আজাদুর রহমান চন্দন
২০২০ থেকে ২০২১ সাল—বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এক যুদ্ধকালই পেরিয়েছে বলা যায়। নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামের এক প্রাণঘাতী ভাইরাস দেশে দেশে অতি দ্রুত ছড়িয়ে মানুষের ফুসফুসকে আক্রান্ত করে শ্বাসপ্রশ্বাস থামিয়ে দিচ্ছিল। ফলে সবখানে বাড়ছিল মৃত্যুর মিছিল। তখন মানুষের শ্বাসযন্ত্র চালু রাখার যুদ্ধে নামতে হয়েছিল দুনিয়ার তাবৎ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর। কোভিডে আক্রান্ত বহু কোটি মানুষকে শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচাতে অক্সিজেনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। অক্সিজেন না পেয়ে বহু রোগীর মৃত্যু ঘটে দেশে দেশে। এমনই এক মহাসংকটকালে বিপুল আশাজাগানিয়া উদ্ভাবন সামনে এনেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ‘অক্সিজেট’ নামের এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেন, যা সাধারণ যন্ত্রের চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে যন্ত্রটি বানানোর খরচও বিস্ময়কর রকম কম। অক্সিজেট একটি নন-ইনভেসিভ সিপ্যাপ ভেন্টিলেটর। অনেক সময়ক্ষেপণের পর প্রাথমিক ধাপের কয়েকটি পরীক্ষা শেষে ২০২১ সালের জুলাই মাসের দিকে যন্ত্রটি সীমিত আকারে উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)। প্রাথমিকভাবে যন্ত্রটির ২০০ ইউনিট উৎপাদন করে তা ব্যবহার করা যাবে।
হাসপাতালগুলোর সাধারণ শয্যায় রোগীকে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। তার বেশি অক্সিজেনের দরকার হলে ‘হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা’ লাগে। কিংবা রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেট সিপ্যাপ যন্ত্রটির মাধ্যমে কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াই সাধারণ শয্যায় রেখেই রোগীকে ৬০-৬৫ লিটার পর্যন্ত উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন দেওয়া যায়।
একটি সম্পূর্ণ অক্সিজেট ব্যবস্থা স্থাপন করতে খরচ লাগে ২০-২৫ হাজার টাকা। এটি সহজে যেকোনো জায়গায় বহনযোগ্য। অথচ উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন দেওয়ার জন্য বাজারে থাকা সিপ্যাপ ডিভাইসগুলোর দাম এক লাখ টাকার বেশি। হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার দাম চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেটের ব্যবহার শুরু হলে আইসিইউ-সেবার জন্য রোগীদের চাপ কমত। যন্ত্রটি ডিজিডিএর অনুমোদন পাওয়ার পথে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এর অনুমোদনের জন্য উচ্চ আদালতকে পরামর্শ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল, যাতে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার ব্যবস্থা করা হয়। তখনই আশঙ্কা করা হচ্ছিল, বিদ্যমান অক্সিজেন সরবরাহযন্ত্রের তুলনায় অক্সিজেটের দাম অনেক কম এবং এর সক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো মহল নিজেদের স্বার্থে এটির বাজারে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। বাস্তবে সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। ডিজিডিএর সীমিত অনুমোদনের পর যন্ত্রটির সীমিত ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ থাকে। ব্যাপক আকারে যন্ত্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন আর হয়নি।
অথচ ২০২১ সালেই ‘অক্সিজেট’ আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সে বছরের নভেম্বরে বুয়েটের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনোভেশন ফোরামের স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক স্টার্টআপ প্রতিযোগিতা ইমাজিন ইফে ‘গ্লোবাল উইনার’ (বৈশ্বিক বিজয়ী) ঘোষণা করা হয় অক্সিজেটকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটির (বিএমইএস) ডিজাইন প্রতিযোগিতায়ও অক্সিজেট চ্যাম্পিয়ন হয়। