দীপেন ভট্টাচার্য
দুরবিনের ব্যাস যত বড় হবে, তত ছোট ও গোল বস্তুর আকার সেটি দেখতে পাবে। এই ক্ষেত্রে দুরবিনের ব্যাস আমাদের পৃথিবীর সমান হয়েছিল। ২০১৯ সালে একই পদ্ধতিতে ইএইচটি আমাদের থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরের, ‘এম-এইটি সেভেন’ নামে একটি বিশাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা অতিকায় কৃষ্ণবিবরের ছবি তুলতে সমর্থ হয়েছিল।
উদ্দেশ্যহীন মহাবিশ্ব?
এ বছর বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন, ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) দিয়ে তাঁরা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণবিবরটির ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ‘বিবর’ অর্থ ‘গর্ত’ বা ‘গহ্বর’। সেই অর্থে কৃষ্ণবিবর হলো ‘ব্ল্যাক হোল’ কথাটির বঙ্গানুবাদ। আসলে এটিকে সরাসরি বিবরের ছবি বলা যাবে না। কারণ, সাধারণ ধারণা অনুযায়ী কৃষ্ণগহ্বর থেকে আলো বের হতে পারে না। তাই এই ছবি আসলে হলো বিবরটি যে ছায়া সৃষ্টি করে, সেটির প্রতিবিম্ব। ইএইচটি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আটটি দুরবিনের তথ্যকে একত্র করে একটি বিশাল ১০ হাজার ৭০০ কিলোমিটার ব্যাসের দুরবিনের ভূমিকা পালন করে। দুরবিনের ব্যাস যত বড় হবে, তত ছোট ও গোল বস্তুর আকার সেটি দেখতে পাবে। এই ক্ষেত্রে দুরবিনের ব্যাস আমাদের পৃথিবীর সমান হয়েছিল। এর আগে ২০১৯ সালে একই পদ্ধতিতে ইএইচটি আমাদের থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরের, ‘এম-এইটি সেভেন’ নামে একটি বিশাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা অতিকায় কৃষ্ণবিবরের ছবি তুলতে সমর্থ হয়েছিল।
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্ৎসশিল্ড আপেক্ষিকতা সমীকরণের একটি সমাধান বের করেন। একটি স্থির (ঘূর্ণমান নয়) বড় তারার চারদিকে দেশ-কালের মেট্রিক (বা চাদর) কী রকম হবে, সেটা এই সমাধান থেকে পাওয়া যায়। এই মেট্রিক ব্যবহার করে আমরা দেখি যে তারাটির সমস্ত ভর যদি একটি বিন্দুসমেত কেন্দ্রে আপতিত হয়, তবে সেই বিন্দু থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত কোনো আলোক কণিকা থাকলে, সেই কণিকা তার উচ্চগতি সত্ত্বেও কেন্দ্রটির মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্তি পাবে না এবং আমরা ওই তারা সম্পর্কে সরাসরিভাবে কোনো তথ্যই পাব না। এই দূরত্বকে সোয়ার্ৎসশিল্ড ব্যাসার্ধ বলা হয়, যা ঘটনা-দিগন্তকে নির্দিষ্ট করে। ঘটনা-দিগন্তের মধ্য থেকে কোনো সংবাদই বহির্বিশ্বে পৌঁছাবে না।
সোয়ার্ৎসশিল্ড মেট্রিকের একটি পরিণাম হচ্ছে সিংগুলারিটি। সিংগুলারিটি কী? একটি বড় ভরের তারা, যদি সেটা সূর্যের চেয়ে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি ভরের হয়, তার সমস্ত জ্বালানি ফুরিয়ে ফেললে; অর্থাৎ, তার জীবনের শেষে, একটি বিন্দুসমেত কেন্দ্রে খুবই ক্ষুদ্র বস্তুতে আপতিত হবে। সেই বস্তুর (তাকে বস্তু বলা হয়তো সংগত নয়) ঘনত্ব এমনই, বা তার মহাকর্ষ বল এমনই যে, সেটি চারদিকের দেশ-কালের বক্রতাকে অসীম করে দেবে। সেই বক্রতা ভেতরের বস্তুটিকে পুরোপুরি ঢেকে দেবে। অর্থাৎ, সে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে বিযুক্ত হয়ে যাবে। এই অসীম ঘনত্বের বা অসীম মহাকর্ষীয় বলের বিন্দুটিকে ইংরেজিতে সিংগুলারিটি বলা হয়। সিংগুলারিটির অর্থ হলো অনন্য। এমন অনন্য অবস্থা মহাবিশ্বের আর অন্য কোথাও বিরাজ করে না।
কৃষ্ণবিবর বা ব্ল্যাক হোল বলতে আমরা সিংগুলারিটিসহ ঘটনা-দিগন্তের মধ্যে যা আছে, তা-ই বোঝাই। অর্থাৎ, কৃষ্ণগহ্বর হলো সিংগুলারিটি ও ঘটনা-দিগন্তের যোগফল।
আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরটি, যার নাম হলো Sgr A*, তার ভর হলো প্রায় ৪০ লাখ সৌরভর। অর্থাৎ, ৪০ লাখ সূর্য একত্র করলে যে ভর পাওয়া যায়। অন্যদিকে অতিকায় গ্যালাক্সি M৮৭-এর কেন্দ্রের কৃষ্ণবিবরটির ভর হলো প্রায় ৬৬০ কোটি সূর্যের সমান। Sgr A* আমাদের থেকে ২৭ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। আলো এক সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার ভ্রমণ করে। আজ যে Sgr A* আমরা দেখছি, তার আলো ২৭ হাজার বছর আগে রওনা দিয়েছিল। আর M৮৭ থেকে যে আলো আমরা দেখছি, সেটি সেখান থেকে বিকিরিত হয়েছিল সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে। সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে বাংলাদেশ যে বঙ্গীয় বদ্বীপের ওপর অবস্থিত, সেটির জন্মই হয়নি। সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের টেকটনিক পাত সবে ইউরেশীয় পাতের সঙ্গে ধাক্কা খেতে শুরু করেছে, হিমালয় তখনো ওঠা শুরু করেনি।
আমাদের এই মহাবিশ্বের শুরু ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। এই শুরুটা হয়েছে কোনো এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে বিগ ব্যাং বলা হয়। এর ফলে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। বিগ ব্যাং একটি মডেল। এটিকে যে একটা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই সংঘটিত হতে হবে—এমন নয়। বরং ‘কোনো কিছু নেই’—এমন একটি পর্যায়ের মধ্যে কোয়ান্টাম বিচলনের ফলে দেশ-কালের আবির্ভাবের মধ্যেও বিগ ব্যাং হতে পারে। এ নিয়ে পরে বলছি। বিগ ব্যাং-এর কয়েক শ মিলিয়ন বছরের মধ্যেই প্রথম নক্ষত্র ও প্রথম গ্যালাক্সির আবির্ভাব হয়। সেই প্রথম একটি গ্যালাক্সি থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে ১ হাজার ৩০০ কোটি বছরের বেশি সময় নেয়। কিন্তু সেই গ্যালাক্সি মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে ‘এই মুহূর্তে’ ১ হাজার ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ নয়, বরং ৪ হাজার ৬০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই মুহূর্তে সেই গ্যালাক্সি থেকে যে আলো বিকিরিত হচ্ছে, তা আমাদের পৃথিবীর এই জায়গায় কোনো দিনই পৌঁছাবে না। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, আমাদের দৃশ্যমান যে মহাবিশ্ব, তা বিশাল এক মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সেই অর্থে পুরো মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না।
আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের সময় দিয়ে এই ধরনের মহাজাগতিক দূরত্ব ও সময়কে কীভাবে বোঝা সম্ভব? নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ একবার বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্বকে আমরা যত বুঝতে পারছি, ততই সেটিকে উদ্দেশ্যহীন মনে হচ্ছে।’ ওয়াইনবার্গ ‘পয়েন্টলেস’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। এই উক্তির জন্য ওয়াইনবার্গকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই ওই উক্তির পরবর্তী বাক্যগুলো পড়েননি। ওয়াইনবার্গ লিখছেন—
‘আমাদের গবেষণার ফলাফল আমাদের স্বস্তি না দিতে পারে, কিন্তু কিছু শান্তি পাওয়া যাবে গবেষণা প্রক্রিয়ার ভেতরেই। দেবতা বা ক্ষমতাশীলদের গল্পকথা দিয়ে, অথবা প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে তাদের চিন্তা আবদ্ধ রেখে নারী ও পুরুষেরা যে সান্ত্বনা পায়, তাতে তারা আর সন্তুষ্ট নয়। তারা এখন তৈরি করছে দুরবিন, কৃত্রিম উপগ্রহ, কণাত্বরক যন্ত্র। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের ডেস্কে বসে গবেষণালব্ধ তথ্যের অন্তর্নিহিত অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। মহাবিশ্বকে বোঝার এই যে প্রচেষ্টা—তা খুব কম জিনিসের মধ্যে একটি, যা মানুষের জীবনকে প্রহসনের ওপরে ওঠায়, তাকে ট্র্যাজেডির সৌন্দর্যের কিছুটা অংশ দেয়।’
ওয়াইনবার্গ ‘গ্রেস অব ট্র্যাজেডি’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। বলাই বাহুল্য, ‘গ্রেস’ শুধু সৌন্দর্য নয়, তার মধ্যে আধ্যাত্মিক একটি ভাব নিহিত আছে। যে বিজ্ঞানীরা মহাজগৎ ও পদার্থবিদ্যার মৌলিক সূত্রগুলো নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁরা তাঁদের কাজে সেই ‘গ্রেস’ খুঁজে পান। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা এটি সম্বন্ধেও সচেতন যে মহাবিশ্ব বা প্রকৃতির গঠনে এমন কিছু আছে, যা আমাদের জ্ঞানকে পূর্ণতা দেবে না। সেই অপূর্ণতাকে মেনে নেওয়ার মধ্যেও একধরনের বলিষ্ঠতা প্রয়োজন।
প্রকৃতির অপূর্ণতা
১৯২৫ সালে হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা (বা অনির্দেশ্যতার) নীতি প্রণয়ন করেন: কণার অবস্থান এবং ভরবেগ (বা বেগ), এই দুটি জিনিসকে একই সঙ্গে যথেচ্ছ সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা যাবে না। অর্থাৎ, আমরা যদি কণার অবস্থানকে সূক্ষ্মভাবে মাপতে পারি, তবে তার বেগ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা থাকবে অস্পষ্ট। ফলে সেটির পরমুহূর্তের অবস্থান থাকবে অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে কণার বেগকে যথার্থভাবে জানলে, সেটির অবস্থানকে নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। (একইভাবে এই নীতি অনুযায়ী শূন্য থেকে শক্তি ঋণ করে কণারা খুব অল্প সময়ের জন্য বাস্তবে আবির্ভূত হতে পারে। এবং সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময় শেষে আবার হারিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে।) ফলে নিউটনীয় চিরায়ত বলবিদ্যার পরিণামবাদী বা নিষ্পত্তিমূলক মহাবিশ্বের অবসান ঘটল। ১৮১৪ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী লাপলাস বলেছিলেন, এমন কোনো অস্তিত্ব যদি থাকে, যে সে কোনো একটা মুহূর্তে মহাবিশ্বের সমস্ত কণার অবস্থান এবং তাদের ওপর প্রযোজ্য বলের পরিমাণ জানবে, তাহলে তার পক্ষে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ ও অতীত অবস্থা নির্ধারণ করা কঠিন হবে না। এই অস্তিত্বকে অনেকে লাপলাসের দানব বলে অভিহিত করেন।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সুনিশ্চিতভাবে লাপলাসের দানবের পরিণামবাদী মহাবিশ্বের অবসান ঘটাল। শুধু তা-ই নয়, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলল কণাসমূহের শুধু কণা বৈশিষ্ট্যই নয়, একটি তরঙ্গ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। তবে এই তরঙ্গ প্রকৃত ‘বাস্তব তরঙ্গ’, নাকি একটি ‘সম্ভাবনা তরঙ্গ’ তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যদিও বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন, মুক্ত কণার (যেমন ইলেকট্রনের) অবস্থান প্রসারণশীল ‘সম্ভাবনা তরঙ্গ’ দিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব, যার প্রকৃতি নিতান্তই গাণিতিক। অন্যদিকে যে মুহূর্তে ওই ইলেকট্রনটিকে অবলোকন করা হবে, সেটি একটি কণায় রূপান্তরিত হবে। কণা ও তরঙ্গের এই যে দ্বৈত বাস্তবতা, তা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরে। একটি ইলেকট্রন একটি বিন্দু থেকে আরেকটি বিন্দুতে কীভাবে ভ্রমণ করে, আমরা তা সঠিক জানি না। কারণ, দুটি বিন্দুর মধ্যে অসংখ্য সম্ভাব্য পথ রয়েছে। সেই পথগুলোকে আমাদের মনে চিত্রিত করা সম্ভব নয়; শুধু গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
