মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
একাত্তর সাল। মুক্তিযুদ্ধকালে রণাঙ্গনে আমাদের একটি প্রিয় গান ছিল, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় এসেছিল। সেদিন ফুল ফুটেছিল, পুষ্পে পুষ্পে ভরে উঠেছিল বিজয়ের ডালি। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সেদিন এসেছিল এক যুগান্তকারী বিজয়। সৃষ্টি হয়েছিল ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা’র মূলনীতির ভিত্তিতে প্রগতির পথে অগ্রযাত্রার অমূল্য ও ঐতিহাসিক এক সম্ভাবনা।
‘বসন্ত’ এসেছিল জাতির জীবনে। স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও দেশের সমগ্র জনগণ সেদিন হয়ে উঠেছিল বিজয়-আনন্দে আত্মহারা। অমূল্য বিজয়ের ফুলের ডালি নিয়েই সেদিনের সেই ‘নববসন্তে’ শুরু হয়েছিল নতুন দেশের নবযাত্রা।
বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ৫০ বছরের মাথায় এসে আজ দেখছি, সেদিনের সেই অমূল্য বিজয়সম্ভারের অতি অল্পই আজ অবশিষ্ট রয়েছে। সে ডালি আজ শূন্যপ্রায়! সুরভিত ফুলের সেই ডালিতে আজ বাসা বেঁধেছে কীট-পতঙ্গ-আবর্জনা। সংগ্রামে বিজয় অর্জন করতে না পারা নিঃসন্দেহে গভীর বেদনার বিষয়। কিন্তু বিজয় অর্জন করার পর সে বিজয় হাতছাড়া হওয়ার বেদনা আরও তীব্র ও মর্মান্তিক। একাত্তরের বিজয়-সম্ভারের অমূল্য সম্পদ ‘হারানোর উপলব্ধি’টিও যেন হারিয়ে যায়, তার অপচেষ্টাও আজ নানা মহল চালাচ্ছে।
বিজয় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার বেদনা মর্মান্তিক; কিন্তু তা যে হাতছাড়া হয়েছে, সেটা বুঝতে না পারা, কিংবা তা বুঝতে না দেওয়ার চেষ্টা করাটা আরও মর্মান্তিক। হৃদয়ে আজ তাই হাহাকার! ‘রোদনভরা এ বসন্ত’! আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শগত ভিত্তি নেতিকরণ করে তার বদলে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল ভিত্তির ওপর, তথা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীতমুখী চরিত্রের নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল–দেশ চলবে অসাম্প্রদায়িক ধারায়। রাষ্ট্রের নীতি হবে ধর্মনিরপেক্ষতা; কিন্তু আজ আমাদের দেশকে সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনা হয়েছে। সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি পুনঃসংযোজিত করা হলেও সেই সংবিধানেই আবার ‘ইসলামকে’ রাষ্ট্রধর্ম করে রাখা হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমাজ ও রাজনীতির ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’ বিপজ্জনকভাবে প্রসারিত হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন ছিল না। তা ছিল জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের প্রগতিশীল উপাদানে সমৃদ্ধ একটি জনযুদ্ধ। একটি মুক্তিসংগ্রাম। সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, ডলারের শৃঙ্খল, বিজাতীয় শক্তির প্রতি অধীনতা-নির্ভরশীলতা ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পূর্ণভাবে বাস্তবায়নই ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল সব ধরনের পরনির্ভরতা দূর করে আত্মশক্তির ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন জাতীয় বিকাশের ধারাকে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশকে আজ সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের কাছে বন্দী করে ফেলা হয়েছে। এদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির আধিপত্য ও আগ্রাসন। চলছে ‘এসব বিদেশি প্রভুর’ তুষ্টিসাধনে ও নির্লজ্জ ভিক্ষাবৃত্তিতে সাফল্য নিয়ে বড়াই করার হীন প্রবৃত্তি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল—জাতীয় মুক্তি অর্জনের পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন পথ অনুসরণ করা। স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ‘পুঁজিবাদের’ শোষণমূলক পথে নয়, ‘সমাজতন্ত্রের’ পথেই হবে এ দেশের অগ্রযাত্রা। সম্পদের মালিকানার রূপ, সম্পদ বণ্টনের নীতি ইত্যাদি বিষয়েও সংবিধানে খুবই স্পষ্টভাবে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখীন ধারাসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছিল। ‘সমাজতন্ত্রের’ সেই লক্ষ্য আজ পরিত্যক্ত হয়েছে। ‘পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি’ চালু করা হয়েছে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ—সবকিছুতেই আজ বিত্ত ও বিত্তবানদের নিরঙ্কুশ দখল প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হয়েছে। দেশে চলছে বেপরোয়া লুটপাট। হাতে গোনা কিছু পরিবার লুটপাট চালিয়ে সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছে, বিলাসী জীবন যাপন করছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। দারিদ্র্য, ধনবৈষম্য, বেকারত্ব, নৈরাজ্য দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত আজ দিশেহারা। এ অবস্থাকে ‘উন্নয়নের প্রসববেদনা’ বলে মেনে নেওয়ার জন্য যুক্তি হাজির করছে।
