পাভেল পার্থ
কি ধান, কি মাছ, কি ঋতু, কি গাছ, কি মানুষ, কি ভাষা, কি উৎসব এমন বৈচিত্র্য বাংলাদেশের মতো দুনিয়ায় আর কোথাও আছে! নানান রঙের জীবন আর নানান রঙের ঋতু। প্রতিটি ঋতুতেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজে প্রকৃতি। প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন সাজে মানুষও সাজায় তার চাষ আর সংগ্রহের জীবন। ধীরে ধীরে সব বদলে যাওয়ার দুনিয়ায় আজ জীবনের নানান রূপ বৈচিত্র্যও বিপন্ন। পৃথিবীব্যাপী তথাকথিত উন্নত আর ধনী দেশের যুদ্ধ তাণ্ডব আর প্রকৃতি বিনাশী কর্মকাণ্ডে জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ের ফলে খসে পড়ছে আমাদের প্রিয় ঋতুবৈচিত্র্যের রংবেরঙের ডানা। তথাকথিত উন্নত বিশ্বের ভোগবিলাসী জীবন আর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ব্যবহার দুনিয়ার জলবায়ুকে উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে।
ভয়াবহভাবে উত্তপ্ত হয়ে ভেঙে যাচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশের ছয়-ছয়টি বর্ণময় ঋতুর ডানা। নানান রঙের ডানায়, নানান প্রাণের পালক গুঁজে দিয়ে সুখী জীবনের আকাশে ওড়ার অধিকার আমরা হারিয়ে ফেলছি। এত সব হাহাকারের ভেতরও কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, কি শরৎ , কি হেমন্ত, কি শীত, কি বসন্তে সমতল গ্রাম বা পাহাড়-জঙ্গলে যখন দেখি জীবনের জয়গানে নেচে ওঠে কৃষক জুমিয়া জেলে কামার কুমার তাঁতি মাঝি কবিরাজ বৈদ্য মৌয়াল বাওয়ালি বাউল পটুয়া চুনারি পাটনি পালাকার বাউল মন; তখন আবারও মনে হয় জলবায়ু পরিবর্তিত দুনিয়ার বুকে দলিতমথিত ডানা নিয়ে সাত আসমান পাড়ি দেওয়ার সাহস কেবলমাত্র এই জনপদের নিম্নবর্গের জীবনেই আছে। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে দুনিয়ার তাপমাত্রা প্রায় শূন্য দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১০-২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্কটিক অঞ্চলের বরফ স্তরের পুরুত্ব প্রায় ৪০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সালের ভেতর পৃথিবীর উষ্ণতা প্রায় ১ দশমিক ৪ থেকে ৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পাবে। উষ্ণতা বাড়ার কারণে পৃথিবীর ২১ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবে, ৩১ লাখেরও বেশি মানুষ পানিঘাটতিতে পড়বে, ৫ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধায় তাড়িত হবে। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। প্রাণবৈচিত্র্যের বিস্তৃতি হ্রাস পাবে, বিলুপ্তির হার বৃদ্ধি পাবে, প্রজনন বা বংশবিস্তারের সময়ের পরিবর্তন ঘটবে, প্রজাতির বৃদ্ধি ও প্রতিবেশগত পরিসরের পরিবর্তন ঘটবে। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে প্রায় ১০ লাখ বৈচিত্র্যময় প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তিত এই বিপন্ন সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার সাধারণ কৃষি ও জুমনির্ভর জনগণ নিজেদের এলাকায় চারপাশে কেবলমাত্র দুটি কি তিনটি ঋতুর বদল বুঝতে পারেন এবং টের পান। ষড়্ঋতুর এই করুণ পরিণতি সব দিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য বিপদবার্তা তৈরি করছে। একদিকে যেমন বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের শস্য ফসলের হাজার জাত, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য। আরেকদিকে আমাদের ঋতুভিত্তিক অভ্যাস ও আচার-আচরণ কী নিদারুণভাবে বদলে যেতেও বাধ্য হচ্ছে। অথচ এই