বিজ্ঞানের দর্শনে পজিটিভিজমের মত হলো, শুধু সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বস্তু সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করা যাবে তা-ই একমাত্র সত্য, এর বাইরে কিছু বললে সেটা হবে জল্পনা। ভিয়েনার বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মাখ এর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। যেহেতু ১৮ শতকের শেষে ও ১৯ শতকের প্রথম দিকে পরমাণুকে সরাসরি পর্যবেক্ষণের কোনো পদ্ধতি জানা ছিল না, পজিটিভিস্টরা পরমাণু সম্পর্কে আলোচনাকে বিজ্ঞানবহির্ভূত মনে করতেন। অন্যদিকে রিয়্যালিস্ট বা বাস্তববাদীরা সরাসরি পরমাণু দেখা না গেলেও সেটিকে বাস্তব ধরে নিয়ে গবেষণা করতেন। আইনস্টাইনকে মাখ বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু ১৯২০-এর দশকের আইনস্টাইন পজিটিভিস্ট ছিলেন না, বরং বাস্তববাদী ছিলেন। অন্যদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রবক্তারা, বিশেষ করে নিলস বোর ও হাইজেনবার্গ পজিটিভিজমকে পুরোপুরি ত্যাগ করেননি। তাঁরা মনে করতেন, কোয়ান্টাম পর্যবেক্ষণের ফলাফল পরীক্ষক কী দেখতে চাইছেন, সেটার ওপর নির্ভর করে: পরীক্ষক যদি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপতে চান, তো ইলেকট্রনকে তরঙ্গ হিসেবে দেখবেন। অন্যদিকে তিনি যদি তাঁর ভরবেগ নির্ধারণ করতে চান, তাহলে কণা হিসেবে দেখবেন। কণা বা তরঙ্গ এ দুই বৈশিষ্ট্যের কোনো অর্থ নেই, যতক্ষণ না পরীক্ষক তাঁর স্বাধীন চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে অবলোকন করবেন। বাস্তববাদী আইনস্টাইনের কাছে এ রকম অজ্ঞেয়বাদ ছিল পুরোপুরিই পরিত্যাজ্য।
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বলে, কণার অবস্থান ও গতিবেগ একই সঙ্গে যথার্থভাবে জানা যাবে না। প্রকৃতি সম্পর্কে এটাও একধরনের অজ্ঞানতা। অর্থাৎ, আমাদের পর্যবেক্ষণপদ্ধতি যতই দক্ষ হোক না কেন, আমাদের কাছে এ দুই জিনিস একসঙ্গে অজানা থেকে যাবে। এই অজ্ঞানতা দেশ-কালের চাদরের মধ্যেই প্রোথিত। একে এড়ানোর উপায় নেই। আইনস্টাইনের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি বললেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বপূর্ণ নয়। লিখলেন, ‘ঈশ্বর পাশা খেলতে পারে, ঠিক আছে; কিন্তু সে যে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে জুয়া খেলবে, এটা আমার ধারণার বাইরে।’ ঈশ্বর অর্থে এখানে তিনি প্রকৃতিকেই বুঝিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৯ আগস্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে আলাপে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর রাজ্যে আকস্মিকতা কাজ করে। কাজেই, অস্তিত্বের নাটক পুরোপুরি পূর্বনির্ধারিত নয়।’ তখন আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তার মানে এই নয় যে, বিজ্ঞান থেকে কার্যকারণ বিদায় হয়েছে।’ কার্যকারণ আইনস্টাইনের দর্শনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বাস্তববাদী ছিলেন এবং মানব-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র বাস্তবতায় বিশ্বাস করতেন। একই সঙ্গে প্রকৃতি যে কিছু জ্ঞান আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে, তাতে বিশ্বাস করতেন না।
আইনস্টাইন নিজে খেয়ালিপনায় সে রকম বিশ্বাস করতেন না। যদিও তাঁর অগোছালো চুলের যে ছবিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, তাতে তাঁকে মন-ভোলা খেয়ালি বিজ্ঞানী হিসেবেই আমরা দেখি। কোয়ান্টাম তত্ত্বে ভরসা না রেখে তিনি জীবনের শেষ ২৫টি বছর আপেক্ষিকতা ও তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রতত্ত্বের সংমিশ্রণে পদার্থবিদ্যার চূড়ান্ত নীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। ‘প্রকৃতি জুয়া খেলবে না’—এই জীবন দর্শন তাঁকে এই পথে পরিচালিত করে। তাঁর সেই উদ্যোগ অবশ্য সফল হয়নি। তাই আইনস্টাইনের পক্ষে কৃষ্ণবিবরের সিংগুলারিটির অস্তিত্ব মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। তাঁর কাছে সিংগুলারিটি হলো প্রকৃতির খেয়ালিপনা, যার বৈশিষ্ট্যকে আমরা কোনোভাবেই নির্ধারণ করতে পারব না। যে সিংগুলারিটি থেকে আমরা কোনো তথ্যই আর আহরণ করতে পারব না (যদিও ইদানীং এই ধারণাটির পরিবর্তন হয়েছে)। আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি কোনোভাবে সিংগুলারিটি (বা ব্ল্যাক হোল) সৃষ্টিতে বাধা দেবে। কারণ, সিংগুলারিটি হলো প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের একধরনের অজ্ঞানতা। এ হলো যেন প্রকৃতির অপূর্ণতা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পরিসংখ্যানগত অনিশ্চয়তাকে তিনি যেমন পছন্দ করেননি, তেমনি একটি তারার পতন সিংগুলারিটি সৃষ্টি করতে পারে—সেটাও মেনে নেননি। অথচ এই দুটি বিষয়ের সূত্রপাত তিনি নিজ হাতে করে গিয়েছিলেন।
পরম ‘কিছু না’
চিন্তা করুন এমন একটি অবস্থা, যেখানে স্থান-কাল-পাত্র নেই। নেই দেশ-কালের চাদর, সময় নেই, স্পেস বা স্থান বলতে যা বোঝাই, সেই স্থান নেই। এমন একটি অবস্থা চিন্তা করা দুরূহ। কারণ, চিন্তার মাধ্যমে আমরা সেটিকে আকার দিই। কারণ, ‘কিছু না’-কে মনে স্থান দিলে সেটি ‘কিছু’-তে পরিণত হয়। বিখ্যাত চৈনিক দার্শনিক গ্রন্থ তাও-তে-চিং শুরুই হয়েছে এই পঙ্ক্তি দিয়ে—
‘যে তাওকে (পথকে) বর্ণনা করা যায়, তা চিরন্তন তাও নয়
যে নামকে উচ্চারণ করা যায়, তা চিরন্তন নাম নয়।
নামহীন যা তা স্বর্গ ও মর্ত্যের সীমানা
আর নামযুক্ত যা তা সকল সৃষ্টির মাতা।।’
আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, পরম ‘কিছু না’-কে নাম দিয়ে আমরা সেটির পরমত্বকে খর্ব করেছি। তবু যদি ধরা যায়, এ রকম একটা অবস্থা থাকা সম্ভব, তাহলে সেটিরই হওয়া উচিত ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই বাক্যটি যে স্ববিরোধিতায় পূর্ণ, তা স্বীকার করি। কিন্তু তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে ভাবেন এবং কেন ‘কিছু না’-এর পরিবর্তে ‘কিছু’-এর (মহাবিশ্বের) আবির্ভাব হয়েছে, এই ধাঁধা তাদের রাতে জাগিয়ে রাখে।
