বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখার মতলবে ২৫ মার্চ রাতে সেনা অভিযান চালিয়েছিলেন এবং এর জন্য বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে তাঁকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিলেন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। নিজে ক্ষমতায় বসার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ভুট্টোকে কাণ্ডজ্ঞানহীন করে তুলেছিল। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কারণেই ভুট্টোর পক্ষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হয়েছিল।
সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁকে দেখার জন্য একশ্রেণির মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল অপ্রত্যাশিত। যে ভুট্টো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘে গিয়ে প্রয়োজনে ঘাস খেয়েও হাজার বছর যুদ্ধ করার আস্ফালন করেছিলেন, সেই ভুট্টোকে দেখার জন্য বাঙালি অত উতলা হয়ে উঠেছিল কেন?
এটা ঠিক যে ৯ মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি, অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু আমাদের বাহিনীর যে প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র, সামর্থ্য তৈরি হয়েছিল, তা কি সত্যি পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল? ভাগ্যিস, ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর মতো একজন বিচক্ষণ, সাহসী মানুষ। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে এক বর্ম হিসেবে। ভারত তার নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোমর বেঁধে না নামলে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ৯ মাসে বাস্তবে রূপ পেত কি না, তা সত্যি এক বড় প্রশ্ন।
আমরা যে বলি, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে আর মুষ্টিমেয় মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, এটা নিয়েও আমার কিছুটা সংশয় আছে। আমার সংশয়ের পক্ষে তথ্য, যুক্তি আছে। কিন্তু সেটা এখানে নিষ্প্রয়োজন। আদর্শভিত্তিক একটি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির দরকার, তার ঘাটতি যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ছিল, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছিল। আমার সঙ্গে অনেকে যদি দ্বিমত পোষণও করেন, তবু আমি এটাই বলব যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একটি ছোট অংশই দৃঢ় আদর্শিক বিশ্বাসের অধিকারী ছিল। অনেকেই ঘটনাক্রমে মুক্তিযুদ্ধে নেমেছেন। পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার হামলার মুখে জান বাঁচানো ফরজ বিবেচনায় অনেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। আরেকটি অংশ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন সতর্ক হিসাব-নিকাশ করে। তাঁরা বেশি বুদ্ধিমান।
চেতনাগতভাবে একটি বড় গ্যাপ থাকার বিষয়টি জাতীয় নেতৃত্বের কেউ কেউ বুঝতেন বলেই আমার মনে হয়। সে জন্য এই গ্যাপ পূরণের কৌশল হিসেবে শর্টকাট পথ নেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় চার নীতি ঘোষণার মাধ্যমে; বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র নীতি হিসেবে বাংলাদেশ গ্রহণ করবে, এটা সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টিরও চিন্তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু যখন এগুলো রাষ্ট্রীয় নীতি হলো, তখন কমিউনিস্ট পার্টি ও এই ধারার বামেরা কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলেন বলে এখন আমার মনে হয়।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর হাতে গোনা কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগী ছাড়া আওয়ামী লীগ দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো মোটেও ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক নীতির প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণে দলের মধ্যে প্রকাশ্যে কেউ এই নীতির বিরোধিতা করেননি, কিন্তু এই নীতি বাস্তবায়নের পথে যতভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করা যায়, সেই চেষ্টা তাঁরা করেছেন।
রাষ্ট্রীয় নীতি যেহেতু সমাজতন্ত্র, সেহেতু সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলোর আলাদা আলাদা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা খুব জরুরি ছিল না। ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব তুলেছিলেন। সেটা বঙ্গবন্ধু আমলে নেননি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্র ইউনিয়নের ওই সম্মেলনে চার নেতার ছবি বেশ বড় করে টানানো হয়েছিল। প্রথমে বঙ্গবন্ধু, তারপর মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও মোজাফফর আহমেদ। এই চারজনকে সম্মেলনে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জাতীয় ঐক্যের একটি ভিত্তি তৈরির আশা থেকেই হয়তো। সম্মেলনে মওলানা ভাসানী অনুপস্থিত থেকে নিজেকে আলাদা রাখার ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।
সম্মেলন উদ্বোধনের আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতিসহ আরও কিছু গঠনমূলক স্লোগান দিয়েছিলেন। শেষে বলেছিলেন—জয় সমাজতন্ত্র। পাশে দাঁড়ানো ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেলিম ভাইয়ের কানে কানে বলেছিলেন, একবার জয় বাংলাও বলো। এই স্লোগান না দিলে আমরা তো সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে বাঁচতে পারব না।
সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য জয় বাংলা স্লোগানকে কার্যকর মনে করার যুক্তি হয়তো এটাই যে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগান মুক্তিকামী বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু এখন? জয় বাংলা স্লোগান দিতে আইন করতে হয়!
ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ওই সম্মেলনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগকে একীভূত করার প্রস্তাব দেওয়া হলে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নূরে আলম সিদ্দিকী এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, এই একীভূত হওয়ার কথাটি শুনতে ভালো, কিন্তু আসলে ভালো কিছু করার জন্য প্রতিযোগিতা থাকতে হয়। আসুন, আমরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করি।
এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছিলেন, ঠিক আছে, আসুন, আমরা অশিক্ষার বিরুদ্ধে, নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে, অপুষ্টির বিরুদ্ধে, সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রতিযোগিতায় নামি।
কিন্তু ছাত্রলীগ কোন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, সেটা দেখা গেছে মুহসীন হলে সেভেন মার্ডার ও জগন্নাথ হলে ছাত্র ইউনিয়নের ওপর হামলার ঘটনায়।
স্বাধীনতার এক বছর যেতে না যেতেই দেশের মধ্যে অস্থিরতার উপাদান বাড়ছিল। আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতার আচরণ, কার্যকলাপে মানুষের মনে বিরূপতা বাড়ছিল। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাও কমছিল নানা প্রচার-অপপ্রচারের কারণে। বঙ্গবন্ধু নিজেও বিষয়টি টের পেয়েছিলেন কি না, বলা কঠিন।
এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এটা আমি সাবেক ছাত্রনেতা ও কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কাছেই শুনেছি।
বঙ্গবন্ধু সেলিম ভাইকে খুবই পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু সেলিম ভাইকে স্নেহ করতেন, বঙ্গবন্ধুর অফিসে যেতে সেলিম ভাইয়ের কোনো পূর্বানুমতি লাগত না।
১৯৭৩ সালের কোনো একদিন বিশেষ কোনো কাজে সেলিম ভাই গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সেলিম ভাই রুমে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, আরে সেলিম, আজ আমি সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বিশেষ নির্দেশ দিলাম, আর আজই তুই আসলি!
সেলিম ভাই কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সারা জীবন কষ্ট করেছে, জেল-জুলুম সহ্য করেছে। তাই আমি আমার কিছু নেতা-কর্মীকে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স পারমিট দিতে বলেছি। দলের জন্য, দলের নেতা-কর্মীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর মনে দরদ থাকবে, ভালোবাসা থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশের রাজনীতির একটি বড় দুর্বলতা হলো ব্যক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। অবশ্য শুধু আমাদের দেশে কেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তো দেখা যায়, রাজনীতি চলে মূলত ব্যক্তির ইমেজকে কেন্দ্র করেই। যদিও বলা হয় যে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে বড় দেশ। দল অবশ্য রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মার্ক্সবাদীরা অবশ্য বলেন যে ব্যক্তি দলের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। আবার দল পারে না শ্রেণির ঊর্ধ্বে উঠতে।
এ কথাগুলো বলার পেছনে কারণ আছে। স্বাধীনতার আগের প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও বাংলাদেশ পর্ব শুরু হওয়ার পরের রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে আলোচনার সময় নেতা, নেতৃত্ব, দল, শ্রেণি ইত্যাদি বিষয় মাথায় না থাকলে কথা বললে তা সরলীকরণ দোষে দুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি কীভাবে, কোন লক্ষ্যে পরিচালিত হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা সম্ভবত নেতৃত্বের মাথায় ছিল না। স্বাধীনতার পরপরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অসংগতিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তা ওই প্রস্তুতির অভাব বা ‘দায়িত্ব পেলে সব করে ফেলব’ মানসিকতার জন্যই হচ্ছিল। একটি নাটক সফল মঞ্চায়নের জন্যও রিহার্সাল বা মহড়া দিতে হয়।
এই মহড়ার ঘাটতির জন্যই কি স্বাধীনতার এত বছর পরও রাজনীতিতে সুস্থ ধারা গড়ে উঠল না?