‘বাজার অর্থনীতি’ জন্ম দিয়েছে ‘বাজার রাজনীতির’। ‘বাজার অর্থনীতির’ অনুষঙ্গ হলো ‘লুটপাট’। এই ‘লুটপাটের অর্থনীতি’ জন্ম দিয়েছে ‘লুটপাটের রাজনীতির’। রাষ্ট্রক্ষমতা এখন হয়ে উঠেছে লুটপাটের সুযোগের সহজ উৎস। তাই যেনতেন উপায়ে ‘গদি দখল’ই এখন পরিণত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের একমাত্র লক্ষ্য। রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের দখলে রাখার জন্য গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে, এবং এমনকি জনগণের ভোটাধিকারকেও হরণ করেছে। ‘রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের’ বদলে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের’ আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট প্রবণতার বিপদ বেড়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় রচিত সংবিধানকে মোশতাক-জিয়া-এরশাদ ক্ষতবিক্ষত করে তার মৌলিক চরিত্র বদলে দিয়েছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করলেও এই ক্ষতগুলো অপসারণ করেনি। ’৭২-এর সংবিধানের মূলভিত্তি পূর্ণভাবে ফিরিয়ে না এনে বরং সেসব ক্ষতের অনেকগুলোই জিইয়ে রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী আজ তাই এক ‘রোদনভরা বসন্ত’। যে শক্তি সেই ‘বসন্তকে’ ছিনিয়ে নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সরাসরি আদর্শিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ না হয়ে ‘হারানো বিজয়’ পুনরুদ্ধার করা যাবে না। এসব মৌলিক প্রশ্নে পশ্চাদপসরণ করে কিংবা সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে অথবা সেসব সম্পর্কে নীরব থেকে একাত্তরের ‘বসন্তসম্ভার’ ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ‘মূলধারার দল’ বলে দাবিদার দেশের বুর্জোয়া দল দুটি ‘গদি দখলে রাখার’ সমীকরণ ঠিক রাখার জন্য এসব অপশক্তিকে নিজ নিজ পক্ষে রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শের প্রতিপক্ষ শক্তির ষড়যন্ত্র ও আঘাত করার ক্ষমতা বিপুল এবং তা দিন দিন বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী অপশক্তি ছোবল দেওয়ার জন্য আজ প্রস্তুত। সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের মতো আরেকটা গণজোয়ার ছাড়া এই অপশক্তিকে ঘায়েল করা যাবে না এবং তা করতে না পারলে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, দেশের অস্তিত্বই বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।
দেশের বুর্জোয়া দল ও জোটের মধ্যে ‘গদির হাতবদল’ হলেও ‘মানুষের ভাগ্যবদল’ হয় না। সেটিও যেন আর না হতে পারে, তেমন ব্যবস্থাও আজ করে রাখা হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো ফিরিয়ে এনে জনগণের ভাগ্যবদল করতে হলে ‘গদিবদলের’ সঙ্গে সঙ্গে ‘ব্যবস্থার বদলও’ ঘটাতে হবে। জাতির বর্তমান দুর্যোগের অবসান ঘটাতে হলে যে দুষ্টচক্রের বেড়াজালে দেশ আজ আটকা পড়েছে, তা ভাঙতে হবে। নবযৌবনের শক্তিকে এ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। উপযুক্ত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে এই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে। এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে সব বামপন্থী-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তিকে। অর্ধশতাব্দীর ভুল, ত্রুটি, ব্যর্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা—এসব থেকে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা গ্রহণ করে গভীরতর উপলব্ধি নিয়ে জেগে উঠতে হবে। জাগিয়ে তুলতে হবে জাতিকে। সে ক্ষেত্রে একাত্তরের ‘নববসন্তই’ আবার দিকনির্দেশনা দিয়ে চেতনার মশাল হয়ে জাতিকে পথ দেখাবে। শত্রুরা সবকিছু কেড়ে নিতে পারলেও একাত্তরের এই বিজয় মশালকে কেউ কখনোই কেড়ে নিতে পারেনি, পারবেও না। ‘রোদনভরা এই বসন্ত’! তথাপি নিঃসংশয়ে ও দৃঢ়চিত্তে বলব, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত!’