ষড়্ঋতুর অদলবদলের সঙ্গে সঙ্গেই জনজীবন সাজিয়েছিল এককালে তার ঋতু বরণ কি বিদায়ের সব উৎসব ও উদ্দীপনা। ষড়্ঋতুর ডানা ঠিক রাখতে না পারলে বাংলাদেশের জনগণের অনন্য পারস্পরিক সম্পর্ক ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের সব ধারাবাহিকতা অচিরেই ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাবে। ক্রমান্বয়ে যা আমাদের সবার জন্যই তৈরি করবে এক দীর্ঘস্থায়ী বিপন্নতা। জলবায়ুজনিত এই পরিবর্তিত সময়েও বাংলাদেশের নানান প্রান্ত থেকে এখনো বর্ণময় ষড়্ঋতুর যে ডানা ভাঙা ঝাপটানি টের পাওয়া যায়, তা নিয়েই এই ছোট্ট ফিরিস্তি।
গ্রীষ্মকাল
কোল পাতলা ডাগর গুছি
লক্ষ্মী বলে ঐখানে আছি
খনার বচন
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ দিয়ে শুরু হয় বাঙালির বাংলা বছর, জমে ওঠে গ্রীষ্মের তাপ ও ঝড়ের আলোড়ন। বাংলাদেশের গ্রাম জনপদে এখনো বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বছরের হিসাবনিকাশ হয়। কেবলমাত্র শহর এলাকায়, সরকারি কাগজপত্র কি মুদ্রিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জিতে নির্ধারণ করা হয়েছে ভিন্ন বাংলা সনের হিসাব। যার সঙ্গে গ্রাম জনপদের মানুষের বছর গোনাগুনতি ও পালনের কোনো মিল নেই। বৈশাখ থেকেই শুরু হয় আউশ ধান বোনার মৌসুম আর পাহাড়ে পাহাড়ে আদিবাসী এলাকায় জুম ধান বোনায় ব্যস্ত থাকেন জুমিয়ারা। অনেক এলাকায় পাট লাগানো হয়, তিল-তিসি তোলা হয়, বর্তমানে এ সময়ে কাটা হয় উফশীজাতের ধান (যদিও বাংলাদেশের গ্রাম জনপদে এই ধান ইরি ধান নামেই প্রচলিত)। এ সময়ে ঝড়-তুফান বেশি হয় বলে গ্রামের মানুষেরা ঘরদুয়ার-গোয়ালঘর-গোলাঘর আবারও মজবুত করে বাঁধেন, বেদেরা নদীর তীরে তীরে নৌকা বহরখানি নিরাপদে নিয়ে যান। নতুন বছর বরণ করে নেওয়ার জন্য বাঙালিরা আয়োজন করে শুভ নববর্ষ; চাকমারা বিজু; রাখাইনরা সংগ্রেং; মারমারা সাংগ্রাই; ত্রিপুরারা বৈসুক; বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা বিষু উৎসব। নতুন বছরের হিসাবনিকাশ, দেনা-পাওনা মিটিয়ে ফেলার জন্য ব্যবসায়ীদের শুভ হালখাতায় লাগে সিঁদুর আর কাঁচা হলুদের দাগ। গ্রামে গ্রামে যেমন নাইল্যা-গিমা-কলমি নানান জাতের তিতা শাক খাওয়ার ভেতর দিয়ে শুরু হয় পয়লা বৈশাখ, তেমনি শহরে জমে ওঠে পান্তা আর ইলিশ খাওয়ার ধুম। ইদানীং পিৎজা হাট কি কেএফসির মতো করপোরেট খাদ্য দোকানদারেরাও পয়লা বৈশাখের বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের খাবার বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রীষ্মকালের গরমের তীব্রতা গ্রীষ্মকালে আর থাকছে না, কালবৈশাখী গ্রীষ্মকাল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই অদলবদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে স্থানীয় জীবনধারার গতিপ্রকৃতি।
বর্ষাকাল
আষাঢ়ের পঞ্চদিনে রোপয়ে যে ধান
সুখে থাকে কৃষি বল বাড়য়ে সম্মান
খনার বচন
ঢপ ঢপ ছলছল বর্ষাকাল আর ঋতুভিত্তিক বর্ষা মৌসুমের বন্যা এখন আর বাংলাদেশে হয় না। এখন হাওর এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মেঘালয় পাহাড় থেকে নামে পাহাড়ি ঢল, হয় অকাল বন্যা আর নদ-নদী সব দখল ও নিশ্চিহ্ন বলে বাড়ে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। এ সময়ে গ্রামে গ্রামে কৃষকের ব্যস্ততা বেড়ে যায়, মাঠে মাঠে আমনের রোয়া লাগাতে লাগাতে আষাঢ়-শ্রাবণ পেরিয়ে যায়। বর্ষার দিনে হাওর থেকে শিশুরা কুড়িয়ে আনে শালুক-পানিফল-ঢ্যাপ আর নারীরা নানান জাতের শাক। পয়লা বর্ষার দিনে পাহাড়-জঙ্গল