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখার মতলবে ২৫ মার্চ রাতে সেনা অভিযান চালিয়েছিলেন এবং এর জন্য বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে তাঁকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিলেন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। নিজে ক্ষমতায় বসার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ভুট্টোকে কাণ্ডজ্ঞানহীন করে তুলেছিল। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কারণেই ভুট্টোর পক্ষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হয়েছিল।
সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁকে দেখার জন্য একশ্রেণির মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল অপ্রত্যাশিত। যে ভুট্টো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘে গিয়ে প্রয়োজনে ঘাস খেয়েও হাজার বছর যুদ্ধ করার আস্ফালন করেছিলেন, সেই ভুট্টোকে দেখার জন্য বাঙালি অত উতলা হয়ে উঠেছিল কেন?
এটা ঠিক যে ৯ মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি, অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু আমাদের বাহিনীর যে প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র, সামর্থ্য তৈরি হয়েছিল, তা কি সত্যি পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল? ভাগ্যিস, ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর মতো একজন বিচক্ষণ, সাহসী মানুষ। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে এক বর্ম হিসেবে। ভারত তার নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোমর বেঁধে না নামলে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ৯ মাসে বাস্তবে রূপ পেত কি না, তা সত্যি এক বড় প্রশ্ন।
আমরা যে বলি, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে আর মুষ্টিমেয় মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, এটা নিয়েও আমার কিছুটা সংশয় আছে। আমার সংশয়ের পক্ষে তথ্য, যুক্তি আছে। কিন্তু সেটা এখানে নিষ্প্রয়োজন। আদর্শভিত্তিক একটি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির দরকার, তার ঘাটতি যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ছিল, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছিল। আমার সঙ্গে অনেকে যদি দ্বিমত পোষণও করেন, তবু আমি এটাই বলব যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একটি ছোট অংশই দৃঢ় আদর্শিক বিশ্বাসের অধিকারী ছিল। অনেকেই ঘটনাক্রমে মুক্তিযুদ্ধে নেমেছেন। পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার হামলার মুখে জান বাঁচানো ফরজ বিবেচনায় অনেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। আরেকটি অংশ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন সতর্ক হিসাব-নিকাশ করে। তাঁরা বেশি বুদ্ধিমান।
চেতনাগতভাবে একটি বড় গ্যাপ থাকার বিষয়টি জাতীয় নেতৃত্বের কেউ কেউ বুঝতেন বলেই আমার মনে হয়। সে জন্য এই গ্যাপ পূরণের কৌশল হিসেবে শর্টকাট পথ নেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় চার নীতি ঘোষণার মাধ্যমে; বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র নীতি হিসেবে বাংলাদেশ গ্রহণ করবে, এটা সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টিরও চিন্তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু যখন এগুলো রাষ্ট্রীয় নীতি হলো, তখন কমিউনিস্ট পার্টি ও এই ধারার বামেরা কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলেন বলে এখন আমার মনে হয়।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর হাতে গোনা কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগী ছাড়া আওয়ামী লীগ দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো মোটেও ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক নীতির প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণে দলের মধ্যে প্রকাশ্যে কেউ এই নীতির বিরোধিতা করেননি, কিন্তু এই নীতি বাস্তবায়নের পথে যতভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করা যায়, সেই চেষ্টা তাঁরা করেছেন।
রাষ্ট্রীয় নীতি যেহেতু সমাজতন্ত্র, সেহেতু সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলোর আলাদা আলাদা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা খুব জরুরি ছিল না। ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব তুলেছিলেন। সেটা বঙ্গবন্ধু আমলে নেননি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্র ইউনিয়নের ওই সম্মেলনে চার নেতার ছবি বেশ বড় করে টানানো হয়েছিল। প্রথমে বঙ্গবন্ধু, তারপর মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও মোজাফফর আহমেদ। এই চারজনকে সম্মেলনে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জাতীয় ঐক্যের একটি ভিত্তি তৈরির আশা থেকেই হয়তো। সম্মেলনে মওলানা ভাসানী অনুপস্থিত থেকে নিজেকে আলাদা রাখার ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।
সম্মেলন উদ্বোধনের আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতিসহ আরও কিছু গঠনমূলক স্লোগান দিয়েছিলেন। শেষে বলেছিলেন—জয় সমাজতন্ত্র। পাশে দাঁড়ানো ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেলিম ভাইয়ের কানে কানে বলেছিলেন, একবার জয় বাংলাও বলো। এই স্লোগান না দিলে আমরা তো সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে বাঁচতে পারব না।
সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য জয় বাংলা স্লোগানকে কার্যকর মনে করার যুক্তি হয়তো এটাই যে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগান মুক্তিকামী বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু এখন? জয় বাংলা স্লোগান দিতে আইন করতে হয়!
ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ওই সম্মেলনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগকে একীভূত করার প্রস্তাব দেওয়া হলে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নূরে আলম সিদ্দিকী এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, এই একীভূত হওয়ার কথাটি শুনতে ভালো, কিন্তু আসলে ভালো কিছু করার জন্য প্রতিযোগিতা থাকতে হয়। আসুন, আমরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করি।
এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছিলেন, ঠিক আছে, আসুন, আমরা অশিক্ষার বিরুদ্ধে, নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে, অপুষ্টির বিরুদ্ধে, সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রতিযোগিতায় নামি।
কিন্তু ছাত্রলীগ কোন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, সেটা দেখা গেছে মুহসীন হলে সেভেন মার্ডার ও জগন্নাথ হলে ছাত্র ইউনিয়নের ওপর হামলার ঘটনায়।
স্বাধীনতার এক বছর যেতে না যেতেই দেশের মধ্যে অস্থিরতার উপাদান বাড়ছিল। আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতার আচরণ, কার্যকলাপে মানুষের মনে বিরূপতা বাড়ছিল। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাও কমছিল নানা প্রচার-অপপ্রচারের কারণে। বঙ্গবন্ধু নিজেও বিষয়টি টের পেয়েছিলেন কি না, বলা কঠিন।
এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এটা আমি সাবেক ছাত্রনেতা ও কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কাছেই শুনেছি।
বঙ্গবন্ধু সেলিম ভাইকে খুবই পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু সেলিম ভাইকে স্নেহ করতেন, বঙ্গবন্ধুর অফিসে যেতে সেলিম ভাইয়ের কোনো পূর্বানুমতি লাগত না।
১৯৭৩ সালের কোনো একদিন বিশেষ কোনো কাজে সেলিম ভাই গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সেলিম ভাই রুমে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, আরে সেলিম, আজ আমি সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বিশেষ নির্দেশ দিলাম, আর আজই তুই আসলি!
সেলিম ভাই কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সারা জীবন কষ্ট করেছে, জেল-জুলুম সহ্য করেছে। তাই আমি আমার কিছু নেতা-কর্মীকে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স পারমিট দিতে বলেছি। দলের জন্য, দলের নেতা-কর্মীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর মনে দরদ থাকবে, ভালোবাসা থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশের রাজনীতির একটি বড় দুর্বলতা হলো ব্যক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। অবশ্য শুধু আমাদের দেশে কেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তো দেখা যায়, রাজনীতি চলে মূলত ব্যক্তির ইমেজকে কেন্দ্র করেই। যদিও বলা হয় যে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে বড় দেশ। দল অবশ্য রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মার্ক্সবাদীরা অবশ্য বলেন যে ব্যক্তি দলের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। আবার দল পারে না শ্রেণির ঊর্ধ্বে উঠতে।
এ কথাগুলো বলার পেছনে কারণ আছে। স্বাধীনতার আগের প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও বাংলাদেশ পর্ব শুরু হওয়ার পরের রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে আলোচনার সময় নেতা, নেতৃত্ব, দল, শ্রেণি ইত্যাদি বিষয় মাথায় না থাকলে কথা বললে তা সরলীকরণ দোষে দুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি কীভাবে, কোন লক্ষ্যে পরিচালিত হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা সম্ভবত নেতৃত্বের মাথায় ছিল না। স্বাধীনতার পরপরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অসংগতিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তা ওই প্রস্তুতির অভাব বা ‘দায়িত্ব পেলে সব করে ফেলব’ মানসিকতার জন্যই হচ্ছিল। একটি নাটক সফল মঞ্চায়নের জন্যও রিহার্সাল বা মহড়া দিতে হয়।
এই মহড়ার ঘাটতির জন্যই কি স্বাধীনতার এত বছর পরও রাজনীতিতে সুস্থ ধারা গড়ে উঠল না?
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