এম এম আকাশ
দেশে যথেষ্ট অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে, গণতন্ত্র কিছুটা কম হলেও ক্ষতি নেই—এমন একটি ধারণার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। এই ধারণার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা চীনের দৃষ্টান্তও হাজির করছে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক পূর্তির পরই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার দৃষ্টান্তটি আড়াল করে রাখে। অথচ কে না জানে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনুপস্থিতি আর সীমাহীন বৈষম্যের কারণেই আইয়ুবের গণতন্ত্রহীন ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন-দর্শন তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৪ বছরের শাসনামলে দেশের অবকাঠামোসহ অর্থনীতির নানা সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। আর গণতন্ত্র ও সুশাসন রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ। প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২’ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত ছিল।
বিপরীতে নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল মোট আয়ের ১৭.১ শতাংশ। অথচ ১৯৮১ সালেও দেশে জাতীয় আয়ের ১১.৮ শতাংশ ছিল ১ শতাংশ মানুষের হাতে, আর নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল সম্পদের ২০ শতাংশ। সম্প্রতি বিআইডিএস এক জরিপের ফল প্রকাশ করে জানিয়েছে, দেশে গত চার বছরে ধনী-গরিব সবার আয় বাড়লেও আয় বাড়ার হার সবচেয়ে কম নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। তবে সব শ্রেণির মানুষেরই খরচ বেড়েছে এবং আয়বৈষম্যও বেড়েছে।
পাকিস্তান শাসনামলে গণতন্ত্রহীনতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি ছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে এসেও কি আমরা ভাষা-সংস্কৃতির ওপর নানা আঘাত লক্ষ করছি না! উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবির মুখে ২০১৭ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয় সম্পাদক ও সংকলকদের কিছু না জানিয়েই। এর বাইরেও নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ বাউল, সুফিসাধক অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। যাত্রা, পালাগান, বাউলগানের আসর তো বন্ধ হওয়ার পথে। এসব প্রবণতা পশ্চাৎ-মুখী রাজনীতিরই পরিচায়ক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর। সেই সুবাদে রাজপথ আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ বিরতির পর মাঠে নামতে শুরু করেছে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতও। এই দৃশ্যপটে বামপন্থীদের বিশেষ অবস্থানটি তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি।
বাংলাদেশের বামপন্থী শক্তি ষাট-সত্তর-আশির দশকে এ দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সম্প্রতি মনে হচ্ছে, তা তারা পারছে না। কেন? তাদের একটি অংশের অবস্থান ক্ষমতাসীনদের নেতৃত্বাধীন জোটে। তাদের আশা, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা যাবে। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁদের একজনকে বলেছিলাম, ছাগলের লেজ ছাগলকে নাড়াতে পারে না বরং ছাগলই ইচ্ছেমতো লেজকে নাড়ায়। তিনি পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁকে যদি এখন পুনরায় জিজ্ঞেস করি, ঐক্য করে ‘কতটুকু কী পারলেন?’ তিনি হয়তো বলবেন, ‘তবু তো এটাই “মন্দের ভালো” নয় কি?
না হলে তো দেশটা জামায়াত-বিএনপি জোটের হাতে চলে যেত।’ তারপরও যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ঘোরতর মন্দকে কি মন্দের ভালোকে আশ্রয় করে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে? ব্যর্থ হলে তখন কি ‘উত্তপ্ত কড়াই’ থেকে ‘জ্বলন্ত উনুনে’ গিয়ে পড়ব না? তখন কি আবার ‘উত্তপ্ত কড়াইয়েই’ ফিরে আসার জন্য ফের একসঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে? এর সদুত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, ঘুরেফিরে একই চক্করে আমরা থেকে যাচ্ছি।
