জাহীদ রেজা নূর
মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একটি পর্যায় অতিক্রম করেছিল বাংলাদেশ। জয়ী হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে। সেই যুদ্ধের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে থাকায় এবং সেই প্রজন্মের মানুষেরা এখনো সেটি বর্ণনা করে চলায় তা অনেক সময় হয়ে উঠছে পক্ষপাতমূলক। নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা হয়তো শুরু হবে আরও কিছুটা কাল গেলেবর্তমান ইতিহাসচর্চা এতটাই রাজনৈতিক একদেশদর্শী যে ইতিহাসের ঘটনাগুলো লেখার সময়ও সেটুকু হাজির করা হয়, যা শুধু নিজ মতামতকে প্রমাণ করবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার সময় বামপন্থী এবং ইসলামপন্থীদের (তমদ্দুন মজলিস) অবদান যতটা সোচ্চারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগকে ততটাই আড়াল করা হয়েছে। অথচ ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ কোনো বানানো ভাষ্য নয়
ইদানীং ভাষা আন্দোলনের নিরপেক্ষ ইতিহাস লেখার চেষ্টা চলছে। যার যে অবদান আছে, তা স্বীকার করে নিতে হবে। আমরা হাতে যেন এমন একটা ইতিহাসগ্রন্থ পাই, যে গ্রন্থে অযাচিতভাবে বিভ্রান্ত বয়ান পরিবেশিত হবে না।
২.আমাদের একটা অভ্যাস আছে, সবকিছুকে সাদা আর কালো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। যাকে নায়ক বানানো হলো, তার চরিত্রে ন্যূনতম কালিমাও থাকবে না; আর যিনি ভিলেন, তার কোনো সদ্গুণ থাকতেই পারে না।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে মূল্যায়ন করা হয়। জিন্নাহর নাম নিলে আমরা প্রথমেই ধরে নিই, তিনি ইতিহাসের একজন নির্মম প্রতিনায়ক। অথচ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এসে উর্দুর সাফাই গেয়ে দেওয়া দুটি ভাষণে জিন্নাহর আচরণে হতাশ হলেও এ ভূখণ্ডের মানুষ কিন্তু তাঁকে সরাসরি ভিলেন বানাননি। এরপর বহু বছর ধরেই জিন্নাহর গুণগান করেছে পূর্ব বাংলার মানুষ। মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেও জিন্নাহর বলা কথাকে মূল্য দিয়েছে
পাকিস্তান আদায়ের জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল বাংলার মুসলমানরাই। কলকাতায় ঠাঁই নেওয়া হিন্দু জমিদারদের হটিয়ে এই অঞ্চলে মুসলিম পুঁজি বিকাশের একটা সুযোগ সৃষ্টি হওয়াকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিল মুসলমানরা। সেই আন্দোলনে মুসলিমদের পক্ষে মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
‘পাকিস্তান’ ছিল জিন্নাহর দর-কষাকষির একটা অস্ত্রমাত্র। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার মতো দলের নেতাদের একাংশের অনমনীয়তার কারণেই অখণ্ড ভারত কিংবা অখণ্ড বাংলা হতে পারেনি। এই দায় ভারতীয় হিন্দু নেতাদেরকেই বহুলাংশে নিতে হবে। আর এই দৃষ্টি থেকেই বিচার করতে হবে দেশভাগ-পরবর্তী রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের আচরণ। তাই কেউ যদি জিন্নাহর সাফাই গেয়ে কবিতা বা প্রবন্ধ লিখে থাকেন, তাহলে সেটা একেবারেই দোষের কিছু ছিল না। এমনকি ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন যখন চলছে, তখনো লাহোর প্রস্তাবের আলোচনা এলে (সেটা আসতেই হবে; কারণ, মুসলিম অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি সেখানে সন্নিবেশিত হয়েছিল) জিন্নাহর স্বপ্নের প্রসঙ্গ এসেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা কোটারি করে যখন পূর্ব বাংলাকে নানাভাবে শোষণ-বঞ্চনার পশ্চাদ্ভূমি বানাল, তখন থেকেই নিজ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিতে থাকল বাঙালি মুসলমান। তারই ফল ছয় দফার জয়জয়কার। জাতীয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি কটাক্ষ করেছেন, এমন উদাহরণ আছে বলে মনে হয় না
