নূহ-উল-আলম লেনিন
স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে একটি মানুষ—নিথর, নিস্পন্দ। পাশে একগুচ্ছ ফুলের শব। কোথাও কেউ নেই। অনুগ্রহভাজন, কৃপাপ্রার্থী, স্তাবক, ভক্ত, অনুরাগী, পারিষদবর্গ—কেউ নেই। চারদিকে কেবল নৈঃশব্দ্যের তর্জনী।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। রাতের প্রায় শেষ প্রহর। পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন বাংলাদেশ। অকস্মাৎ রিকয়েললেস রাইফেল আর কামানের মুহুর্মুহু গর্জন। ভেঙে খান খান রাতের মৌনতা। তারপর আবার সব সুনসান। কেবল বাতাস কেঁদে ফেরে শব্দহীন আর্তনাদে। নিত্যদিনের মতোই সূর্য উঁকি মারে। অদূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের সকরুণ ধ্বনি। ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির ওপর আলো পড়তেই শিউরে ওঠে নিখিল চরাচর। সিঁড়িতে পড়ে আছেন রক্তাপ্লুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির নতুন ইতিহাসের নির্মাতা। কালো গিলাফে ঢাকা পড়ে বাংলাদেশের বাঙালির ইতিহাস।
বদলে যায় দৃশ্যপট। বেতারে খুনি মেজর ডালিমের সদম্ভ ঘোষণা। ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে। অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! রুদ্ধশ্বাস মানুষ অপেক্ষা করেন, হয়তো এক্ষুনি শোনা যাবে সেই বজ্রকণ্ঠের অভয় বাণী। অথবা নতুন যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান। না, তার বদলে এ কার কণ্ঠস্বর! বেদখল বাংলাদেশে স্বঘোষিত শিখণ্ডী ‘প্রেসিডেন্ট’ খন্দকার মোশতাকের বেতার ভাষণ। এ-ও কি সম্ভব? অবিশ্বাস কাটে না মানুষের। বেলা বাড়ে। ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ। বেতারে, মাইকে কারফিউর ঘন ঘন ঘোষণা। সারা দেশে সামরিক আইন জারি।
অপরূপ সাজে সজ্জিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবেন। রাত জেগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু দিনের আলো না ফুটতেই এল সেই দুঃসহ মর্মচেরা বার্তা। কলাভবনে অবস্থানকালেই সবাই জানতে পারেন, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। একটা অকথিত অসাড়, অবসন্নতা গ্রাস করে সমস্ত দেহমনকে। কিন্তু সে কেবল পল কয়েকের জন্য। আকস্মিক বেদনার ঘোর কাটিয়ে উঠে প্রতিজ্ঞায় টান টান হয়ে ওঠে উপস্থিত কেউ কেউ: ‘আমাদের একটা কিছু করতে হবে।’ এই প্রবল তাড়না তাদের করে তোলে সংক্ষুব্ধ। কিন্তু না, কেউ দায়িত্ব নিয়ে, সাহস নিয়ে এগিয়ে এল না। ভীতসন্ত্রস্ত শেখ শহীদুল ইসলাম, জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধুর ভাগনে, অক্ষম আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিশেহারা। আমরা জাতীয় ছাত্রলীগের নেতারা, যে যেখানে ছিলাম, চেষ্টা করি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার। তাঁদের কেউ কেউ আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। তাৎক্ষণিক মোকাবিলার নির্দেশ দিতে, ভরসা দিতে অক্ষম। অথচ এই আমরাই ১৯৭১-এ কারও নির্দেশের অপেক্ষা করিনি।
সত্য বটে, সকাল ৬টার বেতার ঘোষণা শুনেও সাহস হারাইনি। আমরা ছোটাছুটি করেছি। একটা কিছু করার তাড়না অনুভব করেছি। চেয়েছি, কেউ আমাদের বলে দিক। মনে মনে তখনো আশা ছিল, হয়তো সব সত্য নয়। হয়তো এখনই রক্ষীবাহিনী বেরিয়ে পড়বে। তোফায়েল ভাই তো আছেন। হয়তো জেনারেল সফিউল্লাহ কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্রোহ দমনের ঘোষণা দেবেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।
কিন্তু না, এসবের কিছু হয়নি সেদিন। বেলা বাড়তেই শুরু হয় নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা। কিছুক্ষণ পর নেপথ্য থেকে সরাসরি বাস্তব দৃশ্যপটে আবির্ভূত স্বয়ং মোশতাক। জাতির উদ্দেশে নতুন রাষ্ট্রপতির বেতার ভাষণ।
