নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
আমাদের অপরিমেয় শোক, বেদনাঘন একটি দিন ১৫ আগস্ট। এদিন হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতাসংগ্রামের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়ে বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিল জাতি। ১৫ আগস্ট বাঙালির ভালে অপরিসীম লজ্জা, গ্লানি ও অনপনেয় কলঙ্ক লেপন করে দিয়েছে। সেই কলঙ্ক কখনো মুছবে না, ঘুচবে না।
হাজার বছরের মধ্যে এমন প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, হন্তারক ও শঠতাপূর্ণ দিবস বাঙালি জাতির জীবনে আর কখনো আসেনি। কিছুটা হয়তো ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে অভিনীত বিয়োগান্ত নাটকে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের সঙ্গে তুলনীয়। সিরাজউদ্দৌলা যদিও বাঙালি ছিলেন না, তথাপি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সিরাজের প্রতিরোধের মধ্যে জাতীয় বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যের উপাদান খোঁজে বাঙালি।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্যই প্রাণ দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগেও একাধিকবার তাঁর জীবন সংশয় দেখা দিয়েছিল। সেই স্বাধীন দেশ যখন তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখনো স্বাধীনতা বিপন্মুক্ত হলো না। যে স্বাধীনতা এনেছিল বাঙালি জাতি, তাকে রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে জাতির পিতাকে। বঙ্গবন্ধুকেই জীবন দিয়ে স্বাধীনতার দাম দিতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি? হাজার বছরে কত বড় বড় মনীষী, রাজনীতিক বাঙালির জীবনকে আলোকিত ও আন্দোলিত করেছেন, ইতিহাস ও সভ্যতা নির্মাণ করেছেন নিজ নিজ মেধা, উদ্ভাবন, অনন্যসাধারণ সাধনা ও কর্মকৃতি দিয়ে। কিন্তু তাঁরা কেউ বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করেননি। কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেননি। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কালে ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একটি স্বাধীন বঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব এই রাজ্যের রাজা ছিলেন। কিন্তু তাঁরাও বাঙালি নন। দক্ষিণ এবং পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ নিয়ে গৌড়রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা শশাঙ্ক ছিলেন এর প্রথম সার্বভৌম নৃপতি।
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত (১২০৪-১৫৭৬) স্বাধীন সুলতানি আমল বাঙালির ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু সুলতানেরা বাঙালি ছিলেন না এবং সেই বাংলাও এই বাংলা নয়।
এসব রাজতন্ত্রের কথা। বঙ্গবন্ধু প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গোটা বাংলার ইতিহাসে এমনকি আরেকটি উদাহরণ পাই, যখন রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতবর্ষব্যাপী অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহিঃশত্রুর পুনঃপুন আক্রমণে বাংলার গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছিল। তখন দেশে কোনো রাজা ছিল না, প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত লোক, ব্রাহ্মণ এবং বণিক নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। সংস্কৃতে ওই অরাজক পরিস্থিতিকে বলা হয় মাৎস্যন্যায়।
সেই চরম দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তিলাভের জন্য বাঙালি জাতি যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিল, ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের প্রবীণ নেতারা স্থির করলেন, পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করবেন এবং সবাই স্বেচ্ছায় তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করবেন। দেশের জনসাধারণও সানন্দে এই মত গ্রহণ করল। এর ফলে গোপাল নামের এক ব্যক্তি বাংলাদেশের রাজপদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বাঙালির এই দেড়-দুই হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়, তা হলো ১৯৭১ সালে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, আগে কখনো তা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, বাঙালিকে প্রথম জাতি পরিচিতি দিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য ভারতীয় সাহায্য চাইতে অন্তত তিনবার (১৯৬১, ১৯৬২ সালে দুবার এবং আরেকবার সম্ভবত আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর) আগরতলায় গেছেন বঙ্গবন্ধু। সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীরা নেতাজি সুভাষ বসুর স্টাইলে বঙ্গবন্ধুকে ভারতের মধ্য দিয়ে লন্ডন নিয়ে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম চালাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মরত কূটনীতিক এস এস ব্যানার্জির মাধ্যমেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য চেয়ে।
১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য পূর্ববঙ্গ মুক্তিফ্রন্ট নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বইয়ে। তিনি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে ওই সংস্থার নামে মুদ্রিত কিছু লিফলেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলি করার জন্য দিয়েছিলেন। তিনি লিফলেটগুলো শেখ ফজলুল হক মনিকে দিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের বিভিন্ন রুমের দরজার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
