রানা আব্বাস
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, অচিরেই শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার গঠিত হবে। এরপর বলা হয়েছিল ঢাকায় ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এরপর মন্ত্রিসভা বিলোপ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিষয়টাকে নির্বাচন-পরবর্তী বেসামরিক সরকার গঠনের প্রস্তুতি হিসেবেই দেখেছে।
ঘটনা যেদিকে গড়াচ্ছিল, তাতে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। এটা পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত ও পুঁজিপতিদের স্বার্থের অনুকূল ছিল না। এরা আওয়ামী লীগকে সব প্রদেশের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করার জন্য চাপ দিতে থাকল এই আশায়, যেন এ রকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্ভাব্য মিত্রদের একটা বিরোধ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তখন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ঘোষণা করেন, তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠেয় পরিষদে যোগ দেবেন না।
ইয়াহিয়া খান এই ঘটনাটিকে লুফে নিলেন। সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতদ্বৈধতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিলেন।
এর উত্তরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করল। প্রদেশজুড়ে চলল মিছিল আর ধর্মঘট। চরমপন্থী আর নৈরাজ্যবাদীরা এই সুযোগ নিয়ে উসকানিমূলক ঘটনা ঘটাতে থাকল। বাংলা আর উর্দুভাষীদের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় শুরু হলো সংঘর্ষ।
এ রকম সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই প্রদেশের শহরগুলোয় সান্ধ্য আইন জারি করেন এং জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ঢাকায় মিলিত হয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আওয়ামী লীগ সে আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে। তখন ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ।
আওয়ামী লীগ ৭ মার্চে ঘোষণা করেছিল যে তারা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং জাতীয় পরিষদে বসবে, যদি চারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়। দাবিগুলো ছিল—এই প্রদেশে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা, তদন্ত করে মামলা তুলে নেওয়া, সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
এ ব্যাপারে সরকার ছিল নীরব। প্রদেশের পরিস্থিতি তাতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তখন সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, জনগণ কর দিতে অস্বীকার করছে। প্রদেশের জীবনযাত্রা তখন শেখ মুজিবের বিশেষ নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তখন যেন দ্বৈতশাসন চলছে। আওয়ামী লীগের নির্দেশে সেনা ব্যারাকে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ অমান্য করে সেনা ইউনিটে খাবার সরবরাহকারীদের আটক করছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
২.
আমাকে ফোন করেছিলেন খালিদ আলী। তিনি ছিলেন করাচির তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। ঢাকায় ২৫ মার্চ পরিষদ অধিবেশন বসবে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মধ্যে আলোচনা হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা অনুযায়ী পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছে। এখন সূক্ষ্ম কাজগুলো শুধু বাকি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে এ রকম একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ সময় প্লেনের টিকিট পাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। আমাদের টিকিট জোগাড় করে দেওয়া হলো। পাকিস্তানি বিমানগুলো তখন কলম্বো ঘুরে ঢাকায় যেত। ভারত তার আকাশসীমা ব্যবহার করে পাকিস্তানি বিমানকে উড়তে দিত না।...বিমানের টিকিট পাওয়া যেত শুধু সরকারের মাধ্যমে। তখন বলা হতো, বিমানে করে এখন শুধু ঘূর্ণিঝড়ের পর সহায়তার জন্য ওষুধপত্র, বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম, খাদ্যদ্রব্যই নেওয়া হচ্ছে। তবে এর কিছুদিন পরই কেবল পরিষ্কার হয়েছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের ভান করে মূলত পাকিস্তান সরকার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাকিস্তানিরা আকাশপথ আর নৌপথে সৈন্য, যুদ্ধসরঞ্জাম নিয়ে আসছিল ঢাকায়। মালবাহী বিমানগুলো লাহোর ও পেশোয়ার থেকে চীনের ভিতর দিয়ে ঢাকায় আসত।...
ঢাকা বিমানবন্দরকে অবরুদ্ধ শিবিরের মতো মনে হচ্ছিল। সর্বত্রই ভারী অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত সেনাসদস্য। আমি অভ্যাসমতো আমার ক্যামেরায় ছবি তুলতে চাইলাম।
সৈন্যরা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছবি তোলা নিষেধ!’