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
একাত্তর সাল। মুক্তিযুদ্ধকালে রণাঙ্গনে আমাদের একটি প্রিয় গান ছিল, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় এসেছিল। সেদিন ফুল ফুটেছিল, পুষ্পে পুষ্পে ভরে উঠেছিল বিজয়ের ডালি। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সেদিন এসেছিল এক যুগান্তকারী বিজয়। সৃষ্টি হয়েছিল ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা’র মূলনীতির ভিত্তিতে প্রগতির পথে অগ্রযাত্রার অমূল্য ও ঐতিহাসিক এক সম্ভাবনা।
‘বসন্ত’ এসেছিল জাতির জীবনে। স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও দেশের সমগ্র জনগণ সেদিন হয়ে উঠেছিল বিজয়-আনন্দে আত্মহারা। অমূল্য বিজয়ের ফুলের ডালি নিয়েই সেদিনের সেই ‘নববসন্তে’ শুরু হয়েছিল নতুন দেশের নবযাত্রা।
বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ৫০ বছরের মাথায় এসে আজ দেখছি, সেদিনের সেই অমূল্য বিজয়সম্ভারের অতি অল্পই আজ অবশিষ্ট রয়েছে। সে ডালি আজ শূন্যপ্রায়! সুরভিত ফুলের সেই ডালিতে আজ বাসা বেঁধেছে কীট-পতঙ্গ-আবর্জনা। সংগ্রামে বিজয় অর্জন করতে না পারা নিঃসন্দেহে গভীর বেদনার বিষয়। কিন্তু বিজয় অর্জন করার পর সে বিজয় হাতছাড়া হওয়ার বেদনা আরও তীব্র ও মর্মান্তিক। একাত্তরের বিজয়-সম্ভারের অমূল্য সম্পদ ‘হারানোর উপলব্ধি’টিও যেন হারিয়ে যায়, তার অপচেষ্টাও আজ নানা মহল চালাচ্ছে।
বিজয় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার বেদনা মর্মান্তিক; কিন্তু তা যে হাতছাড়া হয়েছে, সেটা বুঝতে না পারা, কিংবা তা বুঝতে না দেওয়ার চেষ্টা করাটা আরও মর্মান্তিক। হৃদয়ে আজ তাই হাহাকার! ‘রোদনভরা এ বসন্ত’! আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শগত ভিত্তি নেতিকরণ করে তার বদলে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল ভিত্তির ওপর, তথা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীতমুখী চরিত্রের নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল–দেশ চলবে অসাম্প্রদায়িক ধারায়। রাষ্ট্রের নীতি হবে ধর্মনিরপেক্ষতা; কিন্তু আজ আমাদের দেশকে সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনা হয়েছে। সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি পুনঃসংযোজিত করা হলেও সেই সংবিধানেই আবার ‘ইসলামকে’ রাষ্ট্রধর্ম করে রাখা হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমাজ ও রাজনীতির ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’ বিপজ্জনকভাবে প্রসারিত হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন ছিল না। তা ছিল জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের প্রগতিশীল উপাদানে সমৃদ্ধ একটি জনযুদ্ধ। একটি মুক্তিসংগ্রাম। সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, ডলারের শৃঙ্খল, বিজাতীয় শক্তির প্রতি অধীনতা-নির্ভরশীলতা ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পূর্ণভাবে বাস্তবায়নই ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল সব ধরনের পরনির্ভরতা দূর করে আত্মশক্তির ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন জাতীয় বিকাশের ধারাকে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশকে আজ সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের কাছে বন্দী করে ফেলা হয়েছে। এদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির আধিপত্য ও আগ্রাসন। চলছে ‘এসব বিদেশি প্রভুর’ তুষ্টিসাধনে ও নির্লজ্জ ভিক্ষাবৃত্তিতে সাফল্য নিয়ে বড়াই করার হীন প্রবৃত্তি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল—জাতীয় মুক্তি অর্জনের পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন পথ অনুসরণ করা। স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ‘পুঁজিবাদের’ শোষণমূলক পথে নয়, ‘সমাজতন্ত্রের’ পথেই হবে এ দেশের অগ্রযাত্রা। সম্পদের মালিকানার রূপ, সম্পদ বণ্টনের নীতি ইত্যাদি বিষয়েও সংবিধানে খুবই স্পষ্টভাবে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখীন ধারাসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছিল। ‘সমাজতন্ত্রের’ সেই লক্ষ্য আজ পরিত্যক্ত হয়েছে। ‘পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি’ চালু করা হয়েছে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ—সবকিছুতেই আজ বিত্ত ও বিত্তবানদের নিরঙ্কুশ দখল প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হয়েছে। দেশে চলছে বেপরোয়া লুটপাট। হাতে গোনা কিছু পরিবার লুটপাট চালিয়ে সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছে, বিলাসী জীবন যাপন করছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। দারিদ্র্য, ধনবৈষম্য, বেকারত্ব, নৈরাজ্য দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত আজ দিশেহারা। এ অবস্থাকে ‘উন্নয়নের প্রসববেদনা’ বলে মেনে নেওয়ার জন্য যুক্তি হাজির করছে।
