সঙ্গীতা ইমাম
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস কেবল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত নয়; বরং হাজার বছর ধরে বাংলায় বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাসের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। হাজার বছর ধরে যে সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসের নির্মাণ-বিনির্মাণ ঘটেছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাতও ঘটেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে।
বিশ শতকের প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সংস্কৃতির যে রাজনৈতিক পরিচয় পাই, তা নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালে এই উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একটি বড় প্রভাব রাখে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে বিকাশ ঘটেছিল, তার মূল প্রেরণাই ছিল সংস্কৃতি, বিশেষত বাংলার সংস্কৃতি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকর্মীরা যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, তা তো ইতিহাসসচেতন পাঠকের অবশ্যই জানা। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে একটি জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা হতে পারেন, তা-ও প্রমাণ করেছে বাংলার মানুষ। ১৯৬১ সালে প্রতিবাদী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রমাণ করেছিল, রবীন্দ্রনাথকেও আমরা লড়ে জিতে নিয়েছি। তাই বাংলাদেশে সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন কথাগুলোর তাৎপর্য খানিকটা আলাদা ও ব্যাপক। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেওয়া জাতি ১৯৬১ সালে পথে নেমেছিল রবীন্দ্রচর্চার অধিকার আদায়ের জন্য। পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯৬২ সালে এই জাতি শুরু করে তার শিক্ষা আন্দোলন। এই যে আন্দোলনের কালানুক্রমিক ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে এর উদ্দেশ্য, এ দুইয়ের সমন্বয় করলেই দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের পর থেকেই তৎকালীন পূর্ব বাংলা রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ তৈরি করেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। ষাটের দশকে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব প্রগতিশীল দলের সমন্বয়ে যে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ তৈরি হয়েছিল, সংস্কৃতিকর্মীরা তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি সোনার মানুষ তৈরি করতে পারে আর রাজনীতি সোনার মানুষকে ব্যবহার করে সোনার দেশ গড়তে পারে।’
দুই
স্বাধীন বাংলাদেশেও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিধি ছিল বেশ বড়। বিশেষ করে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশ যখন সামরিক রাজনীতির অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত, যখন রাজনীতির নামে একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে করে ফেলা হয়েছিল কোণঠাসা; তখন সংস্কৃতিই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক বার্তাবাহক। পঁচাত্তরের পর দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায় না, তখন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করেছিল এক অসাধারণ প্রতিবাদী রূপচিত্র। একটি শূন্য ডায়াসে বঙ্গবন্ধুর চশমার আদলের একটি চশমা—এই ছোট্ট শিল্পকর্মটিই সেদিন এক বড় বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল জনগণের মাঝে। প্রকাশিত হয়েছিল ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’-এর মতো প্রতিবাদী সংকলন।
নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সংস্কৃতিকর্মীরা পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের উদ্যোগে তখন দেশের নানা প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের মেলবন্ধন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সে সময় সংস্কৃতিকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক জোটগুলো।
শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল। অনেকের ধারণা, সংস্কৃতিকর্মীদের অবদান কেবল তাঁদের পরিবেশনায়ই সীমাবদ্ধ। এটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে সীমাবদ্ধ ধারণারই বহিঃপ্রকাশ। সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানে কেবল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নয়; একটি রাজনৈতিক আদর্শকে জনভাষ্যে রূপান্তর করাটাই মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজ। রাজনৈতিক তত্ত্ব বা আদর্শ কিংবা যে লক্ষ্য সামনে রেখে একটি মহৎ গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে, রাজনৈতিক বক্তৃতার মাধ্যমে গণমানুষের কাছে তার মূল ভাব পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংস্কৃতিকর্মীরা সেটা জনভাষ্যে অনুবাদ করেন। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনে বাংদেশ ও দেশের বাইরের সংস্কৃতিকর্মীরা অসংখ্য গান রচনা করেছেন, যেগুলোর প্রতিটি ছত্রে উঠে এসেছে এই আন্দোলনের মূল সুর। কবিরা কবিতা লিখেছেন, তাতে উঠে এসেছে শাহবাগের দাবিগুলো। এই যে রাজনৈতিক বলয়ে থেকে আন্দোলনের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন থেকে সাংস্কৃতিক মাত্রাটি তৈরি করা, এটাই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিক্রমা। সংগ্রামের আদর্শ না জেনে কিংবা আন্দোলনের রাজনৈতিক দায়িত্ব না বুঝে কেবল পরিবেশনা সেরে আসাটাই সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়।
