কাবেরী গায়েন
পত্রিকায় প্রথম যেদিন দেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন, চাবির গোছা ও ব্যাগের স্তূপ; আপ্লুত হয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সেই লাইন। কিন্তু এর জন্য লাইব্রেরি কেন? তবে কি বিসিএস পরীক্ষায় এমন সব প্রশ্ন আসছে আজকাল, যার জন্য লাইব্রেরিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পড়তে হচ্ছে? জানলাম, না, তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি বিসিএস পরীক্ষায়। দ্বিতীয় অনুসন্ধানে জানলাম, মনোযোগ দিয়ে বিসিএস গাইড থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে এত দীর্ঘ লাইন। কিন্তু লাইব্রেরি কেন? উত্তরটি অবশ্য একটু বেদনাদায়ক। অধিকাংশ শিক্ষার্থী হলে পড়াশোনার পরিবেশ পান না, তাই সাতসকালেই চলে আসেন লাইব্রেরিতে। সব বিভাগের শিক্ষার্থীই এখন একই ধারায় পড়াশোনা করছেন। সবার ধ্যান-জ্ঞান বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। লাইব্রেরির কর্মকর্তারা জানালেন, শিক্ষার্থীরা বই তোলেন না লাইব্রেরি থেকে। ধাক্কা খাবার মতোই খবর। সবাই যদি একই লক্ষ্যে একই ধরনের পড়াশোনা করেন, তবে এত বিভাগের কী প্রয়োজন? কবে থেকেই-বা এই প্রবণতা চালু হলো? ভাবলাম, নিশ্চয়ই এটি সাম্প্রতিক কোনো প্রবণতা! স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান অধিকারীদের সাক্ষাৎকার ছাপা হতো পত্রিকায়। তখন সেই অদম্য মেধাবীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ চাইতেন ডাক্তার হতে। ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতেন কেউ কেউ। আশির দশকে এক-আধজন সামরিক কর্মকর্তাও হতে চাইতেন। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করতে চান, এমন তেমন দেখিনি। তাই কৌতূহল নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখলাম, না, এটি মোটেই সাম্প্রতিক প্রবণতা নয় বরং আইসিএস, সিএসপি মেধাবী শিক্ষার্থীদের পছন্দের চাকরি এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল বহুকাল আগে থেকেই। এমনকি অত্যুক্তি হবে না যদি বলি, এ প্রবণতা এই উপমহাদেশের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাদর্শনের ধারাবাহিকতা।
‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি উপমহাদেশের আবহমান ধারা থেকে ভিন্ন নয়। প্রাচীন ভারতবর্ষে শিক্ষার অধিকার ছিল ব্রাহ্মণ এবং রাজপুরুষদের। রাজ্য শাসনই ছিল সেই শিক্ষার উদ্দেশ্য। শিক্ষায় সাধারণের প্রবেশগম্যতাও ছিল সীমিত। অবশ্য শিক্ষায় অংশগ্রহণ সামন্তযুগের ইউরোপেও রাজপুরুষদের জন্য বরাদ্দ ছিল। যাজকশ্রেণির হাতে ছিল সে শিক্ষার ভার। ইংরেজ ভারতবর্ষ দখলে নেওয়ার পরে, মূলত তাদেরই প্রয়োজনে, এ দেশে পাশ্চাত্য ধারায় আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার প্রচলন শুরু। পাশ্চাত্য মিশনারি, বণিকশ্রেণি এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের হাতেই এই শিক্ষার সূচনা। সেই শিক্ষাদানের পেছনে ব্রিটিশ সরকারের মূল অভিপ্রায় ছিল এ দেশ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের কাজটি নির্বিঘ্ন করার জন্য একদল সমর্থক ও লাঠিয়াল তৈরি করা, যাদের ত্বক ভারতীয়, কিন্তু এ শিক্ষার ভেতর দিয়ে তাদের মন হয়ে উঠবে ব্রিটিশ। ১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশমালা, ১৮৩৫ সালের মেকলের প্রতিবেদন, ১৮৩৮ সালের উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষাবিষয়ক জরিপ, ১৮৫৭ সালের চার্লস উডের ডেসপ্যাচ, ১৮৮২ সালে উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন নিয়োগ এবং শেষে ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বর্তমান রূপটি দেওয়া হয়। একদিকে চার্লস উডের শিক্ষাবিষয়ক ডেসপ্যাচে কলিকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন আর হান্টারের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় শিক্ষা কমিশন উচ্চবিদ্যালয়ের পরিবর্তে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছিল। নীতি হিসেবে সর্বজনীন শিক্ষাদান ব্রিটিশ সরকার কখনো গ্রহণ করেনি, তবে উচ্চশিক্ষার প্রসারে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ সম্ভাবনার কথা ভেবে উচ্চশিক্ষা সংকোচন আর প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় এলিটরা সেই প্রস্তাবে কান দেননি। শিক্ষা ইংরেজ আমলে মুষ্টিমেয়র উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার উপলক্ষই থেকে যায়। শিক্ষার দর্শন হয়ে ওঠে—‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’।