তারও আগে ১৯৬০ সালে দিল্লির সাউথ ব্লকে পাকিস্তান ডেস্কে কর্মরত একজন গোয়েন্দা চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তিনি পতেঙ্গা সৈকত, হালিশহর ইত্যাদি এলাকা পরিদর্শন করে নোয়াখালী চলে গিয়েছিলেন। এটিও বঙ্গবন্ধুর একটি স্বাধীনতা প্রচেষ্টার অংশ। ওই গোয়েন্দার নাম রাজ নির্মল নারায়ণ চৌধুরী। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী। তিনি ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাওয়ের সহকারী ছিলেন। তাঁর সফরের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ এবং পরবর্তীকালে আগরতলা মামলার আসামি মানিক চৌধুরী ওই গোয়েন্দার সঙ্গে ছিলেন।
১৯৬১ সালের শেষার্ধ থেকে বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়। সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী এ ব্যাপারে দুই দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। আওয়ামী লীগ থেকে শেখ মুজিব ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মণি সিংহ ও খোকা রায় এসব গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব কর্মসূচিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বৈঠকে বলেন, ওদের সাথে আমাদের আর থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে।
কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে সম্মত হননি। তাঁরা বলেছিলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি এখন একটি হঠকারী দাবি।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও সংগ্রামকে দুভাগে ভাগ করা যায়—একটি স্থানিক ও সাময়িক, আরেকটি স্থায়ী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাঁর রাজনীতির চিরস্থায়ী কথা। পঞ্চাশের দশকে সাতচল্লিশে দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে যখন রাজনীতি শুরু করছেন, তখন বিরোধী নেতাদের মধ্যে ঢাকায় নিয়ন্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনেক পূর্ববর্তী নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, তাঁর সাক্ষাৎ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, কমরেড মণি সিং প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক নেতা ছিলেন অলি আহাদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।
১৯৭০ সালে এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী ছাড়া অন্য সব নেতাই ছিলেন জীবিত। কিন্তু তাঁরা কেউ জনপ্রিয়তায় বঙ্গবন্ধুর ধারেকাছেও ছিলেন না। এ কারণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতার মহানায়ক।
বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতিসত্তা জাগ্রত করেন, জাতি হিসেবে বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করেন। বাঙালির অভিন্ন ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ছিল, কিন্তু যে ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটে, পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী বাঙালির জাতি হিসেবে সংগঠিত হওয়ার অবকাশ মেলে। ১৯৬৬ সালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন ঘটায়।
পূর্ব পাকিস্তানের ‘বাংলাদেশ’ নামকরণও প্রথম বঙ্গবন্ধুই করেন। ১৯৬৯ সালে তিন নেতার মাজারে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ নামে কোনো অখণ্ড রাষ্ট্র কখনো ছিল না। বঙ্গ, গৌড়, রাঢ়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি নানা স্বাধীন বিচ্ছিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বাংলা মুলুক নামে পরিচিত ভূখণ্ডটি। ব্রিটিশ শাসনামলে বিচ্ছিন্ন জনপদ বা স্বাধীন রাজ্যসমূহকে একীভূত করে অখণ্ড বাংলার সৃষ্টি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের চেষ্টা বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ভেস্তে যায়। ১৯৪৭-এ অখণ্ড বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে পূর্ববঙ্গকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাতচল্লিশের বাংলা ভাগের মূলে ছিল জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের তাড়না। জিন্নাহ সাহেব বাঙালি জাতির প্রধান দুই উপাদান হিন্দু ও মুসলমানকে দুই জাতি হিসেবে বর্ণনা করে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও ধর্ম কখনো জাতীয়তার ভিত্তি হতে পারে না। তা সত্ত্বেও জিন্নাহ হাজার মাইলের ব্যবধানে বসবাসকারী মানুষ, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকি গাত্রবর্ণও ভিন্ন, শুধু ধর্ম বিশ্বাসে ছিল অভিন্ন, তাদেরকে ধর্মের রজ্জুতে গেঁথে একটি আজব রাষ্ট্র গঠন করলেন।
