আবু জাফর শামসুদ্দীন
শুনলাম, ঈদের বড় বড় জামাতে সেনাবাহিনী নিযুক্ত লোকরাই বোমা মারবে। উদ্দেশ্য, মুক্তিবাহিনীকে unpopular করা। কি চমৎকার বুদ্ধি! মানুষও ওয়ার্নিং পেয়ে গেছে। বোকারা ছাড়া কেউ ঈদের বড় জামাতে যাবে বলে মনে হয় না।
তা ছাড়া জুমা ও ঈদের নামাজ পড়া এখন এ দেশে জায়েজও নয়।
১৭ থেকে ২২শে পর্যন্ত ঈদের ছুটি। ১৭ তারিখ ২৭শে রমজান। সকালে বেড়াতে বেরিয়ে দেখি সড়ক জনমানবশূন্য। ছোট ছেলেটাও কুকুর নিয়ে বেরিয়েছিল। একটা কিছু আশঙ্কা করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে শুনলাম, অনির্দিষ্টকালের জন্যে সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে।
ঘরে বসে রইলাম। রাত সাড়ে আটটায় সান্ধ্য আইন প্রত্যাহৃত হলো। কার্ফুর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার লোককে গ্রেফতার, বেশ কিছু লোককে হত্যা এবং মারপিট করা হয়। দু’জন এম. বি. বি. এস. ডাক্তার (একজনের নাম বোধ করি জহিরুল হক) ধানমণ্ডিতে পাশাপাশি বাড়ীতে থাকতেন। ওদের দু’জনকে গলাটিপে হত্যা করে নটর ডেম কলেজ সংলগ্ন পুলের নিকটে ফেলে যায়।
কার্ফু প্রত্যাহারের সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ।
ঈদের দিন শনিবার। যুদ্ধকালে কোনো জামাত জায়েজ নয়। নামাজে যাইনি। কনিষ্ঠ পুত্র কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে সকাল নয়টায় সিদ্দিক বাজারের উদ্দেশে বেরুলাম। রিকশায় চড়ে দেখি সড়ক জনমানবশূন্য। টেলিভিশন আফিসের (ডি. আই. টি. বিল্ডিং) সমুখে যেতে রিকশা ফিরিয়ে দিল। ট্রাকে ট্রাকে টহল ও পাহারায়ও মিলিটারি।
স্টেডিয়ামে আবদুর রহমান বেখোদের ইমামতিতে অনুষ্ঠিত জামাতে বোধ করি ৫ / ৭ শত লোক হয়েছিল—অধিকাংশ বিহারী। ওরা দু’চার জন করে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল।
ঘুরে সেক্রেটারিয়েটের কোণ হয়ে জিন্নাহ এভেন্যুর পিছন দিয়ে গুলিস্তান সিনেমার পাশ দিয়ে পুনরায় জিন্নাহ এভেন্যুতে পড়ে কোনোক্রমে সিদ্দিকবাজারে মেজো ছেলের শ্বশুর কাজী হাবিবুল্লাহ সাহেবের বাসায় যাওয়ার সময় দেখলাম বায়তুল মোকাররম মসজিদে মিলিটারি পাহারায় ঈদের জামাত হচ্ছে। এ মসজিদেও বোধ করি হাজারখানিক লোকের বেশি হয়নি। সিদ্দিক বাজার হতে ফেরত আসার সময়ও দেখলাম, সড়ক তেমনি জনমানবশূন্য। কচিৎ দু’একটি মোটর গাড়ী দেখা যায়। দুঃসাহসী ব্যক্তিরা বোধ করি ঈদের মোলাকাত করতে যাচ্ছে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। বেলা তিনটে পর্যন্ত শহর এমনি জনশূন্য ছিল। ২৭শে মার্চ শহর যে-রকম জনশূন্য ছিল আজকের অবস্থাও তাই। তিনটার পর কিছু কিছু লোক সড়কে বেরোয়।
একুশে নভেম্বর রবিবার দিন জহুরের (জহুর হোসেন চৌধুরী) ওখানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম টেক্সটাইল মিল ও চা বাগানের মালিক মকবুলুর রহমানকে (নওয়াব মোশাররফ হোসেনের ভ্রাতুষ্পুত্র)। মকবুলুর রহমান জামাতে ইসলামীর টিকেটে জলপাইগুড়ি সীমান্তে এক নির্বাচনী এলাকা থেকে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে ফেল করেন। আবারও তথাকথিত বাই ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারছেন না। বললেন, এবারের মতো এত বড় ঈদের জামাত নাকি তিনি পল্টন ময়দানে আর কখনও দেখেননি, বায়তুল মোকাররমেও তাই। লোকজন নাকি পুরোদমে ঈদ করছে।
