শাওন আকন্দ
যত দিন যাচ্ছে, এই ভাবনা আমার ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে যে, এই ভারতীয় উপমহাদেশে কিংবা বঙ্গদেশের মানুষেরা আসলে বাস করত চারুকলার জগতে, শিল্পের জগতে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে শিল্প এমনভাবে মিলেমিশে ছিল যে, তা নিয়ে আমরা খুব বেশি ভাবি নাই বা ভাবনার প্রয়োজন বোধ করি নাই। এখনো হয়তো এ দেশের মানুষ কিছু মাত্রায় বাস করে শিল্পের সঙ্গেই। কিন্তু এই বসবাস কিংবা চর্চা— খুব সচেতন নয়, খুব সোচ্চার নয়। কিংবা বিষয়টাকে এভাবেও বলা যায়, পশ্চিমা দৃষ্টিতে চারুকলা বা শিল্পের যে ধারণা তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ার কারণে এগুলোকে আমরা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কিংবা ‘শিল্প’ হিসেবে বিবেচনা করি নাই। কেন করি নাই, তার লম্বা ইতিহাস আছে। আলোচনার প্রয়োজনে আপাতত ছোট করে প্রেক্ষাপটটা বলে নেওয়া দরকার।
বাংলা ভাষায় ‘চারুকলা’ শব্দটি দিয়ে যা বোঝানো হয়, তা এখন পর্যন্ত মূলত আধুনিকতাবাদী চেতনায় আচ্ছন্ন। সে কারণে এটা মূলত প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক, নগরভিত্তিক, ক্ষমতাকাঠামোর পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত এবং সমাজের উচ্চবর্গের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে সচেষ্ট। আধুনিকতাবাদের সূত্র অনুসারে এটা অনেক বেশি ফর্মাল, নিয়মকানুনে আগ্রহী এবং শিল্পকলার গুণ বা মান বিচারে নিশ্চিতভাবেই বিভাজনে বিশ্বাসী। সবাই জানে, আধুনিকতাবাদের বিচারে প্রতিষ্ঠানের বাইরের শিল্প হলো লোকশিল্প, কারুশিল্প, ঐতিহ্যবাহী শিল্প, আদিবাসী শিল্প ইত্যাদি। এগুলো হলো আধুনিক চারুকলার ‘অপর’, যা উপস্থাপিত/ বিবেচিত হয় কিছুটা নিচু মানের শিল্প হিসেবে। এই বিচারপদ্ধতি আমাদের ছিল না। এটা আমরা শিখেছি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্র ধরে।
উনিশ শতকে একাধিক প্রকাশনায় বিভিন্ন ইউরোপীয় লেখক বিভিন্ন ভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে, ভারতবর্ষে আসলে আর্ট বা ফাইন আর্ট বলে কিছু নেই। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে, এই ভূখণ্ডের হাজার বছরের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে এই ‘অসভ্য’, ‘অশিক্ষিত’ ও ‘শিল্পহীন’ জাতিকে শিল্পজ্ঞান দিতে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বা আর্ট স্কুল। সেখানে তারা পশ্চিম থেকে আমদানি করা সাদৃশ্যধর্মী শিল্পরীতির প্রচলন করেছিল, যার সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের কোনো ঐতিহ্যগত সংযোগ ছিল না। এভাবে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতিষ্ঠান, প্রদর্শনী, প্রকাশনা ইত্যাদি নানান কর্মকাণ্ডের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের যে নিজস্ব কোনো শিল্প নেই, তা প্রচারিত হয়েছে এবং আধুনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা যাত্রা শুরু করেছে ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৫১ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে প্রিন্স আলবার্টের উদ্যোগে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এবং বিস্তৃত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে নানান ধরনের অসাধারণ আবিষ্কার ও শিল্প-উপাদান সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেখানে বিশ্বখ্যাত হীরকখণ্ড ‘কোহিনুর’ থেকে শুরু করে বাংলার (ঢাকার) কিংবদন্তির মিহি মসলিন পর্যন্ত স্থান পেয়েছিল। সেখানে ভারতবর্ষের প্যাভিলিয়ন দেখে তৎকালীন ইউরোপবাসী অত্যন্ত মোহিত ও বিস্মিত হয়েছিল। ভারতের শিল্পীদের দক্ষতা ও শিল্পনৈপুণ্য দেখে তাদের মুগ্ধ ভাষ্য ছিল ‘ইউরোপ হ্যাজ নাথিং টু টিচ, বাট এ গ্রেট ডিল টু লার্ন।’ অর্থাৎ ভারতের শিল্পকে ইউরোপের শেখানোর কিছু নেই, বরং তা থেকে তারা (ইউরোপবাসী) মহৎ শিল্প সম্পর্কে শিখতে পারে। তারপরও কেন ইউরোপের সাদৃশ্যধর্মী চারুকলাকে এখানে আর্ট স্কুলে প্রধান রীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, তা আমাদের ভাবনার খোরাক জোগায় বটে!
