আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের সবচেয়ে কঠিন এবং গৌরবোজ্জ্বল পর্ব। সে কারণে আমি সব সময় বলি, এ যুদ্ধটা একাত্তর সালে শুরু হয়নি। এটা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল। দীর্ঘদিন এই অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক, নারী ও ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল এবং এই দাবিগুলো পূরণের যে ধরনের রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন দরকার, তার তাগিদ পুঞ্জীভূত হয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার মধ্যে তিনটি শব্দ ছিল: সাম্য—আমরা কী ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব; সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল সর্বশেষ বায়ান্ন থেকে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। প্রত্যাশা ছিল আমাদের নতুন রাষ্ট্র কোনোভাবেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতো হবে না। মানে আমরা পাকিস্তান থেকে একটা ভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব। পাকিস্তান থেকে ভিন্ন রাষ্ট্র মানে কী? এক. এই রাষ্ট্রে কোনো বৈষম্য থাকবে না; দুই. সম্পদের কেন্দ্রীভবন হবে না; আর আমরা তখন পাকিস্তানের ২২ পরিবারের কথা খুব শুনতাম। এই ২২ পরিবারকে টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুরু হয়েছিল; মানে এভাবে ব্যক্তির কাছে সম্পদের পাহাড় জমে থাকবে না। তিন. সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না; চার. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এসব আকাঙ্ক্ষার পক্ষে দাবিগুলো তৈরি হয়েছিল—সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার একটা প্রকাশ থাকবে। সর্বোপরি সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে ৫২ বছর পার হয়েছে। এ সময়ে আমরা অনেক ধরনের সরকার দেখলাম। সংসদীয় পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি শাসিত, সামরিক-বেসামরিক ও কেয়ারটেকার সরকার—এ রকম বহু ধরনের সরকার দেখলাম। সব সরকারের সময়েই অর্থনীতির ক্ষেত্রে ৫২ বছরে আমরা যা দেখছি, তাতে ফলাফল দাঁড়াচ্ছে যে এখনো পাকিস্তান মডেলেই দেশ চলছে। পাকিস্তান মডেল বলতে আমি বোঝাতে চাই, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের মতো করে বাংলাদেশেও সম্পদের কেন্দ্রীভবন এখানে সমানতালে চলছে। কয়েক দিন ধরে নির্বাচনের তফসিলের হলফনামা প্রকাশিত হচ্ছে। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতায় থেকে কীভাবে ৫-৬ গুণ থেকে ১০০ বা ২০০ গুণ সম্পদ বেড়েছে। এসব হচ্ছে খুব অল্প অংশের মধ্যে। সবাই জানে, তাঁরা হলফনামায় যা উল্লেখ করেছেন, এর বহু গুণ সম্পদ তাঁদের চোরাই টাকা আছে। এই পরিমাণ সম্পদের কেন্দ্রীভবন হয়েছে। আমি একটা গবেষণা করেছিলাম, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের মতো এ দেশে কারা হতে পারে তা নিয়ে। এ দেশের সর্বোচ্চ ধনী ২২ পরিবার তৎকালীন পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও বেশি সম্পদশালী।
দ্বিতীয়ত, বাঙালিরা জাতি হিসেবে নির্যাতিত হয়েছে পাকিস্তান আমলে। সেখানে বাঙালি পরিচালিত রাষ্ট্রেও জাতিগত নিপীড়ন চলছে। কদিন আগেই পাহাড়ে চারজন রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। পাহাড়ে এখনো অগণতান্ত্রিক শাসন নিপীড়ন অব্যাহত আছে।
তৃতীয়ত, এখানেও ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে পাকিস্তানের মতো করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে ধর্মকে ব্যবহার করে, বিশেষ করে নারীদের বৈষম্যমূলক নিপীড়ন করা হতো। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র তার অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক কাজকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করত। বাংলাদেশেও আমরা এ ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছি। যারা যে নামেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা সবাই ধর্মকে ব্যবহার করেছে।
চতুর্থত, পাকিস্তান আমলে এনএসএফ ছিল আইয়ুব খানের সন্ত্রাসী বাহিনী। বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্রসংগঠন এনএসএফের ভূমিকা পালন করেছে। আওয়ামী লীগের আমলে ১৫ বছরে ছাত্রলীগ এই নির্যাতকের ভূমিকায় আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
