মোহাম্মদ আজম
রুশ উপন্যাসতাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিন The Dialogic Imagination: Four Essays গ্রন্থে ভাষার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন জীবনের বৈচিত্র্য ও সমগ্রতার আধার হিসেবে। গ্রন্থটি সাহিত্যতত্ত্ব-সম্পর্কিত। কিন্তু বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাখতিন ব্যতিক্রমহীনভাবে একটা কাজ করে গেছেন —খুব স্বতন্ত্র ধরনে ভাষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ভাষার অস্তিত্বে তিনি দেখেছেন দুই বিপরীত স্বভাবের বিরোধ আর বিরামহীন লড়াই—একদিকে কেন্দ্রাতিগ শক্তি, যা একে বৈচিত্র্যে প্রসারিত করতে চায়; অন্যদিকে এক কেন্দ্রমুখী শক্তি, যা উপাদানগুলোকে সামঞ্জস্যে মেলাতে চায়, একরৈখিকতা তৈরি করতে চায়। এই দ্বন্দ্ব সংস্কৃতিতেও আছে, প্রকৃতিতেও আছে; মানুষের চৈতন্যেরও এটা সহজাত, আর মানুষের উচ্চারণেও তা বিশেষভাবে কাজ করছে। বাখতিনের মতে, মানুষের ভাষা হলো এই দ্বন্দ্বের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এবং জটিল আবাস; আর উপন্যাস হলো এই ভাষার সর্বোত্তম প্রতিলিপি। ভাষা কেবল এই দ্বন্দ্বের প্রকাশক বা আশ্রয় নয়; বরং সে নিজেই এই দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ নমুনা। কাঠামোবাদী তাত্ত্বিকদের মতো বাখতিন এই দুই দ্বন্দ্বকে বিপরীত শব্দজোড় (binary opposition) হিসেবে দেখেননি। তাঁর কাছে এই দুই বিপরীত শক্তি ঐতিহাসিকভাবে ভাষার হয়ে ওঠা, অর্থের স্থিতি ও লয়ের সঙ্গে যুক্ত। এটা যান্ত্রিক নয়, বরং মানুষের স্বভাবের মতোই অনির্দিষ্ট।
বাখতিন ভাষার এ স্বভাব বিশ্লেষণ করেছেন ‘Discourse In The Novel’ প্রবন্ধে। তাঁর এ আলোচনা গভীরভাবে শ্রেণি প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাছাকাছি সময়ে ইতালীয় তাত্ত্বিক গ্রামসি অধিপতি শ্রেণির মতাদর্শিক আধিপত্য বা হেজিমনির ধারণা প্রচার করেছিলেন। বাখতিন সম্ভবত এ ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু অধিপতি মতাদর্শের গড়ন ও চলন সম্পর্কে তাঁর বয়ান গ্রামসির কথা মনে করিয়ে দেয়। বাখতিন অবশ্য ভাষার ‘শুদ্ধরূপ’ প্রণয়নে অধিপতি শ্রেণির এককাট্টা আধিপত্যের কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি দেখিয়েছেন, এ শ্রেণির সব ধরনের তাত্ত্বিক চর্চা ভাষার একরৈখিক ‘শুদ্ধরূপ’-কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় এবং তাকেই শক্তিশালী করে। তাঁর মতে, ব্যাপারটা প্রয়োজনীয় এবং কাজের, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ভাষার স্বভাববিরোধী।
ভাষার দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, শৈলীবিদ্যা—বাখতিন লিখেছেন—এ যাবৎ ব্যক্তির ‘নিজস্ব’ একক ভাষার সঙ্গে সরল সম্পর্ক সাব্যস্ত করে ব্যক্তির ভাষা বিশ্লেষণ করেছে। ব্যক্তির একরৈখিক উচ্চারণে ভাষার সৌন্দর্য খুঁজেছে। বিদ্যার এ শাখাগুলো ভাষার দুটি রূপ সম্পর্কে কেবল ওয়াকিবহাল। এর মধ্যেই তাদের ভাষাগত ও শৈলীগত তাবৎ ধারণাকে তারা গুঁজে দেয়। একটি হলো একরৈখিক ভাষাকাঠামো (unitary language), অন্যটি হলো, এই ভাষা-ব্যবহারকারী ব্যক্তি। যুগে যুগে কাব্যতত্ত্ব বা মতাদর্শিক শৈলীর নানা বিচিত্র রূপ আবির্ভূত হয়েছে। যুগ-সত্যের অধীনে ভাষাদর্শন, ভাষাতত্ত্ব বা শৈলীবিজ্ঞানের নতুন নতুন রূপও আমরা পেয়েছি। ‘ভাষা-কাঠামো’, ‘একরৈখিক উচ্চারণ’, ‘কথক ব্যক্তি’ ইত্যাদি ধারণার নানা সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ তাতে পাওয়া গেছে। কিন্তু এই দুই প্রান্তসীমা সব সময় একই থেকেছে। ইউরোপীয় ইতিহাসের বিশেষ গতিবিধি, আর সে ইতিহাসের পাটাতনে ভাবাদর্শিক ডিসকোর্সগুলো অধিপতি-শ্রেণির যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে চেয়েছে, শৈলীবিদ্যার মূল বর্গগুলো তার নিরিখেই রূপ লাভ করেছে। এ কথা মনে রাখলে বর্গগুলোর জোরের উৎস আর সীমাবদ্ধতা সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। বিশেষ সামাজিক বর্গ বা শ্রেণির ভাষিক-মতাদর্শিক আওতার মধ্যেই ইতিহাসের নির্ধারক ‘মূল শক্তিগুলো’ কাজ করে। ভাষাতাত্ত্বিক বা শৈলী-সম্বন্ধীয় বর্গগুলো এর অধীনেই জন্মলাভ করে, বেড়ে ওঠে, এবং চূড়ান্ত রূপ পায়। ভাষার নতুন প্রাণ-সৃষ্টিকারী এই ‘মূলশক্তিগুলো’র তাত্ত্বিক অভিব্যক্তিই প্রকাশিত হয় বর্গগুলোতে: ‘These forces are the forces that serve to unify and centralize the verbal-ideological world.’