এয়ারপোর্ট ভর্তি নারী ও শিশু। এরা সরকারি কর্মচারীদের পরিবার। এরা ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। টেলিফোনের কাছে গেলাম আমাদের কনসুলেটে ফোন করার জন্য। কিন্তু টেলিফোন নষ্ট। একজন সেনাসদস্য এসে বলল, এখন এখানে সবকিছু আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ‘জয় বাংলা’ বলে ঘিরে ধরে। সোভিয়েত নাগরিক শোনার পর আমার স্যুটকেস চলে যায় একজনের হাতে। কোথা থেকে এসে হাজির হয় একটি টয়োটা গাড়ি। গাড়ির সামনে একটি ছোট্ট পতাকা, যার মাঝখানে পূর্ব বাংলার মানচিত্র আঁকা। গাড়ির চালকের পাশে যে তরুণটি উঠে বসে, ব্যাখ্যা করে, এয়ারপোর্টে আসা বিদেশিদের সাহায্য করার জন্য আওয়ামী লীগের নির্দেশ পালন করছে সে। শহরে এখন নানা ধরনের মাস্তান, ছিঁচকে মাস্তান ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের খপ্পরে যেন বিদেশিরা না পড়ে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসার আগে ছেলেটা নেমে যায়। এই হোটেলে শুধু বিদেশিদেরই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল।
আমি যখন হোটেলের ফরম পূরণ করছি, তখন সেখানে ব্যক্তিগত পাহারাদারসহ উপস্থিত হলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। সাংবাদিকেরা ছুটে গেল তাঁর কাছে, ‘বৈঠক কেমন হচ্ছে?’
‘নতুন কিছু বলার মতো নেই।’ উত্তর দিলেন ভুট্টো। ‘প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কখনো আলাদাভাবে বসবেন, কখনো আমাদের দুজনের সঙ্গে একসাথে। কথাবার্তাগুলো জটিল। কেউই ছাড় দিতে চায় না।’
‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কি এই প্রদেশে সামরিক বাহিনী নামানো হবে?’
‘সেটা করা হলে তা হবে বিশাল ট্র্যাজেডি। রাজনৈতিক সমাধান হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।’
সেখানে তখন উপস্থিত হয়েছেন আমার পুরোনো পরিচিত ইত্তেফাকের অন্যতম সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। এই পত্রিকাটি আওয়ামী লীগের মুখপত্র। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সর্বশেষ নির্দেশাবলি নিয়ে কথা বলছিলেন। আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্রীয় ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিচ্ছে, রেললাইন, ব্যাংক, টেলিগ্রাফ অফিসেরও দায়িত্ব নিচ্ছে। সরকারি মহলকে জনসাধারণ আর কর দেবে না। আওয়ামী লীগের নির্দেশ বা অনুমতি ছাড়া কোনো ঘোষণারই বাস্তবায়ন হবে না।
সকালবেলা। পল্টন ময়দানে জনসভা। সবাই মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শোনার জন্য এসেছে। লোকে লোকারণ্য। গাছে গাছে ঝুলছে মাইক। শেখ মুজিবুর রহমানের গাড়ি এসে হাজির হতেই ময়দানে গগনবিদারী চিৎকার। ‘জয় বাংলা।’ শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে দুই হাত তুলে অভিবাদনের জবাব দিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের দুঃখ ও কষ্টের কথা বললেন, বাঙালিদের ওপর শোষণের কথা বললেন। বাঙালিদের যে ইসলামাবাদের সরকার মানুষ বলে গণ্য করে না, সে কথা ভেসে এল মাইক্রোফোন থেকে। তিনি স্পষ্ট করে বললেন, ‘আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের
বিরুদ্ধে নয়। এই সরকারই আমাদের সঙ্গে ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও আমাদের মতোই মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়ছে।
ঠিক সে সময় পাকিস্তানের বিমানবহর দেখা যায় আকাশে। জনগণ আকাশের দিকে বাকহীন তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সেই দৃষ্টিতে ছিল ঘৃণা আর ঘৃণা।
লেখক: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে প্রাভদার সংবাদদাতা
• রুশ বই পারিভায়া স্প্রোশলিম (অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে) থেকে অনুবাদ করেছেন জাহীদ রেজা নূর
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, অচিরেই শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার গঠিত হবে। এরপর বলা হয়েছিল ঢাকায় ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এরপর মন্ত্রিসভা বিলোপ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিষয়টাকে নির্বাচন-পরবর্তী বেসামরিক সরকার গঠনের প্রস্তুতি হিসেবেই দেখেছে।
