নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও কুমিল্লা প্রতিনিধি
যাঁরা দূরবর্তী লক্ষ্যনির্ভর ভবিষ্যৎ দেখতে পান, তাঁরা ভিশনারি বা দূরদর্শী। বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা ভবিষ্যৎকে দেখেন। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধীসহ যাঁরা স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের মধ্যে ভিশনারি নেতৃত্বের গুণাবলি দেখা যায়।
রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এবং পদক্ষেপগুলোর দিকে তাকালে তাঁর চিন্তাশক্তির প্রখরতা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামে নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যা তাঁর দূরদর্শী চিন্তা থেকে উৎসারিত। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা বিনির্মাণের। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে এই স্বপ্ন পূরণে তাঁর গৃহীত বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ এবং সাহসী সিদ্ধান্ত সোনার বাংলা গড়ার পথ সুগম করে।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার সময়ে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যাতে প্রতিফলিত হয় তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা। ডিজিটাল বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকা শক্তি তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগগুলোর দিকে চোখ ফেরালে স্পষ্টত প্রতীয়মান হবে তিনি তাঁর সোনার বাংলা বিনির্মাণের অভিযাত্রায় অন্যান্য খাতের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও স্বল্প, মধ্য ও দূরবর্তী লক্ষ্যনির্ভর পদক্ষেপ নিতে একটুও দ্বিধা করেননি।
বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি দেখেছেন যেসব দেশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরিবিদ্যায় অগ্রগামী, তারা উন্নয়নের ঝড় তুলেছে। কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে দ্রুত ধনী দেশে পরিণত হয়। বিদেশে গিয়েও তিনি দেখতেন কৃষি, শিল্প ও শিক্ষার উন্নতি। চীন সফরের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমার কিন্তু পুরোনো আমলের ভাঙা বাড়ি দেখার ইচ্ছা ছিল না। কারণ আমি দেখতে চাই কৃষির উন্নতি, শিল্পের উন্নতি, শিক্ষার উন্নতি, সাধারণ মানুষের উন্নতি।’ তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে শামিল হতে ব্যর্থ হলে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সফল করা কঠিন হবে। এই বিপ্লবের প্রধান চালিকা শক্তি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মানবসভ্যতার গতিপথ পাল্টে দেবে এবং উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করে ব্যাপকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। তিনি তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকা শক্তি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি পুরোনো আমলের ঘুণে ধরা শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই উপমহাদেশখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। যে কমিশন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরিবিদ্যা, গবেষণাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট প্রণয়ন করে।
বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা’ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেমিস্ট্রি ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ড. মফিজ চৌধুরীকে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও আণবিক শক্তি বিভাগেরও দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই তাঁর ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেন।
বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে সম্মান দিতেন। একবার মন্ত্রিসভায় বঙ্গোপসাগরে জাপানকে এককভাবে তেল অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় সবাই জাপানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ড. মফিজ যৌক্তিক কারণে কোনো একক দেশকে তেল অনুসন্ধানের দায়িত্ব না দিয়ে একাধিক দেশকে তা দেওয়ার কথা বলেন। প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ডক্টর সাহেব যা বলেছেন, তাই হবে।’ বঙ্গোপসাগরে যেদিন প্রথম কূপ খনন হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধু খুবই উল্লসিত হয়ে ড. মফিজ চৌধুরীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) উৎক্ষেপণ করে। এর মাত্র কয়েক মাস পরই বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ জরিপ, পরিবেশ, দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট (বাংলাদেশ ইআরটিএস) প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নও করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টা চালান। কারণ জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে আইটিইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিকাশ, স্যাটেলাইটের অরবিট বা ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ ও নীতিমালা প্রণয়নে সমন্বয় করে থাকে। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আইটিইউর সদস্য হয়। ১৯৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ’ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট আর্থস্টেশনের উদ্বোধন করেন। একই বছরের ৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু রেডিও-টেলিভিশন দেশেই উৎপাদনের জন্য নথিতে নির্দেশনা দেন। শুধু উৎপাদনের নির্দেশনা নয়, প্রতিটি ব্যান্ড রেডিও এবং টেলিভিশনের মূল্যও নির্ধারণ করে দেন। বলা যেতে পারে, আইটিইউর সদস্যপদ লাভ, বাংলাদেশ ইআরটিএস প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন এবং স্যাটেলাইট আর্থস্টেশন স্থাপন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের ভিত্তি রচনা করে। সর্বোপরি ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার পথ সুগম করে।