এভাবে মন্দের ভালো ও মন্দের যে দ্বিদলীয় চক্রে আমরা আটকে আছি এবং ট্র্যাজেডি ও ফার্সের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, তা থেকে বেরোনোর কি উপায় আছে? আমার মতে, কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হলেও আছে। শুধু আরও ‘মন্দের’ উত্থানের বিরুদ্ধে সজাগ থাকা নয়, পাশাপাশি ‘মন্দের ভালোর’ মন্দ দিকগুলোর বিরুদ্ধেও কার্যকর সংগ্রাম অব্যাহত রাখা এবং সে জন্যই দরকার দুইয়ের বাইরে নিজেদের ও অন্যান্য ভালো শক্তির ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ধীরে ধীরে প্রকৃত সৎ বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলা।
এটা হতে হবে অলটারনেটিভ রাজনৈতিক শক্তি। বামদের তাই একটি স্বতন্ত্র অবস্থান ও ভূমিকা খুবই জরুরি। এ ধরনের একটি দীর্ঘমেয়াদি সংশ্লেষিত ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমুখী রাজনৈতিক ভূমিকাই পারে বামের হৃত গৌরবময় ভূমিকা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু এই বহুমুখী সংগ্রামের মধ্যে কখন কোনটি প্রধান হয়ে উঠবে, সেটি সঠিকভাবে নির্ণয়ের বিচক্ষণতা বাম নেতৃত্বের থাকতে হবে।
বামপন্থীরা অতীতের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের ছাপ রেখেছে দুভাবে। প্রথমত, সমাজের অপেক্ষাকৃত নিঃস্বার্থ তরুণ ছাত্রসমাজের মধ্যে তাদের দৃঢ় যে সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রসমাজকে তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাগে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সমাজের শোষিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠী শহুরে শ্রমিক ও গ্রামীণ শ্রমজীবী জনগণকে তারা সংগঠিত করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মিছিলে টেনে আনতে পেরেছিল। এ জন্যই গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও কর্মসূচিগুলোতে তাদের নির্দেশিত প্রগতিশীল উপাদানগুলো সংযুক্ত হতে পেরেছিল। সে কারণেই দেশ ধীরে ধীরে প্রগতির পথে যাত্রা শুরু করতে পেরেছিল।
কিন্তু এখন কি এই কাজগুলো বামপন্থীরা করতে পারছে? দাবিগুলো কি ঠিকমতো তোলা যাচ্ছে, তা কি সাধারণ ছাত্র ও শ্রমিকের দেহমনে কোনো আলোড়ন তৈরি করতে পারছে? এসব বিষয়ে বামপন্থীদের আরও গভীরে গিয়ে তৃণমূলের ছাত্র ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। বামপন্থীদের একাংশ আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে বসে আছে, অপরাংশ অন্ধ আওয়ামী লীগবিরোধিতা থেকে বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাদের বিচারে আওয়ামী লীগ হচ্ছে ‘মন্দ’, আর বিএনপি হচ্ছে ‘মন্দের ভালো’!
এই দুই ভ্রান্ত প্রবণতার বাইরে যে বামেরা, তারা এখনো তাদের মিত্র শ্রেণি-পেশাগুলোর মধ্যে সাংগঠনিক ভিত্তি প্রসারিত করতে পারেনি। এমনকি জামায়াতেরও যতটুকু ঘাঁটি এলাকা ও সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক শিকড় আছে, দেশি-বিদেশি নেটওয়ার্ক ও সংবাদমাধ্যম আছে, সেসব কিছুই তাদের নেই।
তবে সমাজে ভালো ও পরিচ্ছন্ন লোক হিসেবে বামদের একাংশের এখনো কিছুটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে। ষাট-সত্তর-আশির দশকে তাদের যে বিশাল শক্তি গড়ে উঠেছিল, তারা হয়তো সবাই এখন আর বামপন্থী অবস্থানে নেই। কিন্তু তাদের অনেকেই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ। অন্যদের পাশাপাশি তাদেরও যদি প্রকৃত বিকল্প শক্তি সমাবেশে জড়ো করা যায়, তাহলে বামপন্থীদের ঘিরে আবার বড় একটি বলয় গড়ে তোলা সম্ভব। তখন উদারনৈতিক গণতন্ত্রীরাও তাতে শামিল হবে। এভাবে পুরো প্রক্রিয়াটিকে ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে উদার, বিনয়ী ও স্থিতধী বাম নেতৃত্বের।
আর এখন মূল অ্যাজেন্ডা হবে স্বাধীনতার অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পন্ন করা, গণতান্ত্রিক উন্নয়নসাধন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। ভিত্তি এলাকা গড়ার পাশাপামি বামপন্থীদের প্রভাবাধীন অসংখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং পাকাপোক্ত সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক গড়তে হবে। আদায় করতে হবে বামপন্থীদের প্রতি তৃণমূলে সামাজিক ‘সম্মতি বা আধিপত্য’। কেন্দ্রে থাকতে হবে সৎ এবং উজ্জ্বল ভাবমূর্তিসম্পন্ন উদার ও বিচ্যুতিহীন বামপন্থীদের।