কিছু বললাম না। জহুর আমাকে বহু আগেই মকবুলুর রহমানের সাথে তর্কবিতর্কে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “মকবুল আমার ক্লাস ফ্রেন্ড—তার সঙ্গে আমার খিস্তিখেউড় চলে, সে আমার ক্ষতি করবে না, কিন্তু আপনাকে জাফরভাই ছাড়বে না, মকবুল সাংঘাতিক লোক।”
মকবুলুর রহমান চলে গেলে জহুরকে বললাম, এমন blatent lies—নির্জলা মিথ্যা মানুষ কেমন করে বলতে পারে। নিজে শহরে না বেরোতাম তাহলেও না হয় বুঝতাম। আসলে শহরের অর্ধেক লোক নামাজে যায়নি। বাকীরা মসজিদ বা পাড়ায় পড়েছে। বহু বাড়ীতে সাধারণ ভাত সালুন পাক হয়। বহু বাড়ীতে সেমাই কেনা হয়নি।
আমি নিজে ছেলেমেয়েদের জন্যে নতুন জামাকাপড় ক্রয় করিনি। নাতি-নাতনীরা আছে। ওদের জন্যে দেশী চাউলের সেমাই এবং কিছু গোশত পাক করা হয়েছিল।
আমার জীবনে এই প্রথম ঈদের জামাতে শরিক হইনি। জুমার নামাজ বর্জন করেছি আজ কয়েক মাস যাবৎ।
আত্মস্মৃতি বই থেকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা শহরের ঈদ কেমন ছিল, তার বর্ণনা।
যে চিকিৎসকের নাম লিখেছেন তিনি, সেটি হবে ডা. আজহারুল হক। একই সঙ্গে শহীদ হয়েছিলেন ডা. এ বি এম হুমায়ূন কবির।
আবু জাফর শামসুদ্দীন, লেখক ও সাংবাদিক
শুনলাম, ঈদের বড় বড় জামাতে সেনাবাহিনী নিযুক্ত লোকরাই বোমা মারবে। উদ্দেশ্য, মুক্তিবাহিনীকে unpopular করা। কি চমৎকার বুদ্ধি! মানুষও ওয়ার্নিং পেয়ে গেছে। বোকারা ছাড়া কেউ ঈদের বড় জামাতে যাবে বলে মনে হয় না।
তা ছাড়া জুমা ও ঈদের নামাজ পড়া এখন এ দেশে জায়েজও নয়।
১৭ থেকে ২২শে পর্যন্ত ঈদের ছুটি। ১৭ তারিখ ২৭শে রমজান। সকালে বেড়াতে বেরিয়ে দেখি সড়ক জনমানবশূন্য। ছোট ছেলেটাও কুকুর নিয়ে বেরিয়েছিল। একটা কিছু আশঙ্কা করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে শুনলাম, অনির্দিষ্টকালের জন্যে সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে।
ঘরে বসে রইলাম। রাত সাড়ে আটটায় সান্ধ্য আইন প্রত্যাহৃত হলো। কার্ফুর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার লোককে গ্রেফতার, বেশ কিছু লোককে হত্যা এবং মারপিট করা হয়। দু’জন এম. বি. বি. এস. ডাক্তার (একজনের নাম বোধ করি জহিরুল হক) ধানমণ্ডিতে পাশাপাশি বাড়ীতে থাকতেন। ওদের দু’জনকে গলাটিপে হত্যা করে নটর ডেম কলেজ সংলগ্ন পুলের নিকটে ফেলে যায়।
কার্ফু প্রত্যাহারের সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ।
ঈদের দিন শনিবার। যুদ্ধকালে কোনো জামাত জায়েজ নয়। নামাজে যাইনি। কনিষ্ঠ পুত্র কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে সকাল নয়টায় সিদ্দিক বাজারের উদ্দেশে বেরুলাম। রিকশায় চড়ে দেখি সড়ক জনমানবশূন্য। টেলিভিশন আফিসের (ডি. আই. টি. বিল্ডিং) সমুখে যেতে রিকশা ফিরিয়ে দিল। ট্রাকে ট্রাকে টহল ও পাহারায়ও মিলিটারি।