সেই ‘কিছু না’ অবস্থায় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব যদি কাজ করে, তবে ক্রমাগতই তাতে ছোট ছোট দেশ-কাল সৃষ্টি হবে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সেগুলো আবার ‘কিছু না’-তে বিলীন হয়ে যাবে। একে কোয়ান্টাম বিচলন বলা যেতে পারে। কিন্তু মাঝেমধ্যে যদি সেই ক্ষণিক দেশ-কালের বুদ্বুদে অন্য কোনো বিশেষ ‘ক্ষেত্রের’ আবির্ভাব হয়, যা সেই বুদ্বুদকে খুব দ্রুত স্ফীত করবে, তাহলে সেই দেশ-কালটি স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। এবং আমরা এই দেশ-কালের বুদ্বুদের আবির্ভাব ও দ্রুত প্রসারণকে বিগ ব্যাং বলে অভিহিত করতে পারি।
এই মডেল খুব আকর্ষণীয়, শুধু এখানে একটি বড় সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা যখন ‘কিছু না’ বলছি, তার মধ্যে পদার্থবিদ্যা বা প্রকৃতির কোনো নীতিও থাকবে না। তাই হাইজেনবার্গের তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম বিচলনের সেখানে কাজ করার কথা নয়। যদি করে, তাহলে সেটি পরম শূন্য বা ‘কিছু না’ হবে না। এই মডেলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগেই কোয়ান্টাম বিচলনকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে বলতে হবে—পরম ‘কিছু না’ বলে কখনোই কিছু সম্ভব নয়। কারণ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ‘সব জায়গায়’ প্রতিষ্ঠিত।
নইলে আমাদের এমন এক মহাবিশ্বের কথা ভাবতে হবে, যার ঠিক শুরু নেই, যেমন ভেবেছিলেন স্টিফেন হকিং বহু বছর আগে। তাঁর সেই মডেলে মহাবিশ্বের শুরুতে ‘সময়’ বলে কিছু ছিল না, শুধু ছিল ‘দেশ’ বা ‘স্থান’। যেহেতু সময় ছিল না, বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল, সেই প্রশ্নটি তখন আর করা যাবে না। কিন্তু যা-ই হোক না কেন, এই ধরনের ধাঁধা বা প্রশ্ন যে খুব গভীর এবং দর্শনের সঙ্গে জড়িত, তা বোঝাই যাচ্ছে।
আমাদের গ্যালাক্সিতে তারার সংখ্যা ৪০০ বিলিয়নের (৪০ হাজার কোটি) মতো হবে হয়তো। অথচ আমাদের নিকটবর্তী তারা প্রায় সাড়ে চার আলোকবর্ষ দূরে। এখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সেখানে পৌঁছাতে ৬০-৭০ হাজার বছর লেগে যাবে। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর সমস্ত রাসায়নিক জ্বালানি যথেষ্ট হবে না এই কাজ সম্পন্ন করতে। আমরা চাঁদে, মঙ্গলে, এমনকি বৃহস্পতির চাঁদগুলোতেও হয়তো যেতে পারব। কিন্তু আকাশের তারারা হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের হাতের বাইরে থাকবে। সেখানে হয়তো আমরা আদৌ পৌঁছাতে পারব না।
আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১০ ট্রিলিয়নের (১০ লাখ কোটি) মতো। আর দৃশ্যমান মহাবিশ্ব হয়তো-বা সমগ্র মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। নিঃসন্দেহে শুধু ক্ষুদ্র একটি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির, বুদ্ধিমান চেতনার উদ্ভবের জন্য মহাবিশ্বের কোটি কোটি গ্যালাক্সির প্রয়োজন ছিল না। এই গ্যালাক্সিগুলো সম্পর্কে যতই আমরা জানছি, আমাদের ব্যবহার্য জীবনে তাদের ভূমিকা যে শূন্য, তা-ও বুঝতে পারছি। মহাবিশ্বের এই বিশালতা একদিকে যেমন আমাদের বিস্মিত করে, অন্যদিকে ওয়াইনবার্গের সেই ‘উদ্দেশ্যহীনতা’ উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। কিছু জ্ঞান প্রকৃতি হয়তো আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে—কণার সঠিক অবস্থান ও ভরবেগ একসঙ্গে আমরা কখনোই নিরূপণ করতে পারব না। কৃষ্ণবিবরের মধ্যে সিংগুলারিটিকে আমরা কখনোই দেখব না। সমগ্র মহাবিশ্বের (শুধু দৃশ্যমান মহাবিশ্ব নয়) বিস্তার আমাদের কাছে রইবে অজানা, যেমন অজানা রইবে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর—কেন ‘কিছু’ আছে ‘কোনো কিছু না থাকা’-এর বদলে। কিন্তু এর মধ্যেই রয়েছে আমাদের জীবনদর্শনের পরিপূর্ণতা। প্রকৃতির এই খেলার নিগূঢ় নির্যাসকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে রয়েছে একধরনের স্বস্তি। সেই স্বস্তি আমাদের জীবনকে দেয় অর্থ। জীবনের শেষে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘রূপনারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
বিজ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই মানুষকে কঠিন সত্যের মুখোমুখি করে। আমাদের মধ্যে কে স্বস্তি বোধ করবে এই ভেবে যে আমরা উদ্ভূত হয়েছি এক প্রাককেন্দ্রিক এক কোষী প্রাণী থেকে? আমাদের মধ্যে কে স্বস্তি বোধ করবে, এই ভেবে যে তাপগতি-বিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের অমোঘ গতিতে একদিন আকাশের সব তারা নিভে যাবে? আমি বলব, এই যে অস্বস্তি, সেটিই আমাদের মানবিক বোধকে পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত করে। একদিকে যেমন আমরা মহাবিশ্বের উদাসীনতায় বিভ্রান্ত, অন্যদিকে সেই মহাবিশ্বকে আমাদের চেতনায়, বোধে পুনর্গঠিত করার মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের অনন্য মূল্য নির্ধারিত হয়। আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে এই জ্ঞানটির, এই বোধটির ভূমিকা অতুলনীয়। এটিকে গ্রহণ করতে সাহসের প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ যখন তার সমস্ত ভঙ্গুরতা, নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কঠিন সত্যকে আত্মস্থ করতে পারবে; অর্থাৎ, তার বাসস্থান, পৃথিবী নামের এই জাহাজটিকে অসীম স্থান-কালের অনুপাতে বিচার করতে পারবে; তখন সে আরেক ধরনের শান্তি ও স্বস্তি পাবে। সামগ্রিক মানবকল্যাণের জন্যও সেই বোধটির প্রয়োজন।
দীপেন ভট্টাচার্য: জ্যোতিঃপদার্থবিদ, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
দুরবিনের ব্যাস যত বড় হবে, তত ছোট ও গোল বস্তুর আকার সেটি দেখতে পাবে। এই ক্ষেত্রে দুরবিনের ব্যাস আমাদের পৃথিবীর সমান হয়েছিল। ২০১৯ সালে একই পদ্ধতিতে ইএইচটি আমাদের থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরের, ‘এম-এইটি সেভেন’ নামে একটি বিশাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা অতিকায় কৃষ্ণবিবরের ছবি তুলতে সমর্থ হয়েছিল।
উদ্দেশ্যহীন মহাবিশ্ব?