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে যথেষ্ট অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে, গণতন্ত্র কিছুটা কম হলেও ক্ষতি নেই—এমন একটি ধারণার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। এই ধারণার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা চীনের দৃষ্টান্তও হাজির করছে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক পূর্তির পরই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার দৃষ্টান্তটি আড়াল করে রাখে। অথচ কে না জানে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনুপস্থিতি আর সীমাহীন বৈষম্যের কারণেই আইয়ুবের গণতন্ত্রহীন ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন-দর্শন তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৪ বছরের শাসনামলে দেশের অবকাঠামোসহ অর্থনীতির নানা সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। আর গণতন্ত্র ও সুশাসন রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ। প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২’ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত ছিল।
বিপরীতে নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল মোট আয়ের ১৭.১ শতাংশ। অথচ ১৯৮১ সালেও দেশে জাতীয় আয়ের ১১.৮ শতাংশ ছিল ১ শতাংশ মানুষের হাতে, আর নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল সম্পদের ২০ শতাংশ। সম্প্রতি বিআইডিএস এক জরিপের ফল প্রকাশ করে জানিয়েছে, দেশে গত চার বছরে ধনী-গরিব সবার আয় বাড়লেও আয় বাড়ার হার সবচেয়ে কম নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। তবে সব শ্রেণির মানুষেরই খরচ বেড়েছে এবং আয়বৈষম্যও বেড়েছে।
পাকিস্তান শাসনামলে গণতন্ত্রহীনতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি ছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে এসেও কি আমরা ভাষা-সংস্কৃতির ওপর নানা আঘাত লক্ষ করছি না! উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবির মুখে ২০১৭ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয় সম্পাদক ও সংকলকদের কিছু না জানিয়েই। এর বাইরেও নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ বাউল, সুফিসাধক অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। যাত্রা, পালাগান, বাউলগানের আসর তো বন্ধ হওয়ার পথে। এসব প্রবণতা পশ্চাৎ-মুখী রাজনীতিরই পরিচায়ক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর। সেই সুবাদে রাজপথ আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ বিরতির পর মাঠে নামতে শুরু করেছে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতও। এই দৃশ্যপটে বামপন্থীদের বিশেষ অবস্থানটি তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি।
বাংলাদেশের বামপন্থী শক্তি ষাট-সত্তর-আশির দশকে এ দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সম্প্রতি মনে হচ্ছে, তা তারা পারছে না। কেন? তাদের একটি অংশের অবস্থান ক্ষমতাসীনদের নেতৃত্বাধীন জোটে। তাদের আশা, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা যাবে। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁদের একজনকে বলেছিলাম, ছাগলের লেজ ছাগলকে নাড়াতে পারে না বরং ছাগলই ইচ্ছেমতো লেজকে নাড়ায়। তিনি পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁকে যদি এখন পুনরায় জিজ্ঞেস করি, ঐক্য করে ‘কতটুকু কী পারলেন?’ তিনি হয়তো বলবেন, ‘তবু তো এটাই “মন্দের ভালো” নয় কি?
না হলে তো দেশটা জামায়াত-বিএনপি জোটের হাতে চলে যেত।’ তারপরও যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ঘোরতর মন্দকে কি মন্দের ভালোকে আশ্রয় করে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে? ব্যর্থ হলে তখন কি ‘উত্তপ্ত কড়াই’ থেকে ‘জ্বলন্ত উনুনে’ গিয়ে পড়ব না? তখন কি আবার ‘উত্তপ্ত কড়াইয়েই’ ফিরে আসার জন্য ফের একসঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে? এর সদুত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, ঘুরেফিরে একই চক্করে আমরা থেকে যাচ্ছি।