তিন
বর্তমানে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ। বিদ্বজ্জনেরা বলেন, দেশকে মুক্তিসংগ্রামের আদর্শে এগিয়ে নিতে হলে শক্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজন। কথাটি অবশ্যই সত্য। জঙ্গিবাদ, কূপমণ্ডূকতা বা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প মোকাবিলায় অবশ্যই মুক্তিসংগ্রামের চেতনাবিধৌত সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন। কিন্তু সেটা যে হচ্ছে না, এর দায় কি কেবলই সংস্কৃতিকর্মীদের? সংস্কৃতিকর্মীদের একটি দায় অবশ্যই আছে, আর তা হলো নেতৃত্ব আর নৈতিকতার দায়। যে সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, সে সময়ের সংস্কৃতিকর্মীদের জীবনযাপন, তাঁদের আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু এখন যাঁরা নেতৃত্বে আছেন, তাঁরা কি সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত বা ওয়াহিদুল হকের মতো সাংস্কৃতিক যাপনে বিশ্বাসী? আমি সংশয়ী। যখন দেখি, সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের কিছু অংশ দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত বা আপসে বিশ্বাসী; তখন তাদের ডাকে কেন লোকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আসবে? তাদের ওপর তো সংস্কৃতিকর্মীরাই বীতশ্রদ্ধ। সুতরাং কার্যকর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা জরুরি।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পৃথিবীর ভাষা বদলে গেছে, বদলে গেছে আন্দোলনের ভাষাও। এর ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি আছে নেতিবাচক কিছু প্রতিক্রিয়াও। যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ খুব দ্রুত সংগঠিত হতে পারে, কিন্তু সে অন্যায়ের প্রতিবিধানে যদি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজন হয়, তখন তাদের আর পাওয়া যায় না। সবাই মনে করেন, ফেসবুকে তো প্রতিবাদ করেছি, অতএব দায় শেষ। এখন নতুন ইস্যু নিয়ে কথা বলা যাক। এই যে ইস্যুভিত্তিক প্রতিবাদ বা ফলো দ্য ট্রেন্ড মানসিকতা—এটা কেবল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে নয়, রাজনৈতিক আন্দোলনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আমরা ফেসবুকে যতটা সরব, রাজপথে ততটা হলেই কিন্তু সমস্যাটির সমাধান হতো।
আবার ইতিবাচক দিকও যে নেই, তা নয়; কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতিকর্মীরা প্রযুক্তির সেই ইতিবাচকতাটুকু কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না। রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁরা যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, যাঁরা এই দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারেন, তাঁদের আমরা ততটা সরব হিসেবে পাই না। এই শূন্যস্থানটুকুই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পিছিয়ে দিচ্ছে। আত্মসমালোচনার সুরেই বলতে হয়, প্রযুক্তিকে ঠিকঠাক ব্যবহারে সংস্কৃতিকর্মীরা এখনো অনাগ্রহী। এর একটি কারণ, নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা এর গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পারছেন না; যাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁরা নেতৃত্বে নেই।
তার মানে এই নয় যে দেশে বর্তমানে একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ম্রিয়মাণ। এখন তো মূলধারার সত্য সংবাদের আগে নামসর্বস্ব মিডিয়ার গুজবের লাইক-শেয়ার বেশি। তার মানে কি এই যে সত্য সংবাদের তুলনায় গুজবের গুরুত্ব বেড়েছে? সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো নানা সীমাবদ্ধতার পরও অসামান্য হয়ে ধরা দেয় প্রতিবছর। সুতরাং আমি আশাবাদী। তবে এটাও বলা প্রয়োজন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন আর খুব একটা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে বলে মনে হয় না। ঘড়ি ধরে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করার নির্দেশ তার একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। একটি যাত্রা, বাউল আসর বা কবিগান আয়োজনে প্রশাসনের অনুমতি পেতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেটা সংস্কৃতিকর্মী মাত্রই জানেন। সংস্কৃতিযাত্রার পথে প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে বাধাগুলো তৈরি করে রেখেছে, যত দিন না সেগুলো তারা দূর করছে, তত দিন সাংস্কৃতিক আন্দোলন তার মূলধারায় ফিরতে পারবে না। চেনা শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা চলে; কিন্তু যাদের মিত্র জানি, তাদের সঙ্গেও যদি একই লড়াই করতে হয়, তাহলে কোনো আন্দোলনই এগোয় না।