থেকে খাসিয়ারা খুঁজে আনেন তেতস্লাং, মান্দিরা দামবং, চাকমারা হকেংমূল মানে নানান জাতের ব্যাঙের ছাতা (মাশরুম), যা আমাদের খাবারে যেমন বৈচিত্র্য আনে, একই সঙ্গে তা পুষ্টিও জোগায়। বর্ষা হাওর ও বিল অঞ্চলের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ঋতু যে বর্ষাকালেই হাওরাঞ্চলে নৌকা যাতায়াতের সুবিধার কারণে বিয়েশাদি বেশি হয়। হাওরের অধিকাংশ ধামাইল, কীর্তন, ঢপযাত্রা, গীত রচিত ও চর্চিত হয় এখনো এই বর্ষার দিনেই। বর্ষার দিনে গ্রামে গ্রামে বয়স্ক ব্যক্তিরা জমিয়ে তোলেন গল্পের আসর, সেই সব আসর আরও উৎসাহী করে তোলে চাল ভাজা-বাদাম ভাজা-শিম বিচি ভাজা-কাঁঠাল বিচি ভাজা। বাংলার লোকদেবী মনসা পূজার এই তো সময়, বেহুলা-লখিন্দরের ভেলা ভাসানোর স্মৃতি নিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই করতে করতে ভাটি এলাকার নারীরা সুর তোলেন ধামাইল গীতের।
শরৎকাল
ভাদ্রের চারি আশ্বিনের চারি
কলাই রোবে যত পারি
খনার বচন
ভাদ্র-আশ্বিন মাস নিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ছোপ লাগিয়ে, নদীর তীরে কাশঝাড়ের নাচন বলে দেয় এসেছে শরৎ। কিন্তু গ্রামবাংলায় এই ঋতু সম্পূর্ণ উধাও হয়েছে। এখন গ্রামে কাশঝাড় পাওয়া গেলেও শরৎকাল খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। ভাদ্র মাসে তার বাদেও তাল পাকে। তালের পিঠা এবং তাল নবমী এই ঋতুর এক অনন্য গ্রামীণ আয়োজন। ভাদ্র মাস থেকে আউশ ধান কাটা হয়, অনেক এলাকায় সরিষা বুনতে শুরু করেন কৃষকেরা। বাঙালি হিন্দুর শারদীয় দুর্গাপূজার জন্য কারিগরেরা জোগাড় করতে থাকেন নানান জাতের মাটি, আমন-আউশের খড়, বাঁশ আরও কত-কী!
হেমন্তকাল
আশ্বিনের উনিশ কার্তিকের উনিশ
বাদ দিয়ে যত পারিস মটর কলাই বুনিস
খনার বচন
কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্তকাল। শুরু হয় আমন ধান কাটার পর্ব, ধান ঘরে তোলার পর গ্রামে গ্রামে নয়া ফসল খাওয়ার উৎসব নবান্ন। মান্দিরা এ সময়ে তাদের সবচেয়ে বড় আয়োজনের সামাজিক উৎসব ওয়ান্না পালন করে আর কোচদের হয় গিদেলচাওয়া। আবছা শীতের আমেজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুলা, পালংশাক, খেসারি, কলাই বোনা শুরু হয়। কার্তিক মাসেই ধান কাটার আগেভাগে গ্রামে গ্রামে অভাব ছড়িয়ে পড়ে। কুড়িয়ে পাওয়া নানান শাকসবজি উত্তর জনপদের মানুষের এই কঠিন মঙ্গার কাল পাড়ি দিতে সহভাগী হয়। ধান কাটার পর পরই জমিনগুলো শিশুদের বউচি-কুতকুত-দাঁড়িয়াবান্ধা-গোল্লাছুট-হা-ডু-ডু-পাতাপলান্তি খেলার মাঠ হয়ে ওঠে, গরু-ছাগলগুলোও পায় এক বিস্তৃত চারণভূমি। হাওর এলাকায় শুরু হতে থাকে আড়ঙ্গ, মানে ষাঁড়ের লড়াই। এ সময়ই দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরে, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ডে, সুন্দরবনের দুবলারচরে, কমলগঞ্জে মণিপুরি এলাকায় জমে ওঠে রাসমেলা। অধিকাংশ মাজার শরিফ ও মোকামমে এই সময়টাতেই ওরস ও মেলার আয়োজন হয়। হাওর এলাকায় বর্ষা বাদে হেমন্ত এক প্রধান ঋতু। এ সময়ে হাওর এলাকায় হাঁটা ছাড়া তেমন কোনো গতি নেই সর্বত্র, যদিও এখন মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।
শীতকাল
ছায়ে লাউ উঠানে ঝাল
ক’র বাপু চাষার ছাওয়াল
খনার বচন