একরৈখিক ভাষা (unitary language) বৈচিত্র্যকে একীভূত আর কেন্দ্রীভূত করার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল—ভাষার কেন্দ্রমুখিতার প্রকাশ। একরৈখিক ভাষা কোনো প্রাপ্ত বা বাস্তব বা স্বাভাবিক অবস্থা নয়; বরং সব সময়েই আরোপিত, কৃত্রিমভাবে নির্মিত—জন্মমুহূর্তেই এটি বহুভাষিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করেই বহাল হয়। অবশ্য, এটা বৈচিত্র্যের গোলমাল কমিয়ে পারস্পরিক বোধগম্যতা নিশ্চিত করে; ভাষার প্রাত্যহিক ব্যবহারকে সম্ভবপর করে তোলে। প্রাত্যহিক কথ্যভাষা আর সাহিত্যিক ভাষার বাস্তবসম্মত আপাত-ঐক্য সাধন করেই ‘প্রমিত ভাষা’ প্রস্তাবিত হয়। এর কায়দা-কানুনের মধ্য দিয়ে ভাষা নতুন জীবন পায়; বাচনিক-মতাদর্শিক চিন্তা একীভূত ও কেন্দ্রীভূত হয়। বিচিত্র গতি-প্রকৃতিসম্পন্ন জাতীয় ভাষার মধ্যেই স্বীকৃত সাহিত্যিক ভাষা, তথা প্রমিত ভাষার একটি অনমনীয় স্থায়ী রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা বলতে বাখতিন কখনোই বিমূর্ত ব্যাকরণিক বর্গের সমষ্টি বোঝাননি; বরং ভাষা যে অর্থে মতাদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়, যে অর্থে বিশ্বদৃষ্টি হিসেবে বর্ণিত হয়—তাকেই বুঝিয়েছেন। এমনকি ভাবাদর্শিক জীবন বিচিত্র দিকের পারস্পরিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে ভাষার মধ্যেই প্রকাশিত হয়। ফলে এ রকম কেন্দ্রীভূত একরৈখিক ভাষা সমাজকাঠামোয় বিদ্যমান অধিপতি শক্তিগুলোর বাচনিক-মতাদর্শিক অবস্থানেরই বাহন হয়ে ওঠে। স্পষ্টতই সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতা-সম্পর্কের চলনের সঙ্গে ভাষার এই কেন্দ্রায়ণ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব, অগাস্টিনের কাব্যতত্ত্ব, মধ্যযুগের গির্জাকেন্দ্রিক কাব্যতত্ত্ব, কার্থেজীয় নব্য ধ্রুপদিবাদ, লাইবনিজের বিমূর্ত বিশ্বজনীন ব্যাকরণ কিংবা হামবোল্টের মূর্ততার প্রতি জোরারোপ—এঁদের মধ্যে সূক্ষ্ম যত ভিন্নতাই থাকুক না কেন, আদতে সামাজিক-ভাষিক এবং মতাদর্শিক জীবনের কেন্দ্রমুখী অভীপ্সাই তাতে প্রকাশ পেয়েছে। ইউরোপীয় ভাষাগুলোর কেন্দ্রমুখী একরৈখিক রূপ প্রণয়নের প্রকল্পেই সবাই সাহায্য করেছে। উপভাষাগুলোর মধ্যে একটির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে অন্যগুলোকে হটিয়ে দেওয়া বা অন্যগুলোকে একটির দাস বানানো; ‘খাঁটি শব্দ’-যোগে এগুলোকে আলোকিত করার প্রক্রিয়া; নিম্ন শ্রেণির মানুষ ও ‘বর্বর’-দের একরৈখিক সংস্কৃতি ও সত্যে শামিল করানো; ভাষাদর্শিক কাঠামোর অধীনে নিয়মকানুন তৈরি করা—এই সবকিছুই ‘একক ভাষা’ বা ‘প্রমিত ভাষা’র শক্তি জুগিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এ প্রক্রিয়ায় আরও আছে মৃতভাষা—যে ভাষাগুলো স্বভাবতই একরৈখিক—পড়ানো-শেখানোর ভাষাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া; আছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো পাঠের ক্ষেত্রে কতগুলো বিশেষ রীতিপদ্ধতিতে মনোযোগ, এবং বিশেষত ভাষিক বহুত্বের বদলে একক প্রত্নভাষার সন্ধান। বাখতিন লক্ষ করেছেন, এসব প্রক্রিয়ায় বাহ্যত যত রকম ফারাকই থাক, অন্তর্গত চরিত্রে এগুলোয় ক্ষমতা-সম্পর্কের সুবিধাজনক কোঠায় অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর ভাবাদর্শিক প্রতিফলনই পাওয়া যায়। এ প্রক্রিয়াগুলোই নির্মাণ করেছে অধিকাংশ নন্দনতত্ত্বের রীতি-নির্ধারক বয়ান। কেন্দ্রমুখী বাচনিক-ভাবাদর্শিক জীবনের মতো এই ভাষিক-নন্দনতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াও একই খাতে প্রবাহিত হয়েছে। ভাষা ও নন্দনতত্ত্ব জীবনের প্রভাবশালী ধারাকেই অনুসরণ করেছে।
মুশকিল হলো, ‘একক ভাষা’য় মূর্ত এই কেন্দ্রমুখী ভাষিক বাস্তবতা, যাকে আমরা আজকাল প্রমিত ভাষা নামে চিনি, বহুভাষিক সমাজ-বাস্তবতার মধ্যেই কাজ করে। যেকোনো বিশেষ মুহূর্তে ভাষা কেবল উপভাষায় (প্রচলিত ভাষাতাত্ত্বিক সংজ্ঞা মোতাবেক) বিভক্ত থাকে না, বরং—বাখতিনের কাছে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ—বিভক্ত থাকে নানা সামাজিক-মতাদর্শিক বর্গেও। বিভিন্ন সামাজিক বর্গের ভাষা, পেশাগত বা শ্রেণিগত ভাষা, প্রজন্মের ভাষা ইত্যাদি। এই যে ভাষার বিভিন্ন স্তর এবং বহু ভাষা সমন্বিত বাস্তবতা—এটা যদ্দিন ভাষা জীবিত এবং বিকাশমান থাকে, তদ্দিন বাড়তেই থাকে। কেন্দ্রমুখী একরৈখিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রাতিগ বলের উপাদানগুলোও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায়। বাচনিক-মতাদর্শিক কেন্দ্রীভূতকরণ আর একীকরণের পাশেই চলতে থাকে বিকেন্দ্রীকরণ এবং বহু বিচিত্ররূপে বিভক্তকরণ।