২.
বিশ শতকের গোড়ায় কিছু ভিন্ন কথা শোনা গেল। পশ্চিমা শিল্পতাত্ত্বিকেরা জাপান কিংবা পারস্যের শিল্পের মতো ভারতীয় শিল্পকে কিছু মাত্রায় স্বীকৃতি দিতে শুরু করল। যেমন, ১৯১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ইউরোপের কিছু শিল্পী, শিল্পসমালোচক ও ছাত্র জানান, তাঁরা বুদ্ধের মতো পবিত্র মূর্তিকে বিশ্বের অন্যতম মহান শৈল্পিক অনুপ্রেরণা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন! (স্মিথ, পৃ. ৩)
লক্ষ কবার বিষয়, ভারতের শিল্পকলা কতটা আর্ট কিংবা আর্ট নয়, তা নিয়ে ইউরোপের শিল্পী ও শিল্পসমালোচকেরা তো বটেই, এমনকি সেখানকার ছাত্রদেরও অধিকার আছে মন্তব্য করার! ঔপনিবেশিক বাস্তবতা এমন নির্মম, মর্মান্তিক ও হাস্যকর হতে পারে, কখনো কখনো।
কাছাকাছি সময়ে, বঙ্গদেশে ই বি হ্যাভেল এবং তাঁর শিষ্য অবন ঠাকুরের নেতৃত্বে নব্য বঙ্গীয় শিল্পরীতি বা নিউ বেঙ্গল স্কুলের সূত্রপাত হয়েছিল। হ্যাভেল ছিলেন নব্য বঙ্গীয় শিল্পরীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ও প্রচারক। তিনি অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গেলে পরবর্তী সময়ে এ নব্য বঙ্গীয় শিল্পরীতি নাকি পশ্চিমা সাদৃশ্যধর্মী শিল্পরীতি, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে কেটেছে বিশ শতকের প্রথমার্ধের অনেক বছর। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে এবং নন্দলালের নেতৃত্বে কলাভবন (১৯১৯) গড়ে উঠলে সেখানে আবার কিছু নতুন আলাপ শোনা গিয়েছিল, নতুন ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে ‘কনটেক্সচুয়াল মর্ডানিজম’ নামে অভিহিত করা হয়েছে এটাকে। এ ছাড়া গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন এবং তাঁর লোকশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কিন্তু এত কিছুর পরেও চারুকলাবিষয়ক ভাবনায় আমরা আধুনিকতাবাদী চেতনা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি বলে মনে হয় না।
এ ধরনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর সতীর্থদের কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসা এবং এখানে একটি নতুন শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মনে করা হয়, এখান থেকে শুরু বাংলাদেশের আধুনিক চারুকলার ইতিহাস।
পরবর্তীকালে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বিমূর্ত, আধা-বিমূর্ত ধারার উদ্ভব ও বিকাশ আধুনিকতার জয়গান এ দেশে আরও উচ্চকিত এবং প্রতিষ্ঠিত করেছে। যদিও আমাদের পথিকৃৎ শিল্পীরা জয়নুল, কামরুল কিংবা সুলতান লোকশিল্প কিংবা লোকজীবনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন তাঁদের নিজস্ব শিল্পকর্ম এবং বিবিধ উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডে। কিন্তু পশ্চিমা আধুনিকতার প্রবল প্রভাব থেকে বিশ শতকের বাংলাদেশের চারুকলাকে আলাদা করা মুশকিল। সন্দেহ নেই, কোনো কোনো শিল্পী এই পশ্চিমা রীতি রপ্ত করে দেশজ প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করে উন্নত মানের শিল্পকর্ম নির্মাণ করে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু আধুনিক চারুকলার সঙ্গে জনগণের দূরত্ব ঘোচেনি।
এর পাশাপাশি, স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশজ শিল্প, বিশেষত যেগুলোকে আমরা লোকশিল্প, কারুশিল্প ইত্যাদি বলে থাকি, সেগুলো গ্রামীণ প্রেক্ষাপট কিংবা সনাতনী বিপণনব্যবস্থার বাইরে নগরে নতুন বাজার খুঁজে পেয়েছে। কারিকা থেকে শুরু করে আড়ং, কুমুদিনী ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যে বিভিন্ন হস্তশিল্পজাত পণ্যের কদর আছে। কোর দ্য জুট ওয়ার্কস, প্রকৃতি, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে বেশ অগ্রগামী। কিন্তু লোকশিল্পী বা কারুশিল্পীরা চারুকলার জগতে ‘অপর’ হিসেবে রয়ে গেছেন।