শীতের মৌসুমে গ্রামে গ্রামে লালসালু কাপড় মুড়িয়ে শিমুল-কার্পাস তুলার লেপ বানানোর জন্য ধুনকরদের আনাগোনা বেড়ে যায় এখনো এই সিনথেটিক কম্বল আর প্লাস্টিক কাপড়ের যুগে। বর্তমান এই সময়েই মাঠে মাঠে ইরি-বিরি (উফশী) ধান ফলাতে ব্যস্ত থাকতে হয় কৃষকদের। এই সময়ে উফশী চাষে ব্যাপক সেচের প্রয়োজন হওয়ায় ধীরে ধীরে নেমে যায় পানির স্তর। ধানের জমিনে এই সময়েই সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক সার-বিষ-আগাছানাশক ব্যবহৃত হয়। পৌষসংক্রান্তিতে দেশীয় ধানের পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়, জমে ওঠে পৌষমেলা। খেজুরের রস থেকে গুড় বানানোর জন্য গ্রামের নারীরা তৈরি করেন নানান আকৃতির মাটির চুলা। এ সময়েই লালবুবা-প্যারিহাঁস-বালিহাঁস-ল্যাঞ্জা-সরালিসহ অগণিত অতিথি পাখিতে ভরে যায় জলাভূমি অঞ্চল। শীতের কই মাছ, হাওরের মাখনা ফল, পাহাড়ি এলাকায় কাঁকড়া-কুইচ্চ্যা-শামুক খাবারে আনে পুষ্টি ও ভিন্ন মাত্রা। আদিবাসী এলাকাগুলোয় জুম ধানের ভাত থেকে তৈরি চু-দোচুয়ানি-হাঁড়িয়া-খর এই সব ঐতিহ্যগত পানীয় আয়োজন জমে ওঠে। হাওর এলাকায় দূর-দূরান্ত থেকে দল বেঁধে মানুষেরা দেখতে আসে ষাঁড়ের লড়াই, নানান পসরা নিয়ে বসে আড়ঙ্গ। সিলেটের লালেং আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় সামাজিক আয়োজন ত্তিল সাংরাইন, জৈন্তিয়া আদিবাসীদের বার্ষিক হকতই, কোচদের পুষরা, বাঙালিদের পৌষসংক্রান্তি উৎসব আর মেলার যা-ও কিছু ছিটেফোঁটা এখনো আছে, তা এই শীতকালকে ঘিরেই। তবে দিনে দিনে শীতকালে শীতের তীব্রতা অনেক কমে যাচ্ছে, শহর এলাকায় বলতে গেলে একদম নেই।
বসন্তকাল
ফাল্গুনের আট চৈত্রের আট
সেই তিল দায়ে কাট
খনার বচন
ফাল্গুন-চৈত্র মাস নিয়ে শুরু হয় আড়ম্বরপূর্ণ বসন্তকাল। শাল-মহুয়া-মান্দার-পলাশসহ নানান গাছে গাছে গজায় নতুন পাতা, শাখায় শাখায় রংবেরঙের ফুল। এ সময়ে খোসপাঁচড়াসহ নানান চুলকানি রোগ হয় বলে নিমপাতা-হলুদ-দাদমর্দন পাতা বাটা চলে ঘরে ঘরে। আলু তোলা শেষ হয়, পটোল ঢ্যাঁড়স-ঝিঙে-মরিচ-বেগুন-মিষ্টিকুমড়া-পুঁইশাক লাগানো হয়। বোরো ধান লাগানো শুরু হয়। ফাল্গুনে বাঙালি গ্রামে নানান জাতের শাক দিয়ে পালিত হয় আটআনাজ বর্ত। বসন্তে কোকিল যেমন গান গায়, গানের আসর বসে বাউলের আখড়ায়ও। চৈত্রসংক্রান্তিতে চড়কের মেলায় পুরোনো বছরকে বিদায় জানাতে মানুষের ভিড় জমে ওঠে। চা-বাগানগুলোতে বাগানি ও চা-শ্রমিকেরা মিলে আয়োজন করেন দণ্ড বর্ত। টাঙ্গাইল অঞ্চলে এ সময় গ্রামের পুরুষেরা মিলে সংযাত্রা পালার ভেতর দিয়ে স্থানীয় সামাজিক সমস্যাগুলো তুলে ধরে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা বিষয়ে বাংলা রচনা হিসেবে ‘বাংলাদেশের ষড়্ঋত’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই রচনাটি ভুলভাবে বাংলাদেশের বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের পাঠ করানো হচ্ছে। অধিকাংশ বাংলা রচনা বইয়ে বাংলাদেশের ষড়্ঋতুর যে বিবরণ ও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা সব দিক থেকেই চলতি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা খুব একপক্ষীয় কায়দায় বাংলাদেশের এককালীন ঋতুর বৈচিত্র্যকে দেখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা কীভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতায় নিজেদের অঞ্চলে বাংলাদেশের ঋতুর বৈচিত্র্য দেখছে, তারাই পারে তা নিজেদের মতো করে তুলে ধরতে। আর সেটিই হবে বাংলাদেশের ষড়্ঋতুর নতুন রচনা। দেশের সবার অভিজ্ঞতা থেকেই বাংলাদেশের ষড়্ঋতুর নয়া পাঠ আজ তৈরি করা জরুরি। তা না হলে ডানা ভাঙা এই ষড়্ঋতুর দেশে আমরা হয়তো শেষমেশ আর কাউকেই খুঁজে পাব না যে ঋতুর অদলবদলগুলো ভেতর থেকে টের পাবে। নিজেকে গড়ে তুলবে ষড়্ঋতুর মতো বর্ণ ও বৈভবে অনর্গল।
লেখক: গবেষক
