নজরুল ইসলাম
আজকের পত্রিকার এক বছর হয়ে গেছে। এই এক বছরে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নির্দিষ্ট করে আমরা দু-একটি বিষয় দেখতে পারি। বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতি কেমন হয়েছে, তা একটু দেখা যাক।
গত দুই বছর কোভিডের কারণে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বাধা পড়েছিল। তবু কিছু না কিছু অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। তবে শহরে অগ্রগতি বেশি হয়। শহরের কথা যদি বলি, নানা হিসাবেই রাজধানী ঢাকাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নটা তুলনামূলকভাবে বেশি হয় এবং এখানে বৈষম্য প্রকট। কোভিডের সময় অতি দরিদ্র যারা, যেমন রিকশাওয়ালা, খেটে খাওয়া মানুষ—এদের অনেকের আয় ছিল না। অনেকের আয় একেবারে কমে গেছে। এখন অনেকটা সামাল দেওয়া গেছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ গত এক বছরে খুব খারাপ না করলেও গরিব মানুষের তেমন উন্নতি হয়নি। বরং অনেকের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে।
জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান দিক শিক্ষা। করোনাকালে শিক্ষায় অনেক সমস্যা হয়েছে। অনেক স্কুল, কলেজ বন্ধ ছিল। অনলাইনে ক্লাস হয়েছে; যেটা শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েদের জন্য কঠিন ছিল না। শহরের নিম্নবিত্ত যারা, যাদের হাতে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন নেই, তাদের অনলাইন ক্লাস করা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিক স্কুলগুলোতে অবশ্য অনলাইনে ক্লাস হয়নি। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে কিংবা বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা পড়ে যেসব স্কুলে, সেখানে ক্লাস হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, সেখানে অনলাইন ক্লাস হয়েছে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমরা দেখি, কোভিড সারা দুনিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৬৩ লাখ মানুষ করোনায় মারা গেছে। আমেরিকাতেই মারা গেছে ১০ লাখের বেশি মানুষ। যুক্তরাজ্য কানাডা, ভারত—সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় কম মানুষ মারা গেছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কোভিডে মারা গেছে প্রায় ২৯ হাজার। ভয় ছিল, এ দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি, এদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়। তাদের প্রাণহানির আশঙ্কা বেশি ছিল। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা-ব্যবস্থা প্রথম দিকে খুবই সমস্যায় ছিল। টিকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে সেটি রাখা সম্ভব হয়নি। পরে যদিও সামাল দেওয়া হয়েছে। এখানে সরকারের হয়তো সাফল্য ছিল, জনগণও সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এই ফাঁকে আমরা দেখি স্বাস্থ্য খাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। হাসপাতালে ও বিভিন্ন পর্যায়ে বড় বড় অনেক দুর্নীতি আমরা দেখতে পেয়েছি, যা খুব দুঃখজনক।
ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে রাস্তাঘাট, সড়ক, সেতু তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পদ্মা সেতু। এটি সরকারের একটি বড় সাফল্য। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদাতা গোষ্ঠী ঋণ প্রদানের চুক্তি করেও বাতিল করে দিয়ে বাংলাদেশকে এক সমূহ বিপদে ফেলে। সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো অসম্ভব মনে হয়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোভাব ও সাহসের কারণে এটি নিজস্ব অর্থায়নে করা সম্ভব হয়েছে। হয়তো অর্থ ব্যয় একটু বেশি হয়েছে, সমালোচকেরা বলবেন অর্থ ব্যয় সঠিকভাবে হয়নি। তবে পদ্মা সেতু ২০২২ সালের জন্য একটি বিরাট মাইলফলক। দক্ষিণ বাংলার বরিশাল, খুলনাসহ ২১টি জেলা এর
