বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার জন্য সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে জমায়েত হতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। শুধু ঢাকা শহর নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও আসতে থাকে জনতার স্রোত। বঙ্গবন্ধু যখন সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন, তখন রেসকোর্স পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। এটা এখন সবারই জানা যে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একদিকে বঙ্গবন্ধুর ওপর তাঁর তরুণ সহকর্মী-সমর্থকদের ছিল চাপ, অপরদিকে ইয়াহিয়ার কঠোর পদক্ষেপের হুমকি—এই দুই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে শেখ মুজিবকে স্থির করতে হয় ৭ মার্চে জনসভায় এমন এক মাঝামাঝি অবস্থান, যা দুই দিকের চাপ সাময়িকভাবে হলেও প্রশমিত করতে পারবে।
অনেকের লেখা থেকেই জানা যায়, ৬ মার্চ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা বৈঠকে বসেছিলেন রেসকোর্সের আহূত জনসভায় শেখ মুজিবের ভাষণে কী থাকা বিধেয় তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। এই বৈঠকের মধ্যেই তাঁরা শুনতে পেলেন ইয়াহিয়ার কঠোর সতর্কবাণী। সঙ্গে সঙ্গে সেই বৈঠক মুলতবি করে ড. কামাল হোসেনকে শেখ মুজিব বললেন, ৭ মার্চের জনসভার বক্তৃতার খসড়া লিখে ফেলতে। বৈঠকে আলোচিত অন্য সবার অভিমতের ভিত্তিতে ড. কামাল ইংরেজিতে বক্তৃতার খসড়াটি দাঁড় করান, যা সিনিয়র নেতাদের দেখানো হয়। ইংরেজি ভাষ্যটি তাজউদ্দীনের কাছে রেখে দেওয়া হয় পরদিন জনসভার পর বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে বিতরণের উদ্দেশ্যে। এই খসড়াকে অবলম্বন করেই পরদিন শেখ মুজিব বাংলায় তাঁর অননুকরণীয় ওজস্বিতায় ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতাটি প্রদান করেন।
উপস্থিত লাখ লাখ জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্যেই মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জলদগম্ভীর কণ্ঠে ‘ভায়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করে সবাইকে আপন করে নেন এবং জনসভায় তাঁর উপস্থিতির কারণ যে কারও অজানা নয়, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’
মানুষ কী চায় তারও উল্লেখ করেন শুরুতেই। বলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলব, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’
নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব।’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। যুক্তিসংগত কথায় তাঁর আস্থার কথা ব্যক্ত করে বলেন, ‘অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব; এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’
পরিষদ অধিবেশন আকস্মিক স্থগিত হওয়া ও পরের অবস্থা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্দুকের মুখে মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।’
পাঠক লক্ষ করুন, চরম উত্তেজনাকর অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে ‘সাহেব’ বলেই সম্বোধন করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিষদ অধিবেশন নতুন করে আহ্বান করার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের ওপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে: প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল উইথ্ড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।’
বঙ্গবন্ধু জানতেন, শাসকেরা যুক্তির ভাষা বোঝে না, শক্তির ভাষা বোঝে। তাঁর শর্ত ইয়াহিয়া মানবেন না। তাহলে কী হবে? জনগণের করণীয় কী? বঙ্গবন্ধু দিলেন নির্দেশনা। বললেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’
এই কয়েকটি বাক্যের মধ্যে অনেক কিছু তিনি বলেছেন। তিনি যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন। রাজনৈতিক নির্দেশনা দেওয়ার সময় তিনি না-ও পেতে পারেন। তাই তিনি ‘হুকুম দিবার’ না পারলেও জনতাকে করণীয় বলে দিলেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে বলেন। পরের লড়াইটা যে সহজ ও দ্রুত শেষ হবে না, আবার একটি সংগঠিত সামরিক শক্তিধারী সরকারকে নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে জব্দ করা যে কঠিন, তা বুঝেই তিনি ‘রাস্তাঘাট বন্ধ’ ও ভাতে মারা পানিতে মারার কথা বলে মূলত একটি গেরিলা যুদ্ধের কৌশলই বাতলে দিয়েছিলেন। রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা বন্ধ করা যেকোনো শক্তিকে দুর্বল করার বড় উপায়।
শাসকদের সতর্ক করে বললেন, ‘আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ আর বাঙালির বিজয় যে অনিবার্য সেটাও বললেন এই বলে, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধু জানতেন, তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কী পরিণতি হতে পারে। সেনাবাহিনী তৈরি ছিল তোপ দাগার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এটাও জানতেন যে তিনি যদি মানুষের মনের ভাষা প্রকাশ না করেন তাহলে তাঁরা হতাশ হবেন। তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। শাসকগোষ্ঠীর চোখে ধুলো দিয়ে জনতার উদ্দীপনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভাষণের একেবারে শেষে এসে শোনালেন সেই মহাকাব্যিক বাণী ‘যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’।