৩.
এখন প্রশ্ন হলো, একুশ শতকে বাংলাদেশের চারু ও কারুকলার হাল-হকিকত ও গতি-প্রকৃতিতে কোনো বিশেষ পরিবর্তন কি লক্ষ করা যাচ্ছে? কিংবা বিষয়টাকে এভাবেও বলা যায়, বাংলাদেশের চারুকলার ভবিষ্যৎ কী?
মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে, গত দুই দশকে, বাংলাদেশের চারুকলায় কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। এগুলো হলো—
নতুন মাধ্যমের স্বীকৃতি: একুশ শতকে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের গতানুগতিক মাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে ইনস্টলেশন, পারফরম্যান্স, ভিডিও আর্ট ইত্যাদি নতুন নতুন মাধ্যম ব্যাপক মাত্রায় চর্চিত হতে শুরু করেছে এবং কিছু মাত্রায় স্বীকৃতিও পেয়েছে। বিশ শতকের বাস্তবতায় বাংলাদেশে এটা অভাবনীয় ছিল। ভালোমন্দ বিচার না করেও বলা যায়, এটা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
নতুন প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আয়োজন: একুশ শতকে বেশ কয়েকটি নতুন প্ল্যাটফর্ম বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের চারুকলা নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং নতুন মাধ্যমকে জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে এসব প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ভূমিকা আছে। বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট, সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন, দৃক, ক্র্যাক ট্রাস্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন শিল্পভাবনা এবং নতুন মাধ্যম প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এক সময় শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এশীয় দ্বিবার্ষিক ছিল দেশের একমাত্র বড় মাপের আন্তর্জাতিক আয়োজন। কিন্তু একুশ শতকে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চারুকলাবিষয়ক আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা আর্ট সামিট ও ছবি মেলা—ঢাকায় এ দুই আয়োজন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় ক্র্যাকের আয়োজনে নিয়মিত আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প, চট্টগ্রামে সন্তরণের আন্তর্জাতিক ফোক ট্রিয়েনাল ইত্যাদি উদ্যোগ নতুন শিল্পভাবনা ও চর্চাকে গতিশীল করেছে।
পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ আর্ট ইভেন্টে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ: ভেনিস বিয়েনালে কিংবা ডকুমেন্টার মতো পৃথিবী বিখ্যাত আর্ট ইভেন্টে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঘটেছে একুশ শতকেই। বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট এ দুই বিষয়ে অনেকটা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। বৃত্ত ছাড়াও বাংলাদেশের একাধিক শিল্পী বিভিন্ন সময়ে ভেনিস বিয়েনালে অংশ নিয়েছেন।