লেখক: শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস কেবল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত নয়; বরং হাজার বছর ধরে বাংলায় বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাসের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। হাজার বছর ধরে যে সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসের নির্মাণ-বিনির্মাণ ঘটেছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাতও ঘটেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে।
বিশ শতকের প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সংস্কৃতির যে রাজনৈতিক পরিচয় পাই, তা নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালে এই উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একটি বড় প্রভাব রাখে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে বিকাশ ঘটেছিল, তার মূল প্রেরণাই ছিল সংস্কৃতি, বিশেষত বাংলার সংস্কৃতি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকর্মীরা যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, তা তো ইতিহাসসচেতন পাঠকের অবশ্যই জানা। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে একটি জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা হতে পারেন, তা-ও প্রমাণ করেছে বাংলার মানুষ। ১৯৬১ সালে প্রতিবাদী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রমাণ করেছিল, রবীন্দ্রনাথকেও আমরা লড়ে জিতে নিয়েছি। তাই বাংলাদেশে সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন কথাগুলোর তাৎপর্য খানিকটা আলাদা ও ব্যাপক। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেওয়া জাতি ১৯৬১ সালে পথে নেমেছিল রবীন্দ্রচর্চার অধিকার আদায়ের জন্য। পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯৬২ সালে এই জাতি শুরু করে তার শিক্ষা আন্দোলন। এই যে আন্দোলনের কালানুক্রমিক ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে এর উদ্দেশ্য, এ দুইয়ের সমন্বয় করলেই দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের পর থেকেই তৎকালীন পূর্ব বাংলা রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ তৈরি করেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। ষাটের দশকে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব প্রগতিশীল দলের সমন্বয়ে যে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ তৈরি হয়েছিল, সংস্কৃতিকর্মীরা তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি সোনার মানুষ তৈরি করতে পারে আর রাজনীতি সোনার মানুষকে ব্যবহার করে সোনার দেশ গড়তে পারে।’
দুই
স্বাধীন বাংলাদেশেও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিধি ছিল বেশ বড়। বিশেষ করে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশ যখন সামরিক রাজনীতির অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত, যখন রাজনীতির নামে একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে করে ফেলা হয়েছিল কোণঠাসা; তখন সংস্কৃতিই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক বার্তাবাহক। পঁচাত্তরের পর দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায় না, তখন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করেছিল এক অসাধারণ প্রতিবাদী রূপচিত্র। একটি শূন্য ডায়াসে বঙ্গবন্ধুর চশমার আদলের একটি চশমা—এই ছোট্ট শিল্পকর্মটিই সেদিন এক বড় বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল জনগণের মাঝে। প্রকাশিত হয়েছিল ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’-এর মতো প্রতিবাদী সংকলন।
নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সংস্কৃতিকর্মীরা পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের উদ্যোগে তখন দেশের নানা প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের মেলবন্ধন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সে সময় সংস্কৃতিকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক জোটগুলো।
শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল। অনেকের ধারণা, সংস্কৃতিকর্মীদের অবদান কেবল তাঁদের পরিবেশনায়ই সীমাবদ্ধ। এটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে সীমাবদ্ধ ধারণারই বহিঃপ্রকাশ। সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানে কেবল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নয়; একটি রাজনৈতিক আদর্শকে জনভাষ্যে রূপান্তর করাটাই মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজ। রাজনৈতিক তত্ত্ব বা আদর্শ কিংবা যে লক্ষ্য সামনে রেখে একটি মহৎ গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে, রাজনৈতিক বক্তৃতার মাধ্যমে গণমানুষের কাছে তার মূল ভাব পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংস্কৃতিকর্মীরা সেটা জনভাষ্যে অনুবাদ করেন। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনে বাংদেশ ও দেশের বাইরের সংস্কৃতিকর্মীরা অসংখ্য গান রচনা করেছেন, যেগুলোর প্রতিটি ছত্রে উঠে এসেছে এই আন্দোলনের মূল সুর। কবিরা কবিতা লিখেছেন, তাতে উঠে এসেছে শাহবাগের দাবিগুলো। এই যে রাজনৈতিক বলয়ে থেকে আন্দোলনের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন থেকে সাংস্কৃতিক মাত্রাটি তৈরি করা, এটাই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিক্রমা। সংগ্রামের আদর্শ না জেনে কিংবা আন্দোলনের রাজনৈতিক দায়িত্ব না বুঝে কেবল পরিবেশনা সেরে আসাটাই সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়।