এ বছর বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন, ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) দিয়ে তাঁরা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণবিবরটির ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ‘বিবর’ অর্থ ‘গর্ত’ বা ‘গহ্বর’। সেই অর্থে কৃষ্ণবিবর হলো ‘ব্ল্যাক হোল’ কথাটির বঙ্গানুবাদ। আসলে এটিকে সরাসরি বিবরের ছবি বলা যাবে না। কারণ, সাধারণ ধারণা অনুযায়ী কৃষ্ণগহ্বর থেকে আলো বের হতে পারে না। তাই এই ছবি আসলে হলো বিবরটি যে ছায়া সৃষ্টি করে, সেটির প্রতিবিম্ব। ইএইচটি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আটটি দুরবিনের তথ্যকে একত্র করে একটি বিশাল ১০ হাজার ৭০০ কিলোমিটার ব্যাসের দুরবিনের ভূমিকা পালন করে। দুরবিনের ব্যাস যত বড় হবে, তত ছোট ও গোল বস্তুর আকার সেটি দেখতে পাবে। এই ক্ষেত্রে দুরবিনের ব্যাস আমাদের পৃথিবীর সমান হয়েছিল। এর আগে ২০১৯ সালে একই পদ্ধতিতে ইএইচটি আমাদের থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরের, ‘এম-এইটি সেভেন’ নামে একটি বিশাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা অতিকায় কৃষ্ণবিবরের ছবি তুলতে সমর্থ হয়েছিল।
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্ৎসশিল্ড আপেক্ষিকতা সমীকরণের একটি সমাধান বের করেন। একটি স্থির (ঘূর্ণমান নয়) বড় তারার চারদিকে দেশ-কালের মেট্রিক (বা চাদর) কী রকম হবে, সেটা এই সমাধান থেকে পাওয়া যায়। এই মেট্রিক ব্যবহার করে আমরা দেখি যে তারাটির সমস্ত ভর যদি একটি বিন্দুসমেত কেন্দ্রে আপতিত হয়, তবে সেই বিন্দু থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত কোনো আলোক কণিকা থাকলে, সেই কণিকা তার উচ্চগতি সত্ত্বেও কেন্দ্রটির মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্তি পাবে না এবং আমরা ওই তারা সম্পর্কে সরাসরিভাবে কোনো তথ্যই পাব না। এই দূরত্বকে সোয়ার্ৎসশিল্ড ব্যাসার্ধ বলা হয়, যা ঘটনা-দিগন্তকে নির্দিষ্ট করে। ঘটনা-দিগন্তের মধ্য থেকে কোনো সংবাদই বহির্বিশ্বে পৌঁছাবে না।
সোয়ার্ৎসশিল্ড মেট্রিকের একটি পরিণাম হচ্ছে সিংগুলারিটি। সিংগুলারিটি কী? একটি বড় ভরের তারা, যদি সেটা সূর্যের চেয়ে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি ভরের হয়, তার সমস্ত জ্বালানি ফুরিয়ে ফেললে; অর্থাৎ, তার জীবনের শেষে, একটি বিন্দুসমেত কেন্দ্রে খুবই ক্ষুদ্র বস্তুতে আপতিত হবে। সেই বস্তুর (তাকে বস্তু বলা হয়তো সংগত নয়) ঘনত্ব এমনই, বা তার মহাকর্ষ বল এমনই যে, সেটি চারদিকের দেশ-কালের বক্রতাকে অসীম করে দেবে। সেই বক্রতা ভেতরের বস্তুটিকে পুরোপুরি ঢেকে দেবে। অর্থাৎ, সে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে বিযুক্ত হয়ে যাবে। এই অসীম ঘনত্বের বা অসীম মহাকর্ষীয় বলের বিন্দুটিকে ইংরেজিতে সিংগুলারিটি বলা হয়। সিংগুলারিটির অর্থ হলো অনন্য। এমন অনন্য অবস্থা মহাবিশ্বের আর অন্য কোথাও বিরাজ করে না।
কৃষ্ণবিবর বা ব্ল্যাক হোল বলতে আমরা সিংগুলারিটিসহ ঘটনা-দিগন্তের মধ্যে যা আছে, তা-ই বোঝাই। অর্থাৎ, কৃষ্ণগহ্বর হলো সিংগুলারিটি ও ঘটনা-দিগন্তের যোগফল।
আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরটি, যার নাম হলো Sgr A*, তার ভর হলো প্রায় ৪০ লাখ সৌরভর। অর্থাৎ, ৪০ লাখ সূর্য একত্র করলে যে ভর পাওয়া যায়। অন্যদিকে অতিকায় গ্যালাক্সি M৮৭-এর কেন্দ্রের কৃষ্ণবিবরটির ভর হলো প্রায় ৬৬০ কোটি সূর্যের সমান। Sgr A* আমাদের থেকে ২৭ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। আলো এক সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার ভ্রমণ করে। আজ যে Sgr A* আমরা দেখছি, তার আলো ২৭ হাজার বছর আগে রওনা দিয়েছিল। আর M৮৭ থেকে যে আলো আমরা দেখছি, সেটি সেখান থেকে বিকিরিত হয়েছিল সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে। সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে বাংলাদেশ যে বঙ্গীয় বদ্বীপের ওপর অবস্থিত, সেটির জন্মই হয়নি। সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের টেকটনিক পাত সবে ইউরেশীয় পাতের সঙ্গে ধাক্কা খেতে শুরু করেছে, হিমালয় তখনো ওঠা শুরু করেনি।
আমাদের এই মহাবিশ্বের শুরু ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। এই শুরুটা হয়েছে কোনো এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে বিগ ব্যাং বলা হয়। এর ফলে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। বিগ ব্যাং একটি মডেল। এটিকে যে একটা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই সংঘটিত হতে হবে—এমন নয়। বরং ‘কোনো কিছু নেই’—এমন একটি পর্যায়ের মধ্যে কোয়ান্টাম বিচলনের ফলে দেশ-কালের আবির্ভাবের মধ্যেও বিগ ব্যাং হতে পারে। এ নিয়ে পরে বলছি। বিগ ব্যাং-এর কয়েক শ মিলিয়ন বছরের মধ্যেই প্রথম নক্ষত্র ও প্রথম গ্যালাক্সির আবির্ভাব হয়। সেই প্রথম একটি গ্যালাক্সি থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে ১ হাজার ৩০০ কোটি বছরের বেশি সময় নেয়। কিন্তু সেই গ্যালাক্সি মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে ‘এই মুহূর্তে’ ১ হাজার ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ নয়, বরং ৪ হাজার ৬০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই মুহূর্তে সেই গ্যালাক্সি থেকে যে আলো বিকিরিত হচ্ছে, তা আমাদের পৃথিবীর এই জায়গায় কোনো দিনই পৌঁছাবে না। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, আমাদের দৃশ্যমান যে মহাবিশ্ব, তা বিশাল এক মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সেই অর্থে পুরো মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না।
আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের সময় দিয়ে এই ধরনের মহাজাগতিক দূরত্ব ও সময়কে কীভাবে বোঝা সম্ভব? নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ একবার বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্বকে আমরা যত বুঝতে পারছি, ততই সেটিকে উদ্দেশ্যহীন মনে হচ্ছে।’ ওয়াইনবার্গ ‘পয়েন্টলেস’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। এই উক্তির জন্য ওয়াইনবার্গকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই ওই উক্তির পরবর্তী বাক্যগুলো পড়েননি। ওয়াইনবার্গ লিখছেন—
‘আমাদের গবেষণার ফলাফল আমাদের স্বস্তি না দিতে পারে, কিন্তু কিছু শান্তি পাওয়া যাবে গবেষণা প্রক্রিয়ার ভেতরেই। দেবতা বা ক্ষমতাশীলদের গল্পকথা দিয়ে, অথবা প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে তাদের চিন্তা আবদ্ধ রেখে নারী ও পুরুষেরা যে সান্ত্বনা পায়, তাতে তারা আর সন্তুষ্ট নয়। তারা এখন তৈরি করছে দুরবিন, কৃত্রিম উপগ্রহ, কণাত্বরক যন্ত্র। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের ডেস্কে বসে গবেষণালব্ধ তথ্যের অন্তর্নিহিত অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। মহাবিশ্বকে বোঝার এই যে প্রচেষ্টা—তা খুব কম জিনিসের মধ্যে একটি, যা মানুষের জীবনকে প্রহসনের ওপরে ওঠায়, তাকে ট্র্যাজেডির সৌন্দর্যের কিছুটা অংশ দেয়।’
ওয়াইনবার্গ ‘গ্রেস অব ট্র্যাজেডি’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। বলাই বাহুল্য, ‘গ্রেস’ শুধু সৌন্দর্য নয়, তার মধ্যে আধ্যাত্মিক একটি ভাব নিহিত আছে। যে বিজ্ঞানীরা মহাজগৎ ও পদার্থবিদ্যার মৌলিক সূত্রগুলো নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁরা তাঁদের কাজে সেই ‘গ্রেস’ খুঁজে পান। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা এটি সম্বন্ধেও সচেতন যে মহাবিশ্ব বা প্রকৃতির গঠনে এমন কিছু আছে, যা আমাদের জ্ঞানকে পূর্ণতা দেবে না। সেই অপূর্ণতাকে মেনে নেওয়ার মধ্যেও একধরনের বলিষ্ঠতা প্রয়োজন।
প্রকৃতির অপূর্ণতা
১৯২৫ সালে হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা (বা অনির্দেশ্যতার) নীতি প্রণয়ন করেন: কণার অবস্থান এবং ভরবেগ (বা বেগ), এই দুটি জিনিসকে একই সঙ্গে যথেচ্ছ সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা যাবে না। অর্থাৎ, আমরা যদি কণার অবস্থানকে সূক্ষ্মভাবে মাপতে পারি, তবে তার বেগ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা থাকবে অস্পষ্ট। ফলে সেটির পরমুহূর্তের অবস্থান থাকবে অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে কণার বেগকে যথার্থভাবে জানলে, সেটির অবস্থানকে নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। (একইভাবে এই নীতি অনুযায়ী শূন্য থেকে শক্তি ঋণ করে কণারা খুব অল্প সময়ের জন্য বাস্তবে আবির্ভূত হতে পারে। এবং সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময় শেষে আবার হারিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে।) ফলে নিউটনীয় চিরায়ত বলবিদ্যার পরিণামবাদী বা নিষ্পত্তিমূলক মহাবিশ্বের অবসান ঘটল। ১৮১৪ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী লাপলাস বলেছিলেন, এমন কোনো অস্তিত্ব যদি থাকে, যে সে কোনো একটা মুহূর্তে মহাবিশ্বের সমস্ত কণার অবস্থান এবং তাদের ওপর প্রযোজ্য বলের পরিমাণ জানবে, তাহলে তার পক্ষে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ ও অতীত অবস্থা নির্ধারণ করা কঠিন হবে না। এই অস্তিত্বকে অনেকে লাপলাসের দানব বলে অভিহিত করেন।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সুনিশ্চিতভাবে লাপলাসের দানবের পরিণামবাদী মহাবিশ্বের অবসান ঘটাল। শুধু তা-ই নয়, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলল কণাসমূহের শুধু কণা বৈশিষ্ট্যই নয়, একটি তরঙ্গ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। তবে এই তরঙ্গ প্রকৃত ‘বাস্তব তরঙ্গ’, নাকি একটি ‘সম্ভাবনা তরঙ্গ’ তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যদিও বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন, মুক্ত কণার (যেমন ইলেকট্রনের) অবস্থান প্রসারণশীল ‘সম্ভাবনা তরঙ্গ’ দিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব, যার প্রকৃতি নিতান্তই গাণিতিক। অন্যদিকে যে মুহূর্তে ওই ইলেকট্রনটিকে অবলোকন করা হবে, সেটি একটি কণায় রূপান্তরিত হবে। কণা ও তরঙ্গের এই যে দ্বৈত বাস্তবতা, তা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরে। একটি ইলেকট্রন একটি বিন্দু থেকে আরেকটি বিন্দুতে কীভাবে ভ্রমণ করে, আমরা তা সঠিক জানি না। কারণ, দুটি বিন্দুর মধ্যে অসংখ্য সম্ভাব্য পথ রয়েছে। সেই পথগুলোকে আমাদের মনে চিত্রিত করা সম্ভব নয়; শুধু গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