পঞ্চমত, পাকিস্তান মডেলের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, সরকার ছিল কর্তৃত্ববাদী। কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা থেকে বের হওয়ার সংগ্রামই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম। এই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত হয়েছে বাংলাদেশে। ৫২ বছরের মাথায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভয়ংকরভাবে বিপর্যস্ত। ন্যূনতম ভোটাধিকার যা গণতন্ত্রের প্রাথমিক কথা, সেটাই এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে অসম্ভব প্রত্যাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বিভিন্ন ধরনের আইনকানুন, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের বাইরেও পুলিশ, অন্যান্য বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে এত বেশি কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে যে জুলুম, ধরপাকড়, গুম, খুন এখন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে, ব্যবসায়িক স্বার্থে সরকার দেশি বা বিদেশি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা অন্য রাষ্ট্রকে খুশি করতে গিয়ে এমন সব প্রকল্প গ্রহণ করছে, যেগুলো বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশ বয়ে আনবে। এখন যেসব মেগা প্রকল্প দেখতে পাচ্ছি, এর বেশির ভাগই হচ্ছে মেগা ডিজাস্টার।
ব্যাংক থেকে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই একটা লুণ্ঠনবান্ধব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের একটা গোষ্ঠী ‘যা খুশি তা-ই’ করার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো তদারকি ও নিয়মনীতি নেই। এসব দেখে মনে হয়, সরকার কিছু গোষ্ঠীকে দ্রুত ধনী বানানোর জন্য ব্যাংক করার অনুমতি দিয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দেখা যাচ্ছে ভয়ংকর পরিস্থিতি। কয়েক দিন আগে উৎপাদন হয়েছে ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট আর আমাদের স্থাপিত ক্ষমতা হচ্ছে ২৬ হাজার মেগাওয়াট। বিরাট একটা অংশ অলস পড়ে আছে। আর এই অলস হয়ে বসে থাকার জন্য ১০-১২টি গোষ্ঠীকে ১০ বছরে ১ লাখ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে শুধু বসে থাকার জন্য। এরপরও রামপাল ও রূপপুরে ভয়াবহ প্রকল্প করা হয়েছে।
ভারতের আদানিকে বড় ধরনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আবার রূপপুরে আইনে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মানে যদি এখানে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। ৫২ বছর যখন পূর্তি হচ্ছে, এক থেকে দেড় বছর ধরে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সব জিনিসপত্রের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধির বড় কারণ, তেলের অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি। সেই দামটা এখনো ঠিক করা হয়নি। এর সুযোগ নিয়ে অন্যান্য ব্যবসায়ী সব জিনিসের একচেটিয়া দাম বাড়িয়েছেন। এসব যাঁরা করছেন, তাঁরা সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ।
বাংলাদেশের মানুষ তো এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ করেননি যে যারা ক্ষমতায় থাকবে, দ্রুত লুটেরা পুঁজি গঠন করার জন্য পুরো দেশের মানুষকে বিপদ, বৈষম্য ও বঞ্চনার মধ্যে ফেলে তারা যা খুশি তা-ই করবে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা এই সরকার বলে, কিন্তু তাদের অধিকাংশ কার্যক্রমই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো—সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। সর্বোপরি পাকিস্তানি মডেল থেকে বের হয়ে একটা ভিন্ন ধারা তৈরি করা, যেখানে মানুষ সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে এবং সম্মানিত হবে। সরকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যা করছে, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে করছে। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি যেমন তা একাত্তর সালে শেষও হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের সবচেয়ে কঠিন এবং গৌরবোজ্জ্বল পর্ব। সে কারণে আমি সব সময় বলি, এ যুদ্ধটা একাত্তর সালে শুরু হয়নি। এটা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল। দীর্ঘদিন এই অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক, নারী ও ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল এবং এই দাবিগুলো পূরণের যে ধরনের রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন দরকার, তার তাগিদ পুঞ্জীভূত হয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার মধ্যে তিনটি শব্দ ছিল: সাম্য—আমরা কী ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব; সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল সর্বশেষ বায়ান্ন থেকে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। প্রত্যাশা ছিল আমাদের নতুন রাষ্ট্র কোনোভাবেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতো হবে না। মানে আমরা পাকিস্তান থেকে একটা ভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব। পাকিস্তান থেকে ভিন্ন রাষ্ট্র মানে কী? এক. এই রাষ্ট্রে কোনো বৈষম্য থাকবে না; দুই. সম্পদের কেন্দ্রীভবন হবে না; আর আমরা তখন পাকিস্তানের ২২ পরিবারের কথা খুব শুনতাম। এই ২২ পরিবারকে টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুরু হয়েছিল; মানে এভাবে ব্যক্তির কাছে সম্পদের পাহাড় জমে থাকবে না। তিন. সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না; চার. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এসব আকাঙ্ক্ষার পক্ষে দাবিগুলো তৈরি হয়েছিল—সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার একটা প্রকাশ থাকবে। সর্বোপরি সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে ৫২ বছর পার হয়েছে। এ সময়ে আমরা অনেক ধরনের সরকার দেখলাম। সংসদীয় পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি শাসিত, সামরিক-বেসামরিক ও কেয়ারটেকার সরকার—এ রকম বহু ধরনের সরকার দেখলাম। সব সরকারের সময়েই অর্থনীতির ক্ষেত্রে ৫২ বছরে আমরা যা দেখছি, তাতে ফলাফল দাঁড়াচ্ছে যে এখনো পাকিস্তান মডেলেই দেশ চলছে। পাকিস্তান মডেল বলতে আমি বোঝাতে চাই, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের মতো করে বাংলাদেশেও সম্পদের কেন্দ্রীভবন এখানে সমানতালে চলছে। কয়েক দিন ধরে নির্বাচনের তফসিলের হলফনামা প্রকাশিত হচ্ছে। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতায় থেকে কীভাবে ৫-৬ গুণ থেকে ১০০ বা ২০০ গুণ সম্পদ বেড়েছে। এসব হচ্ছে খুব অল্প অংশের মধ্যে। সবাই জানে, তাঁরা হলফনামায় যা উল্লেখ করেছেন, এর বহু গুণ সম্পদ তাঁদের চোরাই টাকা আছে। এই পরিমাণ সম্পদের কেন্দ্রীভবন হয়েছে। আমি একটা গবেষণা করেছিলাম, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের মতো এ দেশে কারা হতে পারে তা নিয়ে। এ দেশের সর্বোচ্চ ধনী ২২ পরিবার তৎকালীন পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও বেশি সম্পদশালী।
দ্বিতীয়ত, বাঙালিরা জাতি হিসেবে নির্যাতিত হয়েছে পাকিস্তান আমলে। সেখানে বাঙালি পরিচালিত রাষ্ট্রেও জাতিগত নিপীড়ন চলছে। কদিন আগেই পাহাড়ে চারজন রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। পাহাড়ে এখনো অগণতান্ত্রিক শাসন নিপীড়ন অব্যাহত আছে।
তৃতীয়ত, এখানেও ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে পাকিস্তানের মতো করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে ধর্মকে ব্যবহার করে, বিশেষ করে নারীদের বৈষম্যমূলক নিপীড়ন করা হতো। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র তার অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক কাজকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করত। বাংলাদেশেও আমরা এ ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছি। যারা যে নামেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা সবাই ধর্মকে ব্যবহার করেছে।
চতুর্থত, পাকিস্তান আমলে এনএসএফ ছিল আইয়ুব খানের সন্ত্রাসী বাহিনী। বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্রসংগঠন এনএসএফের ভূমিকা পালন করেছে। আওয়ামী লীগের আমলে ১৫ বছরে ছাত্রলীগ এই নির্যাতকের ভূমিকায় আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