অতঃপর চমক। একের পর এক। সত্যি সত্যিই বেতারে নতুন ‘প্রেসিডেন্টের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা। সেনা, বিমান, নৌবাহিনীসহ সব বাহিনীর প্রধানেরা। একের পর এক দৃশ্য। মঞ্চজুড়ে কুশীলবদের পদভারে ক্ষতবিক্ষত স্বদেশের মানচিত্র, ফুসমন্তরে মন্ত্রী হলো রাজা। পারিষদেরা রইল ঠিক। বাংলাদেশ বেতার হলো ‘রেডিও বাংলাদেশ’। বুকজুড়ে আমাদের সংক্রমিত হলো হিমশীতল ভয়—এই না দেশটা পাকিস্তান হয়ে যায়।
নিস্তব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বত্র শঙ্কা ও ঘোর অনিশ্চয়তার ছায়া। ট্যাংক এল বিশ্ববিদ্যালয়ে। হলের সামনে ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে, কোথাও হল গেটে খুনি মেজরদের বক্তৃতা। ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি: সাবধান, মার্শাল ল ভাঙার চেষ্টা করলেই গুলি! কেউ ঘর থেকে বেরোবে না।
আগেই বলেছি, ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন ও বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়ার কথা। বস্তুত রাষ্ট্রপতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা জানানোর লক্ষ্যে বেশ কদিন আগে থেকেই আমরা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম। ১৪ আগস্ট রাতেও ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব জামান, জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা ইসমাত কাদির গামা, ওবায়দুল কাদের, রবিউল মুকতাদির চৌধুরী, কাজী আকরাম হোসেন, অজয় দাশগুপ্ত, আমিসহ ৫০-৬০ জন কর্মী কলাভবনের ডিন অফিস ও ডাকসু অফিসে সারা রাত অবস্থান করি এবং প্রস্তুতির কাজ সারি। রাত ১১টা পর্যন্ত সদ্য বিবাহিত শেখ কামালও ছিলেন। তাঁকে আমরা একরকম জোর করেই বাসায় পাঠিয়ে দিই।
রাত সাড়ে ৪টার দিকে প্রাতঃকৃত্য ও গোসল সেরে জহুরুল হক হলে আসি। মিহি অন্ধকার থাকতে থাকতেই খুনিরা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ৩২ নম্বরের ভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। নিহত হন বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়ও। গোসল করতে করতে উত্তর দিক থেকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনেছি। কিন্তু অনুমানও করতে পারিনি, কী নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। রেডিও থেকে অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর দৌড়ে এসে জানায় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী মান্নান খান। আমিও দৌড়ে সম্ভবত ১৩৭ নম্বর কক্ষে ওদের রেডিও শুনতে গেলাম। শুনলাম হিমশীতল করা সেই খবর ও মেজর ডালিমের ঘোষণা।
মুহূর্তেই স্থির করলাম, কলাভবনে সহকর্মীদের কাছে যাব। কলাভবনে গিয়ে দেখি, ছাত্রনেতারা কেউ নেই। পেলাম জাতীয় ছাত্রলীগের সদস্য চন্দন চৌধুরীকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। পরে শুনেছি, সেলিমসহ জাতীয় ছাত্রলীগের নেতারা সেন্ট্রাল রোডে শেখ শহীদের বাসায় যান ইতিকর্তব্য ঠিক করতে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতায় ভীতসন্ত্রস্ত শেখ শহীদ কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ দিতে অপারগতা জানান। ওঁরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
এদিকে আমি চন্দন চৌধুরীকে নিয়ে পুরান ঢাকায় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের বাসায় যাই। সে পার্টি হাইকমান্ডের কোনো খবর জানাতে পারল না। আমি প্রথমে বাকশাল নেতা আব্দুর রাজ্জাকের বাসায় এবং পরে তোফায়েল আহমেদের বাসায় ফোন করি। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকে ফোন করি। ফরহাদ ভাইকে পেয়ে যাই। তিনি আপাতত নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিলেন। জালাল, চন্দন ও আমি ঠিক করলাম হলে বা বাসায় না থেকে অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার। চন্দনকে নিয়ে বকশীবাজারে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী মোস্তাহিদ ভাইদের বাসায় উঠি। ওই বাসায় থেকেই টেলিভিশনের পর্দায় নাটকের অন্যান্য দৃশ্য দেখলাম।