সুবিধা ভোগ করবে। আশা করা যায়, এসব এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। সব মিলিয়ে সরকার, অর্থনীতিবিদেরা আশা করছেন, এ বছর ১ দশমিক ২ বা ১ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেটি এখন আরও বেড়ে যাবে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক খবর।
উন্নয়ন হলেও ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না হলে, নীতিমালা ঠিকমতো মানানো না গেলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীদূষণ, নদী দখল, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ—এসবের কারণে পরিবেশ দূষিত হয়। প্লাস্টিকের কারণেও ব্যাপকভাবে এখন দূষণ হয়। দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল। ঢাকায় যে প্রায় দুই কোটি লোক বাস করে, তাদের সবার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক নয়। এতে করে আশপাশের নদী ও বায়ু দূষিত হচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকে শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশিতে ভোগে। এখন অবশ্য অনেকেই রাস্তায় বের হলে মাস্ক ব্যবহার করেন। এটি কোভিডের বিরুদ্ধে এবং ধুলাবালি ও দূষণ থেকে বেঁচে থাকার সঠিক ব্যবস্থা। কোভিডের অনেক আগেই চীন, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ানের লোকজন ধুলাবালি ও দূষণ প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহার করত। কোভিডের পরে আমাদের এখানেও মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতা বেড়েছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে নগরায়ণ খুব দ্রুত হয়েছে। স্বাধীনতার আগে হয়তো নগরে ৭০ লাখ লোক ছিল, এখন ৬-৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। শহরে এই চলে আসাটা পরিকল্পিতভাবে হয়নি। এটা হয়েছে তাগিদে। গ্রামের ধাক্কা ও শহরের সুযোগ এবং আকর্ষণের কারণে। একটাকে বলে পুশ ফ্যাক্টর, আরেকটা হলো কুল ফ্যাক্টর। দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, দুর্যোগ—এসব হলো পুশ ফ্যাক্টর। কুল ফ্যাক্টর হলো, শহরে এসে কিছু না কিছু করে খাওয়া যায়। কিছু না হলেও রিকশা চালানো যায়, বাড়িতে কাজ করা যায়, ফুটপাতে বসে চা বিক্রি করা যায়। এই কাজগুলো নিম্নবিত্ত সংসারকে টিকিয়ে রাখে। প্রায় ২ কোটি লোক ঢাকায় এবং সারা দেশে ৬-৭ কোটি লোক শহরে যারা বাস করে, তাদের অধিকাংশই নিজের আয় নিজে ব্যবস্থা করে। এরা সরকারকে বলে না, আমাকে চাকরি দাও। দরকারই নেই। এরা চিনাবাদাম, কমলালেবু, কলা—এসব বিক্রি করে। এটাকে বলে নিম্নমানের নগরায়ণ।
গত ৩০ বছরে কয়েক হাজারের মতো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি হয়েছে, সেখানে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। একটা বাড়ির দুটো মেয়ে যদি কাজ করে, তাহলে ১৫+১৫= ৩০ হাজার টাকা পায়। আগে তো পেত না কিছুই। এখন পায়। আয়-উপার্জন বেড়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে। এটাকে আমরা বলি প্রাতিষ্ঠানিক খাত। এর চেয়ে অনেক বেশি হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। স্বনিয়োজিত শ্রমিক, মজুর, ছোট ব্যবসায়ী, কাজের মানুষ, গৃহকর্মী—এরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে পড়ে।
এ ছাড়া বিভিন্ন কলকারখানা, অফিস-আদালত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এমনকি সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত লোক নিয়োগ করা হয়। এতে কর্মসংস্থান হয়। পত্রিকা অফিসসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু অল্প শিক্ষিত মানুষ, যেমন দারোয়ান ও অন্যদের কাজের সুযোগ হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেবেন। এটা খুব ভালো। একসঙ্গে সব হবে না, ধীরে ধীরে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী নগরায়ণ নিরুৎসাহিত করতে হবে। বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, ৫০০ উপজেলা শহরকে উন্নত করতে হবে, ইনসেনটিভ দিতে হবে। ফ্যাক্টরি, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দিতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো, ঢাকা থেকে লোক সরিয়ে ঢাকার বাইরে আশপাশের শহরে নিয়ে যেতে হবে।
পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুটি শহর হয়ে যাবে। মাওয়া প্রান্তে একটা, জাজিরা প্রান্তে একটা। এগুলো হয়তো ১০-২০ হাজার লোকের শহর হবে। সুবিধা থাকলে ঢাকা থেকে অনেকে চলে যাবে। এটা হলো জাতীয়ভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা। আরেক পদক্ষেপ নেওয়া যায়, প্রতিটি শহরকে পরিকল্পিতভাবে সাজানোর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা বা রাজশাহীর উন্নয়নের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ আছে। এ ছাড়া কয়েকটি জেলায় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে। রাস্তাঘাট, পরিবহন, কোথায় আবাসিক এলাকা, কোথায় বাণিজ্যিক এলাকা, শিক্ষা এলাকা ইত্যাদি হবে, তা পরিকল্পনা করে সাজাতে হবে। আবার পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, সুচারুভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য দরকার ভালো বাস্তবায়নকারী সংস্থা। সেসব সংস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে হবে না।
অর্থাৎ, পরিকল্পনা সঠিক হতে হবে। পরিকল্পনা সঠিক হওয়ার পরে জনগণ যদি মেনে নেয়, তাহলে সঠিকভাবে, সঠিক মানুষ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। চূড়ান্ত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে, যদি কর্তৃপক্ষ সঠিক হয়। সুশাসন সঠিক হতে হবে। নগর কর্মকর্তা, মেয়র, ওয়াসার এমডি, চেয়ারম্যানসহ সবার অংশগ্রহণ দরকার। নগরের নেতা যদি ভালো হন, তাঁর আদর্শ, নীতি, চিন্তাভাবনা যদি ভালো হয়, তাঁর নেতৃত্বগুণ যদি ভালো হয়, তাহলে পরিকল্পিত নগর হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, নগরবিদ ও শিল্প সমালোচক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
অনুলিখন: রিক্তা রিচি
আজকের পত্রিকার এক বছর হয়ে গেছে। এই এক বছরে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নির্দিষ্ট করে আমরা দু-একটি বিষয় দেখতে পারি। বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতি কেমন হয়েছে, তা একটু দেখা যাক।
গত দুই বছর কোভিডের কারণে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বাধা পড়েছিল। তবু কিছু না কিছু অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। তবে শহরে অগ্রগতি বেশি হয়। শহরের কথা যদি বলি, নানা হিসাবেই রাজধানী ঢাকাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নটা তুলনামূলকভাবে বেশি হয় এবং এখানে বৈষম্য প্রকট। কোভিডের সময় অতি দরিদ্র যারা, যেমন রিকশাওয়ালা, খেটে খাওয়া মানুষ—এদের অনেকের আয় ছিল না। অনেকের আয় একেবারে কমে গেছে। এখন অনেকটা সামাল দেওয়া গেছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ গত এক বছরে খুব খারাপ না করলেও গরিব মানুষের তেমন উন্নতি হয়নি। বরং অনেকের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে।
জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান দিক শিক্ষা। করোনাকালে শিক্ষায় অনেক সমস্যা হয়েছে। অনেক স্কুল, কলেজ বন্ধ ছিল। অনলাইনে ক্লাস হয়েছে; যেটা শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েদের জন্য কঠিন ছিল না। শহরের নিম্নবিত্ত যারা, যাদের হাতে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন নেই, তাদের অনলাইন ক্লাস করা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিক স্কুলগুলোতে অবশ্য অনলাইনে ক্লাস হয়নি। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে কিংবা বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা পড়ে যেসব স্কুলে, সেখানে ক্লাস হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, সেখানে অনলাইন ক্লাস হয়েছে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমরা দেখি, কোভিড সারা দুনিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৬৩ লাখ মানুষ করোনায় মারা গেছে। আমেরিকাতেই মারা গেছে ১০ লাখের বেশি মানুষ। যুক্তরাজ্য কানাডা, ভারত—সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় কম মানুষ মারা গেছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কোভিডে মারা গেছে প্রায় ২৯ হাজার। ভয় ছিল, এ দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি, এদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়। তাদের প্রাণহানির আশঙ্কা বেশি ছিল। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা-ব্যবস্থা প্রথম দিকে খুবই সমস্যায় ছিল। টিকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে সেটি রাখা সম্ভব হয়নি। পরে যদিও সামাল দেওয়া হয়েছে। এখানে সরকারের হয়তো সাফল্য ছিল, জনগণও সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এই ফাঁকে আমরা দেখি স্বাস্থ্য খাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। হাসপাতালে ও বিভিন্ন পর্যায়ে বড় বড় অনেক দুর্নীতি আমরা দেখতে পেয়েছি, যা খুব দুঃখজনক।
ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে রাস্তাঘাট, সড়ক, সেতু তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পদ্মা সেতু। এটি সরকারের একটি বড় সাফল্য। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদাতা গোষ্ঠী ঋণ প্রদানের চুক্তি করেও বাতিল করে দিয়ে বাংলাদেশকে এক সমূহ বিপদে ফেলে। সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো অসম্ভব মনে হয়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোভাব ও সাহসের কারণে এটি নিজস্ব অর্থায়নে করা সম্ভব হয়েছে। হয়তো অর্থ ব্যয় একটু বেশি হয়েছে, সমালোচকেরা বলবেন অর্থ ব্যয় সঠিকভাবে হয়নি। তবে পদ্মা সেতু ২০২২ সালের জন্য একটি বিরাট মাইলফলক। দক্ষিণ বাংলার বরিশাল, খুলনাসহ ২১টি জেলা এর
সুবিধা ভোগ করবে। আশা করা যায়, এসব এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। সব মিলিয়ে সরকার, অর্থনীতিবিদেরা আশা করছেন, এ বছর ১ দশমিক ২ বা ১ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেটি এখন আরও বেড়ে যাবে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক খবর।
উন্নয়ন হলেও ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না হলে, নীতিমালা ঠিকমতো মানানো না গেলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীদূষণ, নদী দখল, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ—এসবের কারণে পরিবেশ দূষিত হয়। প্লাস্টিকের কারণেও ব্যাপকভাবে এখন দূষণ হয়। দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল। ঢাকায় যে প্রায় দুই কোটি লোক বাস করে, তাদের সবার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক নয়। এতে করে আশপাশের নদী ও বায়ু দূষিত হচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকে শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশিতে ভোগে। এখন অবশ্য অনেকেই রাস্তায় বের হলে মাস্ক ব্যবহার করেন। এটি কোভিডের বিরুদ্ধে এবং ধুলাবালি ও দূষণ থেকে বেঁচে থাকার সঠিক ব্যবস্থা। কোভিডের অনেক আগেই চীন, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ানের লোকজন ধুলাবালি ও দূষণ প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহার করত। কোভিডের পরে আমাদের এখানেও মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতা বেড়েছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে নগরায়ণ খুব দ্রুত হয়েছে। স্বাধীনতার আগে হয়তো নগরে ৭০ লাখ লোক ছিল, এখন ৬-৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। শহরে এই চলে আসাটা পরিকল্পিতভাবে হয়নি। এটা হয়েছে তাগিদে। গ্রামের ধাক্কা ও শহরের সুযোগ এবং আকর্ষণের কারণে। একটাকে বলে পুশ ফ্যাক্টর, আরেকটা হলো কুল ফ্যাক্টর। দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, দুর্যোগ—এসব হলো পুশ ফ্যাক্টর। কুল ফ্যাক্টর হলো, শহরে এসে কিছু না কিছু করে খাওয়া যায়। কিছু না হলেও রিকশা চালানো যায়, বাড়িতে কাজ করা যায়, ফুটপাতে বসে চা বিক্রি করা যায়। এই কাজগুলো নিম্নবিত্ত সংসারকে টিকিয়ে রাখে। প্রায় ২ কোটি লোক ঢাকায় এবং সারা দেশে ৬-৭ কোটি লোক শহরে যারা বাস করে, তাদের অধিকাংশই নিজের আয় নিজে ব্যবস্থা করে। এরা সরকারকে বলে না, আমাকে চাকরি দাও। দরকারই নেই। এরা চিনাবাদাম, কমলালেবু, কলা—এসব বিক্রি করে। এটাকে বলে নিম্নমানের নগরায়ণ।