বিজ্ঞানের দর্শনে পজিটিভিজমের মত হলো, শুধু সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বস্তু সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করা যাবে তা-ই একমাত্র সত্য, এর বাইরে কিছু বললে সেটা হবে জল্পনা। ভিয়েনার বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মাখ এর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। যেহেতু ১৮ শতকের শেষে ও ১৯ শতকের প্রথম দিকে পরমাণুকে সরাসরি পর্যবেক্ষণের কোনো পদ্ধতি জানা ছিল না, পজিটিভিস্টরা পরমাণু সম্পর্কে আলোচনাকে বিজ্ঞানবহির্ভূত মনে করতেন। অন্যদিকে রিয়্যালিস্ট বা বাস্তববাদীরা সরাসরি পরমাণু দেখা না গেলেও সেটিকে বাস্তব ধরে নিয়ে গবেষণা করতেন। আইনস্টাইনকে মাখ বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু ১৯২০-এর দশকের আইনস্টাইন পজিটিভিস্ট ছিলেন না, বরং বাস্তববাদী ছিলেন। অন্যদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রবক্তারা, বিশেষ করে নিলস বোর ও হাইজেনবার্গ পজিটিভিজমকে পুরোপুরি ত্যাগ করেননি। তাঁরা মনে করতেন, কোয়ান্টাম পর্যবেক্ষণের ফলাফল পরীক্ষক কী দেখতে চাইছেন, সেটার ওপর নির্ভর করে: পরীক্ষক যদি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপতে চান, তো ইলেকট্রনকে তরঙ্গ হিসেবে দেখবেন। অন্যদিকে তিনি যদি তাঁর ভরবেগ নির্ধারণ করতে চান, তাহলে কণা হিসেবে দেখবেন। কণা বা তরঙ্গ এ দুই বৈশিষ্ট্যের কোনো অর্থ নেই, যতক্ষণ না পরীক্ষক তাঁর স্বাধীন চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে অবলোকন করবেন। বাস্তববাদী আইনস্টাইনের কাছে এ রকম অজ্ঞেয়বাদ ছিল পুরোপুরিই পরিত্যাজ্য।
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বলে, কণার অবস্থান ও গতিবেগ একই সঙ্গে যথার্থভাবে জানা যাবে না। প্রকৃতি সম্পর্কে এটাও একধরনের অজ্ঞানতা। অর্থাৎ, আমাদের পর্যবেক্ষণপদ্ধতি যতই দক্ষ হোক না কেন, আমাদের কাছে এ দুই জিনিস একসঙ্গে অজানা থেকে যাবে। এই অজ্ঞানতা দেশ-কালের চাদরের মধ্যেই প্রোথিত। একে এড়ানোর উপায় নেই। আইনস্টাইনের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি বললেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বপূর্ণ নয়। লিখলেন, ‘ঈশ্বর পাশা খেলতে পারে, ঠিক আছে; কিন্তু সে যে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে জুয়া খেলবে, এটা আমার ধারণার বাইরে।’ ঈশ্বর অর্থে এখানে তিনি প্রকৃতিকেই বুঝিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৯ আগস্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে আলাপে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর রাজ্যে আকস্মিকতা কাজ করে। কাজেই, অস্তিত্বের নাটক পুরোপুরি পূর্বনির্ধারিত নয়।’ তখন আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তার মানে এই নয় যে, বিজ্ঞান থেকে কার্যকারণ বিদায় হয়েছে।’ কার্যকারণ আইনস্টাইনের দর্শনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বাস্তববাদী ছিলেন এবং মানব-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র বাস্তবতায় বিশ্বাস করতেন। একই সঙ্গে প্রকৃতি যে কিছু জ্ঞান আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে, তাতে বিশ্বাস করতেন না।
আইনস্টাইন নিজে খেয়ালিপনায় সে রকম বিশ্বাস করতেন না। যদিও তাঁর অগোছালো চুলের যে ছবিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, তাতে তাঁকে মন-ভোলা খেয়ালি বিজ্ঞানী হিসেবেই আমরা দেখি। কোয়ান্টাম তত্ত্বে ভরসা না রেখে তিনি জীবনের শেষ ২৫টি বছর আপেক্ষিকতা ও তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রতত্ত্বের সংমিশ্রণে পদার্থবিদ্যার চূড়ান্ত নীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। ‘প্রকৃতি জুয়া খেলবে না’—এই জীবন দর্শন তাঁকে এই পথে পরিচালিত করে। তাঁর সেই উদ্যোগ অবশ্য সফল হয়নি। তাই আইনস্টাইনের পক্ষে কৃষ্ণবিবরের সিংগুলারিটির অস্তিত্ব মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। তাঁর কাছে সিংগুলারিটি হলো প্রকৃতির খেয়ালিপনা, যার বৈশিষ্ট্যকে আমরা কোনোভাবেই নির্ধারণ করতে পারব না। যে সিংগুলারিটি থেকে আমরা কোনো তথ্যই আর আহরণ করতে পারব না (যদিও ইদানীং এই ধারণাটির পরিবর্তন হয়েছে)। আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি কোনোভাবে সিংগুলারিটি (বা ব্ল্যাক হোল) সৃষ্টিতে বাধা দেবে। কারণ, সিংগুলারিটি হলো প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের একধরনের অজ্ঞানতা। এ হলো যেন প্রকৃতির অপূর্ণতা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পরিসংখ্যানগত অনিশ্চয়তাকে তিনি যেমন পছন্দ করেননি, তেমনি একটি তারার পতন সিংগুলারিটি সৃষ্টি করতে পারে—সেটাও মেনে নেননি। অথচ এই দুটি বিষয়ের সূত্রপাত তিনি নিজ হাতে করে গিয়েছিলেন।
পরম ‘কিছু না’
চিন্তা করুন এমন একটি অবস্থা, যেখানে স্থান-কাল-পাত্র নেই। নেই দেশ-কালের চাদর, সময় নেই, স্পেস বা স্থান বলতে যা বোঝাই, সেই স্থান নেই। এমন একটি অবস্থা চিন্তা করা দুরূহ। কারণ, চিন্তার মাধ্যমে আমরা সেটিকে আকার দিই। কারণ, ‘কিছু না’-কে মনে স্থান দিলে সেটি ‘কিছু’-তে পরিণত হয়। বিখ্যাত চৈনিক দার্শনিক গ্রন্থ তাও-তে-চিং শুরুই হয়েছে এই পঙ্ক্তি দিয়ে—
‘যে তাওকে (পথকে) বর্ণনা করা যায়, তা চিরন্তন তাও নয়
যে নামকে উচ্চারণ করা যায়, তা চিরন্তন নাম নয়।
নামহীন যা তা স্বর্গ ও মর্ত্যের সীমানা
আর নামযুক্ত যা তা সকল সৃষ্টির মাতা।।’
আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, পরম ‘কিছু না’-কে নাম দিয়ে আমরা সেটির পরমত্বকে খর্ব করেছি। তবু যদি ধরা যায়, এ রকম একটা অবস্থা থাকা সম্ভব, তাহলে সেটিরই হওয়া উচিত ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই বাক্যটি যে স্ববিরোধিতায় পূর্ণ, তা স্বীকার করি। কিন্তু তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে ভাবেন এবং কেন ‘কিছু না’-এর পরিবর্তে ‘কিছু’-এর (মহাবিশ্বের) আবির্ভাব হয়েছে, এই ধাঁধা তাদের রাতে জাগিয়ে রাখে।