এ ছাড়া পশ্চিমা পোস্টমডার্ন হাওয়ার প্রভাবে বাংলাদেশের চারুকলায় বাধ্যবাধকতা বা নিয়মের বেড়াজাল কিছুটা কমেছে। বিদ্যায়তনিক পরিসরকে হিসাব থেকে বাদ দিলে, সমকালীন শিল্পচর্চায় মাধ্যমগত সীমাবদ্ধতা আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। সমকালীন শিল্পকর্ম নির্মাণে লোকশিল্পের বিভিন্ন উপাদান কিংবা স্থানীয় পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার বেড়েছে। বাঁশ-বেত, খড়, মাটি থেকে শুরু করে জামদানি, গামছা, রিকশাচিত্র কিংবা সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং নিজ গুণে সমকালীন চারুকলায় মাধ্যম বা শৈলী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। রিকশাচিত্রী কিংবা সিনেমা ব্যানার পেইন্টাররা ঢাকা আর্ট সামিট কিংবা ডকুমেন্টার মতো বড় শিল্প আয়োজনে শিল্পী হিসেবে আমন্ত্রিত হচ্ছেন, এ রকমটা বিশ শতকে দেখা যায়নি। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব শিল্পীর মূল্যায়ন এখনো তেমন একটা হয় না বললেই চলে। শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগ এখনো ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত।
ঔপনিবেশিক পরম্পরার অংশ হিসেবে ঐতিহ্যকে বাতিল করে তৈরি হয়েছিল কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুল (১৮৬৪)। সেখানে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মাধ্যমে ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিক চারুশিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। আর ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী শিক্ষকেরা পরবর্তীকালে আধুনিক শিল্পচর্চার পাশাপাশি নিজেরাও ঐতিহ্য নির্মাণে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ইতিমধ্যে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেসকো থেকে। যদিও কালের বিচারে এই ঐতিহ্য অর্বাচীন।
৪.
সরল বিচারে, একুশ শতকে বাংলাদেশের চারুকলার গতিপ্রকৃতি কোন দিকে ধাবমান হবে কিংবা বিকশিত হবে, তা নির্ভর করছে মূলত এ দেশের তরুণ শিল্পীদের ওপর। তাদের আগ্রহ ও ভালোবাসায় যেসব শিল্পকর্ম ভবিষ্যতে সৃষ্টি হবে, সেসব নিয়েই তৈরি হবে বাংলাদেশের চারুকলার ভবিষ্যৎ।
সূক্ষ্ম বিচারে, গত দেড় শ বছরের চারুকলার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে, আমরা অবশ্য অন্য লক্ষণ বা প্রবণতা দেখতে পাই। এটাকে আমরা বলতে পারি ‘কোম্পানীর ভুত’ কিংবা ঔপনিবেশিক প্রভাব। আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রমের পরেও চারুকলাবিষয়ক ভাবনা ও চর্চায় ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে আমরা খুব বেশি মুক্ত হতে পেরেছি কি? যেসব নতুন নতুন মাধ্যম আমাদের দেশে প্রচলিত হয়েছে সাম্প্রতিক চারুকলার রীতি বা মাধ্যম হিসেবে, তা কি আমরা নির্ধারণ কিংবা নির্মাণ করেছি? নাকি পশ্চিমা দেশে প্রচলিত রীতি ও ভাষা অনুসরণ, অনুকরণ কিংবা আত্মস্থ করেছি মাত্র? এসব বিবেচনায় নিশ্চিতভাবে আশঙ্কা থাকে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের চারুকলাও হয়তো পশ্চিমা রীতি ও শৈলীর অনুগামী হবে। এ পুঁজিবাদী দুনিয়ায় আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এর কোনো ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
লেখক: চারুশিল্পী ও গবেষক
যত দিন যাচ্ছে, এই ভাবনা আমার ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে যে, এই ভারতীয় উপমহাদেশে কিংবা বঙ্গদেশের মানুষেরা আসলে বাস করত চারুকলার জগতে, শিল্পের জগতে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে শিল্প এমনভাবে মিলেমিশে ছিল যে, তা নিয়ে আমরা খুব বেশি ভাবি নাই বা ভাবনার প্রয়োজন বোধ করি নাই। এখনো হয়তো এ দেশের মানুষ কিছু মাত্রায় বাস করে শিল্পের সঙ্গেই। কিন্তু এই বসবাস কিংবা চর্চা— খুব সচেতন নয়, খুব সোচ্চার নয়। কিংবা বিষয়টাকে এভাবেও বলা যায়, পশ্চিমা দৃষ্টিতে চারুকলা বা শিল্পের যে ধারণা তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ার কারণে এগুলোকে আমরা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কিংবা ‘শিল্প’ হিসেবে বিবেচনা করি নাই। কেন করি নাই, তার লম্বা ইতিহাস আছে। আলোচনার প্রয়োজনে আপাতত ছোট করে প্রেক্ষাপটটা বলে নেওয়া দরকার।
