সেলিম জাহান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপিত হলো দুই বছর আগে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের।
সেই স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে। পেছন ফিরে তাকালে দেখি, অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষত আর্থসামাজিক অঙ্গনে। ৫২ বছর আগে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। এ সময়ে অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে। ৫২ নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। মাথাপিছু আয় ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। মধ্য-নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, আজ তা মাত্র ২১ শতাংশ। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০ সালের ৭৫ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ৯৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে তা যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই কালপর্বে দেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার লাখপ্রতি ৫৯৪ থেকে ১৬৫তে নেমেছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে দেশের এ অগ্রগতি বিস্ময়কর। সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ ৭৩, ভারতে ৭০ এবং পাকিস্তানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অর্জন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। জানি, অন্তরায় অনেক, তবু দেশের ভেতরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বারবার উঠে এসেছে উন্নয়ন আলোচনায়। উদ্যোক্তা হিসেবে বহু খাতে নারীরা অগ্রণী অবস্থানে। সামান্য মোবাইল ফোনের ওপর ভরসা করে তাঁরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছেন। পোশাকশিল্পে মূলত তাঁদের অবদান থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগের উৎপত্তি। প্রশাসনের নানা স্তর এবং পর্যায়েও তাঁদের সরব উপস্থিতি। সামাজিক অঙ্গনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। বহু ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান পুরুষের অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে।
দেশের তরুণসমাজের কর্মকুশলতা, সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের আশাবাদী করেছে। প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তারা যেসব নতুন নতুন পদ্ধতি বা জ্ঞান সম্প্রসারণবিষয়ক কাজ করছে, সেগুলো দৃষ্টান্তমূলক। নানা ক্ষেত্রে নব্য জ্ঞান ও উদাহরণমূলক কাজের দ্বারা তরুণসমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। এই অর্জন উদ্যাপিত হওয়া প্রয়োজন।
দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের বিস্তার ও বেসরকারি সংস্থার বিস্তৃতি গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মজবুত করেছে এবং বহু ক্ষেত্রে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা বিষয়ে তারা জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে নানা রকমের সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা লক্ষণীয়। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসুবিধা পৌঁছে দেওয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপেয় জলের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তিনটি অর্জনের জন্য আমি গর্ববোধ করি। এক. জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশিদের ভূমিকা। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতকেন্দ্রে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা সবার কাছে নন্দিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও তাঁরা স্থানীয় জনজীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন। দক্ষিণ সুদানের বুভুক্ষু জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা খাবার ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। হাইতিতে কলেরার প্রকোপ এড়াতে আমাদের সেনারা বহুদূর থেকে বিশুদ্ধ জল বহন করে এনেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। নানা দেশ নানাভাবে এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। সিয়েরা লিওন বাংলাকে তার দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে আমাদের সেনারা চরম আত্মত্যাগও করেছেন। চিরনিদ্রায় তাঁরা শায়িত আছেন নানা ভূমিতে। স্থানীয় জনগণ পরম মমতায় এই বীরদের শেষ শয্যা তৈরি করে দিয়েছেন।
দুই. মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকেরা শুধু কাজই করেন না, শুধু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন না, তাঁরা বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতও বটে। তাঁরা কঠোর পরিশ্রম, কর্মকুশলতা ও সততার দ্বারা দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিপণিতে বাঙালি কর্মীদের চাহিদা বেশি, তাঁদের নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার কারণে। এসব মাত্রিকতা দেশকেও তুলে ধরে।
তিন. কূটনৈতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ নানা প্রয়াসে ও গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব দিয়েছে সাফল্যজনকভাবে। পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক আন্দোলন ও নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রয়াসে বাংলাদেশ নানা সময়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতি সম্প্রতি কোভিডের টিকা আবিষ্কারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলকেও অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু এত অর্জনের মধ্যেও পাঁচটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা—ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সেখানে সিলেটে তা ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়—দরিদ্র মানুষেরা সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছেন। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্রের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, অর্থ-বিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপর। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না। আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, শোভনতা এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমারবৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি—সেগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটেছে। সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমেছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্র, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। বাংলাদেশ এ মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমনতরো ধুয়া তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি যে গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র। সামাজিক ন্যায্যতা আজ শুধুই কথার কথা, কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি।
এসব কাঠামোগত অন্তরায় জয় করতে হলে সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব সমাধান কারোর একার হাতে নেই এবং অল্প সময়ের মধ্যে সব কটির সমাধানও করা যাবে না। কিন্তু কিছু বিষয়ে এখনই চিন্তা করতে পারি। যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। অপশক্তি নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভূত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতিতে সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা-সন্ত্রাস বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে। মনে রাখা দরকার, “আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।”
যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের পথে রওনা হওয়ার সময়, ‘আমার এ পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে।’ সেই সুরে আমি বলি: ‘আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিক্-দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।’
লেখক: অর্থনীতিবিদ, ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের সাবেক পরিচালক
