থানার মেটলি পাহাড়ের ওপর। কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য এটা ভারতের সেরা ক্যাম্প। এ বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আমার বইয়ে আছে।
আজকের পত্রিকা: হাইডআউটে যখন আছেন, ফিরবেন কি ফিরবেন না, জানেন না?
মাহবুব আলম: অপারেশনে যাওয়ার আগে তো আমরা দিনের বেলায়ই তা ঠিক করে ফেলি। একটা টার্গেট তো থাকেই। অধিকাংশই তো আমার নেতৃত্বে টার্গেটে গেছি, হিট করেছি। সন্ধ্যার পর, রাতে। সীমান্তবর্তী এলাকায় জনগণ সাধারণত কম। আমরা সব সময় বাড়িঘর, জনপদ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। প্রতিটি অপারেশনে টার্গেট ঠিক করা, তারপর তো আক্রমণে সফলতা আনার চেষ্টা করা। এতে যদি কেউ মারা যায়, আমি মারা যাই…যেমন প্রতিটা অপারেশনেই শত্রুর ঘাঁটির কাছাকাছি গেলে মনে হতো, এই বুঝি একটা গুলি এসে বুক ঝাঁঝরা করে দেবে। কিন্তু সেটা মনের ওপর খুব প্রভাব ফেলেনি।
আজকের পত্রিকা: সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা তো কোনো কিছুর আশা না করেই ফিরে গেলেন নিজেদের কাজে…
মাহবুব আলম: কাজে আর ফিরলেন কই? ফিরে গেলেন বাড়িতে। তাঁরা তো সাধারণ কৃষক পরিবার থেকেই এসেছিলেন। এসেছিলেন ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিক। তাঁরা অস্ত্র জমা দিলেন যুদ্ধ শেষে। কী পেয়েছেন তাঁরা? একটা সার্টিফিকেট আর এক শ টাকা দিয়ে বলা হলো, বাড়ি যাও। তাঁরা বাড়ি গিয়ে করবেনটা কী? স্বাধীনতাবিরোধীরা তো তখনো আছে, তাদের তাঁরা মোকাবিলা করবেন কীভাবে? তাঁদের শেল্টার বা প্রোটেকশন দেবে কে? এই মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর পরিবারের খাবারটা দেবে কে? এসব বিবেচনা না করেই মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এটা খুবই অমানবিক ব্যাপার ছিল। ছেলেরা যেভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ল, সেটা ভুলতে পারি না।
আজকের পত্রিকা: যুদ্ধটা তো ছিল জনযুদ্ধ। আপনার বইতেই এমন অসংখ্য সাধারণ যোদ্ধাকে পাওয়া যাবে, যাঁরা খেতাব পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু খেতাব মূলত দেওয়া হয়েছে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের। সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে উঠে আসা বীরদের তো এই সম্মান দেওয়া যেত?
মাহবুব আলম: অবশ্যই দেওয়া যেত। সেটাই সংগত ছিল। কিন্তু দেওয়া হয়নি।
আজকের পত্রিকা: আমরা বইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি কি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উচ্চাঙ্গের কোনো কাজ হয়েছে? না হলে কেন হয়নি?
মাহবুব আলম: আমরা পারিনি তুলে আনতে। যাঁরা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, তাঁরা তো কেউ যুদ্ধে যাননি। এটাই সহজ কথা। আপনি যুদ্ধেই যাননি, আপনি যুদ্ধের সাহিত্য রচনা করবেন কী করে? এ কারণেই আমাদের দেশে যুদ্ধ নিয়ে ভালো সাহিত্য নেই। শুধু বানিয়ে লিখে তো উচ্চাঙ্গের সাহিত্য রচনা করা যায়
না। মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের সেই প্রাণরসটা নিয়ে লেখা আর হবে বলে মনে করি না।
আজকের পত্রিকা: ‘জয় বাংলা কি হইবে কোনো দিন, কহেন দেখি’—এই প্রশ্নের উত্তর কী দেবেন?
মাহবুব আলম: হ্যাঁ, হওয়াই নাইগবে। যেখানেই গেছি তখন, সবখানেই আমাদের জিজ্ঞেস করেছে, কবে জয় বাংলা হবে। স্বাধীন হবে তো বলত না, বলত জয় বাংলা। সবখানে আমরা বলেছি, হবে। খুব তাড়াতাড়ি হবে। কখনো কখনো মনে হয়েছে, এই যে আমরা আশ্বাসটা দিচ্ছি, তা কি সঠিকভাবে দিচ্ছি?
আজকের পত্রিকা: বায়ান্ন বছর আগে তো একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। ওই জয় বাংলা কি হয়েছে?
মাহবুব আলম: জয় বাংলা হয়েছে। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। এখন এই জয় বাংলাকে নিয়ে নিজে কী করছেন, সেটা তো আপনার ওপর নির্ভর করবে। নিজেকেই তো প্রশ্ন করতে হবে, কী করছেন দেশকে নিয়ে?
আজকের পত্রিকা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহবুব: আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