ভারত বিভাগের পরে, পাকিস্তান রাষ্ট্রেও শিক্ষা ইংরেজ আমলের মতো সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রায় একচেটিয়া দখলে চলে যায়। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। পশ্চিম পাকিস্তানে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হতে থাকে। গুণগত দিক থেকেও পশ্চিম পাকিস্তানে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানের ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার। শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের পাশাপাশি শ্রেণিবিভক্তির কাজটিও অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক করা হয়। পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে (১৯৪৭) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দ্রুত একটি এলিট শ্রেণি তৈরি করতে হবে। ১৯৪৬ সালে, ভারত বিভক্তি নিয়ে যখন দর-কষাকষি চলছিল, তখনই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার প্রয়াস নেয় এবং পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর একদম চেপে বসে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি নয়া উপনিবেশে পরিণত হয় পাকিস্তান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে মার্কিন নয়া সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্ভুক্তি পাকিস্তানি নেতাদের ইচ্ছায় হয়েছিল। সই হয়েছিল সিয়েটো ও সেন্টোর মতো সামরিক চুক্তি। ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য প্রয়োজন একটি অনুগত ও দক্ষ প্রশাসন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমলে এই শক্তির জোগান পাওয়া যেত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) নামের আমলাতন্ত্রে। একইভাবে পাকিস্তানে গড়ে তোলা হলো সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি), যারা মার্কিনদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে শিখল। ব্রিটিশ আমলের মতো পাকিস্তান আমলেও শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য হয়ে উঠল দেশের মধ্যেই নয়া উপনিবেশ গড়ে তোলা। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শিক্ষা সম্মেলনেও আগের শিক্ষানীতি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য হয়ে উঠল সিএসপি হওয়া, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের প্রবেশগম্যতা ছিল খুবই সীমিত। ১৯৫২ সালে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে যে শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি গঠিত হয়, সেখানে বেশ কিছু ভালো সুপারিশ থাকলেও পাকিস্তানের ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার তাগিদ থেকে শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলে আরও তিনটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল—১৯৫৯ সালের শরীফ কমিশন, ১৯৬৬ সালের হামুদুর রহমান কমিশন এবং ১৯৬৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন নূর খাঁ কমিশন। প্রতিটি শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য একই—মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যে শিক্ষার সব সুযোগ নানা কৌশলে সীমাবদ্ধ রাখা। স্কুলে অবৈজ্ঞানিক পন্থায় ধর্মশিক্ষা, প্রথম শ্রেণি থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি সাহিত্যের পরিবর্তে ফাংশনাল ইংলিশ নামে কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়। পাশাপাশি চালু করা হয় ব্যয়বহুল মডেল স্কুল, ক্যাডেট কলেজ ও মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানে মূল ধারার স্কুলের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষে দুই থেকে ৪০০ গুণ বেশি ব্যয় করা হতে থাকে। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি ও জিইয়ে রাখার প্রকল্প হিসেবেই এসব শিক্ষা সংকোচন নীতি নেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলজুড়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং সংকোচন নীতির বীজ বপন করে চারা তৈরির কাজ সম্পন্ন হতে দেখি, যার লিগেসি বাংলাদেশ এড়াতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয় শিক্ষানীতিগুলোর পাঠ থেকে।