বঙ্গবন্ধু যে মানুষের ‘সৃজনশীলতা’ এবং ‘বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতির মাধ্যমে উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের’ স্বপ্ন দেখতেন, সে কথাও আন্তর্জাতিক বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরতে ভুলে যাননি। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন। মানুষের সৃজনশীলতা এবং বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব, যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে এবং যে বিশ্ব কারিগরিবিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখা যায় অন্য খাতগুলোতেও। জ্বালানি খাতে তিনি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। একটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সে সময়ে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ তখন একেবারেই তলানিতে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ৪৫ লাখ পাউন্ড দিয়ে শেল কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেয়। এগুলো হচ্ছে তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাশটিলা। এমন একটি উদ্যোগকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকার প্রতিবছর ৯ আগস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করছে। এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো কেনা কতটা সুচিন্তিত ও দূরদর্শী ছিল তা বর্তমান বাস্তবতা থেকে সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে এর ৩৫ শতাংশ সরবরাহ করা হয় এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান পেট্রোলিয়ামের মালিকানাধীন সিলেট অঞ্চলের দুটি গ্যাসক্ষেত্রকে জাতীয়করণও করেছিলেন।
সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমির সুফল ঘরে তোলার জন্য তিনি সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। তাঁর সরকার সমুদ্রসম্পদ আহরণে ১৯৭৪ সালেই ‘টেরিটরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪’ (জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা আইন করে ১৯৮২ সালে) প্রণয়ন করে। সমুদ্র এলাকায় সীমানা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘সম্মত কার্যবিবরণী’ স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু স্থলভাগের পাশাপাশি সমুদ্র থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করেছিলেন।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মানির সঙ্গে এ নিয়ে চুক্তি করেছিলেন। তেল আবিষ্কারের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে আটটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ৩১ হাজার ৬০০ লাইন কিলোমিটার ভূ-কম্পন জরিপ করান। পেট্রোলিয়াম আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা, পেট্রোবাংলা এবং মিনারেল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন প্রতিষ্ঠা, জামালগঞ্জ কয়লাখনি, জয়পুরহাট চুনাপাথর খনি, মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি উন্নয়নের পদক্ষেপ নেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্থগিত হয়ে যাওয়া (১৯৬১ সালে স্থগিত করা হয়) পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন গঠন করেন। ভেবে অবাক হতে হয়, মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু কত বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। এসব উদ্যোগের আসল লক্ষ্য ছিল তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ।
যাঁরা দূরবর্তী লক্ষ্যনির্ভর ভবিষ্যৎ দেখতে পান, তাঁরা ভিশনারি বা দূরদর্শী। বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা ভবিষ্যৎকে দেখেন। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধীসহ যাঁরা স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের মধ্যে ভিশনারি নেতৃত্বের গুণাবলি দেখা যায়।
রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এবং পদক্ষেপগুলোর দিকে তাকালে তাঁর চিন্তাশক্তির প্রখরতা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামে নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যা তাঁর দূরদর্শী চিন্তা থেকে উৎসারিত। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা বিনির্মাণের। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে এই স্বপ্ন পূরণে তাঁর গৃহীত বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ এবং সাহসী সিদ্ধান্ত সোনার বাংলা গড়ার পথ সুগম করে।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার সময়ে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যাতে প্রতিফলিত হয় তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা। ডিজিটাল বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকা শক্তি তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগগুলোর দিকে চোখ ফেরালে স্পষ্টত প্রতীয়মান হবে তিনি তাঁর সোনার বাংলা বিনির্মাণের অভিযাত্রায় অন্যান্য খাতের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও স্বল্প, মধ্য ও দূরবর্তী লক্ষ্যনির্ভর পদক্ষেপ নিতে একটুও দ্বিধা করেননি।
বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি দেখেছেন যেসব দেশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরিবিদ্যায় অগ্রগামী, তারা উন্নয়নের ঝড় তুলেছে। কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে দ্রুত ধনী দেশে পরিণত হয়। বিদেশে গিয়েও তিনি দেখতেন কৃষি, শিল্প ও শিক্ষার উন্নতি। চীন সফরের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমার কিন্তু পুরোনো আমলের ভাঙা বাড়ি দেখার ইচ্ছা ছিল না। কারণ আমি দেখতে চাই কৃষির উন্নতি, শিল্পের উন্নতি, শিক্ষার উন্নতি, সাধারণ মানুষের উন্নতি।’ তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে শামিল হতে ব্যর্থ হলে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সফল করা কঠিন হবে। এই বিপ্লবের প্রধান চালিকা শক্তি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মানবসভ্যতার গতিপথ পাল্টে দেবে এবং উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করে ব্যাপকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। তিনি তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকা শক্তি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি পুরোনো আমলের ঘুণে ধরা শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই উপমহাদেশখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। যে কমিশন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরিবিদ্যা, গবেষণাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট প্রণয়ন করে।
বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা’ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেমিস্ট্রি ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ড. মফিজ চৌধুরীকে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও আণবিক শক্তি বিভাগেরও দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই তাঁর ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেন।
বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে সম্মান দিতেন। একবার মন্ত্রিসভায় বঙ্গোপসাগরে জাপানকে এককভাবে তেল অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় সবাই জাপানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ড. মফিজ যৌক্তিক কারণে কোনো একক দেশকে তেল অনুসন্ধানের দায়িত্ব না দিয়ে একাধিক দেশকে তা দেওয়ার কথা বলেন। প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ডক্টর সাহেব যা বলেছেন, তাই হবে।’ বঙ্গোপসাগরে যেদিন প্রথম কূপ খনন হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধু খুবই উল্লসিত হয়ে ড. মফিজ চৌধুরীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) উৎক্ষেপণ করে। এর মাত্র কয়েক মাস পরই বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ জরিপ, পরিবেশ, দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট (বাংলাদেশ ইআরটিএস) প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নও করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টা চালান। কারণ জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে আইটিইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিকাশ, স্যাটেলাইটের অরবিট বা ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ ও নীতিমালা প্রণয়নে সমন্বয় করে থাকে। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আইটিইউর সদস্য হয়। ১৯৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ’ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট আর্থস্টেশনের উদ্বোধন করেন। একই বছরের ৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু রেডিও-টেলিভিশন দেশেই উৎপাদনের জন্য নথিতে নির্দেশনা দেন। শুধু উৎপাদনের নির্দেশনা নয়, প্রতিটি ব্যান্ড রেডিও এবং টেলিভিশনের মূল্যও নির্ধারণ করে দেন। বলা যেতে পারে, আইটিইউর সদস্যপদ লাভ, বাংলাদেশ ইআরটিএস প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন এবং স্যাটেলাইট আর্থস্টেশন স্থাপন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের ভিত্তি রচনা করে। সর্বোপরি ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার পথ সুগম করে।
বঙ্গবন্ধু যে মানুষের ‘সৃজনশীলতা’ এবং ‘বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতির মাধ্যমে উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের’ স্বপ্ন দেখতেন, সে কথাও আন্তর্জাতিক বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরতে ভুলে যাননি। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন। মানুষের সৃজনশীলতা এবং বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব, যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে এবং যে বিশ্ব কারিগরিবিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখা যায় অন্য খাতগুলোতেও। জ্বালানি খাতে তিনি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। একটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সে সময়ে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ তখন একেবারেই তলানিতে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ৪৫ লাখ পাউন্ড দিয়ে শেল কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেয়। এগুলো হচ্ছে তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাশটিলা। এমন একটি উদ্যোগকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকার প্রতিবছর ৯ আগস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করছে। এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো কেনা কতটা সুচিন্তিত ও দূরদর্শী ছিল তা বর্তমান বাস্তবতা থেকে সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে এর ৩৫ শতাংশ সরবরাহ করা হয় এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান পেট্রোলিয়ামের মালিকানাধীন সিলেট অঞ্চলের দুটি গ্যাসক্ষেত্রকে জাতীয়করণও করেছিলেন।
সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমির সুফল ঘরে তোলার জন্য তিনি সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। তাঁর সরকার সমুদ্রসম্পদ আহরণে ১৯৭৪ সালেই ‘টেরিটরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪’ (জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা আইন করে ১৯৮২ সালে) প্রণয়ন করে। সমুদ্র এলাকায় সীমানা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘সম্মত কার্যবিবরণী’ স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু স্থলভাগের পাশাপাশি সমুদ্র থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করেছিলেন।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মানির সঙ্গে এ নিয়ে চুক্তি করেছিলেন। তেল আবিষ্কারের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে আটটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ৩১ হাজার ৬০০ লাইন কিলোমিটার ভূ-কম্পন জরিপ করান। পেট্রোলিয়াম আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা, পেট্রোবাংলা এবং মিনারেল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন প্রতিষ্ঠা, জামালগঞ্জ কয়লাখনি, জয়পুরহাট চুনাপাথর খনি, মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি উন্নয়নের পদক্ষেপ নেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্থগিত হয়ে যাওয়া (১৯৬১ সালে স্থগিত করা হয়) পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন গঠন করেন। ভেবে অবাক হতে হয়, মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু কত বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। এসব উদ্যোগের আসল লক্ষ্য ছিল তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