বাংলা ভাষায় ‘চারুকলা’ শব্দটি দিয়ে যা বোঝানো হয়, তা এখন পর্যন্ত মূলত আধুনিকতাবাদী চেতনায় আচ্ছন্ন। সে কারণে এটা মূলত প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক, নগরভিত্তিক, ক্ষমতাকাঠামোর পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত এবং সমাজের উচ্চবর্গের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে সচেষ্ট। আধুনিকতাবাদের সূত্র অনুসারে এটা অনেক বেশি ফর্মাল, নিয়মকানুনে আগ্রহী এবং শিল্পকলার গুণ বা মান বিচারে নিশ্চিতভাবেই বিভাজনে বিশ্বাসী। সবাই জানে, আধুনিকতাবাদের বিচারে প্রতিষ্ঠানের বাইরের শিল্প হলো লোকশিল্প, কারুশিল্প, ঐতিহ্যবাহী শিল্প, আদিবাসী শিল্প ইত্যাদি। এগুলো হলো আধুনিক চারুকলার ‘অপর’, যা উপস্থাপিত/ বিবেচিত হয় কিছুটা নিচু মানের শিল্প হিসেবে। এই বিচারপদ্ধতি আমাদের ছিল না। এটা আমরা শিখেছি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্র ধরে।
উনিশ শতকে একাধিক প্রকাশনায় বিভিন্ন ইউরোপীয় লেখক বিভিন্ন ভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে, ভারতবর্ষে আসলে আর্ট বা ফাইন আর্ট বলে কিছু নেই। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে, এই ভূখণ্ডের হাজার বছরের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে এই ‘অসভ্য’, ‘অশিক্ষিত’ ও ‘শিল্পহীন’ জাতিকে শিল্পজ্ঞান দিতে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বা আর্ট স্কুল। সেখানে তারা পশ্চিম থেকে আমদানি করা সাদৃশ্যধর্মী শিল্পরীতির প্রচলন করেছিল, যার সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের কোনো ঐতিহ্যগত সংযোগ ছিল না। এভাবে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতিষ্ঠান, প্রদর্শনী, প্রকাশনা ইত্যাদি নানান কর্মকাণ্ডের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের যে নিজস্ব কোনো শিল্প নেই, তা প্রচারিত হয়েছে এবং আধুনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা যাত্রা শুরু করেছে ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৫১ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে প্রিন্স আলবার্টের উদ্যোগে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এবং বিস্তৃত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে নানান ধরনের অসাধারণ আবিষ্কার ও শিল্প-উপাদান সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেখানে বিশ্বখ্যাত হীরকখণ্ড ‘কোহিনুর’ থেকে শুরু করে বাংলার (ঢাকার) কিংবদন্তির মিহি মসলিন পর্যন্ত স্থান পেয়েছিল। সেখানে ভারতবর্ষের প্যাভিলিয়ন দেখে তৎকালীন ইউরোপবাসী অত্যন্ত মোহিত ও বিস্মিত হয়েছিল। ভারতের শিল্পীদের দক্ষতা ও শিল্পনৈপুণ্য দেখে তাদের মুগ্ধ ভাষ্য ছিল ‘ইউরোপ হ্যাজ নাথিং টু টিচ, বাট এ গ্রেট ডিল টু লার্ন।’ অর্থাৎ ভারতের শিল্পকে ইউরোপের শেখানোর কিছু নেই, বরং তা থেকে তারা (ইউরোপবাসী) মহৎ শিল্প সম্পর্কে শিখতে পারে। তারপরও কেন ইউরোপের সাদৃশ্যধর্মী চারুকলাকে এখানে আর্ট স্কুলে প্রধান রীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, তা আমাদের ভাবনার খোরাক জোগায় বটে!