তাই কেউ যদি ইতিহাসের সেই কালপর্বে জিন্নাহর জয়গান গেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা হবে হাস্যকর। ইদানীং কেউ কেউ সে রকম কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশ্ন তুলছেন এবং ফর্মুলা অনুযায়ী এ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের ‘পাকিস্তানপ্রেমী’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। ভুলে গেলে চলবে না, জিন্নাহ ছিলেন পাকিস্তানের জাতির জনক। সেই জাতির জনককে অগ্রাহ্য করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে এবং সেই দেশের জাতির পিতা হয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান—ইতিহাসের এই অংশটুকু খুবই দলনিরপেক্ষভাবে লিখে রাখা জরুরি।
৩.স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে হাস্যকর ঘটনাগুলো এ দেশে ঘটে চলেছে, কিছুকাল বাদে সেই তর্কগুলোকে শিশুতোষ বা প্রলাপ মনে হবে। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল নায়ক যে শেখ মুজিবুর রহমান, সে কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় জিয়াউর রহমানকে প্রতিস্থাপন করতে পারেন না।
এই অশুভ রাজনৈতিক বয়ান তৈরি হতো না, যদি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত না হতেন এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় না আসতেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে রাজনৈতিক দল বানালেন, সেই দলই প্রথম ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’ বলে নতুন গল্পের জন্ম দিল। সেই সময় তারা ভেবেও দেখল না, আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। ২৬ মার্চেই এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে। সেদিনই আরও কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করেছিলেন কালুরঘাট থেকে। এম এ হান্নানও সেখানে গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণাটির আরেকটু বড় ভার্সন পাঠ করেছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন ২৭ মার্চ। বেলাল মোহাম্মদের কথার ওপর ভরসা রাখলে স্বীকার করতে হবে, এরপর আরও দুবার তিনি ঘোষণা পাঠ করেন। দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধুর নাম নেননি, তৃতীয়বার নিয়েছেন এবং সে ঘোষণা বারবার প্রচার করা হয়েছে।
এটা আসলে একেবারেই বিতর্কের বিষয় নয়। একজন অখ্যাত মেজর একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন আর দেশবাসী প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল—এটা কি কেউ বিশ্বাস করবে? দীর্ঘদিন ধরে চলা স্বাধিকার আন্দোলন তাতে মিথ্যে হয়ে যাবে, ছয় দফার কোনো দায় থাকবে না, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা সত্তরের নির্বাচনের ম্যান্ডেটও ইতিহাসে কোনো অবদান রাখবে না, ৭ মার্চের অনবদ্য ভাষণটিরও কোনো মূল্য থাকবে না—এর সবকিছু অগ্রাহ্য করে সত্যদর্শী ভবিষ্যৎ পাঠককে কি বিভ্রান্ত করা যাবে চিরকাল? বিএনপি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল নায়ক বানানোর যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তা শুধু অবান্তর নয়, জিয়াউর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় এই দাবিই করেননি।
ইতিহাসের সবচেয়ে নিরর্থক প্রশ্নটি একসময় পুরো জাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল, এ কথা স্মরণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হাসবে।
৪.মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে একটা বিতর্ক তোলা হয়েছে। যারা ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটিকে বিতর্কিত করে তুলতে চেয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য কী, সেই প্রশ্ন এড়ানো যাবে না। এটিও ইতিহাসের একটি নিরর্থক প্রশ্ন। নিজের জাতির আত্মত্যাগ প্রসঙ্গটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে আদর্শিকভাবে বিভক্ত একটি জাতিই। শুধু নিজের আদর্শ আঁকড়ে ধরার জন্য ইতিহাসের সত্যকে অগ্রাহ্য করার এ প্রয়াসে সততা নেই।
তার চেয়ে বড় কথা, শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কটা ওঠাতে হলো কেন? মুক্তিযুদ্ধে যদি ১০ লাখ কিংবা ২ লাখ মানুষও শহীদ হয়ে থাকেন, তাহলেও কি তার মূল্য কমে যাবে?