সন্ধ্যার আবছায়া নামার আগেই বঙ্গভবনে উন্মোচিত ১৫ আগস্ট প্রহসনের শেষ দৃশ্য। খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ। পরিচিত সব মুখ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য—আব্দুল মান্নান, আব্দুল মমিন, আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আসাদুজ্জামান খান, ড. এ আর মল্লিক, ড. মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর ও সোহরাব হোসেন পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং কে এম ওবায়দুর রহমান। ছায়াচ্ছন্ন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল ঝাড়বাতি শোভিত বঙ্গভবনের দরবার হলে নতুন রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রিসভার অভিষেক ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দৃশ্য। ৩২ নম্বরের বাড়িতে তখনো বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে।
এসব দেখেশুনে আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের সকল আশা ভেঙে পড়ে। এর মধ্যেই ২০ আগস্ট খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আরও পাঁচজন। আমরা ছাত্রসমাজও কিছু করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এটি ছিল আমাদের সম্মিলিত পাপ। তবে প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে দ্রুতই আমরা, জাতীয় ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ও কর্তব্য নির্ধারণ করতে সক্ষম হই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই ঢাকা মহানগরীর পাড়ায় পাড়ায় যোগাযোগ করি। টার্গেট, বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু করব।
সে কাজটি আমরা করেছি। ভীরুতা ও কাপুরুষতা ছুড়ে ফেলে আমরা আমাদের পাপ মোচনের জন্য নতুন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি।
লেখক: সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে একটি মানুষ—নিথর, নিস্পন্দ। পাশে একগুচ্ছ ফুলের শব। কোথাও কেউ নেই। অনুগ্রহভাজন, কৃপাপ্রার্থী, স্তাবক, ভক্ত, অনুরাগী, পারিষদবর্গ—কেউ নেই। চারদিকে কেবল নৈঃশব্দ্যের তর্জনী।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। রাতের প্রায় শেষ প্রহর। পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন বাংলাদেশ। অকস্মাৎ রিকয়েললেস রাইফেল আর কামানের মুহুর্মুহু গর্জন। ভেঙে খান খান রাতের মৌনতা। তারপর আবার সব সুনসান। কেবল বাতাস কেঁদে ফেরে শব্দহীন আর্তনাদে। নিত্যদিনের মতোই সূর্য উঁকি মারে। অদূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের সকরুণ ধ্বনি। ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির ওপর আলো পড়তেই শিউরে ওঠে নিখিল চরাচর। সিঁড়িতে পড়ে আছেন রক্তাপ্লুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির নতুন ইতিহাসের নির্মাতা। কালো গিলাফে ঢাকা পড়ে বাংলাদেশের বাঙালির ইতিহাস।
বদলে যায় দৃশ্যপট। বেতারে খুনি মেজর ডালিমের সদম্ভ ঘোষণা। ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে। অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! রুদ্ধশ্বাস মানুষ অপেক্ষা করেন, হয়তো এক্ষুনি শোনা যাবে সেই বজ্রকণ্ঠের অভয় বাণী। অথবা নতুন যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান। না, তার বদলে এ কার কণ্ঠস্বর! বেদখল বাংলাদেশে স্বঘোষিত শিখণ্ডী ‘প্রেসিডেন্ট’ খন্দকার মোশতাকের বেতার ভাষণ। এ-ও কি সম্ভব? অবিশ্বাস কাটে না মানুষের। বেলা বাড়ে। ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ। বেতারে, মাইকে কারফিউর ঘন ঘন ঘোষণা। সারা দেশে সামরিক আইন জারি।
