হাসান মোরশেদ
স্টিভেন পিংকার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এনলাইটমেন্ট টুডে’-তে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলতে চেয়েছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে মানুষ ভালো আছে। মানুষ ভালো আছে যুক্তি, বিজ্ঞান, মানবতাবোধ ও প্রগতির অগ্রসরতায়। এই অগ্রসরতা অব্যাহত থাকলে মানুষের ভবিষ্যৎ আরও সমুজ্জ্বল। পিংকার দেখিয়েছেন, ২০০ বছর আগেও পৃথিবীর ৯০ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমায় ছিল। এই হার এখন ১০ শতাংশ। সম্পদের বৃদ্ধি কেবল উন্নত দেশগুলোতেই হচ্ছে না, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোও আগের চেয়ে সম্পদশালী হয়ে উঠছে। ধনী রাষ্ট্রগুলোতে সম্পদ দ্বিগুণ হচ্ছে ৩৫ বছরে অথচ রুয়ান্ডা ও এল সালভাদরের মতো তুলনামূলক দরিদ্র রাষ্ট্রে সম্পদ দ্বিগুণ হচ্ছে প্রতি ১৮ বছরে। ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন সবচেয়ে বেশি শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। উনিশ শতক পর্যন্ত যুদ্ধ ছিল নিয়মিত ঘটনা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধ আর সমাদৃত নয় বরং যুদ্ধবিরোধী বিশ্ব জনমত ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের মৌলিক মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয়েছে, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, জেন্ডার-নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের অধিকারের আইনি স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিও সমকালেরই ঘটনা। এর আগে ইতিহাসের সকল বাঁকেই এই জনপদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপনিবেশ ছিল, সমাজ ছিল সামন্ততান্ত্রিক। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আধুনিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে, তেমনি সমাজকেও বদলে দিয়েছে। পরবর্তী পাঁচ দশকে নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উত্থানপতন ছিল, সামরিক শাসনের দুঃসহ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তবু মানুষ পিছিয়ে যায়নি। স্বাধীনতার সবচেয়ে জরুরি অনুষঙ্গ ‘নিজের অধিকার’ বিষয়ে মানুষ সচেতন হয়েছে। গত এক যুগের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুবাদে অর্থনীতি ও সামাজিক নানা সূচকে সুস্পষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। এই উন্নয়নের অনেকটুকু যেমন অবকাঠামোগত, তেমনি প্রযুক্তি ও মানবিক মর্যাদাগতও। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন, প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, ডিজিটাল সুবিধার সুযোগ বৃদ্ধি, অধিকসংখ্যক নাগরিককে সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় নিয়ে আসার মতো অনেক মানদণ্ডে বাংলাদেশ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে। স্টিভেন পিংকার বর্তমান সময়ের যে দ্রুত অগ্রসরতার কথা বলেছেন, বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে সেই গতিশীলতার ভালো উদাহরণ। এই গতিশীলতা অব্যাহত থাকলে সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ কেবল স্বপ্ন নয়, বর্তমানের উপকূলে দাঁড়িয়ে আলোকিত ভবিষ্যতের মহাসমুদ্র এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের এই যৌথ অগ্রসরতায় অতীতের অবস্থান আসলে কোথায়? অতীত কি এখন কেবলই এক ভিনদেশ, যেখানে আমরা আর ফিরে যাব না? আলোকায়নের পথে দ্রুত অগ্রসরতার এ সময়ে ইতিহাসকে মনে রাখা, ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা কি কেবলই অলস বিলাসিতা?
‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এ মিলান কুন্ডেরা ভবিষ্যৎকে সংজ্ঞায়িত করেছেন একটি উদাসীন শূন্যতা হিসেবে, ব্যক্তিমানুষের প্রতি যার কোনো আগ্রহ নেই। অন্যদিকে অতীত হচ্ছে জীবনের ঘটে যাওয়া বাস্তবতা, যা প্রতিনিয়ত মানুষকে তাড়িত করে। ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণে মানুষ দক্ষ হয়ে উঠতে চায় মূলত তার অতীতকে বদলে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য। আজকের বাংলাদেশের যে আধুনিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির সম্ভাবনা, এর ভিত্তিতে রয়েছে অতীত ইতিহাস। সেই ইতিহাসে যেমন লড়াইয়ের গৌরব আছে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বিশ্বাসঘাতকতার বেদনা আছে; তেমনি আছে একটি পূর্ণাঙ্গ জেনোসাইডের নৃশংসতার স্মৃতি।
বিগত শতাব্দী ছিল জেনোসাইডের। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, বসনিয়ায় জেনোসাইডের নৃশংসতায় মানবতা বিক্ষত হয়েছে বারবার। এসব অভিজ্ঞতা থেকে জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক আইন তৈরি হয়েছে। ‘নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য অতীতের স্মৃতি সংরক্ষণ’-এর মতো সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদও গৃহীত হয়েছে। অতীতে অনভিপ্রেত যা ঘটেছে, তা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে জন্য অতীতকে জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে যত দ্রুতগতিতে আমরা এগোই, ইতিহাসচর্চাকে অপ্রয়োজনীয় অতীত ভেবে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
এ ক্ষেত্রেও ভাবনার জরুরি উপাদান রয়ে যায়—কার ইতিহাস, কতটুকু ইতিহাসচর্চা হবে? ইতিহাসের ভিত্তিতে কার সংস্কৃতি, কতটুকু সংস্কৃতি ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে?
সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ পেছনে ফেলে আমরা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। রাষ্ট্র সাংবিধানিক নিশ্চয়তা দিচ্ছে সব ধরনের পরিচয়-নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার। তবু রাষ্ট্রের প্রধান প্রশাসনিক নগর এখনো ‘রাজধানী’ বলে বিবৃত হয় কেন? গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থায় কে রাজা, কার রাজধানী? তথাকথিত রাজধানী ঘিরে কেন এই জনপদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠছে?
ঢাকায় বসবাসরত মানুষের কথ্যভাষা হয়ে উঠছে নাটক, সিনেমা কিংবা সাহিত্যের ভাষা। অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে হাসিঠাট্টার উপাদান হিসেবে। ঢাকার সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, রাজনীতি—সব মূল্যায়িত হচ্ছে ‘জাতীয়’ হিসেবে, বাকি বাংলাদেশ এখনো মফস্বল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রধান ঐতিহাসিক নিয়ামক যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জেনোসাইড ’৭১, সেসবের ইতিহাস সংরক্ষণেও ‘মফস্বল’ ও ‘মফস্বলের মানুষ’ রয়ে যাচ্ছে উপেক্ষিত। অবকাঠামো ও প্রযুক্তি উন্নয়নে শহর ও গ্রামগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সংযুক্ত অথচ বেড়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক ব্যবধান। সাংস্কৃতিক ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভেতরে সাধারণ ‘বোঝাপড়া’র বিষয়টি গড়ে উঠছে না, সুসংহত জাতি গঠনের জন্য এই বোঝাপড়া অতি জরুরি। কুষ্টিয়ার গ্রামে যখন প্রকৃত বাউল নির্যাতিত হচ্ছেন, ঢাকার মঞ্চে তখন বাউলগানের ফিউশন হচ্ছে।
‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্ত’র মতো সামন্তবাদী পশ্চাৎ-মুখী ধারণার বৃত্তে এখনো বন্দী আমরা। সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে এই বৃত্ত ভাঙতে হবে। যে ইতিহাসের ভিত্তিতে আজকের বর্তমান, সেই ইতিহাসে সব মানুষের অভিজ্ঞতা যুক্ত হতে হবে। বর্তমানের সব মানুষকে সমান মর্যাদা ও সমান সুযোগ দিতে হবে। সবার অংশগ্রহণেই নিশ্চিত হবে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটি দল এসেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত শূন্য রিজার্ভের নতুন রাষ্ট্রটির নির্মাণপর্ব দেখার জন্য। নৃশংস জেনোসাইডের শিকার হওয়া অতিদরিদ্র একটি জাতির মধ্যে তারা প্রবল আশাবাদ দেখেছিল। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ন্যাটজিও প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল ‘Bangladesh: Hope Nurishes a New Nation’ শিরোনামে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বর্তমানের বাংলাদেশ এখনো আশাবাদে ভরসা ছাড়ছে না।