আরিফ আহমেদ একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৯৭১ সালে কীভাবে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের লারকানায় ইয়াহিয়া-ভুট্টোর হাঁস শিকার, ২২ ফেব্রুয়ারি সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার দম্ভোক্তি, ‘৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হলে ওরা আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না’, ‘অপারেশন ব্লিৎস’-এর প্রস্তুতি নেওয়া, সেটারই নাম বদলে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ করা ইত্যাদি ঘটনার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে, পাকিস্তানিরা একটা জেনোসাইডই চালাতে চেয়েছিল এখানে। এবং সেটাই তারা ঘটিয়েছিল একাত্তরের ৯ মাসজুড়ে।
গুনে গুনে ৩০ লাখ মানুষকেই হত্যা করা হয়েছে, তা হয়তো নয়। সংখ্যাটা এর বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে। কিন্তু প্রতীকী এই সংখ্যা নিয়ে কাদের মনে এত জ্বালাপোড়া? শহীদের সংখ্যা কমাতে পারলে কাদের লাভ? এই প্রশ্নগুলো উঠে আসা দরকার। সঙ্গে এই কথাও বলা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় দুই কোটি মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে। হিটলার বাহিনী হত্যাকাণ্ডের সময় সামরিক-বেসামরিক বাছবিচার করেনি। দুই কোটি সোভিয়েত নাগরিক শহীদ হয়েছে—এটাও একটি প্রতীকী সংখ্যা। সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো দায়িত্বশীল নাগরিক সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি।বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক এখানেই। নির্মোহ ইতিহাস একদিন প্রমাণ করবে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কটি স্থূল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এ রকম কিছু অযথা বিতর্কের রাশ টেনে ধরা দরকার। সে জন্য চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সত্যকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার সদিচ্ছা। একটি স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি থাকতে পারে, এ রকম আশ্চর্য ঘটনা কি পৃথিবীর আর কোথাও আছে? দেশকে এই অপমানটা যত দিন আমরা উপহার দিয়ে যাব, তত দিন রুচি ও নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে পারব না। ইতিহাস ঘাঁটলে এ রকম আরও অনেক উদাহরণ তুলে আনা যাবে। তাতে আমাদের রুচির দৈন্যই প্রকাশ পাবে কেবল।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একটি পর্যায় অতিক্রম করেছিল বাংলাদেশ। জয়ী হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে। সেই যুদ্ধের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে থাকায় এবং সেই প্রজন্মের মানুষেরা এখনো সেটি বর্ণনা করে চলায় তা অনেক সময় হয়ে উঠছে পক্ষপাতমূলক। নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা হয়তো শুরু হবে আরও কিছুটা কাল গেলেবর্তমান ইতিহাসচর্চা এতটাই রাজনৈতিক একদেশদর্শী যে ইতিহাসের ঘটনাগুলো লেখার সময়ও সেটুকু হাজির করা হয়, যা শুধু নিজ মতামতকে প্রমাণ করবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার সময় বামপন্থী এবং ইসলামপন্থীদের (তমদ্দুন মজলিস) অবদান যতটা সোচ্চারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগকে ততটাই আড়াল করা হয়েছে। অথচ ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ কোনো বানানো ভাষ্য নয়
ইদানীং ভাষা আন্দোলনের নিরপেক্ষ ইতিহাস লেখার চেষ্টা চলছে। যার যে অবদান আছে, তা স্বীকার করে নিতে হবে। আমরা হাতে যেন এমন একটা ইতিহাসগ্রন্থ পাই, যে গ্রন্থে অযাচিতভাবে বিভ্রান্ত বয়ান পরিবেশিত হবে না।
২.আমাদের একটা অভ্যাস আছে, সবকিছুকে সাদা আর কালো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। যাকে নায়ক বানানো হলো, তার চরিত্রে ন্যূনতম কালিমাও থাকবে না; আর যিনি ভিলেন, তার কোনো সদ্গুণ থাকতেই পারে না।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে মূল্যায়ন করা হয়। জিন্নাহর নাম নিলে আমরা প্রথমেই ধরে নিই, তিনি ইতিহাসের একজন নির্মম প্রতিনায়ক। অথচ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এসে উর্দুর সাফাই গেয়ে দেওয়া দুটি ভাষণে জিন্নাহর আচরণে হতাশ হলেও এ ভূখণ্ডের মানুষ কিন্তু তাঁকে সরাসরি ভিলেন বানাননি। এরপর বহু বছর ধরেই জিন্নাহর গুণগান করেছে পূর্ব বাংলার মানুষ। মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেও জিন্নাহর বলা কথাকে মূল্য দিয়েছে