ঘটনা যেদিকে গড়াচ্ছিল, তাতে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। এটা পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত ও পুঁজিপতিদের স্বার্থের অনুকূল ছিল না। এরা আওয়ামী লীগকে সব প্রদেশের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করার জন্য চাপ দিতে থাকল এই আশায়, যেন এ রকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্ভাব্য মিত্রদের একটা বিরোধ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তখন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ঘোষণা করেন, তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠেয় পরিষদে যোগ দেবেন না।
ইয়াহিয়া খান এই ঘটনাটিকে লুফে নিলেন। সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতদ্বৈধতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিলেন।
এর উত্তরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করল। প্রদেশজুড়ে চলল মিছিল আর ধর্মঘট। চরমপন্থী আর নৈরাজ্যবাদীরা এই সুযোগ নিয়ে উসকানিমূলক ঘটনা ঘটাতে থাকল। বাংলা আর উর্দুভাষীদের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় শুরু হলো সংঘর্ষ।
এ রকম সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই প্রদেশের শহরগুলোয় সান্ধ্য আইন জারি করেন এং জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ঢাকায় মিলিত হয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আওয়ামী লীগ সে আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে। তখন ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ।
আওয়ামী লীগ ৭ মার্চে ঘোষণা করেছিল যে তারা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং জাতীয় পরিষদে বসবে, যদি চারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়। দাবিগুলো ছিল—এই প্রদেশে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা, তদন্ত করে মামলা তুলে নেওয়া, সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
এ ব্যাপারে সরকার ছিল নীরব। প্রদেশের পরিস্থিতি তাতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তখন সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, জনগণ কর দিতে অস্বীকার করছে। প্রদেশের জীবনযাত্রা তখন শেখ মুজিবের বিশেষ নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তখন যেন দ্বৈতশাসন চলছে। আওয়ামী লীগের নির্দেশে সেনা ব্যারাকে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ অমান্য করে সেনা ইউনিটে খাবার সরবরাহকারীদের আটক করছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
২.
আমাকে ফোন করেছিলেন খালিদ আলী। তিনি ছিলেন করাচির তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। ঢাকায় ২৫ মার্চ পরিষদ অধিবেশন বসবে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মধ্যে আলোচনা হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা অনুযায়ী পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছে। এখন সূক্ষ্ম কাজগুলো শুধু বাকি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে এ রকম একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ সময় প্লেনের টিকিট পাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। আমাদের টিকিট জোগাড় করে দেওয়া হলো। পাকিস্তানি বিমানগুলো তখন কলম্বো ঘুরে ঢাকায় যেত। ভারত তার আকাশসীমা ব্যবহার করে পাকিস্তানি বিমানকে উড়তে দিত না।...বিমানের টিকিট পাওয়া যেত শুধু সরকারের মাধ্যমে। তখন বলা হতো, বিমানে করে এখন শুধু ঘূর্ণিঝড়ের পর সহায়তার জন্য ওষুধপত্র, বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম, খাদ্যদ্রব্যই নেওয়া হচ্ছে। তবে এর কিছুদিন পরই কেবল পরিষ্কার হয়েছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের ভান করে মূলত পাকিস্তান সরকার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাকিস্তানিরা আকাশপথ আর নৌপথে সৈন্য, যুদ্ধসরঞ্জাম নিয়ে আসছিল ঢাকায়। মালবাহী বিমানগুলো লাহোর ও পেশোয়ার থেকে চীনের ভিতর দিয়ে ঢাকায় আসত।...
ঢাকা বিমানবন্দরকে অবরুদ্ধ শিবিরের মতো মনে হচ্ছিল। সর্বত্রই ভারী অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত সেনাসদস্য। আমি অভ্যাসমতো আমার ক্যামেরায় ছবি তুলতে চাইলাম।
সৈন্যরা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছবি তোলা নিষেধ!’