কি ধান, কি মাছ, কি ঋতু, কি গাছ, কি মানুষ, কি ভাষা, কি উৎসব এমন বৈচিত্র্য বাংলাদেশের মতো দুনিয়ায় আর কোথাও আছে! নানান রঙের জীবন আর নানান রঙের ঋতু। প্রতিটি ঋতুতেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজে প্রকৃতি। প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন সাজে মানুষও সাজায় তার চাষ আর সংগ্রহের জীবন। ধীরে ধীরে সব বদলে যাওয়ার দুনিয়ায় আজ জীবনের নানান রূপ বৈচিত্র্যও বিপন্ন। পৃথিবীব্যাপী তথাকথিত উন্নত আর ধনী দেশের যুদ্ধ তাণ্ডব আর প্রকৃতি বিনাশী কর্মকাণ্ডে জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ের ফলে খসে পড়ছে আমাদের প্রিয় ঋতুবৈচিত্র্যের রংবেরঙের ডানা। তথাকথিত উন্নত বিশ্বের ভোগবিলাসী জীবন আর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ব্যবহার দুনিয়ার জলবায়ুকে উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে।
ভয়াবহভাবে উত্তপ্ত হয়ে ভেঙে যাচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশের ছয়-ছয়টি বর্ণময় ঋতুর ডানা। নানান রঙের ডানায়, নানান প্রাণের পালক গুঁজে দিয়ে সুখী জীবনের আকাশে ওড়ার অধিকার আমরা হারিয়ে ফেলছি। এত সব হাহাকারের ভেতরও কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, কি শরৎ , কি হেমন্ত, কি শীত, কি বসন্তে সমতল গ্রাম বা পাহাড়-জঙ্গলে যখন দেখি জীবনের জয়গানে নেচে ওঠে কৃষক জুমিয়া জেলে কামার কুমার তাঁতি মাঝি কবিরাজ বৈদ্য মৌয়াল বাওয়ালি বাউল পটুয়া চুনারি পাটনি পালাকার বাউল মন; তখন আবারও মনে হয় জলবায়ু পরিবর্তিত দুনিয়ার বুকে দলিতমথিত ডানা নিয়ে সাত আসমান পাড়ি দেওয়ার সাহস কেবলমাত্র এই জনপদের নিম্নবর্গের জীবনেই আছে। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে দুনিয়ার তাপমাত্রা প্রায় শূন্য দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১০-২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্কটিক অঞ্চলের বরফ স্তরের পুরুত্ব প্রায় ৪০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সালের ভেতর পৃথিবীর উষ্ণতা প্রায় ১ দশমিক ৪ থেকে ৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পাবে। উষ্ণতা বাড়ার কারণে পৃথিবীর ২১ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবে, ৩১ লাখেরও বেশি মানুষ পানিঘাটতিতে পড়বে, ৫ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধায় তাড়িত হবে। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। প্রাণবৈচিত্র্যের বিস্তৃতি হ্রাস পাবে, বিলুপ্তির হার বৃদ্ধি পাবে, প্রজনন বা বংশবিস্তারের সময়ের পরিবর্তন ঘটবে, প্রজাতির বৃদ্ধি ও প্রতিবেশগত পরিসরের পরিবর্তন ঘটবে। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে প্রায় ১০ লাখ বৈচিত্র্যময় প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তিত এই বিপন্ন সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার সাধারণ কৃষি ও জুমনির্ভর জনগণ নিজেদের এলাকায় চারপাশে কেবলমাত্র দুটি কি তিনটি ঋতুর বদল বুঝতে পারেন এবং টের পান। ষড়্ঋতুর এই করুণ পরিণতি সব দিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য বিপদবার্তা তৈরি করছে। একদিকে যেমন বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের শস্য ফসলের হাজার জাত, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য। আরেকদিকে আমাদের ঋতুভিত্তিক অভ্যাস ও আচার-আচরণ কী নিদারুণভাবে বদলে যেতেও বাধ্য হচ্ছে। অথচ এই ষড়্ঋতুর অদলবদলের সঙ্গে সঙ্গেই