গত ৩০ বছরে কয়েক হাজারের মতো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি হয়েছে, সেখানে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। একটা বাড়ির দুটো মেয়ে যদি কাজ করে, তাহলে ১৫+১৫= ৩০ হাজার টাকা পায়। আগে তো পেত না কিছুই। এখন পায়। আয়-উপার্জন বেড়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে। এটাকে আমরা বলি প্রাতিষ্ঠানিক খাত। এর চেয়ে অনেক বেশি হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। স্বনিয়োজিত শ্রমিক, মজুর, ছোট ব্যবসায়ী, কাজের মানুষ, গৃহকর্মী—এরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে পড়ে।
এ ছাড়া বিভিন্ন কলকারখানা, অফিস-আদালত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এমনকি সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত লোক নিয়োগ করা হয়। এতে কর্মসংস্থান হয়। পত্রিকা অফিসসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু অল্প শিক্ষিত মানুষ, যেমন দারোয়ান ও অন্যদের কাজের সুযোগ হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেবেন। এটা খুব ভালো। একসঙ্গে সব হবে না, ধীরে ধীরে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী নগরায়ণ নিরুৎসাহিত করতে হবে। বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, ৫০০ উপজেলা শহরকে উন্নত করতে হবে, ইনসেনটিভ দিতে হবে। ফ্যাক্টরি, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দিতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো, ঢাকা থেকে লোক সরিয়ে ঢাকার বাইরে আশপাশের শহরে নিয়ে যেতে হবে।
পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুটি শহর হয়ে যাবে। মাওয়া প্রান্তে একটা, জাজিরা প্রান্তে একটা। এগুলো হয়তো ১০-২০ হাজার লোকের শহর হবে। সুবিধা থাকলে ঢাকা থেকে অনেকে চলে যাবে। এটা হলো জাতীয়ভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা। আরেক পদক্ষেপ নেওয়া যায়, প্রতিটি শহরকে পরিকল্পিতভাবে সাজানোর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা বা রাজশাহীর উন্নয়নের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ আছে। এ ছাড়া কয়েকটি জেলায় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে। রাস্তাঘাট, পরিবহন, কোথায় আবাসিক এলাকা, কোথায় বাণিজ্যিক এলাকা, শিক্ষা এলাকা ইত্যাদি হবে, তা পরিকল্পনা করে সাজাতে হবে। আবার পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, সুচারুভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য দরকার ভালো বাস্তবায়নকারী সংস্থা। সেসব সংস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে হবে না।
অর্থাৎ, পরিকল্পনা সঠিক হতে হবে। পরিকল্পনা সঠিক হওয়ার পরে জনগণ যদি মেনে নেয়, তাহলে সঠিকভাবে, সঠিক মানুষ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। চূড়ান্ত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে, যদি কর্তৃপক্ষ সঠিক হয়। সুশাসন সঠিক হতে হবে। নগর কর্মকর্তা, মেয়র, ওয়াসার এমডি, চেয়ারম্যানসহ সবার অংশগ্রহণ দরকার। নগরের নেতা যদি ভালো হন, তাঁর আদর্শ, নীতি, চিন্তাভাবনা যদি ভালো হয়, তাঁর নেতৃত্বগুণ যদি ভালো হয়, তাহলে পরিকল্পিত নগর হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, নগরবিদ ও শিল্প সমালোচক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
অনুলিখন: রিক্তা রিচি
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