এ কারণে প্রত্যেক উচ্চারণ স্বভাবতই কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রাতিগ শক্তির চিহ্ন বহন করে। কোনো বিশেষ উচ্চারণ কেবল ব্যবহার-মুহূর্তে নিজের বিচ্ছিন্ন একক প্রয়োজন মেটায় না, বহু-বাস্তবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যে ভাষা-জগতে তার জন্ম ও অবস্থিতি, তার প্রয়োজনও মেটায়। তার চেয়ে বড় কথা, ভাষাগত অবয়ব আর শৈলীর দিক থেকে উচ্চারণটি একরৈখিক ভাষাকাঠামোর কেন্দ্রমুখী নির্দেশনা দ্বারা যতটা চালিত হয়, তাতে বহুভাষিক বাস্তবের প্রভাব তার চেয়ে মোটেই কম থাকে না। তার মানেই হলো, ভাষিক উচ্চারণ একই সঙ্গে একরৈখিক ভাষা [প্রমিত ভাষা] এবং বহুভাষিক বাস্তবতা—দুইয়ের যৌথতায় নিষ্পন্ন হয়। যে পরিবেশে উচ্চারণটির জন্ম ও পরিণতি, তা পরস্পর-সম্পর্কিত বা সংলাপায়িত (dialogized) বাস্তব; ভাষার মতোই তা সামাজিক আর আকারহীন; অন্যদিকে আবার তা মূর্ত, নির্দিষ্ট বার্তাবাহী এবং ব্যক্তিক উচ্চারণের বিশিষ্টতায় চিহ্নিত।
বাখতিন মানভাষা বা প্রমিত ভাষা ইত্যাদি বর্গ নামত ব্যবহার করেননি। কিন্তু তাঁর প্রস্তাবিত ‘একরৈখিক ভাষা’ স্পষ্টতই ভাষার ওই রূপ, যা সচরাচর প্রমিত ভাষা নামে বর্ণিত হয়। হুমায়ুন আজাদ প্রমিত বা মানভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: ‘কোনো ভাষা তার সমগ্র এলাকাজুড়ে একরূপ হয় না;–তার থাকে নানা আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন শ্রেণিক চারিত্র্য, তবে ওই সমস্ত বৈচিত্র্য পেরিয়ে থাকে তার এমন একটি রূপ, যা সর্বাঞ্চলিক। ওই রূপকে বলা হয় মান বা প্রমিত ভাষা।’ প্রমিত ভাষা সম্পর্কে এটি একটি প্রতিনিধিত্বশীল ধারণা। ধারণাটির গলদ এই যে, এখানে প্রমিত ভাষারূপকে একটি ‘প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক’ নিরীহ ধারণা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সামগ্রিক বাস্তবতা ও ভাষাবৈচিত্র্য থেকে একে আলগা করে দেখা হয়। বাখতিনের ‘একরৈখিক ভাষা’র বয়ান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এ ভাষা স্বাভাবিকও নয়, নিরীহও নয়। এটি বিচ্ছিন্ন এবং অগণতান্ত্রিক। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাষারূপগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ের রক্তাক্ত চিহ্ন ধারণ করেই এটি নিজ ভূমিকা পালন করে। এটি ‘উন্নত’ ভাষাও নয়, ‘শুদ্ধ বা পবিত্র’-ও নয়, তবে সন্দেহাতীতভাবে প্রভাবশালী এবং দরকারি ও কেজো ভাষারূপ। বিপুল ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যেই এটি কাজ করে, এবং প্রতিনিয়ত ওই ভাষা-বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বাখতিন কাজ করেছেন ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে। সেখানকার প্রধান ভাষাগুলোর প্রমিতায়নে নিজ নিজ অঞ্চলের অভিজাত শ্রেণির ভূমিকাই ছিল মুখ্য। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির কারণে বাংলা ভাষার মানরূপ একই কায়দায় গড়ে ওঠেনি। বিভাষী শাসক-এলিট এবং সংস্কৃতজ্ঞ ধর্মীয় এলিটের যৌথতায় নিষ্পন্ন হয়েছে বাংলা ভাষা বিধিবদ্ধকরণের প্রথম পর্ব। পরবর্তী দুই শতাধিক বছরজুড়ে স্বভাবতই আরও অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু প্রথম যুগের প্রভাবশালী ভাষাদর্শ ও তৎপরতার দায় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