জনজীবন সাজিয়েছিল এককালে তার ঋতু বরণ কি বিদায়ের সব উৎসব ও উদ্দীপনা। ষড়্ঋতুর ডানা ঠিক রাখতে না পারলে বাংলাদেশের জনগণের অনন্য পারস্পরিক সম্পর্ক ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের সব ধারাবাহিকতা অচিরেই ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাবে। ক্রমান্বয়ে যা আমাদের সবার জন্যই তৈরি করবে এক দীর্ঘস্থায়ী বিপন্নতা। জলবায়ুজনিত এই পরিবর্তিত সময়েও বাংলাদেশের নানান প্রান্ত থেকে এখনো বর্ণময় ষড়্ঋতুর যে ডানা ভাঙা ঝাপটানি টের পাওয়া যায়, তা নিয়েই এই ছোট্ট ফিরিস্তি।
গ্রীষ্মকাল
কোল পাতলা ডাগর গুছি
লক্ষ্মী বলে ঐখানে আছি
খনার বচন
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ দিয়ে শুরু হয় বাঙালির বাংলা বছর, জমে ওঠে গ্রীষ্মের তাপ ও ঝড়ের আলোড়ন। বাংলাদেশের গ্রাম জনপদে এখনো বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বছরের হিসাবনিকাশ হয়। কেবলমাত্র শহর এলাকায়, সরকারি কাগজপত্র কি মুদ্রিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জিতে নির্ধারণ করা হয়েছে ভিন্ন বাংলা সনের হিসাব। যার সঙ্গে গ্রাম জনপদের মানুষের বছর গোনাগুনতি ও পালনের কোনো মিল নেই। বৈশাখ থেকেই শুরু হয় আউশ ধান বোনার মৌসুম আর পাহাড়ে পাহাড়ে আদিবাসী এলাকায় জুম ধান বোনায় ব্যস্ত থাকেন জুমিয়ারা। অনেক এলাকায় পাট লাগানো হয়, তিল-তিসি তোলা হয়, বর্তমানে এ সময়ে কাটা হয় উফশীজাতের ধান (যদিও বাংলাদেশের গ্রাম জনপদে এই ধান ইরি ধান নামেই প্রচলিত)। এ সময়ে ঝড়-তুফান বেশি হয় বলে গ্রামের মানুষেরা ঘরদুয়ার-গোয়ালঘর-গোলাঘর আবারও মজবুত করে বাঁধেন, বেদেরা নদীর তীরে তীরে নৌকা বহরখানি নিরাপদে নিয়ে যান। নতুন বছর বরণ করে নেওয়ার জন্য বাঙালিরা আয়োজন করে শুভ নববর্ষ; চাকমারা বিজু; রাখাইনরা সংগ্রেং; মারমারা সাংগ্রাই; ত্রিপুরারা বৈসুক; বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা বিষু উৎসব। নতুন বছরের হিসাবনিকাশ, দেনা-পাওনা মিটিয়ে ফেলার জন্য ব্যবসায়ীদের শুভ হালখাতায় লাগে সিঁদুর আর কাঁচা হলুদের দাগ। গ্রামে গ্রামে যেমন নাইল্যা-গিমা-কলমি নানান জাতের তিতা শাক খাওয়ার ভেতর দিয়ে শুরু হয় পয়লা বৈশাখ, তেমনি শহরে জমে ওঠে পান্তা আর ইলিশ খাওয়ার ধুম। ইদানীং পিৎজা হাট কি কেএফসির মতো করপোরেট খাদ্য দোকানদারেরাও পয়লা বৈশাখের বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের খাবার বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রীষ্মকালের গরমের তীব্রতা গ্রীষ্মকালে আর থাকছে না, কালবৈশাখী গ্রীষ্মকাল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই অদলবদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে স্থানীয় জীবনধারার গতিপ্রকৃতি।
বর্ষাকাল
আষাঢ়ের পঞ্চদিনে রোপয়ে যে ধান
সুখে থাকে কৃষি বল বাড়য়ে সম্মান
খনার বচন
ঢপ ঢপ ছলছল বর্ষাকাল আর ঋতুভিত্তিক বর্ষা মৌসুমের বন্যা এখন আর বাংলাদেশে হয় না। এখন হাওর এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মেঘালয় পাহাড় থেকে নামে পাহাড়ি ঢল, হয় অকাল বন্যা আর নদ-নদী সব দখল ও নিশ্চিহ্ন বলে বাড়ে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। এ সময়ে গ্রামে গ্রামে কৃষকের ব্যস্ততা বেড়ে যায়, মাঠে মাঠে আমনের রোয়া লাগাতে লাগাতে আষাঢ়-শ্রাবণ পেরিয়ে যায়। বর্ষার দিনে হাওর থেকে শিশুরা কুড়িয়ে আনে শালুক-পানিফল-ঢ্যাপ আর নারীরা নানান জাতের শাক। পয়লা বর্ষার দিনে পাহাড়-জঙ্গল থেকে খাসিয়ারা খুঁজে আনেন