মাহা মির্জা
প্রায় ১০ বছর আগে ফিলিপাইনের এক অধ্যাপক এসেছিলেন ঢাকায়। ব্র্যাকের আমন্ত্রণে। তাঁর বক্তব্য শুনতে গেলাম (দুর্ভাগ্যবশত অধ্যাপকের নাম মনে নেই)। সেই অধ্যাপক ফিলিপাইনের ‘মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার’ নিয়ে কথা বলেছিলেন।
ফিলিপাইন তখন বিশ্বের অন্যতম বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া দেশ। প্রবাসী শ্রমিকেরা ফিলিপাইনের অর্থনীতির ‘মেরুদণ্ড’। আমার ধারণা ছিল, ফিলিপাইনের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান নিয়ে অধ্যাপক কথা বলবেন। কী করে প্রবাসী শ্রমিকেরা বদলে দিলেন ফিলিপাইনের অর্থনীতির চেহারা, কী করে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো টাকায় জিডিপি বাড়ল, মাথাপিছু আয় বাড়ল, কী করে আশি-নব্বইয়ের দশকজুড়ে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান আর দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে হাজার হাজার ফিলিপিনো নারীর কর্মসংস্থান হলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফিলিপিনো অধ্যাপক খুবই অবাক করলেন আমাকে। তিনি ফিলিপাইনের বৈদেশিক রিজার্ভের গল্প করলেন না। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির গল্প করলেন না। তিনি অন্য এক ফিলিপাইনের গল্প বললেন। তিনি ফিলিপাইনের ভেঙে পড়া এক সমাজের গল্প বললেন। বললেন তিল তিল করে দেশে অর্থ পাঠানো সেই সব মায়ের গল্প, যাঁরা শিশুসন্তানকে বাড়িতে ফেলে কাঁদতে কাঁদতে প্লেনে উঠেছেন। তিনি বললেন মা-বিহীন এক অন্ধকার সমাজের গল্প। স্কুলের শিশুদের মাদক আর বিষণ্নতার গল্প। বছরে একবার দেশে বেড়াতে আসা মাকে দেখে চিনতে না পারা শিশুদের গল্প। আশি-নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের ব্যবহার ছিল না, ফোন ব্যয়বহুল ছিল, ফিলিপাইনের যে মা সিঙ্গাপুরে বাসাবাড়িতে কাজ করেন, সেই মাকে দেখা যায় বছরে মাত্র একবার। মায়ের সঙ্গে সংযোগবিহীন এক সমাজের গল্প বললেন সেই অধ্যাপক।
তাইওয়ানে, সিঙ্গাপুরে, মালয়েশিয়ার বাসাবাড়িতে কাজ করা ফিলিপিনো মায়েরা নিয়মিত দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। সেই পাঠানো টাকায় ফিলিপাইনের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে গেলেও গোটা একটা সমাজ তছনছ হয়ে গেছে।
আমার মাথায় হাজারটা প্রশ্নটা এল। একটা দেশের অর্থনীতি কি তার সমাজ থেকে আলাদা? অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গিয়ে সমাজ কেন ভেঙে যায়? দেশের অর্থনীতির ভালো হলে দেশের মানুষের ভালো হয় না কেন? অর্থনীতির ভালোটা তাহলে কার ভালো?
নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশেরও বিপুলসংখ্যক শ্রমিক গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। মালয়েশিয়ার নির্মাণশ্রমিক, আবুধাবির শপিং মলের পরিচ্ছন্নতা কর্মী, তুরস্কের বিমানবন্দরে টয়লেট ক্লিনার—সবই তো আমার দেশেরই মানুষ। নিজে খেয়ে না খেয়ে তাঁরা দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। গত ৩০ বছরে বৈদেশিক রিজার্ভে বিপ্লব ঘটেছে, অর্থনীতির আকার বেড়েছে। বর্তমানে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জিডিপির ৭ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কায় ডলারের সংকট চলছে। বিদেশ থেকে জরুরি খাদ্য, ওষুধ আর জ্বালানি কেনার মতো ডলার ফুরিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির এই মহাসংকট দেখে এ দেশের অর্থনীতিবিদেরা খুব স্বাভাবিকভাবেই তুলনামূলক আলোচনা করছেন। প্রায় সবাই বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এমন বিপদের আশঙ্কা কম। আমাদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো, রিজার্ভ সন্তোষজনক। সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছে, আমরা শ্রীলঙ্কা হব না।
চলতি বছরের বাজেট আলোচনায় দেশের সাম্প্রতিক ডলার-সংকটের ব্যাপারটি বারবার সামনে এসেছে। এ বছরের মার্চেও রিজার্ভ ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার। জুন মাসে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, সংকটের আভাস। বাজেট আলোচনার একটা বড় অংশজুড়েই তাই রিজার্ভের আলাপ। রিজার্ভ কমছে কেন? প্রবাসী শ্রমিকদের হঠাৎ কী হলো? তাঁরা কি টাকা পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন, নাকি ঠিক চ্যানেলে টাকা পাঠাচ্ছেন না? সরকারি চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন? কেন যে তাঁরা এমন অবৈধ কাজ করেন! অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী, মিডিয়া—সবাই হা-হুতাশ করছেন। সরকারের উচিত বেশি বেশি করে সরকারি চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উৎসাহ দেওয়া। সরকারের উচিত বেশি বেশি শ্রমিক বিদেশে ‘এক্সপোর্ট’ করা। সরকারের উচিত বেশি বেশি করে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ধরা। অথচ এসব দীর্ঘ আলোচনায় কোথাও কেউ বললেন না, ‘ভাই রে, প্রবাসী শ্রমিকেরা তো ভালো নেই।’
বিশ্বব্যাংক আর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের অভিবাসন খরচ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। যেমন কুয়েতে যেতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিকের লাগছে ২ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা, যা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা নেপালি শ্রমিকের খরচের তুলনায় অনেক বেশি। এর মধ্যে আবার মোট খরচের ৭৭ শতাংশই লুটে নিচ্ছে দালাল চক্র! এই চক্রের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। টাকা জোগাড় করতে কেউ চড়া সুদে ঋণ করেন, কেউ জমিজমা বিক্রি করেন। এরপর চক্রাকারে বাড়তে থাকে সুদের বোঝা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা জানাচ্ছে, ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও পর্যাপ্ত মজুরি পাচ্ছেন না মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা অনেক শ্রমিক। তার ওপর খরচ বাঁচাতে ৮-১০ জন মিলে চাপাচাপি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকাও একটি স্বাভাবিক ঘটনা। অর্থাৎ, অতিরিক্ত শ্রম, অল্প খাবার, ঋণের বোঝা প্রবাসী শ্রমিকের জীবনের নিত্যসঙ্গী। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা হলো, প্রতিবছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাজার হাজার শ্রমিকের লাশ ফিরছে কফিনে। ১৩ বছরে ফেরত এসেছে ৩৩ হাজার শ্রমিকের লাশ!
সরকারি সূত্রই বলছে, বেশির ভাগের মৃত্যুর কারণ হৃদ্রোগ বা স্ট্রোক। অথচ এই শ্রমিকদের বয়স মাত্র ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়? হাজার হাজার কর্মক্ষম টগবগে তরুণের এই বয়সে স্ট্রোক হবে কেন? আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ বা হিটওয়েভের মধ্যেও দীর্ঘ সময় ধরে দালান নির্মাণের কাজে রোদে থাকা, প্রতি মাসে দেশে টাকা পাঠানোর অমানবিক চাপ এবং সর্বোপরি সুদ বৃদ্ধির দুশ্চিন্তায় দুর্বল শরীরে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব তরুণ শ্রমিক।
অথচ অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় প্রবাসী শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ এবং অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ ঠাঁই পায় না। রেমিট্যান্সের আলোচনায় নেই কোনো ‘হিউম্যান ফেইস’। যেন অর্থনীতিবিদ শুধু রিজার্ভের হিসাব করবেন, রেমিট্যান্স জিডিপির কত শতাংশ, সেই হিসাব করবেন অথবা এক মাসের রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে কত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যায়, সেই হিসাব করবেন। বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যেতে এত বেশি খরচ লাগছে কেন—সেটা তো টাকারই আলাপ। কিন্তু শ্রমিক পরিবারের সেই রক্ত পানি করা টাকার হিসাব অর্থনীতিবিদদের আলাপের বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি আজও। বাজেট আলোচনায় প্রায় সবাই পরামর্শ দিয়েছেন, আরও বেশি বেশি শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে হবে। কিন্তু কাউকে বলতে শুনিনি, বাংলাদেশের শ্রমিকদের কুয়েতে যেতে ডাবল খরচ লাগছে কেন? যেন ‘ওদের বেশি টাকা লাগলে লাগুক, ওরা ম্যানেজ করুক, আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ যেন কমে-টমে না যায় আরকি!’