বাখতিনের ‘একরৈখিক ভাষা’র সংজ্ঞায়ন প্রমিত ভাষার শ্রেণিভিত্তি আর অগণতান্ত্রিকতার দিকে গভীরভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেকোনো প্রমিত রীতি আবশ্যিকভাবে অগণতান্ত্রিক; কারণ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ও উচ্চারণরীতিকে অগ্রাহ্য করেই এ রীতি নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই আধিপত্য প্রাথমিকভাবে শ্রেণি-আধিপত্য, যদিও শ্রেণির বাস্তবতা দিয়ে একে সব সময় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেমন, বাংলা ভাষার প্রমিতায়নের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের যে অচ্ছেদ্য যোগ, ইউরোপীয় ভাষা-ইতিহাসের যে পাটাতনে বাখতিন কাজ করেছেন, তার নিরিখে একে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু উপনিবেশিত এলিটের গড়ন, মনস্তত্ত্ব এবং তৎপরতা শেষ পর্যন্ত প্রমিত বাংলার নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রমথ চৌধুরীকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ প্রতিষ্ঠার যে দুটি পর্ব চলেছে, তা এই বাস্তবতার নিখুঁত নজির। বাখতিন ইউরোপীয় ইতিহাস থেকে অন্তত আড়াই হাজার বছরের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, অভিজাত শ্রেণির ভাষিক-নান্দনিক তৎপরতা শেষ পর্যন্ত একরৈখিক ভাষাকেই নতুন নতুন রূপে সম্ভবপর করে তোলে। বাংলার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে—বিদেশিদের তৎপরতা আর বাঙালি অভিজাত শ্রেণির ঔপনিবেশিক খাসলতজনিত অতিরিক্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রমিত বাংলাকে অধিকতর অগণতান্ত্রিক, আর বিশৃঙ্খল করেছে মাত্র।
বাখতিনের পর্যালোচনা আরেকটি গুরুতর ভাষিক বাস্তবতার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে বলে। তা এই যে, প্রমিত ভাষা কোনো আলগা অস্তিত্ব নয়। বহুভাষিক-বহুস্বরিক বাস্তবতার মধ্যেই তাকে কাজ করতে হয়। তার মানেই হলো একদিকে নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ‘টানা’ এবং অন্যদিকে বহুভাষিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রক্ষার ‘পড়েন’ তার ঐতিহাসিক হয়ে ওঠা আর স্থিতির নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়। এ কারণেই প্রমিতের কোনো চিরন্তন বা স্থির আদর্শ থাকতে পারে না। কালের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে নতুন নতুন অভিযোজনের মধ্য দিয়েই প্রমিত ভাষা নিজের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারে।
বাংলাদেশে প্রমিত ভাষা-সম্পর্কিত প্রভাবশালী দৃষ্টিভঙ্গি অতিমাত্রায় সংকীর্ণ। মোটা দাগে তার দুই কারণ। এক. কলকাতায় বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় নিরূপিত ভাষাটি হুবহু বাংলাদেশের প্রমিত রীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ অঞ্চলের ভাষিক বাস্তবতা আর উচ্চারণরীতিকে মোটেই আমলে আনা হয়নি। দুই. ওই গৃহীত রীতিটিকে ভাবা হয় ‘বিশুদ্ধ’, ‘পবিত্র’ আর ‘চিরকালীন’। এই দুই কারণে এখানকার ভাষাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি অধিকতর অগণতান্ত্রিক। সে এতটাই যে, প্রায়ই তা ফ্যাসিবাদী উচ্চারণে রূপ নেয়। বিপরীতে, প্রমিতবিরোধী প্রতিক্রিয়াও এখানে বেশ প্রবল। সে প্রতিক্রিয়া প্রাত্যহিক উচ্চারণ থেকে শুরু করে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান এবং লেখালেখি পর্যন্ত বিস্তৃত। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এই প্রতিক্রিয়া সামলানোর জন্য প্রমিত-পক্ষীয়রা দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের অন্যায্য দোহাই পেড়েছে এবং আদালতের নির্দেশনাও চেয়েছে।
আদতে প্রমিত-বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম বা ভাষাপ্রেমের কোনো সম্পর্ক থাকতেই পারে না। আর প্রমিত রূপ নির্ধারিত হয় সমাজের অভিজাত-পক্ষের সম্মতিতে, আদালতের হুকুমে নয়। বাখতিন আমাদের নিশ্চিত করেন, ভাষার প্রমিত রূপ একটি ব্যবহারিক বর্গ মাত্র এবং পরিবর্তনই তার নিয়তি। বাংলা প্রমিতের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই রূপ বিধিবদ্ধ হয়েছে অবৈজ্ঞানিকভাবে; অভিজাত শ্রেণির মুখের ভাষা অবলম্বনে নয়। একমাত্র উদার ও গ্রহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্রমিক বিধিবদ্ধকরণই এই জরুরি ব্যবহারিক বর্গটিকে কার্যকরভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। তারপরও অবশ্য প্রমিত-বিরোধিতা থেকেই যাবে। সেটাই ভাষাসম্মত এবং স্বাস্থ্যকর।