তেতস্লাং, মান্দিরা দামবং, চাকমারা হকেংমূল মানে নানান জাতের ব্যাঙের ছাতা (মাশরুম), যা আমাদের খাবারে যেমন বৈচিত্র্য আনে, একই সঙ্গে তা পুষ্টিও জোগায়। বর্ষা হাওর ও বিল অঞ্চলের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ঋতু যে বর্ষাকালেই হাওরাঞ্চলে নৌকা যাতায়াতের সুবিধার কারণে বিয়েশাদি বেশি হয়। হাওরের অধিকাংশ ধামাইল, কীর্তন, ঢপযাত্রা, গীত রচিত ও চর্চিত হয় এখনো এই বর্ষার দিনেই। বর্ষার দিনে গ্রামে গ্রামে বয়স্ক ব্যক্তিরা জমিয়ে তোলেন গল্পের আসর, সেই সব আসর আরও উৎসাহী করে তোলে চাল ভাজা-বাদাম ভাজা-শিম বিচি ভাজা-কাঁঠাল বিচি ভাজা। বাংলার লোকদেবী মনসা পূজার এই তো সময়, বেহুলা-লখিন্দরের ভেলা ভাসানোর স্মৃতি নিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই করতে করতে ভাটি এলাকার নারীরা সুর তোলেন ধামাইল গীতের।
শরৎকাল
ভাদ্রের চারি আশ্বিনের চারি
কলাই রোবে যত পারি
খনার বচন
ভাদ্র-আশ্বিন মাস নিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ছোপ লাগিয়ে, নদীর তীরে কাশঝাড়ের নাচন বলে দেয় এসেছে শরৎ। কিন্তু গ্রামবাংলায় এই ঋতু সম্পূর্ণ উধাও হয়েছে। এখন গ্রামে কাশঝাড় পাওয়া গেলেও শরৎকাল খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। ভাদ্র মাসে তার বাদেও তাল পাকে। তালের পিঠা এবং তাল নবমী এই ঋতুর এক অনন্য গ্রামীণ আয়োজন। ভাদ্র মাস থেকে আউশ ধান কাটা হয়, অনেক এলাকায় সরিষা বুনতে শুরু করেন কৃষকেরা। বাঙালি হিন্দুর শারদীয় দুর্গাপূজার জন্য কারিগরেরা জোগাড় করতে থাকেন নানান জাতের মাটি, আমন-আউশের খড়, বাঁশ আরও কত-কী!
হেমন্তকাল
আশ্বিনের উনিশ কার্তিকের উনিশ
বাদ দিয়ে যত পারিস মটর কলাই বুনিস
খনার বচন
কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্তকাল। শুরু হয় আমন ধান কাটার পর্ব, ধান ঘরে তোলার পর গ্রামে গ্রামে নয়া ফসল খাওয়ার উৎসব নবান্ন। মান্দিরা এ সময়ে তাদের সবচেয়ে বড় আয়োজনের সামাজিক উৎসব ওয়ান্না পালন করে আর কোচদের হয় গিদেলচাওয়া। আবছা শীতের আমেজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুলা, পালংশাক, খেসারি, কলাই বোনা শুরু হয়। কার্তিক মাসেই ধান কাটার আগেভাগে গ্রামে গ্রামে অভাব ছড়িয়ে পড়ে। কুড়িয়ে পাওয়া নানান শাকসবজি উত্তর জনপদের মানুষের এই কঠিন মঙ্গার কাল পাড়ি দিতে সহভাগী হয়। ধান কাটার পর পরই জমিনগুলো শিশুদের বউচি-কুতকুত-দাঁড়িয়াবান্ধা-গোল্লাছুট-হা-ডু-ডু-পাতাপলান্তি খেলার মাঠ হয়ে ওঠে, গরু-ছাগলগুলোও পায় এক বিস্তৃত চারণভূমি। হাওর এলাকায় শুরু হতে থাকে আড়ঙ্গ, মানে ষাঁড়ের লড়াই। এ সময়ই দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরে, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ডে, সুন্দরবনের দুবলারচরে, কমলগঞ্জে মণিপুরি এলাকায় জমে ওঠে রাসমেলা। অধিকাংশ মাজার শরিফ ও মোকামমে এই সময়টাতেই ওরস ও মেলার আয়োজন হয়। হাওর এলাকায় বর্ষা বাদে হেমন্ত এক প্রধান ঋতু। এ সময়ে হাওর এলাকায় হাঁটা ছাড়া তেমন কোনো গতি নেই সর্বত্র, যদিও এখন মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।
শীতকাল
ছায়ে লাউ উঠানে ঝাল
ক’র বাপু চাষার ছাওয়াল
খনার বচন