বঙ্গবন্ধু জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে একজাতিতত্ত্বের ধারণা উপস্থাপন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি বললেন, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো জাতি হতে পারে না। অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য জাতি গঠনের আবশ্যকীয় শর্ত। সাতচল্লিশে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে এই ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তার উপাদান দেখতে পেলেন এবং বাংলাদেশের যে ছবি তিনি মনে মনে কল্পনা করতেন, পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে তার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করেন। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে জাতীয়তা নির্মাণে সচেষ্ট হলেন। পূর্ববঙ্গকে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের উপনিবেশের মতো শোষণ এবং সর্বক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য দেখতে দেখতে অভিমানাহত বাঙালি জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করে। ষাটের দশকে বাঙালি জনমনে ধূমায়মান অসন্তোষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়। ৬ দফার মধ্যে নিহিত স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। ৬ দফা মানতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অস্বীকৃতি থেকে বাঙালি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
অতঃপর সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গণরায় মানতে অস্বীকার করে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতিকে পাকিস্তানি হানাদারদের বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়ন করার আহ্বান জানালে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন।
সব আলোচনা থেকে একথা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয়, বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতির পিতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।
পঁচাত্তরের খুনিরা ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির পিতাকেই শুধু হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছিল বাংলাদেশকে। কেননা বঙ্গবন্ধু একজন ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক, একটি চেতনার নাম। সে আদর্শ বাংলাদেশ, সেই চেতনা বাঙালিত্ব।
তবে খুনিরা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর দেহান্ত হলেও তাঁর আদর্শ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি বেঁচে আছে। বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যুর ৪৮ বছর পরও আজও বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নিত্য উপস্থিতি, বঙ্গবন্ধু আজও এ দেশে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, বঙ্গবন্ধু তত দিন বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের মাঝে।
মোশতাক, চাষী, ঠাকুর, রশিদ, ফারুক—যাদের আমরা খুনি বলে চিনি, ব্যক্তি পরিচয়ের আড়ালে আসলে কী ছিল তারা? তারাও একটি আদর্শের প্রতীক, কিংবা তাদের শিখণ্ডী হিসেবে খাড়া করে আড়ালে বসে যিনি অট্টহাসি হাসছিলেন, ১৫ আগস্ট ভোর হতে না হতেই পূর্ণ সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে কিলিং মিশন অ্যাকমপ্লিশ্ড হওয়ার খবরটা শোনার জন্য যে প্রস্তুত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় পায়চারী করছিলেন, তিনি জিয়াউর রহমান। ক্ষমতারূঢ় হওয়ার অনেক পরে তিনি নিজেই জানান দিয়েছিলেন, তার আদর্শ ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’, যা আসলে ইসলামি তথা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর। তার আগে মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শ বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, বাংলাদেশ বেতারকে ‘রেডিও বাংলাদেশ’-এ বদলে দেয়। বঙ্গবন্ধু নয়, বঙ্গবন্ধুর পোশাককেও ঘৃণা করত মোশতাক, তাই সে কিম্ভুতকিমাকার নতুন এক জাতীয় পোশাকের প্রচলন করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রকে একে একে পাল্টে দেওয়া হলো। এই মূলনীতিগুলো মুক্তিযুদ্ধেরই অর্জন। এরপর যা থাকল, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ নামের খোলসে ‘পাকিস্তান’।
মোশতাক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করল, জিয়া তাকে জায়েজ করলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে। আসলে মোশতাক, চাষীরা ছিল একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রেতাত্মা। মোশতাক, চাষী মুক্তিযুদ্ধেই পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাব নিয়ে কম দেনদরবার করেনি। জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সতর্কতা ও দৃঢ়তায় তখন সফল হতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মোশতাক ক্ষমতায় আরোহণের তার বহুদিনের সাধ পূরণ করল। পর্দার অন্তরালে থেকে যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মদত জুগিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাপ্রধান করেননি, এই ক্ষোভ থেকে জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চক্রান্তে শামিল হন।