লেখক: লেখক ও গবেষক
স্টিভেন পিংকার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এনলাইটমেন্ট টুডে’-তে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলতে চেয়েছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে মানুষ ভালো আছে। মানুষ ভালো আছে যুক্তি, বিজ্ঞান, মানবতাবোধ ও প্রগতির অগ্রসরতায়। এই অগ্রসরতা অব্যাহত থাকলে মানুষের ভবিষ্যৎ আরও সমুজ্জ্বল। পিংকার দেখিয়েছেন, ২০০ বছর আগেও পৃথিবীর ৯০ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমায় ছিল। এই হার এখন ১০ শতাংশ। সম্পদের বৃদ্ধি কেবল উন্নত দেশগুলোতেই হচ্ছে না, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোও আগের চেয়ে সম্পদশালী হয়ে উঠছে। ধনী রাষ্ট্রগুলোতে সম্পদ দ্বিগুণ হচ্ছে ৩৫ বছরে অথচ রুয়ান্ডা ও এল সালভাদরের মতো তুলনামূলক দরিদ্র রাষ্ট্রে সম্পদ দ্বিগুণ হচ্ছে প্রতি ১৮ বছরে। ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন সবচেয়ে বেশি শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। উনিশ শতক পর্যন্ত যুদ্ধ ছিল নিয়মিত ঘটনা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধ আর সমাদৃত নয় বরং যুদ্ধবিরোধী বিশ্ব জনমত ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের মৌলিক মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয়েছে, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, জেন্ডার-নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের অধিকারের আইনি স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিও সমকালেরই ঘটনা। এর আগে ইতিহাসের সকল বাঁকেই এই জনপদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপনিবেশ ছিল, সমাজ ছিল সামন্ততান্ত্রিক। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আধুনিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে, তেমনি সমাজকেও বদলে দিয়েছে। পরবর্তী পাঁচ দশকে নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উত্থানপতন ছিল, সামরিক শাসনের দুঃসহ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তবু মানুষ পিছিয়ে যায়নি। স্বাধীনতার সবচেয়ে জরুরি অনুষঙ্গ ‘নিজের অধিকার’ বিষয়ে মানুষ সচেতন হয়েছে। গত এক যুগের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুবাদে অর্থনীতি ও সামাজিক নানা সূচকে সুস্পষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। এই উন্নয়নের অনেকটুকু যেমন অবকাঠামোগত, তেমনি প্রযুক্তি ও মানবিক মর্যাদাগতও। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন, প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, ডিজিটাল সুবিধার সুযোগ বৃদ্ধি, অধিকসংখ্যক নাগরিককে সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় নিয়ে আসার মতো অনেক মানদণ্ডে বাংলাদেশ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে। স্টিভেন পিংকার বর্তমান সময়ের যে দ্রুত অগ্রসরতার কথা বলেছেন, বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে সেই গতিশীলতার ভালো উদাহরণ। এই গতিশীলতা অব্যাহত থাকলে সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ কেবল স্বপ্ন নয়, বর্তমানের উপকূলে দাঁড়িয়ে আলোকিত ভবিষ্যতের মহাসমুদ্র এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের এই যৌথ অগ্রসরতায় অতীতের অবস্থান আসলে কোথায়? অতীত কি এখন কেবলই এক ভিনদেশ, যেখানে আমরা আর ফিরে যাব না? আলোকায়নের পথে দ্রুত অগ্রসরতার এ সময়ে ইতিহাসকে মনে রাখা, ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা কি কেবলই অলস বিলাসিতা?
‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এ মিলান কুন্ডেরা ভবিষ্যৎকে সংজ্ঞায়িত করেছেন একটি উদাসীন শূন্যতা হিসেবে, ব্যক্তিমানুষের প্রতি যার কোনো আগ্রহ নেই। অন্যদিকে অতীত হচ্ছে জীবনের ঘটে যাওয়া বাস্তবতা, যা প্রতিনিয়ত মানুষকে তাড়িত করে। ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণে মানুষ দক্ষ হয়ে উঠতে চায় মূলত তার অতীতকে বদলে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য। আজকের বাংলাদেশের যে আধুনিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির সম্ভাবনা, এর ভিত্তিতে রয়েছে অতীত ইতিহাস। সেই ইতিহাসে যেমন লড়াইয়ের গৌরব আছে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বিশ্বাসঘাতকতার বেদনা আছে; তেমনি আছে একটি পূর্ণাঙ্গ জেনোসাইডের নৃশংসতার স্মৃতি।
বিগত শতাব্দী ছিল জেনোসাইডের। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, বসনিয়ায় জেনোসাইডের নৃশংসতায় মানবতা বিক্ষত হয়েছে বারবার। এসব অভিজ্ঞতা থেকে জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক আইন তৈরি হয়েছে। ‘নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য অতীতের স্মৃতি সংরক্ষণ’-এর মতো সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদও গৃহীত হয়েছে। অতীতে অনভিপ্রেত যা ঘটেছে, তা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে জন্য অতীতকে জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে যত দ্রুতগতিতে আমরা এগোই, ইতিহাসচর্চাকে অপ্রয়োজনীয় অতীত ভেবে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
এ ক্ষেত্রেও ভাবনার জরুরি উপাদান রয়ে যায়—কার ইতিহাস, কতটুকু ইতিহাসচর্চা হবে? ইতিহাসের ভিত্তিতে কার সংস্কৃতি, কতটুকু সংস্কৃতি ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে?
সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ পেছনে ফেলে আমরা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। রাষ্ট্র সাংবিধানিক নিশ্চয়তা দিচ্ছে সব ধরনের পরিচয়-নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার। তবু রাষ্ট্রের প্রধান প্রশাসনিক নগর এখনো ‘রাজধানী’ বলে বিবৃত হয় কেন? গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থায় কে রাজা, কার রাজধানী? তথাকথিত রাজধানী ঘিরে কেন এই জনপদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠছে?
ঢাকায় বসবাসরত মানুষের কথ্যভাষা হয়ে উঠছে নাটক, সিনেমা কিংবা সাহিত্যের ভাষা। অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে হাসিঠাট্টার উপাদান হিসেবে। ঢাকার সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, রাজনীতি—সব মূল্যায়িত হচ্ছে ‘জাতীয়’ হিসেবে, বাকি বাংলাদেশ এখনো মফস্বল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রধান ঐতিহাসিক নিয়ামক যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জেনোসাইড ’৭১, সেসবের ইতিহাস সংরক্ষণেও ‘মফস্বল’ ও ‘মফস্বলের মানুষ’ রয়ে যাচ্ছে উপেক্ষিত। অবকাঠামো ও প্রযুক্তি উন্নয়নে শহর ও গ্রামগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সংযুক্ত অথচ বেড়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক ব্যবধান। সাংস্কৃতিক ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভেতরে সাধারণ ‘বোঝাপড়া’র বিষয়টি গড়ে উঠছে না, সুসংহত জাতি গঠনের জন্য এই বোঝাপড়া অতি জরুরি। কুষ্টিয়ার গ্রামে যখন প্রকৃত বাউল নির্যাতিত হচ্ছেন, ঢাকার মঞ্চে তখন বাউলগানের ফিউশন হচ্ছে।
‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্ত’র মতো সামন্তবাদী পশ্চাৎ-মুখী ধারণার বৃত্তে এখনো বন্দী আমরা। সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে এই বৃত্ত ভাঙতে হবে। যে ইতিহাসের ভিত্তিতে আজকের বর্তমান, সেই ইতিহাসে সব মানুষের অভিজ্ঞতা যুক্ত হতে হবে। বর্তমানের সব মানুষকে সমান মর্যাদা ও সমান সুযোগ দিতে হবে। সবার অংশগ্রহণেই নিশ্চিত হবে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটি দল এসেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত শূন্য রিজার্ভের নতুন রাষ্ট্রটির নির্মাণপর্ব দেখার জন্য। নৃশংস জেনোসাইডের শিকার হওয়া অতিদরিদ্র একটি জাতির মধ্যে তারা প্রবল আশাবাদ দেখেছিল। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ন্যাটজিও প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল ‘Bangladesh: Hope Nurishes a New Nation’ শিরোনামে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বর্তমানের বাংলাদেশ এখনো আশাবাদে ভরসা ছাড়ছে না।
লেখক: লেখক ও গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