শীতের মৌসুমে গ্রামে গ্রামে লালসালু কাপড় মুড়িয়ে শিমুল-কার্পাস তুলার লেপ বানানোর জন্য ধুনকরদের আনাগোনা বেড়ে যায় এখনো এই সিনথেটিক কম্বল আর প্লাস্টিক কাপড়ের যুগে। বর্তমান এই সময়েই মাঠে মাঠে ইরি-বিরি (উফশী) ধান ফলাতে ব্যস্ত থাকতে হয় কৃষকদের। এই সময়ে উফশী চাষে ব্যাপক সেচের প্রয়োজন হওয়ায় ধীরে ধীরে নেমে যায় পানির স্তর। ধানের জমিনে এই সময়েই সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক সার-বিষ-আগাছানাশক ব্যবহৃত হয়। পৌষসংক্রান্তিতে দেশীয় ধানের পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়, জমে ওঠে পৌষমেলা। খেজুরের রস থেকে গুড় বানানোর জন্য গ্রামের নারীরা তৈরি করেন নানান আকৃতির মাটির চুলা। এ সময়েই লালবুবা-প্যারিহাঁস-বালিহাঁস-ল্যাঞ্জা-সরালিসহ অগণিত অতিথি পাখিতে ভরে যায় জলাভূমি অঞ্চল। শীতের কই মাছ, হাওরের মাখনা ফল, পাহাড়ি এলাকায় কাঁকড়া-কুইচ্চ্যা-শামুক খাবারে আনে পুষ্টি ও ভিন্ন মাত্রা। আদিবাসী এলাকাগুলোয় জুম ধানের ভাত থেকে তৈরি চু-দোচুয়ানি-হাঁড়িয়া-খর এই সব ঐতিহ্যগত পানীয় আয়োজন জমে ওঠে। হাওর এলাকায় দূর-দূরান্ত থেকে দল বেঁধে মানুষেরা দেখতে আসে ষাঁড়ের লড়াই, নানান পসরা নিয়ে বসে আড়ঙ্গ। সিলেটের লালেং আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় সামাজিক আয়োজন ত্তিল সাংরাইন, জৈন্তিয়া আদিবাসীদের বার্ষিক হকতই, কোচদের পুষরা, বাঙালিদের পৌষসংক্রান্তি উৎসব আর মেলার যা-ও কিছু ছিটেফোঁটা এখনো আছে, তা এই শীতকালকে ঘিরেই। তবে দিনে দিনে শীতকালে শীতের তীব্রতা অনেক কমে যাচ্ছে, শহর এলাকায় বলতে গেলে একদম নেই।
বসন্তকাল
ফাল্গুনের আট চৈত্রের আট
সেই তিল দায়ে কাট
খনার বচন
ফাল্গুন-চৈত্র মাস নিয়ে শুরু হয় আড়ম্বরপূর্ণ বসন্তকাল। শাল-মহুয়া-মান্দার-পলাশসহ নানান গাছে গাছে গজায় নতুন পাতা, শাখায় শাখায় রংবেরঙের ফুল। এ সময়ে খোসপাঁচড়াসহ নানান চুলকানি রোগ হয় বলে নিমপাতা-হলুদ-দাদমর্দন পাতা বাটা চলে ঘরে ঘরে। আলু তোলা শেষ হয়, পটোল ঢ্যাঁড়স-ঝিঙে-মরিচ-বেগুন-মিষ্টিকুমড়া-পুঁইশাক লাগানো হয়। বোরো ধান লাগানো শুরু হয়। ফাল্গুনে বাঙালি গ্রামে নানান জাতের শাক দিয়ে পালিত হয় আটআনাজ বর্ত। বসন্তে কোকিল যেমন গান গায়, গানের আসর বসে বাউলের আখড়ায়ও। চৈত্রসংক্রান্তিতে চড়কের মেলায় পুরোনো বছরকে বিদায় জানাতে মানুষের ভিড় জমে ওঠে। চা-বাগানগুলোতে বাগানি ও চা-শ্রমিকেরা মিলে আয়োজন করেন দণ্ড বর্ত। টাঙ্গাইল অঞ্চলে এ সময় গ্রামের পুরুষেরা মিলে সংযাত্রা পালার ভেতর দিয়ে স্থানীয় সামাজিক সমস্যাগুলো তুলে ধরে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা বিষয়ে বাংলা রচনা হিসেবে ‘বাংলাদেশের ষড়্ঋত’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই রচনাটি ভুলভাবে বাংলাদেশের বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের পাঠ করানো হচ্ছে। অধিকাংশ বাংলা রচনা বইয়ে বাংলাদেশের ষড়্ঋতুর যে বিবরণ ও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা সব দিক থেকেই চলতি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা খুব একপক্ষীয় কায়দায় বাংলাদেশের এককালীন ঋতুর বৈচিত্র্যকে দেখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা কীভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতায় নিজেদের অঞ্চলে বাংলাদেশের ঋতুর বৈচিত্র্য দেখছে, তারাই পারে তা নিজেদের মতো করে তুলে ধরতে। আর সেটিই হবে বাংলাদেশের ষড়্ঋতুর নতুন রচনা। দেশের সবার অভিজ্ঞতা থেকেই বাংলাদেশের ষড়্ঋতুর নয়া পাঠ আজ তৈরি করা জরুরি। তা না হলে ডানা ভাঙা এই ষড়্ঋতুর দেশে আমরা হয়তো শেষমেশ আর কাউকেই খুঁজে পাব না যে ঋতুর অদলবদলগুলো ভেতর থেকে টের পাবে। নিজেকে গড়ে তুলবে ষড়্ঋতুর মতো বর্ণ ও বৈভবে অনর্গল।
লেখক: গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