মুক্তিযুদ্ধ থেকেই জিয়া এক রহস্যময় চরিত্র। জিয়া দায়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রথম দিকে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ক্যাম্পে ১ নম্বরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু তার সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করে তাকে ১ নম্বর সেক্টর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। তিনি ওসমানী সাহেবের প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগের বিরোধিতা করেন এবং তাঁকে প্রধান সেনাপতি পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের বিরোধিতার কারণে পারেননি। কামালপুর যুদ্ধে জিয়ার ভুলের কারণে বাংলাদেশ বাহিনীর অনেক অফিসার ও জওয়ান হতাহত হন। সে জন্য জেনারেল ওসমানী তাকে স্যাক করতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি জিয়া। তিনি ক্রমান্বয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং শেষে রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী, আলীম ও মতিনকে মন্ত্রী করার মাধ্যমে একে একে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেন। দালাল আইন বাতিল করে ঘাতক দালাল, রাজাকার, আলবদরদের ছেড়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন বর্জন করেন, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ করে দেন।
মোশতাক ও জিয়া চেয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে দিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও মানুষ যাঁকে হৃদয়ে ধারণ করেছে, অত সহজে কি তাঁকে মুছে ফেলা যায়! মানুষের চেতনায় ঠাঁই নিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ভেবেছিল, একাত্তরে পরাজিত ও পরিত্যক্ত পাকিস্তানকে আবার তারা ফিরিয়ে এনেছেন বাংলাদেশে, তারা বোকার স্বর্গেই বাস করছিলেন। তাদের যিনি বধ করবেন, তিনি গোকুলে বেড়ে উঠছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা; বিদেশে থাকার কারণে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেট থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার প্রথমজন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা ফিরে এলেন স্বদেশে। প্রথমে পিতার গড়া দল, স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। হতাশ, মনোবলহারা দলীয় নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত করে আওয়ামী লীগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। পুনর্গঠিত দল নিয়ে তিনি ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশ শাসনের অধিকারী হয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে এনেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠা করলেন; তাঁকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করলেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের দিনকে জাতীয় শোক দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস ঘোষণা, ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা; বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তির ওপর বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর করেন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
আমাদের অপরিমেয় শোক, বেদনাঘন একটি দিন ১৫ আগস্ট। এদিন হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতাসংগ্রামের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়ে বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিল জাতি। ১৫ আগস্ট বাঙালির ভালে অপরিসীম লজ্জা, গ্লানি ও অনপনেয় কলঙ্ক লেপন করে দিয়েছে। সেই কলঙ্ক কখনো মুছবে না, ঘুচবে না।
হাজার বছরের মধ্যে এমন প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, হন্তারক ও শঠতাপূর্ণ দিবস বাঙালি জাতির জীবনে আর কখনো আসেনি। কিছুটা হয়তো ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে অভিনীত বিয়োগান্ত নাটকে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের সঙ্গে তুলনীয়। সিরাজউদ্দৌলা যদিও বাঙালি ছিলেন না, তথাপি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সিরাজের প্রতিরোধের মধ্যে জাতীয় বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যের উপাদান খোঁজে বাঙালি।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্যই প্রাণ দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগেও একাধিকবার তাঁর জীবন সংশয় দেখা দিয়েছিল। সেই স্বাধীন দেশ যখন তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখনো স্বাধীনতা বিপন্মুক্ত হলো না। যে স্বাধীনতা এনেছিল বাঙালি জাতি, তাকে রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে জাতির পিতাকে। বঙ্গবন্ধুকেই জীবন দিয়ে স্বাধীনতার দাম দিতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি? হাজার বছরে কত বড় বড় মনীষী, রাজনীতিক বাঙালির জীবনকে আলোকিত ও আন্দোলিত করেছেন, ইতিহাস ও সভ্যতা নির্মাণ করেছেন নিজ নিজ মেধা, উদ্ভাবন, অনন্যসাধারণ সাধনা ও কর্মকৃতি দিয়ে। কিন্তু তাঁরা কেউ বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করেননি। কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেননি। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কালে ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একটি স্বাধীন বঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব এই রাজ্যের রাজা ছিলেন। কিন্তু তাঁরাও বাঙালি নন। দক্ষিণ এবং পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ নিয়ে গৌড়রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা শশাঙ্ক ছিলেন এর প্রথম সার্বভৌম নৃপতি।
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত (১২০৪-১৫৭৬) স্বাধীন সুলতানি আমল বাঙালির ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু সুলতানেরা বাঙালি ছিলেন না এবং সেই বাংলাও এই বাংলা নয়।