২.
বিশ শতকের গোড়ায় কিছু ভিন্ন কথা শোনা গেল। পশ্চিমা শিল্পতাত্ত্বিকেরা জাপান কিংবা পারস্যের শিল্পের মতো ভারতীয় শিল্পকে কিছু মাত্রায় স্বীকৃতি দিতে শুরু করল। যেমন, ১৯১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ইউরোপের কিছু শিল্পী, শিল্পসমালোচক ও ছাত্র জানান, তাঁরা বুদ্ধের মতো পবিত্র মূর্তিকে বিশ্বের অন্যতম মহান শৈল্পিক অনুপ্রেরণা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন! (স্মিথ, পৃ. ৩)
লক্ষ কবার বিষয়, ভারতের শিল্পকলা কতটা আর্ট কিংবা আর্ট নয়, তা নিয়ে ইউরোপের শিল্পী ও শিল্পসমালোচকেরা তো বটেই, এমনকি সেখানকার ছাত্রদেরও অধিকার আছে মন্তব্য করার! ঔপনিবেশিক বাস্তবতা এমন নির্মম, মর্মান্তিক ও হাস্যকর হতে পারে, কখনো কখনো।
কাছাকাছি সময়ে, বঙ্গদেশে ই বি হ্যাভেল এবং তাঁর শিষ্য অবন ঠাকুরের নেতৃত্বে নব্য বঙ্গীয় শিল্পরীতি বা নিউ বেঙ্গল স্কুলের সূত্রপাত হয়েছিল। হ্যাভেল ছিলেন নব্য বঙ্গীয় শিল্পরীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ও প্রচারক। তিনি অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গেলে পরবর্তী সময়ে এ নব্য বঙ্গীয় শিল্পরীতি নাকি পশ্চিমা সাদৃশ্যধর্মী শিল্পরীতি, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে কেটেছে বিশ শতকের প্রথমার্ধের অনেক বছর। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে এবং নন্দলালের নেতৃত্বে কলাভবন (১৯১৯) গড়ে উঠলে সেখানে আবার কিছু নতুন আলাপ শোনা গিয়েছিল, নতুন ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে ‘কনটেক্সচুয়াল মর্ডানিজম’ নামে অভিহিত করা হয়েছে এটাকে। এ ছাড়া গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন এবং তাঁর লোকশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কিন্তু এত কিছুর পরেও চারুকলাবিষয়ক ভাবনায় আমরা আধুনিকতাবাদী চেতনা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি বলে মনে হয় না।
এ ধরনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর সতীর্থদের কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসা এবং এখানে একটি নতুন শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মনে করা হয়, এখান থেকে শুরু বাংলাদেশের আধুনিক চারুকলার ইতিহাস।
পরবর্তীকালে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বিমূর্ত, আধা-বিমূর্ত ধারার উদ্ভব ও বিকাশ আধুনিকতার জয়গান এ দেশে আরও উচ্চকিত এবং প্রতিষ্ঠিত করেছে। যদিও আমাদের পথিকৃৎ শিল্পীরা জয়নুল, কামরুল কিংবা সুলতান লোকশিল্প কিংবা লোকজীবনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন তাঁদের নিজস্ব শিল্পকর্ম এবং বিবিধ উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডে। কিন্তু পশ্চিমা আধুনিকতার প্রবল প্রভাব থেকে বিশ শতকের বাংলাদেশের চারুকলাকে আলাদা করা মুশকিল। সন্দেহ নেই, কোনো কোনো শিল্পী এই পশ্চিমা রীতি রপ্ত করে দেশজ প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করে উন্নত মানের শিল্পকর্ম নির্মাণ করে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু আধুনিক চারুকলার সঙ্গে জনগণের দূরত্ব ঘোচেনি।