অপরূপ সাজে সজ্জিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবেন। রাত জেগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু দিনের আলো না ফুটতেই এল সেই দুঃসহ মর্মচেরা বার্তা। কলাভবনে অবস্থানকালেই সবাই জানতে পারেন, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। একটা অকথিত অসাড়, অবসন্নতা গ্রাস করে সমস্ত দেহমনকে। কিন্তু সে কেবল পল কয়েকের জন্য। আকস্মিক বেদনার ঘোর কাটিয়ে উঠে প্রতিজ্ঞায় টান টান হয়ে ওঠে উপস্থিত কেউ কেউ: ‘আমাদের একটা কিছু করতে হবে।’ এই প্রবল তাড়না তাদের করে তোলে সংক্ষুব্ধ। কিন্তু না, কেউ দায়িত্ব নিয়ে, সাহস নিয়ে এগিয়ে এল না। ভীতসন্ত্রস্ত শেখ শহীদুল ইসলাম, জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধুর ভাগনে, অক্ষম আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিশেহারা। আমরা জাতীয় ছাত্রলীগের নেতারা, যে যেখানে ছিলাম, চেষ্টা করি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার। তাঁদের কেউ কেউ আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। তাৎক্ষণিক মোকাবিলার নির্দেশ দিতে, ভরসা দিতে অক্ষম। অথচ এই আমরাই ১৯৭১-এ কারও নির্দেশের অপেক্ষা করিনি।
সত্য বটে, সকাল ৬টার বেতার ঘোষণা শুনেও সাহস হারাইনি। আমরা ছোটাছুটি করেছি। একটা কিছু করার তাড়না অনুভব করেছি। চেয়েছি, কেউ আমাদের বলে দিক। মনে মনে তখনো আশা ছিল, হয়তো সব সত্য নয়। হয়তো এখনই রক্ষীবাহিনী বেরিয়ে পড়বে। তোফায়েল ভাই তো আছেন। হয়তো জেনারেল সফিউল্লাহ কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্রোহ দমনের ঘোষণা দেবেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।
কিন্তু না, এসবের কিছু হয়নি সেদিন। বেলা বাড়তেই শুরু হয় নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা। কিছুক্ষণ পর নেপথ্য থেকে সরাসরি বাস্তব দৃশ্যপটে আবির্ভূত স্বয়ং মোশতাক। জাতির উদ্দেশে নতুন রাষ্ট্রপতির বেতার ভাষণ।
অতঃপর চমক। একের পর এক। সত্যি সত্যিই বেতারে নতুন ‘প্রেসিডেন্টের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা। সেনা, বিমান, নৌবাহিনীসহ সব বাহিনীর প্রধানেরা। একের পর এক দৃশ্য। মঞ্চজুড়ে কুশীলবদের পদভারে ক্ষতবিক্ষত স্বদেশের মানচিত্র, ফুসমন্তরে মন্ত্রী হলো রাজা। পারিষদেরা রইল ঠিক। বাংলাদেশ বেতার হলো ‘রেডিও বাংলাদেশ’। বুকজুড়ে আমাদের সংক্রমিত হলো হিমশীতল ভয়—এই না দেশটা পাকিস্তান হয়ে যায়।
নিস্তব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বত্র শঙ্কা ও ঘোর অনিশ্চয়তার ছায়া। ট্যাংক এল বিশ্ববিদ্যালয়ে। হলের সামনে ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে, কোথাও হল গেটে খুনি মেজরদের বক্তৃতা। ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি: সাবধান, মার্শাল ল ভাঙার চেষ্টা করলেই গুলি! কেউ ঘর থেকে বেরোবে না।
আগেই বলেছি, ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন ও বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়ার কথা। বস্তুত রাষ্ট্রপতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা জানানোর লক্ষ্যে বেশ কদিন আগে থেকেই আমরা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম। ১৪ আগস্ট রাতেও ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব জামান, জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা ইসমাত কাদির গামা, ওবায়দুল কাদের, রবিউল মুকতাদির চৌধুরী, কাজী আকরাম হোসেন, অজয় দাশগুপ্ত, আমিসহ ৫০-৬০ জন কর্মী কলাভবনের ডিন অফিস ও ডাকসু অফিসে সারা রাত অবস্থান করি এবং প্রস্তুতির কাজ সারি। রাত ১১টা পর্যন্ত সদ্য বিবাহিত শেখ কামালও ছিলেন। তাঁকে আমরা একরকম জোর করেই বাসায় পাঠিয়ে দিই।