পঞ্চমত, পাকিস্তান মডেলের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, সরকার ছিল কর্তৃত্ববাদী। কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা থেকে বের হওয়ার সংগ্রামই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম। এই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত হয়েছে বাংলাদেশে। ৫২ বছরের মাথায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভয়ংকরভাবে বিপর্যস্ত। ন্যূনতম ভোটাধিকার যা গণতন্ত্রের প্রাথমিক কথা, সেটাই এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে অসম্ভব প্রত্যাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বিভিন্ন ধরনের আইনকানুন, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের বাইরেও পুলিশ, অন্যান্য বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে এত বেশি কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে যে জুলুম, ধরপাকড়, গুম, খুন এখন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে, ব্যবসায়িক স্বার্থে সরকার দেশি বা বিদেশি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা অন্য রাষ্ট্রকে খুশি করতে গিয়ে এমন সব প্রকল্প গ্রহণ করছে, যেগুলো বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশ বয়ে আনবে। এখন যেসব মেগা প্রকল্প দেখতে পাচ্ছি, এর বেশির ভাগই হচ্ছে মেগা ডিজাস্টার।
ব্যাংক থেকে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই একটা লুণ্ঠনবান্ধব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের একটা গোষ্ঠী ‘যা খুশি তা-ই’ করার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো তদারকি ও নিয়মনীতি নেই। এসব দেখে মনে হয়, সরকার কিছু গোষ্ঠীকে দ্রুত ধনী বানানোর জন্য ব্যাংক করার অনুমতি দিয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দেখা যাচ্ছে ভয়ংকর পরিস্থিতি। কয়েক দিন আগে উৎপাদন হয়েছে ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট আর আমাদের স্থাপিত ক্ষমতা হচ্ছে ২৬ হাজার মেগাওয়াট। বিরাট একটা অংশ অলস পড়ে আছে। আর এই অলস হয়ে বসে থাকার জন্য ১০-১২টি গোষ্ঠীকে ১০ বছরে ১ লাখ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে শুধু বসে থাকার জন্য। এরপরও রামপাল ও রূপপুরে ভয়াবহ প্রকল্প করা হয়েছে।
ভারতের আদানিকে বড় ধরনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আবার রূপপুরে আইনে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মানে যদি এখানে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। ৫২ বছর যখন পূর্তি হচ্ছে, এক থেকে দেড় বছর ধরে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সব জিনিসপত্রের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধির বড় কারণ, তেলের অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি। সেই দামটা এখনো ঠিক করা হয়নি। এর সুযোগ নিয়ে অন্যান্য ব্যবসায়ী সব জিনিসের একচেটিয়া দাম বাড়িয়েছেন। এসব যাঁরা করছেন, তাঁরা সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ।
বাংলাদেশের মানুষ তো এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ করেননি যে যারা ক্ষমতায় থাকবে, দ্রুত লুটেরা পুঁজি গঠন করার জন্য পুরো দেশের মানুষকে বিপদ, বৈষম্য ও বঞ্চনার মধ্যে ফেলে তারা যা খুশি তা-ই করবে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা এই সরকার বলে, কিন্তু তাদের অধিকাংশ কার্যক্রমই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো—সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। সর্বোপরি পাকিস্তানি মডেল থেকে বের হয়ে একটা ভিন্ন ধারা তৈরি করা, যেখানে মানুষ সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে এবং সম্মানিত হবে। সরকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যা করছে, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে করছে। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি যেমন তা একাত্তর সালে শেষও হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