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপিত হলো দুই বছর আগে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের।
সেই স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে। পেছন ফিরে তাকালে দেখি, অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষত আর্থসামাজিক অঙ্গনে। ৫২ বছর আগে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। এ সময়ে অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে। ৫২ নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। মাথাপিছু আয় ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। মধ্য-নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, আজ তা মাত্র ২১ শতাংশ। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০ সালের ৭৫ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ৯৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে তা যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই কালপর্বে দেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার লাখপ্রতি ৫৯৪ থেকে ১৬৫তে নেমেছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে দেশের এ অগ্রগতি বিস্ময়কর। সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ ৭৩, ভারতে ৭০ এবং পাকিস্তানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অর্জন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। জানি, অন্তরায় অনেক, তবু দেশের ভেতরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বারবার উঠে এসেছে উন্নয়ন আলোচনায়। উদ্যোক্তা হিসেবে বহু খাতে নারীরা অগ্রণী অবস্থানে। সামান্য মোবাইল ফোনের ওপর ভরসা করে তাঁরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছেন। পোশাকশিল্পে মূলত তাঁদের অবদান থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগের উৎপত্তি। প্রশাসনের নানা স্তর এবং পর্যায়েও তাঁদের সরব উপস্থিতি। সামাজিক অঙ্গনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। বহু ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান পুরুষের অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে।
দেশের তরুণসমাজের কর্মকুশলতা, সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের আশাবাদী করেছে। প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তারা যেসব নতুন নতুন পদ্ধতি বা জ্ঞান সম্প্রসারণবিষয়ক কাজ করছে, সেগুলো দৃষ্টান্তমূলক। নানা ক্ষেত্রে নব্য জ্ঞান ও উদাহরণমূলক কাজের দ্বারা তরুণসমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। এই অর্জন উদ্যাপিত হওয়া প্রয়োজন।
দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের বিস্তার ও বেসরকারি সংস্থার বিস্তৃতি গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মজবুত করেছে এবং বহু ক্ষেত্রে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা বিষয়ে তারা জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে নানা রকমের সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা লক্ষণীয়। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসুবিধা পৌঁছে দেওয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপেয় জলের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তিনটি অর্জনের জন্য আমি গর্ববোধ করি। এক. জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশিদের ভূমিকা। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতকেন্দ্রে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা সবার কাছে নন্দিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও তাঁরা স্থানীয় জনজীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন। দক্ষিণ সুদানের বুভুক্ষু জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা খাবার ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। হাইতিতে কলেরার প্রকোপ এড়াতে আমাদের সেনারা বহুদূর থেকে বিশুদ্ধ জল বহন করে এনেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। নানা দেশ নানাভাবে এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। সিয়েরা লিওন বাংলাকে তার দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে আমাদের সেনারা চরম আত্মত্যাগও করেছেন। চিরনিদ্রায় তাঁরা শায়িত আছেন নানা ভূমিতে। স্থানীয় জনগণ পরম মমতায় এই বীরদের শেষ শয্যা তৈরি করে দিয়েছেন।
দুই. মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকেরা শুধু কাজই করেন না, শুধু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন না, তাঁরা বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতও বটে। তাঁরা কঠোর পরিশ্রম, কর্মকুশলতা ও সততার দ্বারা দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিপণিতে বাঙালি কর্মীদের চাহিদা বেশি, তাঁদের নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার কারণে। এসব মাত্রিকতা দেশকেও তুলে ধরে।
তিন. কূটনৈতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ নানা প্রয়াসে ও গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব দিয়েছে সাফল্যজনকভাবে। পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক আন্দোলন ও নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রয়াসে বাংলাদেশ নানা সময়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতি সম্প্রতি কোভিডের টিকা আবিষ্কারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলকেও অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু এত অর্জনের মধ্যেও পাঁচটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা—ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সেখানে সিলেটে তা ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়—দরিদ্র মানুষেরা সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছেন। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্রের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, অর্থ-বিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপর। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না। আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, শোভনতা এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমারবৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি—সেগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটেছে। সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমেছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্র, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। বাংলাদেশ এ মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমনতরো ধুয়া তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি যে গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র। সামাজিক ন্যায্যতা আজ শুধুই কথার কথা, কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি।
এসব কাঠামোগত অন্তরায় জয় করতে হলে সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব সমাধান কারোর একার হাতে নেই এবং অল্প সময়ের মধ্যে সব কটির সমাধানও করা যাবে না। কিন্তু কিছু বিষয়ে এখনই চিন্তা করতে পারি। যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। অপশক্তি নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভূত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতিতে সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা-সন্ত্রাস বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে। মনে রাখা দরকার, “আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।”
যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের পথে রওনা হওয়ার সময়, ‘আমার এ পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে।’ সেই সুরে আমি বলি: ‘আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিক্-দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।’
লেখক: অর্থনীতিবিদ, ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের সাবেক পরিচালক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