এই যে প্রবাসী শ্রমিকের হাড়ভাঙা রেমিট্যান্সের ওপর একচেটিয়া নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতি, এর কি বিকল্প ছিল না? ছিল তো বটেই। বিকল্প ছিল দেশের ভেতরে স্থানীয় শিল্পের বিকাশ এবং দেশের ভেতরে মানসম্মত কর্মসংস্থান তৈরি। এ ছাড়া বিদেশের চাহিদার বদলে দেশের ভেতরে শ্রমিকের আয়রোজগার বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় পণ্যের চাহিদা তৈরি করা যেত। আশির দশকে দক্ষিণ কোরিয়া বা মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল ব্যাপক হারে স্থানীয় শিল্পায়ন ও স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি। যদিও প্রচার করা হয় যে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পুরোটাই রপ্তানিশিল্পের অবদান। বাস্তবতা হলো, একই সময়ে রপ্তানিশিল্পের পাশাপাশি এসব দেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল বহু স্থানীয় শিল্পকারখানা। তাই বৈশ্বিক মন্দা-পরবর্তী সময়ে এশিয়ার রপ্তানিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও স্থানীয় মানুষের রমরমা চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই নতুন নতুন স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
আর আমরা কী করেছি? একের পর এক আমাদের রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ করেছি। কয়েক লাখ সচল কর্মসংস্থান নষ্ট করেছি। কারখানার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একেকটি প্রাণবন্ত স্থানীয় অর্থনীতিকেও ধ্বংস করেছি। পাটকল ও চিনিকলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কয়েক লাখ পাটচাষি ও আখচাষির জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত করেছি। দীর্ঘদিনের সচল জীবিকা নষ্ট করা হয়েছে, কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান তৈরির কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। গত কয়েক বছরে পোশাকশিল্পে অটোমেশনের কারণে ব্যাপক ছাঁটাই শুরু হয়েছে। ম্যাকেঞ্জি রিপোর্ট বলছে, ভবিষ্যতে গার্মেন্টস খাতের ছাঁটাই আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। কিন্তু গার্মেন্টস খাতের বিকল্প নিয়ে ভাবার ফুরসত আমাদের হয়ে ওঠেনি।
নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্যোগ নেই, স্থানীয় শিল্পে আগ্রহ নেই, উল্টো একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ। নিজ থেকে তৈরি হওয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক নিয়মিত প্রশাসনিক জুলুমের শিকার। দেশীয় শিল্প অবহেলিত। আমদানি পণ্যের বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারত যে সম্ভাবনাময় দেশীয় খাতগুলো, চীন ও ভারতের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেই খাতগুলোও আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সম্ভাবনাময় শিল্প বাঁচাতে রাষ্ট্রের শুল্কনীতি, ভ্যাট বা বাণিজ্যনীতিতেও কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। নিজের দেশের শ্রমিকের জীবন নিয়েই যাঁরা ভাবেননি কখনো, তাঁরা প্রবাসী শ্রমিকের জীবন নিয়ে ভাববেন কেন?