এর পাশাপাশি, স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশজ শিল্প, বিশেষত যেগুলোকে আমরা লোকশিল্প, কারুশিল্প ইত্যাদি বলে থাকি, সেগুলো গ্রামীণ প্রেক্ষাপট কিংবা সনাতনী বিপণনব্যবস্থার বাইরে নগরে নতুন বাজার খুঁজে পেয়েছে। কারিকা থেকে শুরু করে আড়ং, কুমুদিনী ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যে বিভিন্ন হস্তশিল্পজাত পণ্যের কদর আছে। কোর দ্য জুট ওয়ার্কস, প্রকৃতি, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে বেশ অগ্রগামী। কিন্তু লোকশিল্পী বা কারুশিল্পীরা চারুকলার জগতে ‘অপর’ হিসেবে রয়ে গেছেন।
৩.
এখন প্রশ্ন হলো, একুশ শতকে বাংলাদেশের চারু ও কারুকলার হাল-হকিকত ও গতি-প্রকৃতিতে কোনো বিশেষ পরিবর্তন কি লক্ষ করা যাচ্ছে? কিংবা বিষয়টাকে এভাবেও বলা যায়, বাংলাদেশের চারুকলার ভবিষ্যৎ কী?
মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে, গত দুই দশকে, বাংলাদেশের চারুকলায় কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। এগুলো হলো—
নতুন মাধ্যমের স্বীকৃতি: একুশ শতকে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের গতানুগতিক মাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে ইনস্টলেশন, পারফরম্যান্স, ভিডিও আর্ট ইত্যাদি নতুন নতুন মাধ্যম ব্যাপক মাত্রায় চর্চিত হতে শুরু করেছে এবং কিছু মাত্রায় স্বীকৃতিও পেয়েছে। বিশ শতকের বাস্তবতায় বাংলাদেশে এটা অভাবনীয় ছিল। ভালোমন্দ বিচার না করেও বলা যায়, এটা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
নতুন প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আয়োজন: একুশ শতকে বেশ কয়েকটি নতুন প্ল্যাটফর্ম বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের চারুকলা নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং নতুন মাধ্যমকে জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে এসব প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ভূমিকা আছে। বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট, সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন, দৃক, ক্র্যাক ট্রাস্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন শিল্পভাবনা এবং নতুন মাধ্যম প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এক সময় শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এশীয় দ্বিবার্ষিক ছিল দেশের একমাত্র বড় মাপের আন্তর্জাতিক আয়োজন। কিন্তু একুশ শতকে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চারুকলাবিষয়ক আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা আর্ট সামিট ও ছবি মেলা—ঢাকায় এ দুই আয়োজন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় ক্র্যাকের আয়োজনে নিয়মিত আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প, চট্টগ্রামে সন্তরণের আন্তর্জাতিক ফোক ট্রিয়েনাল ইত্যাদি উদ্যোগ নতুন শিল্পভাবনা ও চর্চাকে গতিশীল করেছে।
পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ আর্ট ইভেন্টে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ: ভেনিস বিয়েনালে কিংবা ডকুমেন্টার মতো পৃথিবী বিখ্যাত আর্ট ইভেন্টে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঘটেছে একুশ শতকেই। বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট এ দুই বিষয়ে অনেকটা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। বৃত্ত ছাড়াও বাংলাদেশের একাধিক শিল্পী বিভিন্ন সময়ে ভেনিস বিয়েনালে অংশ নিয়েছেন।