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর যে যন্ত্রটির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছিল, সেটি হচ্ছে মেডিকেল ভেন্টিলেটর। বেশির ভাগ দেশের মতো বাংলাদেশেরও প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে দুষ্প্রাপ্য এই জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রের অভাবে কোভিডে আক্রান্ত রোগীরা শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন এবং মারা যান। কিন্তু মেডিকেল ভেন্টিলেটর অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় চাইলেই সব হাসপাতালে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে মহামারির সেই সময়ে বাংলাদেশের প্রযুক্তি উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান ‘ক্রাক্স’-এর গবেষকেরা দেশে প্রথমবারের মতো তৈরি করেন একটি উন্নত প্রযুক্তির মেডিকেল ভেন্টিলেটর, যা স্বল্প খরচে সহজেই তৈরি করা যায়। একই সঙ্গে এটি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এবং সহজে বহনযোগ্য। বাংলাদেশি গবেষকদের এ-সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি ২০২১ সালের ১২ থেকে ১৫ নভেম্বর জাপানের কিয়োটোতে অনুষ্ঠিত বায়োমেডিকেল এবং বায়োইনফরম্যাটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য গৃহীত হয়। সে বছরের ১০ আগস্ট এই ভেন্টিলেটর বাংলাদেশের প্রথম ওপেন সোর্স হার্ডওয়্যার হিসেবে ওপেন সোর্স হার্ডওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (ওএসএইচডব্লিউএ) প্রত্যয়ন পায়। এর আগে বাংলাদেশের অসংখ্য সফটওয়্যার ওপেন সোর্স প্রত্যয়ন পেলেও এটিই প্রথম কোনো ওপেন সোর্স হার্ডওয়্যার, যা আন্তর্জাতিক এই সংস্থার মাধ্যমে প্রত্যয়িত হয়েছে।
ক্রাক্সের প্রতিষ্ঠাতা নাবিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও দেশের প্রথম ড্রোন প্রকল্পের টিম লিডার হিসেবে পরিচিত। ভেন্টিলেটর প্রসঙ্গে নাবিল সে সময় সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘দ্রুত উৎপাদনযোগ্য, স্বল্প খরচ এবং বিদ্যুৎসাশ্রয়ী পোর্টেবল টারবাইনভিত্তিক ভেন্টিলেটরটি অন্য যেকোনো বাণিজ্যিক ভেন্টিলেটরের মতোই দক্ষতার সঙ্গে কার্যকর। এর শব্দের মাত্রা অন্য ভেন্টিলেটরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক এবং এটি পিআরভিসি, পিসিবি, এসআইএমভি এবং বাইপেপ মোডে কার্যকর। আমরা সোলেনয়েড এবং পিপ ভালভের পরিবর্তে একটি প্রেশার রিলিজ মেকানিজম তৈরি করছি, যা ৩৫ শতাংশ কম শক্তি খরচ করে এবং অত্যন্ত সাশ্রয়ী। এটি যেকোনো ধরনের পেশেন্ট সার্কিটের সঙ্গে কার্যকর। ভেন্টিলেটরে রিয়েলটাইম ডেটা প্রদর্শনের জন্য একটি বড় স্ক্রিনও সংযুক্ত করা হয়েছে।’ নাবিল জানিয়েছিলেন, বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত একটি ভেন্টিলেটরের বাজারদর ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে। কিন্তু তাঁদের উদ্ভাবন করা ওপেন সোর্স ভেন্টিলেটরটি উৎপাদনে আনুষঙ্গিক সব খরচসহ মাত্র ১ থেকে ২ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত যন্ত্রটিরও দেশে বাণিজ্যিক উৎপাদন হতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী পাট থেকে এমন এক ধরনের পলিমার তৈরি করেছেন, যেটি দেখতে পলিথিনের মতো হলেও সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। এই পলিমারের তৈরি ব্যাগ ফেলে দিলে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। ওই বিজ্ঞানীর নাম ড. মোবারক আহমেদ খান। তিনি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহাপরিচালক। ছয় বছর গবেষণার পর ড. মোবারক ২০১৭ সালে পাটের আঁশ থেকে এই পলিমার সফলভাবে তৈরি করেন। পরীক্ষামূলকভাবে তৈরির পর সোনালি ব্যাগটি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বব্যাপী সবার নজর কাড়ে।
রাজধানীর ডেমরায় রাষ্ট্রায়ত্ত লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণে তৈরি করা হয় পাট থেকে তৈরি পলিমার ব্যাগ। এর নাম দেওয়া হয় ‘সোনালি ব্যাগ’। পাটের আঁশ থেকে সেলুলোজকে আলাদা করে এই পলিমার তৈরি করা হয়। দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতো এই ব্যাগগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক টেকসই এবং ভার বহনে সক্ষম। পচনশীল হলেও এই ব্যাগের ভেতর বাতাস বা পানি ঢুকতে পারে না। পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ সম্পর্কে ড. মোবারক বলেন, পলিথিনের তুলনায় পাটের পলিমার দেড় গুণ বেশি ভার বহন করতে পারে। এটি পানি শোষণ না করলেও ফেলে দেওয়ার তিন থেকে চার মাসের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য পাটের পলিমারভিত্তিক এই সোনালি ব্যাগ বিতরণ করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ইউএনডিপি এই উদ্যোগ নেয়।
ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বলেন, ‘জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন হিসেবে টেকসই ব্যবহারের প্রচার এবং সবার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা আমাদের দায়িত্ব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের সব কর্মীর জন্য এই পরিবেশবান্ধব ব্যাগ শুধু সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই নিয়ে আসিনি, পাশাপাশি প্লাস্টিকের বিকল্প কী হতে পারে, এটি তার একটি সমাধান।’
বিশ্ব এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে একবার ব্যবহারোপযোগী প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে এখনই কাজ শুরু করা না হলে ভবিষ্যতে কিছুই করার থাকবে না।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করার জন্য একটি বৈশ্বিক চুক্তির আলোচনা সম্পন্ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি সরকার রাজধানীতে পলিথিনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সে বছরই ৩১ মার্চ সারা দেশে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু কম মূল্যে পরিবেশবান্ধব বিকল্প না থাকায় এবং সরকারি তদারকির দুর্বলতার কারণে দেশে পলিথিনের শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। অথচ পাটের পলিমার দিয়ে তৈরি সোনালি ব্যাগ সহজলভ্য হলে এমনিতেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। ‘সোনালি ব্যাগ’ নামটিও ঠিক করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। এই ব্যাগ দিয়েই ক্ষতিকর পলিথিনের রাজত্ব দূর করে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পাটের পুনরুজ্জীবনের স্বপ্নও পূরণ করা সম্ভব। বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিও সই হয়েছিল। কিন্তু বাজারে আসছে না পাটের পলিথিন। দেশে উদ্ভাবিত এই সোনালি ব্যাগের ব্যাপকভিত্তিক বাণিজ্যিক উৎপাদন ছয় বছরেও কেন শুরু হয়নি, কোন অপশক্তি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে, তা কেউ জানে না।
বাংলাদেশের এমন আরও অনেক উদ্ভাবনই কাজে আসে না কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের প্রভাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
২০২০ থেকে ২০২১ সাল—বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এক যুদ্ধকালই পেরিয়েছে বলা যায়। নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামের এক প্রাণঘাতী ভাইরাস দেশে দেশে অতি দ্রুত ছড়িয়ে মানুষের ফুসফুসকে আক্রান্ত করে শ্বাসপ্রশ্বাস থামিয়ে দিচ্ছিল। ফলে সবখানে বাড়ছিল মৃত্যুর মিছিল। তখন মানুষের শ্বাসযন্ত্র চালু রাখার যুদ্ধে নামতে হয়েছিল দুনিয়ার তাবৎ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর। কোভিডে আক্রান্ত বহু কোটি মানুষকে শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচাতে অক্সিজেনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। অক্সিজেন না পেয়ে বহু রোগীর মৃত্যু ঘটে দেশে দেশে। এমনই এক মহাসংকটকালে বিপুল আশাজাগানিয়া উদ্ভাবন সামনে এনেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ‘অক্সিজেট’ নামের এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেন, যা সাধারণ যন্ত্রের চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে যন্ত্রটি বানানোর খরচও বিস্ময়কর রকম কম। অক্সিজেট একটি নন-ইনভেসিভ সিপ্যাপ ভেন্টিলেটর। অনেক সময়ক্ষেপণের পর প্রাথমিক ধাপের কয়েকটি পরীক্ষা শেষে ২০২১ সালের জুলাই মাসের দিকে যন্ত্রটি সীমিত আকারে উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)। প্রাথমিকভাবে যন্ত্রটির ২০০ ইউনিট উৎপাদন করে তা ব্যবহার করা যাবে।
হাসপাতালগুলোর সাধারণ শয্যায় রোগীকে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। তার বেশি অক্সিজেনের দরকার হলে ‘হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা’ লাগে। কিংবা রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেট সিপ্যাপ যন্ত্রটির মাধ্যমে কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াই সাধারণ শয্যায় রেখেই রোগীকে ৬০-৬৫ লিটার পর্যন্ত উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন দেওয়া যায়।