এসব রাজতন্ত্রের কথা। বঙ্গবন্ধু প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গোটা বাংলার ইতিহাসে এমনকি আরেকটি উদাহরণ পাই, যখন রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতবর্ষব্যাপী অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহিঃশত্রুর পুনঃপুন আক্রমণে বাংলার গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছিল। তখন দেশে কোনো রাজা ছিল না, প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত লোক, ব্রাহ্মণ এবং বণিক নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। সংস্কৃতে ওই অরাজক পরিস্থিতিকে বলা হয় মাৎস্যন্যায়।
সেই চরম দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তিলাভের জন্য বাঙালি জাতি যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিল, ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের প্রবীণ নেতারা স্থির করলেন, পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করবেন এবং সবাই স্বেচ্ছায় তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করবেন। দেশের জনসাধারণও সানন্দে এই মত গ্রহণ করল। এর ফলে গোপাল নামের এক ব্যক্তি বাংলাদেশের রাজপদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বাঙালির এই দেড়-দুই হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়, তা হলো ১৯৭১ সালে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, আগে কখনো তা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, বাঙালিকে প্রথম জাতি পরিচিতি দিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য ভারতীয় সাহায্য চাইতে অন্তত তিনবার (১৯৬১, ১৯৬২ সালে দুবার এবং আরেকবার সম্ভবত আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর) আগরতলায় গেছেন বঙ্গবন্ধু। সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীরা নেতাজি সুভাষ বসুর স্টাইলে বঙ্গবন্ধুকে ভারতের মধ্য দিয়ে লন্ডন নিয়ে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম চালাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মরত কূটনীতিক এস এস ব্যানার্জির মাধ্যমেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য চেয়ে।
১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য পূর্ববঙ্গ মুক্তিফ্রন্ট নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বইয়ে। তিনি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে ওই সংস্থার নামে মুদ্রিত কিছু লিফলেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলি করার জন্য দিয়েছিলেন। তিনি লিফলেটগুলো শেখ ফজলুল হক মনিকে দিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের বিভিন্ন রুমের দরজার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
তারও আগে ১৯৬০ সালে দিল্লির সাউথ ব্লকে পাকিস্তান ডেস্কে কর্মরত একজন গোয়েন্দা চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তিনি পতেঙ্গা সৈকত, হালিশহর ইত্যাদি এলাকা পরিদর্শন করে নোয়াখালী চলে গিয়েছিলেন। এটিও বঙ্গবন্ধুর একটি স্বাধীনতা প্রচেষ্টার অংশ। ওই গোয়েন্দার নাম রাজ নির্মল নারায়ণ চৌধুরী। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী। তিনি ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাওয়ের সহকারী ছিলেন। তাঁর সফরের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ এবং পরবর্তীকালে আগরতলা মামলার আসামি মানিক চৌধুরী ওই গোয়েন্দার সঙ্গে ছিলেন।
১৯৬১ সালের শেষার্ধ থেকে বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়। সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী এ ব্যাপারে দুই দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। আওয়ামী লীগ থেকে শেখ মুজিব ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মণি সিংহ ও খোকা রায় এসব গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব কর্মসূচিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বৈঠকে বলেন, ওদের সাথে আমাদের আর থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে।
কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে সম্মত হননি। তাঁরা বলেছিলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি এখন একটি হঠকারী দাবি।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও সংগ্রামকে দুভাগে ভাগ করা যায়—একটি স্থানিক ও সাময়িক, আরেকটি স্থায়ী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাঁর রাজনীতির চিরস্থায়ী কথা। পঞ্চাশের দশকে সাতচল্লিশে দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে যখন রাজনীতি শুরু করছেন, তখন বিরোধী নেতাদের মধ্যে ঢাকায় নিয়ন্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনেক পূর্ববর্তী নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, তাঁর সাক্ষাৎ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, কমরেড মণি সিং প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক নেতা ছিলেন অলি আহাদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।
১৯৭০ সালে এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী ছাড়া অন্য সব নেতাই ছিলেন জীবিত। কিন্তু তাঁরা কেউ জনপ্রিয়তায় বঙ্গবন্ধুর ধারেকাছেও ছিলেন না। এ কারণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতার মহানায়ক।
বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতিসত্তা জাগ্রত করেন, জাতি হিসেবে বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করেন। বাঙালির অভিন্ন ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ছিল, কিন্তু যে ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটে, পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী বাঙালির জাতি হিসেবে সংগঠিত হওয়ার অবকাশ মেলে। ১৯৬৬ সালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন ঘটায়।
পূর্ব পাকিস্তানের ‘বাংলাদেশ’ নামকরণও প্রথম বঙ্গবন্ধুই করেন। ১৯৬৯ সালে তিন নেতার মাজারে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ নামে কোনো অখণ্ড রাষ্ট্র কখনো ছিল না। বঙ্গ, গৌড়, রাঢ়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি নানা স্বাধীন বিচ্ছিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বাংলা মুলুক নামে পরিচিত ভূখণ্ডটি। ব্রিটিশ শাসনামলে বিচ্ছিন্ন জনপদ বা স্বাধীন রাজ্যসমূহকে একীভূত করে অখণ্ড বাংলার সৃষ্টি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের চেষ্টা বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ভেস্তে যায়। ১৯৪৭-এ অখণ্ড বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে পূর্ববঙ্গকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাতচল্লিশের বাংলা ভাগের মূলে ছিল জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের তাড়না। জিন্নাহ সাহেব বাঙালি জাতির প্রধান দুই উপাদান হিন্দু ও মুসলমানকে দুই জাতি হিসেবে বর্ণনা করে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও ধর্ম কখনো জাতীয়তার ভিত্তি হতে পারে না। তা সত্ত্বেও জিন্নাহ হাজার মাইলের ব্যবধানে বসবাসকারী মানুষ, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকি গাত্রবর্ণও ভিন্ন, শুধু ধর্ম বিশ্বাসে ছিল অভিন্ন, তাদেরকে ধর্মের রজ্জুতে গেঁথে একটি আজব রাষ্ট্র গঠন করলেন।
বঙ্গবন্ধু জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে একজাতিতত্ত্বের ধারণা উপস্থাপন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি বললেন, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো জাতি হতে পারে না। অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য জাতি গঠনের আবশ্যকীয় শর্ত। সাতচল্লিশে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে এই ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তার উপাদান দেখতে পেলেন এবং বাংলাদেশের যে ছবি তিনি মনে মনে কল্পনা করতেন, পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে তার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করেন। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে জাতীয়তা নির্মাণে সচেষ্ট হলেন। পূর্ববঙ্গকে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের উপনিবেশের মতো শোষণ এবং সর্বক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য দেখতে দেখতে অভিমানাহত বাঙালি জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করে। ষাটের দশকে বাঙালি জনমনে ধূমায়মান অসন্তোষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়। ৬ দফার মধ্যে নিহিত স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। ৬ দফা মানতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অস্বীকৃতি থেকে বাঙালি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
অতঃপর সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গণরায় মানতে অস্বীকার করে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতিকে পাকিস্তানি হানাদারদের বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়ন করার আহ্বান জানালে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন।
সব আলোচনা থেকে একথা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয়, বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতির পিতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।
পঁচাত্তরের খুনিরা ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির পিতাকেই শুধু হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছিল বাংলাদেশকে। কেননা বঙ্গবন্ধু একজন ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক, একটি চেতনার নাম। সে আদর্শ বাংলাদেশ, সেই চেতনা বাঙালিত্ব।
তবে খুনিরা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর দেহান্ত হলেও তাঁর আদর্শ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি বেঁচে আছে। বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যুর ৪৮ বছর পরও আজও বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নিত্য উপস্থিতি, বঙ্গবন্ধু আজও এ দেশে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, বঙ্গবন্ধু তত দিন বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের মাঝে।