সেই ‘কিছু না’ অবস্থায় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব যদি কাজ করে, তবে ক্রমাগতই তাতে ছোট ছোট দেশ-কাল সৃষ্টি হবে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সেগুলো আবার ‘কিছু না’-তে বিলীন হয়ে যাবে। একে কোয়ান্টাম বিচলন বলা যেতে পারে। কিন্তু মাঝেমধ্যে যদি সেই ক্ষণিক দেশ-কালের বুদ্বুদে অন্য কোনো বিশেষ ‘ক্ষেত্রের’ আবির্ভাব হয়, যা সেই বুদ্বুদকে খুব দ্রুত স্ফীত করবে, তাহলে সেই দেশ-কালটি স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। এবং আমরা এই দেশ-কালের বুদ্বুদের আবির্ভাব ও দ্রুত প্রসারণকে বিগ ব্যাং বলে অভিহিত করতে পারি।
এই মডেল খুব আকর্ষণীয়, শুধু এখানে একটি বড় সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা যখন ‘কিছু না’ বলছি, তার মধ্যে পদার্থবিদ্যা বা প্রকৃতির কোনো নীতিও থাকবে না। তাই হাইজেনবার্গের তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম বিচলনের সেখানে কাজ করার কথা নয়। যদি করে, তাহলে সেটি পরম শূন্য বা ‘কিছু না’ হবে না। এই মডেলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগেই কোয়ান্টাম বিচলনকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে বলতে হবে—পরম ‘কিছু না’ বলে কখনোই কিছু সম্ভব নয়। কারণ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ‘সব জায়গায়’ প্রতিষ্ঠিত।
নইলে আমাদের এমন এক মহাবিশ্বের কথা ভাবতে হবে, যার ঠিক শুরু নেই, যেমন ভেবেছিলেন স্টিফেন হকিং বহু বছর আগে। তাঁর সেই মডেলে মহাবিশ্বের শুরুতে ‘সময়’ বলে কিছু ছিল না, শুধু ছিল ‘দেশ’ বা ‘স্থান’। যেহেতু সময় ছিল না, বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল, সেই প্রশ্নটি তখন আর করা যাবে না। কিন্তু যা-ই হোক না কেন, এই ধরনের ধাঁধা বা প্রশ্ন যে খুব গভীর এবং দর্শনের সঙ্গে জড়িত, তা বোঝাই যাচ্ছে।
আমাদের গ্যালাক্সিতে তারার সংখ্যা ৪০০ বিলিয়নের (৪০ হাজার কোটি) মতো হবে হয়তো। অথচ আমাদের নিকটবর্তী তারা প্রায় সাড়ে চার আলোকবর্ষ দূরে। এখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সেখানে পৌঁছাতে ৬০-৭০ হাজার বছর লেগে যাবে। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর সমস্ত রাসায়নিক জ্বালানি যথেষ্ট হবে না এই কাজ সম্পন্ন করতে। আমরা চাঁদে, মঙ্গলে, এমনকি বৃহস্পতির চাঁদগুলোতেও হয়তো যেতে পারব। কিন্তু আকাশের তারারা হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের হাতের বাইরে থাকবে। সেখানে হয়তো আমরা আদৌ পৌঁছাতে পারব না।
আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১০ ট্রিলিয়নের (১০ লাখ কোটি) মতো। আর দৃশ্যমান মহাবিশ্ব হয়তো-বা সমগ্র মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। নিঃসন্দেহে শুধু ক্ষুদ্র একটি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির, বুদ্ধিমান চেতনার উদ্ভবের জন্য মহাবিশ্বের কোটি কোটি গ্যালাক্সির প্রয়োজন ছিল না। এই গ্যালাক্সিগুলো সম্পর্কে যতই আমরা জানছি, আমাদের ব্যবহার্য জীবনে তাদের ভূমিকা যে শূন্য, তা-ও বুঝতে পারছি। মহাবিশ্বের এই বিশালতা একদিকে যেমন আমাদের বিস্মিত করে, অন্যদিকে ওয়াইনবার্গের সেই ‘উদ্দেশ্যহীনতা’ উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। কিছু জ্ঞান প্রকৃতি হয়তো আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে—কণার সঠিক অবস্থান ও ভরবেগ একসঙ্গে আমরা কখনোই নিরূপণ করতে পারব না। কৃষ্ণবিবরের মধ্যে সিংগুলারিটিকে আমরা কখনোই দেখব না। সমগ্র মহাবিশ্বের (শুধু দৃশ্যমান মহাবিশ্ব নয়) বিস্তার আমাদের কাছে রইবে অজানা, যেমন অজানা রইবে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর—কেন ‘কিছু’ আছে ‘কোনো কিছু না থাকা’-এর বদলে। কিন্তু এর মধ্যেই রয়েছে আমাদের জীবনদর্শনের পরিপূর্ণতা। প্রকৃতির এই খেলার নিগূঢ় নির্যাসকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে রয়েছে একধরনের স্বস্তি। সেই স্বস্তি আমাদের জীবনকে দেয় অর্থ। জীবনের শেষে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘রূপনারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
বিজ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই মানুষকে কঠিন সত্যের মুখোমুখি করে। আমাদের মধ্যে কে স্বস্তি বোধ করবে এই ভেবে যে আমরা উদ্ভূত হয়েছি এক প্রাককেন্দ্রিক এক কোষী প্রাণী থেকে? আমাদের মধ্যে কে স্বস্তি বোধ করবে, এই ভেবে যে তাপগতি-বিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের অমোঘ গতিতে একদিন আকাশের সব তারা নিভে যাবে? আমি বলব, এই যে অস্বস্তি, সেটিই আমাদের মানবিক বোধকে পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত করে। একদিকে যেমন আমরা মহাবিশ্বের উদাসীনতায় বিভ্রান্ত, অন্যদিকে সেই মহাবিশ্বকে আমাদের চেতনায়, বোধে পুনর্গঠিত করার মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের অনন্য মূল্য নির্ধারিত হয়। আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে এই জ্ঞানটির, এই বোধটির ভূমিকা অতুলনীয়। এটিকে গ্রহণ করতে সাহসের প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ যখন তার সমস্ত ভঙ্গুরতা, নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কঠিন সত্যকে আত্মস্থ করতে পারবে; অর্থাৎ, তার বাসস্থান, পৃথিবী নামের এই জাহাজটিকে অসীম স্থান-কালের অনুপাতে বিচার করতে পারবে; তখন সে আরেক ধরনের শান্তি ও স্বস্তি পাবে। সামগ্রিক মানবকল্যাণের জন্যও সেই বোধটির প্রয়োজন।
দীপেন ভট্টাচার্য: জ্যোতিঃপদার্থবিদ, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