উপস্থিত উচ্ছ্বসিত জনতা পেয়ে গেল স্বাধীনতার ঘোষণা। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। আরও বহু রক্ত দিয়ে মুক্ত স্বদেশে ওড়ানো হলো স্বাধীনতার পতাকা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার জন্য সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে জমায়েত হতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। শুধু ঢাকা শহর নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও আসতে থাকে জনতার স্রোত। বঙ্গবন্ধু যখন সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন, তখন রেসকোর্স পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। এটা এখন সবারই জানা যে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একদিকে বঙ্গবন্ধুর ওপর তাঁর তরুণ সহকর্মী-সমর্থকদের ছিল চাপ, অপরদিকে ইয়াহিয়ার কঠোর পদক্ষেপের হুমকি—এই দুই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে শেখ মুজিবকে স্থির করতে হয় ৭ মার্চে জনসভায় এমন এক মাঝামাঝি অবস্থান, যা দুই দিকের চাপ সাময়িকভাবে হলেও প্রশমিত করতে পারবে।
অনেকের লেখা থেকেই জানা যায়, ৬ মার্চ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা বৈঠকে বসেছিলেন রেসকোর্সের আহূত জনসভায় শেখ মুজিবের ভাষণে কী থাকা বিধেয় তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। এই বৈঠকের মধ্যেই তাঁরা শুনতে পেলেন ইয়াহিয়ার কঠোর সতর্কবাণী। সঙ্গে সঙ্গে সেই বৈঠক মুলতবি করে ড. কামাল হোসেনকে শেখ মুজিব বললেন, ৭ মার্চের জনসভার বক্তৃতার খসড়া লিখে ফেলতে। বৈঠকে আলোচিত অন্য সবার অভিমতের ভিত্তিতে ড. কামাল ইংরেজিতে বক্তৃতার খসড়াটি দাঁড় করান, যা সিনিয়র নেতাদের দেখানো হয়। ইংরেজি ভাষ্যটি তাজউদ্দীনের কাছে রেখে দেওয়া হয় পরদিন জনসভার পর বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে বিতরণের উদ্দেশ্যে। এই খসড়াকে অবলম্বন করেই পরদিন শেখ মুজিব বাংলায় তাঁর অননুকরণীয় ওজস্বিতায় ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতাটি প্রদান করেন।
উপস্থিত লাখ লাখ জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্যেই মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জলদগম্ভীর কণ্ঠে ‘ভায়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করে সবাইকে আপন করে নেন এবং জনসভায় তাঁর উপস্থিতির কারণ যে কারও অজানা নয়, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’
মানুষ কী চায় তারও উল্লেখ করেন শুরুতেই। বলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলব, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’
নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব।’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। যুক্তিসংগত কথায় তাঁর আস্থার কথা ব্যক্ত করে বলেন, ‘অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব; এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’
পরিষদ অধিবেশন আকস্মিক স্থগিত হওয়া ও পরের অবস্থা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্দুকের মুখে মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।’
পাঠক লক্ষ করুন, চরম উত্তেজনাকর অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে ‘সাহেব’ বলেই সম্বোধন করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিষদ অধিবেশন নতুন করে আহ্বান করার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের ওপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে: প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল উইথ্ড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।’
বঙ্গবন্ধু জানতেন, শাসকেরা যুক্তির ভাষা বোঝে না, শক্তির ভাষা বোঝে। তাঁর শর্ত ইয়াহিয়া মানবেন না। তাহলে কী হবে? জনগণের করণীয় কী? বঙ্গবন্ধু দিলেন নির্দেশনা। বললেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’
এই কয়েকটি বাক্যের মধ্যে অনেক কিছু তিনি বলেছেন। তিনি যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন। রাজনৈতিক নির্দেশনা দেওয়ার সময় তিনি না-ও পেতে পারেন। তাই তিনি ‘হুকুম দিবার’ না পারলেও জনতাকে করণীয় বলে দিলেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে বলেন। পরের লড়াইটা যে সহজ ও দ্রুত শেষ হবে না, আবার একটি সংগঠিত সামরিক শক্তিধারী সরকারকে নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে জব্দ করা যে কঠিন, তা বুঝেই তিনি ‘রাস্তাঘাট বন্ধ’ ও ভাতে মারা পানিতে মারার কথা বলে মূলত একটি গেরিলা যুদ্ধের কৌশলই বাতলে দিয়েছিলেন। রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা বন্ধ করা যেকোনো শক্তিকে দুর্বল করার বড় উপায়।
শাসকদের সতর্ক করে বললেন, ‘আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ আর বাঙালির বিজয় যে অনিবার্য সেটাও বললেন এই বলে, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধু জানতেন, তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কী পরিণতি হতে পারে। সেনাবাহিনী তৈরি ছিল তোপ দাগার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এটাও জানতেন যে তিনি যদি মানুষের মনের ভাষা প্রকাশ না করেন তাহলে তাঁরা হতাশ হবেন। তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। শাসকগোষ্ঠীর চোখে ধুলো দিয়ে জনতার উদ্দীপনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভাষণের একেবারে শেষে এসে শোনালেন সেই মহাকাব্যিক বাণী ‘যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’।
উপস্থিত উচ্ছ্বসিত জনতা পেয়ে গেল স্বাধীনতার ঘোষণা। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। আরও বহু রক্ত দিয়ে মুক্ত স্বদেশে ওড়ানো হলো স্বাধীনতার পতাকা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