মোহাম্মদ আজম, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রুশ উপন্যাসতাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিন The Dialogic Imagination: Four Essays গ্রন্থে ভাষার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন জীবনের বৈচিত্র্য ও সমগ্রতার আধার হিসেবে। গ্রন্থটি সাহিত্যতত্ত্ব-সম্পর্কিত। কিন্তু বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাখতিন ব্যতিক্রমহীনভাবে একটা কাজ করে গেছেন —খুব স্বতন্ত্র ধরনে ভাষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ভাষার অস্তিত্বে তিনি দেখেছেন দুই বিপরীত স্বভাবের বিরোধ আর বিরামহীন লড়াই—একদিকে কেন্দ্রাতিগ শক্তি, যা একে বৈচিত্র্যে প্রসারিত করতে চায়; অন্যদিকে এক কেন্দ্রমুখী শক্তি, যা উপাদানগুলোকে সামঞ্জস্যে মেলাতে চায়, একরৈখিকতা তৈরি করতে চায়। এই দ্বন্দ্ব সংস্কৃতিতেও আছে, প্রকৃতিতেও আছে; মানুষের চৈতন্যেরও এটা সহজাত, আর মানুষের উচ্চারণেও তা বিশেষভাবে কাজ করছে। বাখতিনের মতে, মানুষের ভাষা হলো এই দ্বন্দ্বের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এবং জটিল আবাস; আর উপন্যাস হলো এই ভাষার সর্বোত্তম প্রতিলিপি। ভাষা কেবল এই দ্বন্দ্বের প্রকাশক বা আশ্রয় নয়; বরং সে নিজেই এই দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ নমুনা। কাঠামোবাদী তাত্ত্বিকদের মতো বাখতিন এই দুই দ্বন্দ্বকে বিপরীত শব্দজোড় (binary opposition) হিসেবে দেখেননি। তাঁর কাছে এই দুই বিপরীত শক্তি ঐতিহাসিকভাবে ভাষার হয়ে ওঠা, অর্থের স্থিতি ও লয়ের সঙ্গে যুক্ত। এটা যান্ত্রিক নয়, বরং মানুষের স্বভাবের মতোই অনির্দিষ্ট।
বাখতিন ভাষার এ স্বভাব বিশ্লেষণ করেছেন ‘Discourse In The Novel’ প্রবন্ধে। তাঁর এ আলোচনা গভীরভাবে শ্রেণি প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাছাকাছি সময়ে ইতালীয় তাত্ত্বিক গ্রামসি অধিপতি শ্রেণির মতাদর্শিক আধিপত্য বা হেজিমনির ধারণা প্রচার করেছিলেন। বাখতিন সম্ভবত এ ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু অধিপতি মতাদর্শের গড়ন ও চলন সম্পর্কে তাঁর বয়ান গ্রামসির কথা মনে করিয়ে দেয়। বাখতিন অবশ্য ভাষার ‘শুদ্ধরূপ’ প্রণয়নে অধিপতি শ্রেণির এককাট্টা আধিপত্যের কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি দেখিয়েছেন, এ শ্রেণির সব ধরনের তাত্ত্বিক চর্চা ভাষার একরৈখিক ‘শুদ্ধরূপ’-কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় এবং তাকেই শক্তিশালী করে। তাঁর মতে, ব্যাপারটা প্রয়োজনীয় এবং কাজের, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ভাষার স্বভাববিরোধী।
ভাষার দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, শৈলীবিদ্যা—বাখতিন লিখেছেন—এ যাবৎ ব্যক্তির ‘নিজস্ব’ একক ভাষার সঙ্গে সরল সম্পর্ক সাব্যস্ত করে ব্যক্তির ভাষা বিশ্লেষণ করেছে। ব্যক্তির একরৈখিক উচ্চারণে ভাষার সৌন্দর্য খুঁজেছে। বিদ্যার এ শাখাগুলো ভাষার দুটি রূপ সম্পর্কে কেবল ওয়াকিবহাল। এর মধ্যেই তাদের ভাষাগত ও শৈলীগত তাবৎ ধারণাকে তারা গুঁজে দেয়। একটি হলো একরৈখিক ভাষাকাঠামো (unitary language), অন্যটি হলো, এই ভাষা-ব্যবহারকারী ব্যক্তি। যুগে যুগে কাব্যতত্ত্ব বা মতাদর্শিক শৈলীর নানা বিচিত্র রূপ আবির্ভূত হয়েছে। যুগ-সত্যের অধীনে ভাষাদর্শন, ভাষাতত্ত্ব বা শৈলীবিজ্ঞানের নতুন নতুন রূপও আমরা পেয়েছি। ‘ভাষা-কাঠামো’, ‘একরৈখিক উচ্চারণ’, ‘কথক ব্যক্তি’ ইত্যাদি ধারণার নানা সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ তাতে পাওয়া গেছে। কিন্তু এই দুই প্রান্তসীমা সব সময় একই থেকেছে। ইউরোপীয় ইতিহাসের বিশেষ গতিবিধি, আর সে ইতিহাসের পাটাতনে ভাবাদর্শিক ডিসকোর্সগুলো অধিপতি-শ্রেণির যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে চেয়েছে, শৈলীবিদ্যার মূল বর্গগুলো তার নিরিখেই রূপ লাভ করেছে। এ কথা মনে রাখলে বর্গগুলোর জোরের উৎস আর সীমাবদ্ধতা সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। বিশেষ সামাজিক বর্গ বা শ্রেণির ভাষিক-মতাদর্শিক আওতার মধ্যেই ইতিহাসের নির্ধারক ‘মূল শক্তিগুলো’ কাজ করে। ভাষাতাত্ত্বিক বা শৈলী-সম্বন্ধীয় বর্গগুলো এর অধীনেই জন্মলাভ করে, বেড়ে ওঠে, এবং চূড়ান্ত রূপ পায়। ভাষার নতুন প্রাণ-সৃষ্টিকারী এই ‘মূলশক্তিগুলো’র তাত্ত্বিক অভিব্যক্তিই প্রকাশিত হয় বর্গগুলোতে: ‘These forces are the forces that serve to unify and centralize the verbal-ideological world.’