‘বাজার অর্থনীতি’ জন্ম দিয়েছে ‘বাজার রাজনীতির’। ‘বাজার অর্থনীতির’ অনুষঙ্গ হলো ‘লুটপাট’। এই ‘লুটপাটের অর্থনীতি’ জন্ম দিয়েছে ‘লুটপাটের রাজনীতির’। রাষ্ট্রক্ষমতা এখন হয়ে উঠেছে লুটপাটের সুযোগের সহজ উৎস। তাই যেনতেন উপায়ে ‘গদি দখল’ই এখন পরিণত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের একমাত্র লক্ষ্য। রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের দখলে রাখার জন্য গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে, এবং এমনকি জনগণের ভোটাধিকারকেও হরণ করেছে। ‘রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের’ বদলে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের’ আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট প্রবণতার বিপদ বেড়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় রচিত সংবিধানকে মোশতাক-জিয়া-এরশাদ ক্ষতবিক্ষত করে তার মৌলিক চরিত্র বদলে দিয়েছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করলেও এই ক্ষতগুলো অপসারণ করেনি। ’৭২-এর সংবিধানের মূলভিত্তি পূর্ণভাবে ফিরিয়ে না এনে বরং সেসব ক্ষতের অনেকগুলোই জিইয়ে রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী আজ তাই এক ‘রোদনভরা বসন্ত’। যে শক্তি সেই ‘বসন্তকে’ ছিনিয়ে নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সরাসরি আদর্শিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ না হয়ে ‘হারানো বিজয়’ পুনরুদ্ধার করা যাবে না। এসব মৌলিক প্রশ্নে পশ্চাদপসরণ করে কিংবা সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে অথবা সেসব সম্পর্কে নীরব থেকে একাত্তরের ‘বসন্তসম্ভার’ ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ‘মূলধারার দল’ বলে দাবিদার দেশের বুর্জোয়া দল দুটি ‘গদি দখলে রাখার’ সমীকরণ ঠিক রাখার জন্য এসব অপশক্তিকে নিজ নিজ পক্ষে রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শের প্রতিপক্ষ শক্তির ষড়যন্ত্র ও আঘাত করার ক্ষমতা বিপুল এবং তা দিন দিন বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী অপশক্তি ছোবল দেওয়ার জন্য আজ প্রস্তুত। সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের মতো আরেকটা গণজোয়ার ছাড়া এই অপশক্তিকে ঘায়েল করা যাবে না এবং তা করতে না পারলে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, দেশের অস্তিত্বই বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।
দেশের বুর্জোয়া দল ও জোটের মধ্যে ‘গদির হাতবদল’ হলেও ‘মানুষের ভাগ্যবদল’ হয় না। সেটিও যেন আর না হতে পারে, তেমন ব্যবস্থাও আজ করে রাখা হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো ফিরিয়ে এনে জনগণের ভাগ্যবদল করতে হলে ‘গদিবদলের’ সঙ্গে সঙ্গে ‘ব্যবস্থার বদলও’ ঘটাতে হবে। জাতির বর্তমান দুর্যোগের অবসান ঘটাতে হলে যে দুষ্টচক্রের বেড়াজালে দেশ আজ আটকা পড়েছে, তা ভাঙতে হবে। নবযৌবনের শক্তিকে এ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। উপযুক্ত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে এই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে। এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে সব বামপন্থী-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তিকে। অর্ধশতাব্দীর ভুল, ত্রুটি, ব্যর্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা—এসব থেকে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা গ্রহণ করে গভীরতর উপলব্ধি নিয়ে জেগে উঠতে হবে। জাগিয়ে তুলতে হবে জাতিকে। সে ক্ষেত্রে একাত্তরের ‘নববসন্তই’ আবার দিকনির্দেশনা দিয়ে চেতনার মশাল হয়ে জাতিকে পথ দেখাবে। শত্রুরা সবকিছু কেড়ে নিতে পারলেও একাত্তরের এই বিজয় মশালকে কেউ কখনোই কেড়ে নিতে পারেনি, পারবেও না। ‘রোদনভরা এই বসন্ত’! তথাপি নিঃসংশয়ে ও দৃঢ়চিত্তে বলব, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত!’
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