এ ছাড়া পশ্চিমা পোস্টমডার্ন হাওয়ার প্রভাবে বাংলাদেশের চারুকলায় বাধ্যবাধকতা বা নিয়মের বেড়াজাল কিছুটা কমেছে। বিদ্যায়তনিক পরিসরকে হিসাব থেকে বাদ দিলে, সমকালীন শিল্পচর্চায় মাধ্যমগত সীমাবদ্ধতা আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। সমকালীন শিল্পকর্ম নির্মাণে লোকশিল্পের বিভিন্ন উপাদান কিংবা স্থানীয় পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার বেড়েছে। বাঁশ-বেত, খড়, মাটি থেকে শুরু করে জামদানি, গামছা, রিকশাচিত্র কিংবা সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং নিজ গুণে সমকালীন চারুকলায় মাধ্যম বা শৈলী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। রিকশাচিত্রী কিংবা সিনেমা ব্যানার পেইন্টাররা ঢাকা আর্ট সামিট কিংবা ডকুমেন্টার মতো বড় শিল্প আয়োজনে শিল্পী হিসেবে আমন্ত্রিত হচ্ছেন, এ রকমটা বিশ শতকে দেখা যায়নি। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব শিল্পীর মূল্যায়ন এখনো তেমন একটা হয় না বললেই চলে। শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগ এখনো ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত।
ঔপনিবেশিক পরম্পরার অংশ হিসেবে ঐতিহ্যকে বাতিল করে তৈরি হয়েছিল কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুল (১৮৬৪)। সেখানে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মাধ্যমে ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিক চারুশিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। আর ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী শিক্ষকেরা পরবর্তীকালে আধুনিক শিল্পচর্চার পাশাপাশি নিজেরাও ঐতিহ্য নির্মাণে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ইতিমধ্যে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেসকো থেকে। যদিও কালের বিচারে এই ঐতিহ্য অর্বাচীন।
৪.
সরল বিচারে, একুশ শতকে বাংলাদেশের চারুকলার গতিপ্রকৃতি কোন দিকে ধাবমান হবে কিংবা বিকশিত হবে, তা নির্ভর করছে মূলত এ দেশের তরুণ শিল্পীদের ওপর। তাদের আগ্রহ ও ভালোবাসায় যেসব শিল্পকর্ম ভবিষ্যতে সৃষ্টি হবে, সেসব নিয়েই তৈরি হবে বাংলাদেশের চারুকলার ভবিষ্যৎ।
সূক্ষ্ম বিচারে, গত দেড় শ বছরের চারুকলার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে, আমরা অবশ্য অন্য লক্ষণ বা প্রবণতা দেখতে পাই। এটাকে আমরা বলতে পারি ‘কোম্পানীর ভুত’ কিংবা ঔপনিবেশিক প্রভাব। আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রমের পরেও চারুকলাবিষয়ক ভাবনা ও চর্চায় ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে আমরা খুব বেশি মুক্ত হতে পেরেছি কি? যেসব নতুন নতুন মাধ্যম আমাদের দেশে প্রচলিত হয়েছে সাম্প্রতিক চারুকলার রীতি বা মাধ্যম হিসেবে, তা কি আমরা নির্ধারণ কিংবা নির্মাণ করেছি? নাকি পশ্চিমা দেশে প্রচলিত রীতি ও ভাষা অনুসরণ, অনুকরণ কিংবা আত্মস্থ করেছি মাত্র? এসব বিবেচনায় নিশ্চিতভাবে আশঙ্কা থাকে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের চারুকলাও হয়তো পশ্চিমা রীতি ও শৈলীর অনুগামী হবে। এ পুঁজিবাদী দুনিয়ায় আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এর কোনো ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
লেখক: চারুশিল্পী ও গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