একরৈখিক ভাষা (unitary language) বৈচিত্র্যকে একীভূত আর কেন্দ্রীভূত করার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল—ভাষার কেন্দ্রমুখিতার প্রকাশ। একরৈখিক ভাষা কোনো প্রাপ্ত বা বাস্তব বা স্বাভাবিক অবস্থা নয়; বরং সব সময়েই আরোপিত, কৃত্রিমভাবে নির্মিত—জন্মমুহূর্তেই এটি বহুভাষিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করেই বহাল হয়। অবশ্য, এটা বৈচিত্র্যের গোলমাল কমিয়ে পারস্পরিক বোধগম্যতা নিশ্চিত করে; ভাষার প্রাত্যহিক ব্যবহারকে সম্ভবপর করে তোলে। প্রাত্যহিক কথ্যভাষা আর সাহিত্যিক ভাষার বাস্তবসম্মত আপাত-ঐক্য সাধন করেই ‘প্রমিত ভাষা’ প্রস্তাবিত হয়। এর কায়দা-কানুনের মধ্য দিয়ে ভাষা নতুন জীবন পায়; বাচনিক-মতাদর্শিক চিন্তা একীভূত ও কেন্দ্রীভূত হয়। বিচিত্র গতি-প্রকৃতিসম্পন্ন জাতীয় ভাষার মধ্যেই স্বীকৃত সাহিত্যিক ভাষা, তথা প্রমিত ভাষার একটি অনমনীয় স্থায়ী রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা বলতে বাখতিন কখনোই বিমূর্ত ব্যাকরণিক বর্গের সমষ্টি বোঝাননি; বরং ভাষা যে অর্থে মতাদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়, যে অর্থে বিশ্বদৃষ্টি হিসেবে বর্ণিত হয়—তাকেই বুঝিয়েছেন। এমনকি ভাবাদর্শিক জীবন বিচিত্র দিকের পারস্পরিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে ভাষার মধ্যেই প্রকাশিত হয়। ফলে এ রকম কেন্দ্রীভূত একরৈখিক ভাষা সমাজকাঠামোয় বিদ্যমান অধিপতি শক্তিগুলোর বাচনিক-মতাদর্শিক অবস্থানেরই বাহন হয়ে ওঠে। স্পষ্টতই সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতা-সম্পর্কের চলনের সঙ্গে ভাষার এই কেন্দ্রায়ণ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব, অগাস্টিনের কাব্যতত্ত্ব, মধ্যযুগের গির্জাকেন্দ্রিক কাব্যতত্ত্ব, কার্থেজীয় নব্য ধ্রুপদিবাদ, লাইবনিজের বিমূর্ত বিশ্বজনীন ব্যাকরণ কিংবা হামবোল্টের মূর্ততার প্রতি জোরারোপ—এঁদের মধ্যে সূক্ষ্ম যত ভিন্নতাই থাকুক না কেন, আদতে সামাজিক-ভাষিক এবং মতাদর্শিক জীবনের কেন্দ্রমুখী অভীপ্সাই তাতে প্রকাশ পেয়েছে। ইউরোপীয় ভাষাগুলোর কেন্দ্রমুখী একরৈখিক রূপ প্রণয়নের প্রকল্পেই সবাই সাহায্য করেছে। উপভাষাগুলোর মধ্যে একটির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে অন্যগুলোকে হটিয়ে দেওয়া বা অন্যগুলোকে একটির দাস বানানো; ‘খাঁটি শব্দ’-যোগে এগুলোকে আলোকিত করার প্রক্রিয়া; নিম্ন শ্রেণির মানুষ ও ‘বর্বর’-দের একরৈখিক সংস্কৃতি ও সত্যে শামিল করানো; ভাষাদর্শিক কাঠামোর অধীনে নিয়মকানুন তৈরি করা—এই সবকিছুই ‘একক ভাষা’ বা ‘প্রমিত ভাষা’র শক্তি জুগিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এ প্রক্রিয়ায় আরও আছে মৃতভাষা—যে ভাষাগুলো স্বভাবতই একরৈখিক—পড়ানো-শেখানোর ভাষাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া; আছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো পাঠের ক্ষেত্রে কতগুলো বিশেষ রীতিপদ্ধতিতে মনোযোগ, এবং বিশেষত ভাষিক বহুত্বের বদলে একক প্রত্নভাষার সন্ধান। বাখতিন লক্ষ করেছেন, এসব প্রক্রিয়ায় বাহ্যত যত রকম ফারাকই থাক, অন্তর্গত চরিত্রে এগুলোয় ক্ষমতা-সম্পর্কের সুবিধাজনক কোঠায় অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর ভাবাদর্শিক প্রতিফলনই পাওয়া যায়। এ প্রক্রিয়াগুলোই নির্মাণ করেছে অধিকাংশ নন্দনতত্ত্বের রীতি-নির্ধারক বয়ান। কেন্দ্রমুখী বাচনিক-ভাবাদর্শিক জীবনের মতো এই ভাষিক-নন্দনতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াও একই খাতে প্রবাহিত হয়েছে। ভাষা ও নন্দনতত্ত্ব জীবনের প্রভাবশালী ধারাকেই অনুসরণ করেছে।
মুশকিল হলো, ‘একক ভাষা’য় মূর্ত এই কেন্দ্রমুখী ভাষিক বাস্তবতা, যাকে আমরা আজকাল প্রমিত ভাষা নামে চিনি, বহুভাষিক সমাজ-বাস্তবতার মধ্যেই কাজ করে। যেকোনো বিশেষ মুহূর্তে ভাষা কেবল উপভাষায় (প্রচলিত ভাষাতাত্ত্বিক সংজ্ঞা মোতাবেক) বিভক্ত থাকে না, বরং—বাখতিনের কাছে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ—বিভক্ত থাকে নানা সামাজিক-মতাদর্শিক বর্গেও। বিভিন্ন সামাজিক বর্গের ভাষা, পেশাগত বা শ্রেণিগত ভাষা, প্রজন্মের ভাষা ইত্যাদি। এই যে ভাষার বিভিন্ন স্তর এবং বহু ভাষা সমন্বিত বাস্তবতা—এটা যদ্দিন ভাষা জীবিত এবং বিকাশমান থাকে, তদ্দিন বাড়তেই থাকে। কেন্দ্রমুখী একরৈখিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রাতিগ বলের উপাদানগুলোও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায়। বাচনিক-মতাদর্শিক কেন্দ্রীভূতকরণ আর একীকরণের পাশেই চলতে থাকে বিকেন্দ্রীকরণ এবং বহু বিচিত্ররূপে বিভক্তকরণ।