এভাবে মন্দের ভালো ও মন্দের যে দ্বিদলীয় চক্রে আমরা আটকে আছি এবং ট্র্যাজেডি ও ফার্সের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, তা থেকে বেরোনোর কি উপায় আছে? আমার মতে, কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হলেও আছে। শুধু আরও ‘মন্দের’ উত্থানের বিরুদ্ধে সজাগ থাকা নয়, পাশাপাশি ‘মন্দের ভালোর’ মন্দ দিকগুলোর বিরুদ্ধেও কার্যকর সংগ্রাম অব্যাহত রাখা এবং সে জন্যই দরকার দুইয়ের বাইরে নিজেদের ও অন্যান্য ভালো শক্তির ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ধীরে ধীরে প্রকৃত সৎ বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলা।
এটা হতে হবে অলটারনেটিভ রাজনৈতিক শক্তি। বামদের তাই একটি স্বতন্ত্র অবস্থান ও ভূমিকা খুবই জরুরি। এ ধরনের একটি দীর্ঘমেয়াদি সংশ্লেষিত ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমুখী রাজনৈতিক ভূমিকাই পারে বামের হৃত গৌরবময় ভূমিকা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু এই বহুমুখী সংগ্রামের মধ্যে কখন কোনটি প্রধান হয়ে উঠবে, সেটি সঠিকভাবে নির্ণয়ের বিচক্ষণতা বাম নেতৃত্বের থাকতে হবে।
বামপন্থীরা অতীতের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের ছাপ রেখেছে দুভাবে। প্রথমত, সমাজের অপেক্ষাকৃত নিঃস্বার্থ তরুণ ছাত্রসমাজের মধ্যে তাদের দৃঢ় যে সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রসমাজকে তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাগে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সমাজের শোষিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠী শহুরে শ্রমিক ও গ্রামীণ শ্রমজীবী জনগণকে তারা সংগঠিত করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মিছিলে টেনে আনতে পেরেছিল। এ জন্যই গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও কর্মসূচিগুলোতে তাদের নির্দেশিত প্রগতিশীল উপাদানগুলো সংযুক্ত হতে পেরেছিল। সে কারণেই দেশ ধীরে ধীরে প্রগতির পথে যাত্রা শুরু করতে পেরেছিল।
কিন্তু এখন কি এই কাজগুলো বামপন্থীরা করতে পারছে? দাবিগুলো কি ঠিকমতো তোলা যাচ্ছে, তা কি সাধারণ ছাত্র ও শ্রমিকের দেহমনে কোনো আলোড়ন তৈরি করতে পারছে? এসব বিষয়ে বামপন্থীদের আরও গভীরে গিয়ে তৃণমূলের ছাত্র ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। বামপন্থীদের একাংশ আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে বসে আছে, অপরাংশ অন্ধ আওয়ামী লীগবিরোধিতা থেকে বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাদের বিচারে আওয়ামী লীগ হচ্ছে ‘মন্দ’, আর বিএনপি হচ্ছে ‘মন্দের ভালো’!
এই দুই ভ্রান্ত প্রবণতার বাইরে যে বামেরা, তারা এখনো তাদের মিত্র শ্রেণি-পেশাগুলোর মধ্যে সাংগঠনিক ভিত্তি প্রসারিত করতে পারেনি। এমনকি জামায়াতেরও যতটুকু ঘাঁটি এলাকা ও সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক শিকড় আছে, দেশি-বিদেশি নেটওয়ার্ক ও সংবাদমাধ্যম আছে, সেসব কিছুই তাদের নেই।
তবে সমাজে ভালো ও পরিচ্ছন্ন লোক হিসেবে বামদের একাংশের এখনো কিছুটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে। ষাট-সত্তর-আশির দশকে তাদের যে বিশাল শক্তি গড়ে উঠেছিল, তারা হয়তো সবাই এখন আর বামপন্থী অবস্থানে নেই। কিন্তু তাদের অনেকেই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ। অন্যদের পাশাপাশি তাদেরও যদি প্রকৃত বিকল্প শক্তি সমাবেশে জড়ো করা যায়, তাহলে বামপন্থীদের ঘিরে আবার বড় একটি বলয় গড়ে তোলা সম্ভব। তখন উদারনৈতিক গণতন্ত্রীরাও তাতে শামিল হবে। এভাবে পুরো প্রক্রিয়াটিকে ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে উদার, বিনয়ী ও স্থিতধী বাম নেতৃত্বের।
আর এখন মূল অ্যাজেন্ডা হবে স্বাধীনতার অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পন্ন করা, গণতান্ত্রিক উন্নয়নসাধন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। ভিত্তি এলাকা গড়ার পাশাপামি বামপন্থীদের প্রভাবাধীন অসংখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং পাকাপোক্ত সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক গড়তে হবে। আদায় করতে হবে বামপন্থীদের প্রতি তৃণমূলে সামাজিক ‘সম্মতি বা আধিপত্য’। কেন্দ্রে থাকতে হবে সৎ এবং উজ্জ্বল ভাবমূর্তিসম্পন্ন উদার ও বিচ্যুতিহীন বামপন্থীদের।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