১৯৭৩ সালে আমেরিকান লেখক আরসুলা লে গুইন লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত ছোট গল্প ‘দ্য ওয়ান্স হু ওয়াক অ্যাওয়ে ফ্রম ওমেলাস’। এক রূপকথার মতো সুন্দর শহর। শহরের নাম ওমেলাস। কোনো কিছুর অভাব নেই সেখানে। সবার ঘরে ঘরে খাবার। বসন্ত এলে উৎসব হয়। শিশুরা সবাই হাসছে-খেলছে, ছেলে-মেয়ে, তরুণ-বৃদ্ধ—সবাই নেচে-গেয়ে আনন্দে জীবন পার করছে। কোথাও কোনো দুঃখ নেই। শুধু একটা ‘সিক্রেট’ আছে ওমেলাসে। কী সেই গোপন কথা? শহরের এক প্রান্তে একটা অন্ধকার বাড়ির নিচে একটা জানালাবিহীন ছোট্ট ঘর। সেই অন্ধকার ঘরে আটক রাখা হয়েছে ছয় বছরের এক ছেলেকে। ছেলেটা আছে সবাই জানে, কিন্তু ছেলেটাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা কেউ বলে না। কারণ, এই ছোট্ট ছেলেটিকে আটকে রাখলেই ওমেলাসের মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকবে। অর্থাৎ, এই আটকে রাখা ছেলেটাই ওমেলাসের প্রাণভোমরা। ছেলেটাকে ছেড়ে দিলে ওমেলাসের ঘরে ঘরে দুর্যোগ নেমে আসবে। ওমেলাসের মানুষের আনন্দের দিন শেষ হবে।
ওমেলাসকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য বিশ্লেষণী লেখা। কেউ বলেছে, ওমেলাস এই যুগের আধুনিক সভ্যতার গল্প। আমাদের ভালো থাকার জন্য কোথাও না কোথাও একটা অন্ধকার কারখানা আছে, কোথাও না কোথাও শ্রমিক মারা যাচ্ছেন।
১৯৩১ সালে রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন সেই একই গল্প, ‘…চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হওয়ার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব চেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে মরে—জীবনযাত্রার জন্য যত কিছু সুযোগ-সুবিধে, সবকিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাঁড়া দাঁড়িয়ে থাকে—উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’
আমাদের প্রবাসী শ্রমিক সেই সভ্যতার পিলসুজই তো। ওমেলাসের অন্ধকার ঘরে আটকে থাকা সেই ছেলেটা আমাদের ‘ওপেন সিক্রেট’। তাদের কম খেয়ে টাকা পাঠানোর ওপর দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের অর্থনীতি। তাদের কফিনগুলো আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, বরং আমরা বেশি বেশি করে শ্রমিক বিদেশে পাঠাব আর শ্রমিকদের বকে দেব—হুন্ডি যেন না করেন! কিন্তু ভুলেও জিজ্ঞেস করব না, তাঁরা মারা যাচ্ছেন কেন?
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক
প্রায় ১০ বছর আগে ফিলিপাইনের এক অধ্যাপক এসেছিলেন ঢাকায়। ব্র্যাকের আমন্ত্রণে। তাঁর বক্তব্য শুনতে গেলাম (দুর্ভাগ্যবশত অধ্যাপকের নাম মনে নেই)। সেই অধ্যাপক ফিলিপাইনের ‘মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার’ নিয়ে কথা বলেছিলেন।
ফিলিপাইন তখন বিশ্বের অন্যতম বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া দেশ। প্রবাসী শ্রমিকেরা ফিলিপাইনের অর্থনীতির ‘মেরুদণ্ড’। আমার ধারণা ছিল, ফিলিপাইনের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান নিয়ে অধ্যাপক কথা বলবেন। কী করে প্রবাসী শ্রমিকেরা বদলে দিলেন ফিলিপাইনের অর্থনীতির চেহারা, কী করে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো টাকায় জিডিপি বাড়ল, মাথাপিছু আয় বাড়ল, কী করে আশি-নব্বইয়ের দশকজুড়ে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান আর দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে হাজার হাজার ফিলিপিনো নারীর কর্মসংস্থান হলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফিলিপিনো অধ্যাপক খুবই অবাক করলেন আমাকে। তিনি ফিলিপাইনের বৈদেশিক রিজার্ভের গল্প করলেন না। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির গল্প করলেন না। তিনি অন্য এক ফিলিপাইনের গল্প বললেন। তিনি ফিলিপাইনের ভেঙে পড়া এক সমাজের গল্প বললেন। বললেন তিল তিল করে দেশে অর্থ পাঠানো সেই সব মায়ের গল্প, যাঁরা শিশুসন্তানকে বাড়িতে ফেলে কাঁদতে কাঁদতে প্লেনে উঠেছেন। তিনি বললেন মা-বিহীন এক অন্ধকার সমাজের গল্প। স্কুলের শিশুদের মাদক আর বিষণ্নতার গল্প। বছরে একবার দেশে বেড়াতে আসা মাকে দেখে চিনতে না পারা শিশুদের গল্প। আশি-নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের ব্যবহার ছিল না, ফোন ব্যয়বহুল ছিল, ফিলিপাইনের যে মা সিঙ্গাপুরে বাসাবাড়িতে কাজ করেন, সেই মাকে দেখা যায় বছরে মাত্র একবার। মায়ের সঙ্গে সংযোগবিহীন এক সমাজের গল্প বললেন সেই অধ্যাপক।
তাইওয়ানে, সিঙ্গাপুরে, মালয়েশিয়ার বাসাবাড়িতে কাজ করা ফিলিপিনো মায়েরা নিয়মিত দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। সেই পাঠানো টাকায় ফিলিপাইনের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে গেলেও গোটা একটা সমাজ তছনছ হয়ে গেছে।
আমার মাথায় হাজারটা প্রশ্নটা এল। একটা দেশের অর্থনীতি কি তার সমাজ থেকে আলাদা? অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গিয়ে সমাজ কেন ভেঙে যায়? দেশের অর্থনীতির ভালো হলে দেশের মানুষের ভালো হয় না কেন? অর্থনীতির ভালোটা তাহলে কার ভালো?
নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশেরও বিপুলসংখ্যক শ্রমিক গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। মালয়েশিয়ার নির্মাণশ্রমিক, আবুধাবির শপিং মলের পরিচ্ছন্নতা কর্মী, তুরস্কের বিমানবন্দরে টয়লেট ক্লিনার—সবই তো আমার দেশেরই মানুষ। নিজে খেয়ে না খেয়ে তাঁরা দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। গত ৩০ বছরে বৈদেশিক রিজার্ভে বিপ্লব ঘটেছে, অর্থনীতির আকার বেড়েছে। বর্তমানে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জিডিপির ৭ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কায় ডলারের সংকট চলছে। বিদেশ থেকে জরুরি খাদ্য, ওষুধ আর জ্বালানি কেনার মতো ডলার ফুরিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির এই মহাসংকট দেখে এ দেশের অর্থনীতিবিদেরা খুব স্বাভাবিকভাবেই তুলনামূলক আলোচনা করছেন। প্রায় সবাই বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এমন বিপদের আশঙ্কা কম। আমাদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো, রিজার্ভ সন্তোষজনক। সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছে, আমরা শ্রীলঙ্কা হব না।
চলতি বছরের বাজেট আলোচনায় দেশের সাম্প্রতিক ডলার-সংকটের ব্যাপারটি বারবার সামনে এসেছে। এ বছরের মার্চেও রিজার্ভ ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার। জুন মাসে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, সংকটের আভাস। বাজেট আলোচনার একটা বড় অংশজুড়েই তাই রিজার্ভের আলাপ। রিজার্ভ কমছে কেন? প্রবাসী শ্রমিকদের হঠাৎ কী হলো? তাঁরা কি টাকা পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন, নাকি ঠিক চ্যানেলে টাকা পাঠাচ্ছেন না? সরকারি চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন? কেন যে তাঁরা এমন অবৈধ কাজ করেন! অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী, মিডিয়া—সবাই হা-হুতাশ করছেন। সরকারের উচিত বেশি বেশি করে সরকারি চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উৎসাহ দেওয়া। সরকারের উচিত বেশি বেশি শ্রমিক বিদেশে ‘এক্সপোর্ট’ করা। সরকারের উচিত বেশি বেশি করে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ধরা। অথচ এসব দীর্ঘ আলোচনায় কোথাও কেউ বললেন না, ‘ভাই রে, প্রবাসী শ্রমিকেরা তো ভালো নেই।’
বিশ্বব্যাংক আর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের অভিবাসন খরচ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। যেমন কুয়েতে যেতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিকের লাগছে ২ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা, যা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা নেপালি শ্রমিকের খরচের তুলনায় অনেক বেশি। এর মধ্যে আবার মোট খরচের ৭৭ শতাংশই লুটে নিচ্ছে দালাল চক্র! এই চক্রের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। টাকা জোগাড় করতে কেউ চড়া সুদে ঋণ করেন, কেউ জমিজমা বিক্রি করেন। এরপর চক্রাকারে বাড়তে থাকে সুদের বোঝা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা জানাচ্ছে, ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও পর্যাপ্ত মজুরি পাচ্ছেন না মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা অনেক শ্রমিক। তার ওপর খরচ বাঁচাতে ৮-১০ জন মিলে চাপাচাপি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকাও একটি স্বাভাবিক ঘটনা। অর্থাৎ, অতিরিক্ত শ্রম, অল্প খাবার, ঋণের বোঝা প্রবাসী শ্রমিকের জীবনের নিত্যসঙ্গী। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা হলো, প্রতিবছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাজার হাজার শ্রমিকের লাশ ফিরছে কফিনে। ১৩ বছরে ফেরত এসেছে ৩৩ হাজার শ্রমিকের লাশ!