এ কারণে প্রত্যেক উচ্চারণ স্বভাবতই কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রাতিগ শক্তির চিহ্ন বহন করে। কোনো বিশেষ উচ্চারণ কেবল ব্যবহার-মুহূর্তে নিজের বিচ্ছিন্ন একক প্রয়োজন মেটায় না, বহু-বাস্তবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যে ভাষা-জগতে তার জন্ম ও অবস্থিতি, তার প্রয়োজনও মেটায়। তার চেয়ে বড় কথা, ভাষাগত অবয়ব আর শৈলীর দিক থেকে উচ্চারণটি একরৈখিক ভাষাকাঠামোর কেন্দ্রমুখী নির্দেশনা দ্বারা যতটা চালিত হয়, তাতে বহুভাষিক বাস্তবের প্রভাব তার চেয়ে মোটেই কম থাকে না। তার মানেই হলো, ভাষিক উচ্চারণ একই সঙ্গে একরৈখিক ভাষা [প্রমিত ভাষা] এবং বহুভাষিক বাস্তবতা—দুইয়ের যৌথতায় নিষ্পন্ন হয়। যে পরিবেশে উচ্চারণটির জন্ম ও পরিণতি, তা পরস্পর-সম্পর্কিত বা সংলাপায়িত (dialogized) বাস্তব; ভাষার মতোই তা সামাজিক আর আকারহীন; অন্যদিকে আবার তা মূর্ত, নির্দিষ্ট বার্তাবাহী এবং ব্যক্তিক উচ্চারণের বিশিষ্টতায় চিহ্নিত।
বাখতিন মানভাষা বা প্রমিত ভাষা ইত্যাদি বর্গ নামত ব্যবহার করেননি। কিন্তু তাঁর প্রস্তাবিত ‘একরৈখিক ভাষা’ স্পষ্টতই ভাষার ওই রূপ, যা সচরাচর প্রমিত ভাষা নামে বর্ণিত হয়। হুমায়ুন আজাদ প্রমিত বা মানভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: ‘কোনো ভাষা তার সমগ্র এলাকাজুড়ে একরূপ হয় না;–তার থাকে নানা আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন শ্রেণিক চারিত্র্য, তবে ওই সমস্ত বৈচিত্র্য পেরিয়ে থাকে তার এমন একটি রূপ, যা সর্বাঞ্চলিক। ওই রূপকে বলা হয় মান বা প্রমিত ভাষা।’ প্রমিত ভাষা সম্পর্কে এটি একটি প্রতিনিধিত্বশীল ধারণা। ধারণাটির গলদ এই যে, এখানে প্রমিত ভাষারূপকে একটি ‘প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক’ নিরীহ ধারণা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সামগ্রিক বাস্তবতা ও ভাষাবৈচিত্র্য থেকে একে আলগা করে দেখা হয়। বাখতিনের ‘একরৈখিক ভাষা’র বয়ান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এ ভাষা স্বাভাবিকও নয়, নিরীহও নয়। এটি বিচ্ছিন্ন এবং অগণতান্ত্রিক। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাষারূপগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ের রক্তাক্ত চিহ্ন ধারণ করেই এটি নিজ ভূমিকা পালন করে। এটি ‘উন্নত’ ভাষাও নয়, ‘শুদ্ধ বা পবিত্র’-ও নয়, তবে সন্দেহাতীতভাবে প্রভাবশালী এবং দরকারি ও কেজো ভাষারূপ। বিপুল ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যেই এটি কাজ করে, এবং প্রতিনিয়ত ওই ভাষা-বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বাখতিন কাজ করেছেন ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে। সেখানকার প্রধান ভাষাগুলোর প্রমিতায়নে নিজ নিজ অঞ্চলের অভিজাত শ্রেণির ভূমিকাই ছিল মুখ্য। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির কারণে বাংলা ভাষার মানরূপ একই কায়দায় গড়ে ওঠেনি। বিভাষী শাসক-এলিট এবং সংস্কৃতজ্ঞ ধর্মীয় এলিটের যৌথতায় নিষ্পন্ন হয়েছে বাংলা ভাষা বিধিবদ্ধকরণের প্রথম পর্ব। পরবর্তী দুই শতাধিক বছরজুড়ে স্বভাবতই আরও অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু প্রথম যুগের প্রভাবশালী ভাষাদর্শ ও তৎপরতার দায় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