পাকিস্তান আদায়ের জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল বাংলার মুসলমানরাই। কলকাতায় ঠাঁই নেওয়া হিন্দু জমিদারদের হটিয়ে এই অঞ্চলে মুসলিম পুঁজি বিকাশের একটা সুযোগ সৃষ্টি হওয়াকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিল মুসলমানরা। সেই আন্দোলনে মুসলিমদের পক্ষে মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
‘পাকিস্তান’ ছিল জিন্নাহর দর-কষাকষির একটা অস্ত্রমাত্র। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার মতো দলের নেতাদের একাংশের অনমনীয়তার কারণেই অখণ্ড ভারত কিংবা অখণ্ড বাংলা হতে পারেনি। এই দায় ভারতীয় হিন্দু নেতাদেরকেই বহুলাংশে নিতে হবে। আর এই দৃষ্টি থেকেই বিচার করতে হবে দেশভাগ-পরবর্তী রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের আচরণ। তাই কেউ যদি জিন্নাহর সাফাই গেয়ে কবিতা বা প্রবন্ধ লিখে থাকেন, তাহলে সেটা একেবারেই দোষের কিছু ছিল না। এমনকি ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন যখন চলছে, তখনো লাহোর প্রস্তাবের আলোচনা এলে (সেটা আসতেই হবে; কারণ, মুসলিম অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি সেখানে সন্নিবেশিত হয়েছিল) জিন্নাহর স্বপ্নের প্রসঙ্গ এসেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা কোটারি করে যখন পূর্ব বাংলাকে নানাভাবে শোষণ-বঞ্চনার পশ্চাদ্ভূমি বানাল, তখন থেকেই নিজ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিতে থাকল বাঙালি মুসলমান। তারই ফল ছয় দফার জয়জয়কার। জাতীয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি কটাক্ষ করেছেন, এমন উদাহরণ আছে বলে মনে হয় না
তাই কেউ যদি ইতিহাসের সেই কালপর্বে জিন্নাহর জয়গান গেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা হবে হাস্যকর। ইদানীং কেউ কেউ সে রকম কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশ্ন তুলছেন এবং ফর্মুলা অনুযায়ী এ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের ‘পাকিস্তানপ্রেমী’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। ভুলে গেলে চলবে না, জিন্নাহ ছিলেন পাকিস্তানের জাতির জনক। সেই জাতির জনককে অগ্রাহ্য করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে এবং সেই দেশের জাতির পিতা হয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান—ইতিহাসের এই অংশটুকু খুবই দলনিরপেক্ষভাবে লিখে রাখা জরুরি।
৩.স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে হাস্যকর ঘটনাগুলো এ দেশে ঘটে চলেছে, কিছুকাল বাদে সেই তর্কগুলোকে শিশুতোষ বা প্রলাপ মনে হবে। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল নায়ক যে শেখ মুজিবুর রহমান, সে কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় জিয়াউর রহমানকে প্রতিস্থাপন করতে পারেন না।
এই অশুভ রাজনৈতিক বয়ান তৈরি হতো না, যদি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত না হতেন এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় না আসতেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে রাজনৈতিক দল বানালেন, সেই দলই প্রথম ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’ বলে নতুন গল্পের জন্ম দিল। সেই সময় তারা ভেবেও দেখল না, আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। ২৬ মার্চেই এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে। সেদিনই আরও কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করেছিলেন কালুরঘাট থেকে। এম এ হান্নানও সেখানে গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণাটির আরেকটু বড় ভার্সন পাঠ করেছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন ২৭ মার্চ। বেলাল মোহাম্মদের কথার ওপর ভরসা রাখলে স্বীকার করতে হবে, এরপর আরও দুবার তিনি ঘোষণা পাঠ করেন। দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধুর নাম নেননি, তৃতীয়বার নিয়েছেন এবং সে ঘোষণা বারবার প্রচার করা হয়েছে।