সরকারি সূত্রই বলছে, বেশির ভাগের মৃত্যুর কারণ হৃদ্রোগ বা স্ট্রোক। অথচ এই শ্রমিকদের বয়স মাত্র ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়? হাজার হাজার কর্মক্ষম টগবগে তরুণের এই বয়সে স্ট্রোক হবে কেন? আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ বা হিটওয়েভের মধ্যেও দীর্ঘ সময় ধরে দালান নির্মাণের কাজে রোদে থাকা, প্রতি মাসে দেশে টাকা পাঠানোর অমানবিক চাপ এবং সর্বোপরি সুদ বৃদ্ধির দুশ্চিন্তায় দুর্বল শরীরে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব তরুণ শ্রমিক।
অথচ অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় প্রবাসী শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ এবং অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ ঠাঁই পায় না। রেমিট্যান্সের আলোচনায় নেই কোনো ‘হিউম্যান ফেইস’। যেন অর্থনীতিবিদ শুধু রিজার্ভের হিসাব করবেন, রেমিট্যান্স জিডিপির কত শতাংশ, সেই হিসাব করবেন অথবা এক মাসের রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে কত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যায়, সেই হিসাব করবেন। বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যেতে এত বেশি খরচ লাগছে কেন—সেটা তো টাকারই আলাপ। কিন্তু শ্রমিক পরিবারের সেই রক্ত পানি করা টাকার হিসাব অর্থনীতিবিদদের আলাপের বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি আজও। বাজেট আলোচনায় প্রায় সবাই পরামর্শ দিয়েছেন, আরও বেশি বেশি শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে হবে। কিন্তু কাউকে বলতে শুনিনি, বাংলাদেশের শ্রমিকদের কুয়েতে যেতে ডাবল খরচ লাগছে কেন? যেন ‘ওদের বেশি টাকা লাগলে লাগুক, ওরা ম্যানেজ করুক, আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ যেন কমে-টমে না যায় আরকি!’
এই যে প্রবাসী শ্রমিকের হাড়ভাঙা রেমিট্যান্সের ওপর একচেটিয়া নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতি, এর কি বিকল্প ছিল না? ছিল তো বটেই। বিকল্প ছিল দেশের ভেতরে স্থানীয় শিল্পের বিকাশ এবং দেশের ভেতরে মানসম্মত কর্মসংস্থান তৈরি। এ ছাড়া বিদেশের চাহিদার বদলে দেশের ভেতরে শ্রমিকের আয়রোজগার বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় পণ্যের চাহিদা তৈরি করা যেত। আশির দশকে দক্ষিণ কোরিয়া বা মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল ব্যাপক হারে স্থানীয় শিল্পায়ন ও স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি। যদিও প্রচার করা হয় যে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পুরোটাই রপ্তানিশিল্পের অবদান। বাস্তবতা হলো, একই সময়ে রপ্তানিশিল্পের পাশাপাশি এসব দেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল বহু স্থানীয় শিল্পকারখানা। তাই বৈশ্বিক মন্দা-পরবর্তী সময়ে এশিয়ার রপ্তানিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও স্থানীয় মানুষের রমরমা চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই নতুন নতুন স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
আর আমরা কী করেছি? একের পর এক আমাদের রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ করেছি। কয়েক লাখ সচল কর্মসংস্থান নষ্ট করেছি। কারখানার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একেকটি প্রাণবন্ত স্থানীয় অর্থনীতিকেও ধ্বংস করেছি। পাটকল ও চিনিকলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কয়েক লাখ পাটচাষি ও আখচাষির জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত করেছি। দীর্ঘদিনের সচল জীবিকা নষ্ট করা হয়েছে, কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান তৈরির কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। গত কয়েক বছরে পোশাকশিল্পে অটোমেশনের কারণে ব্যাপক ছাঁটাই শুরু হয়েছে। ম্যাকেঞ্জি রিপোর্ট বলছে, ভবিষ্যতে গার্মেন্টস খাতের ছাঁটাই আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। কিন্তু গার্মেন্টস খাতের বিকল্প নিয়ে ভাবার ফুরসত আমাদের হয়ে ওঠেনি।
নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্যোগ নেই, স্থানীয় শিল্পে আগ্রহ নেই, উল্টো একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ। নিজ থেকে তৈরি হওয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক নিয়মিত প্রশাসনিক জুলুমের শিকার। দেশীয় শিল্প অবহেলিত। আমদানি পণ্যের বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারত যে সম্ভাবনাময় দেশীয় খাতগুলো, চীন ও ভারতের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেই খাতগুলোও আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সম্ভাবনাময় শিল্প বাঁচাতে রাষ্ট্রের শুল্কনীতি, ভ্যাট বা বাণিজ্যনীতিতেও কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। নিজের দেশের শ্রমিকের জীবন নিয়েই যাঁরা ভাবেননি কখনো, তাঁরা প্রবাসী শ্রমিকের জীবন নিয়ে ভাববেন কেন?
১৯৭৩ সালে আমেরিকান লেখক আরসুলা লে গুইন লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত ছোট গল্প ‘দ্য ওয়ান্স হু ওয়াক অ্যাওয়ে ফ্রম ওমেলাস’। এক রূপকথার মতো সুন্দর শহর। শহরের নাম ওমেলাস। কোনো কিছুর অভাব নেই সেখানে। সবার ঘরে ঘরে খাবার। বসন্ত এলে উৎসব হয়। শিশুরা সবাই হাসছে-খেলছে, ছেলে-মেয়ে, তরুণ-বৃদ্ধ—সবাই নেচে-গেয়ে আনন্দে জীবন পার করছে। কোথাও কোনো দুঃখ নেই। শুধু একটা ‘সিক্রেট’ আছে ওমেলাসে। কী সেই গোপন কথা? শহরের এক প্রান্তে একটা অন্ধকার বাড়ির নিচে একটা জানালাবিহীন ছোট্ট ঘর। সেই অন্ধকার ঘরে আটক রাখা হয়েছে ছয় বছরের এক ছেলেকে। ছেলেটা আছে সবাই জানে, কিন্তু ছেলেটাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা কেউ বলে না। কারণ, এই ছোট্ট ছেলেটিকে আটকে রাখলেই ওমেলাসের মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকবে। অর্থাৎ, এই আটকে রাখা ছেলেটাই ওমেলাসের প্রাণভোমরা। ছেলেটাকে ছেড়ে দিলে ওমেলাসের ঘরে ঘরে দুর্যোগ নেমে আসবে। ওমেলাসের মানুষের আনন্দের দিন শেষ হবে।
ওমেলাসকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য বিশ্লেষণী লেখা। কেউ বলেছে, ওমেলাস এই যুগের আধুনিক সভ্যতার গল্প। আমাদের ভালো থাকার জন্য কোথাও না কোথাও একটা অন্ধকার কারখানা আছে, কোথাও না কোথাও শ্রমিক মারা যাচ্ছেন।
১৯৩১ সালে রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন সেই একই গল্প, ‘…চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হওয়ার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব চেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে মরে—জীবনযাত্রার জন্য যত কিছু সুযোগ-সুবিধে, সবকিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাঁড়া দাঁড়িয়ে থাকে—উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’
আমাদের প্রবাসী শ্রমিক সেই সভ্যতার পিলসুজই তো। ওমেলাসের অন্ধকার ঘরে আটকে থাকা সেই ছেলেটা আমাদের ‘ওপেন সিক্রেট’। তাদের কম খেয়ে টাকা পাঠানোর ওপর দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের অর্থনীতি। তাদের কফিনগুলো আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, বরং আমরা বেশি বেশি করে শ্রমিক বিদেশে পাঠাব আর শ্রমিকদের বকে দেব—হুন্ডি যেন না করেন! কিন্তু ভুলেও জিজ্ঞেস করব না, তাঁরা মারা যাচ্ছেন কেন?
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