স্টেডিয়ামে আবদুর রহমান বেখোদের ইমামতিতে অনুষ্ঠিত জামাতে বোধ করি ৫ / ৭ শত লোক হয়েছিল—অধিকাংশ বিহারী। ওরা দু’চার জন করে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল।
ঘুরে সেক্রেটারিয়েটের কোণ হয়ে জিন্নাহ এভেন্যুর পিছন দিয়ে গুলিস্তান সিনেমার পাশ দিয়ে পুনরায় জিন্নাহ এভেন্যুতে পড়ে কোনোক্রমে সিদ্দিকবাজারে মেজো ছেলের শ্বশুর কাজী হাবিবুল্লাহ সাহেবের বাসায় যাওয়ার সময় দেখলাম বায়তুল মোকাররম মসজিদে মিলিটারি পাহারায় ঈদের জামাত হচ্ছে। এ মসজিদেও বোধ করি হাজারখানিক লোকের বেশি হয়নি। সিদ্দিক বাজার হতে ফেরত আসার সময়ও দেখলাম, সড়ক তেমনি জনমানবশূন্য। কচিৎ দু’একটি মোটর গাড়ী দেখা যায়। দুঃসাহসী ব্যক্তিরা বোধ করি ঈদের মোলাকাত করতে যাচ্ছে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। বেলা তিনটে পর্যন্ত শহর এমনি জনশূন্য ছিল। ২৭শে মার্চ শহর যে-রকম জনশূন্য ছিল আজকের অবস্থাও তাই। তিনটার পর কিছু কিছু লোক সড়কে বেরোয়।
একুশে নভেম্বর রবিবার দিন জহুরের (জহুর হোসেন চৌধুরী) ওখানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম টেক্সটাইল মিল ও চা বাগানের মালিক মকবুলুর রহমানকে (নওয়াব মোশাররফ হোসেনের ভ্রাতুষ্পুত্র)। মকবুলুর রহমান জামাতে ইসলামীর টিকেটে জলপাইগুড়ি সীমান্তে এক নির্বাচনী এলাকা থেকে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে ফেল করেন। আবারও তথাকথিত বাই ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারছেন না। বললেন, এবারের মতো এত বড় ঈদের জামাত নাকি তিনি পল্টন ময়দানে আর কখনও দেখেননি, বায়তুল মোকাররমেও তাই। লোকজন নাকি পুরোদমে ঈদ করছে।
কিছু বললাম না। জহুর আমাকে বহু আগেই মকবুলুর রহমানের সাথে তর্কবিতর্কে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “মকবুল আমার ক্লাস ফ্রেন্ড—তার সঙ্গে আমার খিস্তিখেউড় চলে, সে আমার ক্ষতি করবে না, কিন্তু আপনাকে জাফরভাই ছাড়বে না, মকবুল সাংঘাতিক লোক।”
মকবুলুর রহমান চলে গেলে জহুরকে বললাম, এমন blatent lies—নির্জলা মিথ্যা মানুষ কেমন করে বলতে পারে। নিজে শহরে না বেরোতাম তাহলেও না হয় বুঝতাম। আসলে শহরের অর্ধেক লোক নামাজে যায়নি। বাকীরা মসজিদ বা পাড়ায় পড়েছে। বহু বাড়ীতে সাধারণ ভাত সালুন পাক হয়। বহু বাড়ীতে সেমাই কেনা হয়নি।
আমি নিজে ছেলেমেয়েদের জন্যে নতুন জামাকাপড় ক্রয় করিনি। নাতি-নাতনীরা আছে। ওদের জন্যে দেশী চাউলের সেমাই এবং কিছু গোশত পাক করা হয়েছিল।
আমার জীবনে এই প্রথম ঈদের জামাতে শরিক হইনি। জুমার নামাজ বর্জন করেছি আজ কয়েক মাস যাবৎ।
আত্মস্মৃতি বই থেকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা শহরের ঈদ কেমন ছিল, তার বর্ণনা।
যে চিকিৎসকের নাম লিখেছেন তিনি, সেটি হবে ডা. আজহারুল হক। একই সঙ্গে শহীদ হয়েছিলেন ডা. এ বি এম হুমায়ূন কবির।
আবু জাফর শামসুদ্দীন, লেখক ও সাংবাদিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