এটা আসলে একেবারেই বিতর্কের বিষয় নয়। একজন অখ্যাত মেজর একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন আর দেশবাসী প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল—এটা কি কেউ বিশ্বাস করবে? দীর্ঘদিন ধরে চলা স্বাধিকার আন্দোলন তাতে মিথ্যে হয়ে যাবে, ছয় দফার কোনো দায় থাকবে না, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা সত্তরের নির্বাচনের ম্যান্ডেটও ইতিহাসে কোনো অবদান রাখবে না, ৭ মার্চের অনবদ্য ভাষণটিরও কোনো মূল্য থাকবে না—এর সবকিছু অগ্রাহ্য করে সত্যদর্শী ভবিষ্যৎ পাঠককে কি বিভ্রান্ত করা যাবে চিরকাল? বিএনপি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল নায়ক বানানোর যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তা শুধু অবান্তর নয়, জিয়াউর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় এই দাবিই করেননি।
ইতিহাসের সবচেয়ে নিরর্থক প্রশ্নটি একসময় পুরো জাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল, এ কথা স্মরণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হাসবে।
৪.মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে একটা বিতর্ক তোলা হয়েছে। যারা ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটিকে বিতর্কিত করে তুলতে চেয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য কী, সেই প্রশ্ন এড়ানো যাবে না। এটিও ইতিহাসের একটি নিরর্থক প্রশ্ন। নিজের জাতির আত্মত্যাগ প্রসঙ্গটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে আদর্শিকভাবে বিভক্ত একটি জাতিই। শুধু নিজের আদর্শ আঁকড়ে ধরার জন্য ইতিহাসের সত্যকে অগ্রাহ্য করার এ প্রয়াসে সততা নেই।
তার চেয়ে বড় কথা, শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কটা ওঠাতে হলো কেন? মুক্তিযুদ্ধে যদি ১০ লাখ কিংবা ২ লাখ মানুষও শহীদ হয়ে থাকেন, তাহলেও কি তার মূল্য কমে যাবে?
আরিফ আহমেদ একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৯৭১ সালে কীভাবে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের লারকানায় ইয়াহিয়া-ভুট্টোর হাঁস শিকার, ২২ ফেব্রুয়ারি সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার দম্ভোক্তি, ‘৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হলে ওরা আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না’, ‘অপারেশন ব্লিৎস’-এর প্রস্তুতি নেওয়া, সেটারই নাম বদলে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ করা ইত্যাদি ঘটনার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে, পাকিস্তানিরা একটা জেনোসাইডই চালাতে চেয়েছিল এখানে। এবং সেটাই তারা ঘটিয়েছিল একাত্তরের ৯ মাসজুড়ে।
গুনে গুনে ৩০ লাখ মানুষকেই হত্যা করা হয়েছে, তা হয়তো নয়। সংখ্যাটা এর বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে। কিন্তু প্রতীকী এই সংখ্যা নিয়ে কাদের মনে এত জ্বালাপোড়া? শহীদের সংখ্যা কমাতে পারলে কাদের লাভ? এই প্রশ্নগুলো উঠে আসা দরকার। সঙ্গে এই কথাও বলা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় দুই কোটি মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে। হিটলার বাহিনী হত্যাকাণ্ডের সময় সামরিক-বেসামরিক বাছবিচার করেনি। দুই কোটি সোভিয়েত নাগরিক শহীদ হয়েছে—এটাও একটি প্রতীকী সংখ্যা। সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো দায়িত্বশীল নাগরিক সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি।বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক এখানেই। নির্মোহ ইতিহাস একদিন প্রমাণ করবে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কটি স্থূল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এ রকম কিছু অযথা বিতর্কের রাশ টেনে ধরা দরকার। সে জন্য চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সত্যকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার সদিচ্ছা। একটি স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি থাকতে পারে, এ রকম আশ্চর্য ঘটনা কি পৃথিবীর আর কোথাও আছে? দেশকে এই অপমানটা যত দিন আমরা উপহার দিয়ে যাব, তত দিন রুচি ও নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে পারব না। ইতিহাস ঘাঁটলে এ রকম আরও অনেক উদাহরণ তুলে আনা যাবে। তাতে আমাদের রুচির দৈন্যই প্রকাশ পাবে কেবল।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