রাত সাড়ে ৪টার দিকে প্রাতঃকৃত্য ও গোসল সেরে জহুরুল হক হলে আসি। মিহি অন্ধকার থাকতে থাকতেই খুনিরা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ৩২ নম্বরের ভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। নিহত হন বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়ও। গোসল করতে করতে উত্তর দিক থেকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনেছি। কিন্তু অনুমানও করতে পারিনি, কী নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। রেডিও থেকে অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর দৌড়ে এসে জানায় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী মান্নান খান। আমিও দৌড়ে সম্ভবত ১৩৭ নম্বর কক্ষে ওদের রেডিও শুনতে গেলাম। শুনলাম হিমশীতল করা সেই খবর ও মেজর ডালিমের ঘোষণা।
মুহূর্তেই স্থির করলাম, কলাভবনে সহকর্মীদের কাছে যাব। কলাভবনে গিয়ে দেখি, ছাত্রনেতারা কেউ নেই। পেলাম জাতীয় ছাত্রলীগের সদস্য চন্দন চৌধুরীকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। পরে শুনেছি, সেলিমসহ জাতীয় ছাত্রলীগের নেতারা সেন্ট্রাল রোডে শেখ শহীদের বাসায় যান ইতিকর্তব্য ঠিক করতে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতায় ভীতসন্ত্রস্ত শেখ শহীদ কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ দিতে অপারগতা জানান। ওঁরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
এদিকে আমি চন্দন চৌধুরীকে নিয়ে পুরান ঢাকায় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের বাসায় যাই। সে পার্টি হাইকমান্ডের কোনো খবর জানাতে পারল না। আমি প্রথমে বাকশাল নেতা আব্দুর রাজ্জাকের বাসায় এবং পরে তোফায়েল আহমেদের বাসায় ফোন করি। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকে ফোন করি। ফরহাদ ভাইকে পেয়ে যাই। তিনি আপাতত নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিলেন। জালাল, চন্দন ও আমি ঠিক করলাম হলে বা বাসায় না থেকে অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার। চন্দনকে নিয়ে বকশীবাজারে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী মোস্তাহিদ ভাইদের বাসায় উঠি। ওই বাসায় থেকেই টেলিভিশনের পর্দায় নাটকের অন্যান্য দৃশ্য দেখলাম।
সন্ধ্যার আবছায়া নামার আগেই বঙ্গভবনে উন্মোচিত ১৫ আগস্ট প্রহসনের শেষ দৃশ্য। খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ। পরিচিত সব মুখ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য—আব্দুল মান্নান, আব্দুল মমিন, আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আসাদুজ্জামান খান, ড. এ আর মল্লিক, ড. মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর ও সোহরাব হোসেন পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং কে এম ওবায়দুর রহমান। ছায়াচ্ছন্ন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল ঝাড়বাতি শোভিত বঙ্গভবনের দরবার হলে নতুন রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রিসভার অভিষেক ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দৃশ্য। ৩২ নম্বরের বাড়িতে তখনো বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে।
এসব দেখেশুনে আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের সকল আশা ভেঙে পড়ে। এর মধ্যেই ২০ আগস্ট খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আরও পাঁচজন। আমরা ছাত্রসমাজও কিছু করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এটি ছিল আমাদের সম্মিলিত পাপ। তবে প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে দ্রুতই আমরা, জাতীয় ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ও কর্তব্য নির্ধারণ করতে সক্ষম হই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই ঢাকা মহানগরীর পাড়ায় পাড়ায় যোগাযোগ করি। টার্গেট, বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু করব।
সে কাজটি আমরা করেছি। ভীরুতা ও কাপুরুষতা ছুড়ে ফেলে আমরা আমাদের পাপ মোচনের জন্য নতুন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি।
লেখক: সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