মোশতাক, চাষী, ঠাকুর, রশিদ, ফারুক—যাদের আমরা খুনি বলে চিনি, ব্যক্তি পরিচয়ের আড়ালে আসলে কী ছিল তারা? তারাও একটি আদর্শের প্রতীক, কিংবা তাদের শিখণ্ডী হিসেবে খাড়া করে আড়ালে বসে যিনি অট্টহাসি হাসছিলেন, ১৫ আগস্ট ভোর হতে না হতেই পূর্ণ সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে কিলিং মিশন অ্যাকমপ্লিশ্ড হওয়ার খবরটা শোনার জন্য যে প্রস্তুত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় পায়চারী করছিলেন, তিনি জিয়াউর রহমান। ক্ষমতারূঢ় হওয়ার অনেক পরে তিনি নিজেই জানান দিয়েছিলেন, তার আদর্শ ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’, যা আসলে ইসলামি তথা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর। তার আগে মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শ বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, বাংলাদেশ বেতারকে ‘রেডিও বাংলাদেশ’-এ বদলে দেয়। বঙ্গবন্ধু নয়, বঙ্গবন্ধুর পোশাককেও ঘৃণা করত মোশতাক, তাই সে কিম্ভুতকিমাকার নতুন এক জাতীয় পোশাকের প্রচলন করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রকে একে একে পাল্টে দেওয়া হলো। এই মূলনীতিগুলো মুক্তিযুদ্ধেরই অর্জন। এরপর যা থাকল, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ নামের খোলসে ‘পাকিস্তান’।
মোশতাক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করল, জিয়া তাকে জায়েজ করলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে। আসলে মোশতাক, চাষীরা ছিল একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রেতাত্মা। মোশতাক, চাষী মুক্তিযুদ্ধেই পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাব নিয়ে কম দেনদরবার করেনি। জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সতর্কতা ও দৃঢ়তায় তখন সফল হতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মোশতাক ক্ষমতায় আরোহণের তার বহুদিনের সাধ পূরণ করল। পর্দার অন্তরালে থেকে যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মদত জুগিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাপ্রধান করেননি, এই ক্ষোভ থেকে জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চক্রান্তে শামিল হন।
মুক্তিযুদ্ধ থেকেই জিয়া এক রহস্যময় চরিত্র। জিয়া দায়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রথম দিকে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ক্যাম্পে ১ নম্বরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু তার সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করে তাকে ১ নম্বর সেক্টর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। তিনি ওসমানী সাহেবের প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগের বিরোধিতা করেন এবং তাঁকে প্রধান সেনাপতি পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের বিরোধিতার কারণে পারেননি। কামালপুর যুদ্ধে জিয়ার ভুলের কারণে বাংলাদেশ বাহিনীর অনেক অফিসার ও জওয়ান হতাহত হন। সে জন্য জেনারেল ওসমানী তাকে স্যাক করতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি জিয়া। তিনি ক্রমান্বয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং শেষে রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী, আলীম ও মতিনকে মন্ত্রী করার মাধ্যমে একে একে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেন। দালাল আইন বাতিল করে ঘাতক দালাল, রাজাকার, আলবদরদের ছেড়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন বর্জন করেন, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ করে দেন।
মোশতাক ও জিয়া চেয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে দিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও মানুষ যাঁকে হৃদয়ে ধারণ করেছে, অত সহজে কি তাঁকে মুছে ফেলা যায়! মানুষের চেতনায় ঠাঁই নিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ভেবেছিল, একাত্তরে পরাজিত ও পরিত্যক্ত পাকিস্তানকে আবার তারা ফিরিয়ে এনেছেন বাংলাদেশে, তারা বোকার স্বর্গেই বাস করছিলেন। তাদের যিনি বধ করবেন, তিনি গোকুলে বেড়ে উঠছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা; বিদেশে থাকার কারণে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেট থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার প্রথমজন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা ফিরে এলেন স্বদেশে। প্রথমে পিতার গড়া দল, স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। হতাশ, মনোবলহারা দলীয় নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত করে আওয়ামী লীগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। পুনর্গঠিত দল নিয়ে তিনি ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশ শাসনের অধিকারী হয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে এনেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠা করলেন; তাঁকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করলেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের দিনকে জাতীয় শোক দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস ঘোষণা, ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা; বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তির ওপর বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর করেন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