একটি সম্পূর্ণ অক্সিজেট ব্যবস্থা স্থাপন করতে খরচ লাগে ২০-২৫ হাজার টাকা। এটি সহজে যেকোনো জায়গায় বহনযোগ্য। অথচ উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন দেওয়ার জন্য বাজারে থাকা সিপ্যাপ ডিভাইসগুলোর দাম এক লাখ টাকার বেশি। হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার দাম চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেটের ব্যবহার শুরু হলে আইসিইউ-সেবার জন্য রোগীদের চাপ কমত। যন্ত্রটি ডিজিডিএর অনুমোদন পাওয়ার পথে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এর অনুমোদনের জন্য উচ্চ আদালতকে পরামর্শ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল, যাতে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার ব্যবস্থা করা হয়। তখনই আশঙ্কা করা হচ্ছিল, বিদ্যমান অক্সিজেন সরবরাহযন্ত্রের তুলনায় অক্সিজেটের দাম অনেক কম এবং এর সক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো মহল নিজেদের স্বার্থে এটির বাজারে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। বাস্তবে সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। ডিজিডিএর সীমিত অনুমোদনের পর যন্ত্রটির সীমিত ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ থাকে। ব্যাপক আকারে যন্ত্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন আর হয়নি।
অথচ ২০২১ সালেই ‘অক্সিজেট’ আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সে বছরের নভেম্বরে বুয়েটের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনোভেশন ফোরামের স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক স্টার্টআপ প্রতিযোগিতা ইমাজিন ইফে ‘গ্লোবাল উইনার’ (বৈশ্বিক বিজয়ী) ঘোষণা করা হয় অক্সিজেটকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটির (বিএমইএস) ডিজাইন প্রতিযোগিতায়ও অক্সিজেট চ্যাম্পিয়ন হয়। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর যে যন্ত্রটির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছিল, সেটি হচ্ছে মেডিকেল ভেন্টিলেটর। বেশির ভাগ দেশের মতো বাংলাদেশেরও প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে দুষ্প্রাপ্য এই জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রের অভাবে কোভিডে আক্রান্ত রোগীরা শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন এবং মারা যান। কিন্তু মেডিকেল ভেন্টিলেটর অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় চাইলেই সব হাসপাতালে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে মহামারির সেই সময়ে বাংলাদেশের প্রযুক্তি উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান ‘ক্রাক্স’-এর গবেষকেরা দেশে প্রথমবারের মতো তৈরি করেন একটি উন্নত প্রযুক্তির মেডিকেল ভেন্টিলেটর, যা স্বল্প খরচে সহজেই তৈরি করা যায়। একই সঙ্গে এটি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এবং সহজে বহনযোগ্য। বাংলাদেশি গবেষকদের এ-সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি ২০২১ সালের ১২ থেকে ১৫ নভেম্বর জাপানের কিয়োটোতে অনুষ্ঠিত বায়োমেডিকেল এবং বায়োইনফরম্যাটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য গৃহীত হয়। সে বছরের ১০ আগস্ট এই ভেন্টিলেটর বাংলাদেশের প্রথম ওপেন সোর্স হার্ডওয়্যার হিসেবে ওপেন সোর্স হার্ডওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (ওএসএইচডব্লিউএ) প্রত্যয়ন পায়। এর আগে বাংলাদেশের অসংখ্য সফটওয়্যার ওপেন সোর্স প্রত্যয়ন পেলেও এটিই প্রথম কোনো ওপেন সোর্স হার্ডওয়্যার, যা আন্তর্জাতিক এই সংস্থার মাধ্যমে প্রত্যয়িত হয়েছে।
ক্রাক্সের প্রতিষ্ঠাতা নাবিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও দেশের প্রথম ড্রোন প্রকল্পের টিম লিডার হিসেবে পরিচিত। ভেন্টিলেটর প্রসঙ্গে নাবিল সে সময় সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘দ্রুত উৎপাদনযোগ্য, স্বল্প খরচ এবং বিদ্যুৎসাশ্রয়ী পোর্টেবল টারবাইনভিত্তিক ভেন্টিলেটরটি অন্য যেকোনো বাণিজ্যিক ভেন্টিলেটরের মতোই দক্ষতার সঙ্গে কার্যকর। এর শব্দের মাত্রা অন্য ভেন্টিলেটরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক এবং এটি পিআরভিসি, পিসিবি, এসআইএমভি এবং বাইপেপ মোডে কার্যকর। আমরা সোলেনয়েড এবং পিপ ভালভের পরিবর্তে একটি প্রেশার রিলিজ মেকানিজম তৈরি করছি, যা ৩৫ শতাংশ কম শক্তি খরচ করে এবং অত্যন্ত সাশ্রয়ী। এটি যেকোনো ধরনের পেশেন্ট সার্কিটের সঙ্গে কার্যকর। ভেন্টিলেটরে রিয়েলটাইম ডেটা প্রদর্শনের জন্য একটি বড় স্ক্রিনও সংযুক্ত করা হয়েছে।’ নাবিল জানিয়েছিলেন, বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত একটি ভেন্টিলেটরের বাজারদর ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে। কিন্তু তাঁদের উদ্ভাবন করা ওপেন সোর্স ভেন্টিলেটরটি উৎপাদনে আনুষঙ্গিক সব খরচসহ মাত্র ১ থেকে ২ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত যন্ত্রটিরও দেশে বাণিজ্যিক উৎপাদন হতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী পাট থেকে এমন এক ধরনের পলিমার তৈরি করেছেন, যেটি দেখতে পলিথিনের মতো হলেও সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। এই পলিমারের তৈরি ব্যাগ ফেলে দিলে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। ওই বিজ্ঞানীর নাম ড. মোবারক আহমেদ খান। তিনি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহাপরিচালক। ছয় বছর গবেষণার পর ড. মোবারক ২০১৭ সালে পাটের আঁশ থেকে এই পলিমার সফলভাবে তৈরি করেন। পরীক্ষামূলকভাবে তৈরির পর সোনালি ব্যাগটি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বব্যাপী সবার নজর কাড়ে।
রাজধানীর ডেমরায় রাষ্ট্রায়ত্ত লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণে তৈরি করা হয় পাট থেকে তৈরি পলিমার ব্যাগ। এর নাম দেওয়া হয় ‘সোনালি ব্যাগ’। পাটের আঁশ থেকে সেলুলোজকে আলাদা করে এই পলিমার তৈরি করা হয়। দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতো এই ব্যাগগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক টেকসই এবং ভার বহনে সক্ষম। পচনশীল হলেও এই ব্যাগের ভেতর বাতাস বা পানি ঢুকতে পারে না। পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ সম্পর্কে ড. মোবারক বলেন, পলিথিনের তুলনায় পাটের পলিমার দেড় গুণ বেশি ভার বহন করতে পারে। এটি পানি শোষণ না করলেও ফেলে দেওয়ার তিন থেকে চার মাসের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য পাটের পলিমারভিত্তিক এই সোনালি ব্যাগ বিতরণ করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ইউএনডিপি এই উদ্যোগ নেয়।
ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বলেন, ‘জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন হিসেবে টেকসই ব্যবহারের প্রচার এবং সবার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা আমাদের দায়িত্ব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের সব কর্মীর জন্য এই পরিবেশবান্ধব ব্যাগ শুধু সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই নিয়ে আসিনি, পাশাপাশি প্লাস্টিকের বিকল্প কী হতে পারে, এটি তার একটি সমাধান।’
বিশ্ব এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে একবার ব্যবহারোপযোগী প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে এখনই কাজ শুরু করা না হলে ভবিষ্যতে কিছুই করার থাকবে না।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করার জন্য একটি বৈশ্বিক চুক্তির আলোচনা সম্পন্ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি সরকার রাজধানীতে পলিথিনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সে বছরই ৩১ মার্চ সারা দেশে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু কম মূল্যে পরিবেশবান্ধব বিকল্প না থাকায় এবং সরকারি তদারকির দুর্বলতার কারণে দেশে পলিথিনের শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। অথচ পাটের পলিমার দিয়ে তৈরি সোনালি ব্যাগ সহজলভ্য হলে এমনিতেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। ‘সোনালি ব্যাগ’ নামটিও ঠিক করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। এই ব্যাগ দিয়েই ক্ষতিকর পলিথিনের রাজত্ব দূর করে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পাটের পুনরুজ্জীবনের স্বপ্নও পূরণ করা সম্ভব। বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিও সই হয়েছিল। কিন্তু বাজারে আসছে না পাটের পলিথিন। দেশে উদ্ভাবিত এই সোনালি ব্যাগের ব্যাপকভিত্তিক বাণিজ্যিক উৎপাদন ছয় বছরেও কেন শুরু হয়নি, কোন অপশক্তি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে, তা কেউ জানে না।
বাংলাদেশের এমন আরও অনেক উদ্ভাবনই কাজে আসে না কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের প্রভাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