তিন
বর্তমানে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ। বিদ্বজ্জনেরা বলেন, দেশকে মুক্তিসংগ্রামের আদর্শে এগিয়ে নিতে হলে শক্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজন। কথাটি অবশ্যই সত্য। জঙ্গিবাদ, কূপমণ্ডূকতা বা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প মোকাবিলায় অবশ্যই মুক্তিসংগ্রামের চেতনাবিধৌত সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন। কিন্তু সেটা যে হচ্ছে না, এর দায় কি কেবলই সংস্কৃতিকর্মীদের? সংস্কৃতিকর্মীদের একটি দায় অবশ্যই আছে, আর তা হলো নেতৃত্ব আর নৈতিকতার দায়। যে সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, সে সময়ের সংস্কৃতিকর্মীদের জীবনযাপন, তাঁদের আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু এখন যাঁরা নেতৃত্বে আছেন, তাঁরা কি সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত বা ওয়াহিদুল হকের মতো সাংস্কৃতিক যাপনে বিশ্বাসী? আমি সংশয়ী। যখন দেখি, সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের কিছু অংশ দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত বা আপসে বিশ্বাসী; তখন তাদের ডাকে কেন লোকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আসবে? তাদের ওপর তো সংস্কৃতিকর্মীরাই বীতশ্রদ্ধ। সুতরাং কার্যকর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা জরুরি।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পৃথিবীর ভাষা বদলে গেছে, বদলে গেছে আন্দোলনের ভাষাও। এর ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি আছে নেতিবাচক কিছু প্রতিক্রিয়াও। যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ খুব দ্রুত সংগঠিত হতে পারে, কিন্তু সে অন্যায়ের প্রতিবিধানে যদি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজন হয়, তখন তাদের আর পাওয়া যায় না। সবাই মনে করেন, ফেসবুকে তো প্রতিবাদ করেছি, অতএব দায় শেষ। এখন নতুন ইস্যু নিয়ে কথা বলা যাক। এই যে ইস্যুভিত্তিক প্রতিবাদ বা ফলো দ্য ট্রেন্ড মানসিকতা—এটা কেবল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে নয়, রাজনৈতিক আন্দোলনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আমরা ফেসবুকে যতটা সরব, রাজপথে ততটা হলেই কিন্তু সমস্যাটির সমাধান হতো।
আবার ইতিবাচক দিকও যে নেই, তা নয়; কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতিকর্মীরা প্রযুক্তির সেই ইতিবাচকতাটুকু কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না। রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁরা যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, যাঁরা এই দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারেন, তাঁদের আমরা ততটা সরব হিসেবে পাই না। এই শূন্যস্থানটুকুই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পিছিয়ে দিচ্ছে। আত্মসমালোচনার সুরেই বলতে হয়, প্রযুক্তিকে ঠিকঠাক ব্যবহারে সংস্কৃতিকর্মীরা এখনো অনাগ্রহী। এর একটি কারণ, নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা এর গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পারছেন না; যাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁরা নেতৃত্বে নেই।
তার মানে এই নয় যে দেশে বর্তমানে একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ম্রিয়মাণ। এখন তো মূলধারার সত্য সংবাদের আগে নামসর্বস্ব মিডিয়ার গুজবের লাইক-শেয়ার বেশি। তার মানে কি এই যে সত্য সংবাদের তুলনায় গুজবের গুরুত্ব বেড়েছে? সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো নানা সীমাবদ্ধতার পরও অসামান্য হয়ে ধরা দেয় প্রতিবছর। সুতরাং আমি আশাবাদী। তবে এটাও বলা প্রয়োজন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন আর খুব একটা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে বলে মনে হয় না। ঘড়ি ধরে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করার নির্দেশ তার একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। একটি যাত্রা, বাউল আসর বা কবিগান আয়োজনে প্রশাসনের অনুমতি পেতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেটা সংস্কৃতিকর্মী মাত্রই জানেন। সংস্কৃতিযাত্রার পথে প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে বাধাগুলো তৈরি করে রেখেছে, যত দিন না সেগুলো তারা দূর করছে, তত দিন সাংস্কৃতিক আন্দোলন তার মূলধারায় ফিরতে পারবে না। চেনা শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা চলে; কিন্তু যাদের মিত্র জানি, তাদের সঙ্গেও যদি একই লড়াই করতে হয়, তাহলে কোনো আন্দোলনই এগোয় না।
লেখক: শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