বাখতিনের ‘একরৈখিক ভাষা’র সংজ্ঞায়ন প্রমিত ভাষার শ্রেণিভিত্তি আর অগণতান্ত্রিকতার দিকে গভীরভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেকোনো প্রমিত রীতি আবশ্যিকভাবে অগণতান্ত্রিক; কারণ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ও উচ্চারণরীতিকে অগ্রাহ্য করেই এ রীতি নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই আধিপত্য প্রাথমিকভাবে শ্রেণি-আধিপত্য, যদিও শ্রেণির বাস্তবতা দিয়ে একে সব সময় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেমন, বাংলা ভাষার প্রমিতায়নের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের যে অচ্ছেদ্য যোগ, ইউরোপীয় ভাষা-ইতিহাসের যে পাটাতনে বাখতিন কাজ করেছেন, তার নিরিখে একে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু উপনিবেশিত এলিটের গড়ন, মনস্তত্ত্ব এবং তৎপরতা শেষ পর্যন্ত প্রমিত বাংলার নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রমথ চৌধুরীকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ প্রতিষ্ঠার যে দুটি পর্ব চলেছে, তা এই বাস্তবতার নিখুঁত নজির। বাখতিন ইউরোপীয় ইতিহাস থেকে অন্তত আড়াই হাজার বছরের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, অভিজাত শ্রেণির ভাষিক-নান্দনিক তৎপরতা শেষ পর্যন্ত একরৈখিক ভাষাকেই নতুন নতুন রূপে সম্ভবপর করে তোলে। বাংলার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে—বিদেশিদের তৎপরতা আর বাঙালি অভিজাত শ্রেণির ঔপনিবেশিক খাসলতজনিত অতিরিক্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রমিত বাংলাকে অধিকতর অগণতান্ত্রিক, আর বিশৃঙ্খল করেছে মাত্র।
বাখতিনের পর্যালোচনা আরেকটি গুরুতর ভাষিক বাস্তবতার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে বলে। তা এই যে, প্রমিত ভাষা কোনো আলগা অস্তিত্ব নয়। বহুভাষিক-বহুস্বরিক বাস্তবতার মধ্যেই তাকে কাজ করতে হয়। তার মানেই হলো একদিকে নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ‘টানা’ এবং অন্যদিকে বহুভাষিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রক্ষার ‘পড়েন’ তার ঐতিহাসিক হয়ে ওঠা আর স্থিতির নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়। এ কারণেই প্রমিতের কোনো চিরন্তন বা স্থির আদর্শ থাকতে পারে না। কালের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে নতুন নতুন অভিযোজনের মধ্য দিয়েই প্রমিত ভাষা নিজের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারে।
বাংলাদেশে প্রমিত ভাষা-সম্পর্কিত প্রভাবশালী দৃষ্টিভঙ্গি অতিমাত্রায় সংকীর্ণ। মোটা দাগে তার দুই কারণ। এক. কলকাতায় বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় নিরূপিত ভাষাটি হুবহু বাংলাদেশের প্রমিত রীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ অঞ্চলের ভাষিক বাস্তবতা আর উচ্চারণরীতিকে মোটেই আমলে আনা হয়নি। দুই. ওই গৃহীত রীতিটিকে ভাবা হয় ‘বিশুদ্ধ’, ‘পবিত্র’ আর ‘চিরকালীন’। এই দুই কারণে এখানকার ভাষাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি অধিকতর অগণতান্ত্রিক। সে এতটাই যে, প্রায়ই তা ফ্যাসিবাদী উচ্চারণে রূপ নেয়। বিপরীতে, প্রমিতবিরোধী প্রতিক্রিয়াও এখানে বেশ প্রবল। সে প্রতিক্রিয়া প্রাত্যহিক উচ্চারণ থেকে শুরু করে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান এবং লেখালেখি পর্যন্ত বিস্তৃত। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এই প্রতিক্রিয়া সামলানোর জন্য প্রমিত-পক্ষীয়রা দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের অন্যায্য দোহাই পেড়েছে এবং আদালতের নির্দেশনাও চেয়েছে।
আদতে প্রমিত-বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম বা ভাষাপ্রেমের কোনো সম্পর্ক থাকতেই পারে না। আর প্রমিত রূপ নির্ধারিত হয় সমাজের অভিজাত-পক্ষের সম্মতিতে, আদালতের হুকুমে নয়। বাখতিন আমাদের নিশ্চিত করেন, ভাষার প্রমিত রূপ একটি ব্যবহারিক বর্গ মাত্র এবং পরিবর্তনই তার নিয়তি। বাংলা প্রমিতের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই রূপ বিধিবদ্ধ হয়েছে অবৈজ্ঞানিকভাবে; অভিজাত শ্রেণির মুখের ভাষা অবলম্বনে নয়। একমাত্র উদার ও গ্রহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্রমিক বিধিবদ্ধকরণই এই জরুরি ব্যবহারিক বর্গটিকে কার্যকরভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। তারপরও অবশ্য প্রমিত-বিরোধিতা থেকেই যাবে। সেটাই ভাষাসম্মত এবং স্বাস্থ্যকর।
মোহাম্মদ আজম, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