এয়ারপোর্ট ভর্তি নারী ও শিশু। এরা সরকারি কর্মচারীদের পরিবার। এরা ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। টেলিফোনের কাছে গেলাম আমাদের কনসুলেটে ফোন করার জন্য। কিন্তু টেলিফোন নষ্ট। একজন সেনাসদস্য এসে বলল, এখন এখানে সবকিছু আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ‘জয় বাংলা’ বলে ঘিরে ধরে। সোভিয়েত নাগরিক শোনার পর আমার স্যুটকেস চলে যায় একজনের হাতে। কোথা থেকে এসে হাজির হয় একটি টয়োটা গাড়ি। গাড়ির সামনে একটি ছোট্ট পতাকা, যার মাঝখানে পূর্ব বাংলার মানচিত্র আঁকা। গাড়ির চালকের পাশে যে তরুণটি উঠে বসে, ব্যাখ্যা করে, এয়ারপোর্টে আসা বিদেশিদের সাহায্য করার জন্য আওয়ামী লীগের নির্দেশ পালন করছে সে। শহরে এখন নানা ধরনের মাস্তান, ছিঁচকে মাস্তান ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের খপ্পরে যেন বিদেশিরা না পড়ে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসার আগে ছেলেটা নেমে যায়। এই হোটেলে শুধু বিদেশিদেরই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল।
আমি যখন হোটেলের ফরম পূরণ করছি, তখন সেখানে ব্যক্তিগত পাহারাদারসহ উপস্থিত হলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। সাংবাদিকেরা ছুটে গেল তাঁর কাছে, ‘বৈঠক কেমন হচ্ছে?’
‘নতুন কিছু বলার মতো নেই।’ উত্তর দিলেন ভুট্টো। ‘প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কখনো আলাদাভাবে বসবেন, কখনো আমাদের দুজনের সঙ্গে একসাথে। কথাবার্তাগুলো জটিল। কেউই ছাড় দিতে চায় না।’
‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কি এই প্রদেশে সামরিক বাহিনী নামানো হবে?’
‘সেটা করা হলে তা হবে বিশাল ট্র্যাজেডি। রাজনৈতিক সমাধান হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।’
সেখানে তখন উপস্থিত হয়েছেন আমার পুরোনো পরিচিত ইত্তেফাকের অন্যতম সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। এই পত্রিকাটি আওয়ামী লীগের মুখপত্র। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সর্বশেষ নির্দেশাবলি নিয়ে কথা বলছিলেন। আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্রীয় ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিচ্ছে, রেললাইন, ব্যাংক, টেলিগ্রাফ অফিসেরও দায়িত্ব নিচ্ছে। সরকারি মহলকে জনসাধারণ আর কর দেবে না। আওয়ামী লীগের নির্দেশ বা অনুমতি ছাড়া কোনো ঘোষণারই বাস্তবায়ন হবে না।
সকালবেলা। পল্টন ময়দানে জনসভা। সবাই মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শোনার জন্য এসেছে। লোকে লোকারণ্য। গাছে গাছে ঝুলছে মাইক। শেখ মুজিবুর রহমানের গাড়ি এসে হাজির হতেই ময়দানে গগনবিদারী চিৎকার। ‘জয় বাংলা।’ শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে দুই হাত তুলে অভিবাদনের জবাব দিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের দুঃখ ও কষ্টের কথা বললেন, বাঙালিদের ওপর শোষণের কথা বললেন। বাঙালিদের যে ইসলামাবাদের সরকার মানুষ বলে গণ্য করে না, সে কথা ভেসে এল মাইক্রোফোন থেকে। তিনি স্পষ্ট করে বললেন, ‘আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের
বিরুদ্ধে নয়। এই সরকারই আমাদের সঙ্গে ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও আমাদের মতোই মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়ছে।
ঠিক সে সময় পাকিস্তানের বিমানবহর দেখা যায় আকাশে। জনগণ আকাশের দিকে বাকহীন তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সেই দৃষ্টিতে ছিল ঘৃণা আর ঘৃণা।
লেখক: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে প্রাভদার সংবাদদাতা
• রুশ বই পারিভায়া স্প্রোশলিম (অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে) থেকে অনুবাদ করেছেন জাহীদ রেজা নূর
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