বিসিএসমুখী শিক্ষা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান আমলের সরকারি কর্মকর্তা, যাঁরা পাকিস্তান সরকারকে সেবা দিয়েছেন, তাঁরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে আত্তীকৃত হন। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের প্রতিপত্তি শুরুর দিকে একটু হ্রাস পেয়েছিল। নতুন যে বিসিএস কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের সম্পর্কে জনধারণা তৈরি হয় যে পাকিস্তান আমল থেকে এসে আমলাতন্ত্রে আত্তীকৃত সিএসপি কর্মকর্তাদের মতো নয় তাঁদের মান। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে যেহেতু নামে-বেনামে সামরিক শাসন চলেছে দীর্ঘকাল, এই কালপর্বে, বেশ বড় সময়জুড়ে সিভিল ব্যুরোক্রেসির তুলনায় সামরিক ব্যুরোক্রেসি অধিকতর আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পরে ফের সিভিল ব্যুরোক্রেসি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়তে থাকে। অবধারিতভাবে সরকারি এসব কর্মকর্তাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে কাজ করিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ক্ষমতাবান শ্রেণি এই আমলাতন্ত্র। এখনো সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় যেতে চান; কিন্তু সরকারি চাকরিতে ঢুকে বিদেশে ট্রেনিং এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বহু বছর ধরেই সরকারি কর্মকর্তাদের। এই প্রায়োগিক বাস্তবতার পাশাপাশি রাষ্ট্রের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতিও জড়িত এই বাস্তবতা নির্মাণে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন যে শিক্ষানীতি প্রস্তাব করেছিল, সেখানে সমাজতন্ত্র অভিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা এবং অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। শিক্ষাবিষয়ক চাকরিকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার প্রস্তাব ছিল, যেন সবচেয়ে যোগ্য শিক্ষার্থীরা সেখানে যোগ দিতে চায়। সব ভবিষ্যৎ নাগরিকের অন্তর্ভুক্তিমূলক সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শিক্ষানীতি প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব শিক্ষানীতিতে ক্রমে সাম্প্রদায়িকতা ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা স্পষ্ট হয়। মানসম্মত শিক্ষা এবং মানসম্মত শিক্ষায় সাধারণের প্রবেশগম্যতার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানসম্মত প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষা, গবেষণাধর্মী উচ্চশিক্ষার বিষয়টি ক্রমেই সাধারণের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ধনিক শ্রেণি মানসম্মত শিক্ষা কিনে নিতে পারছে। দেশে পছন্দ না হলে বিদেশ থেকে শিক্ষা কিনতে পারছে। কিন্তু দেশে ক্রমাগত শিক্ষায় বরাদ্দ কমে যাচ্ছে, যা গবেষণাধর্মী উচ্চশিক্ষার পরিসরকে ক্রমাগত সংকুচিত করে দিচ্ছে।
এ বছর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা গত বছরের চেয়ে কম। গত অর্থবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। অর্থাৎ ক্রমাগতভাবে কমছে শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বরাদ্দ, যা বহু বছর ধরেই এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। কাজেই শিক্ষা, গবেষণা বা অন্যান্য পেশাগত কাজের উৎকর্ষ সাধনের অনিশ্চয়তার তুলনায় বিসিএস অনেক বেশি আকর্ষণীয় চাকরি। তাই বৈজ্ঞানিক কিংবা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা সাংবাদিক হওয়ার চেয়ে বিসিএসকেই সার মনে করা হচ্ছে।
শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাব্যবস্থার ঔপনিবেশিক অতীত, সাম্প্রদায়িক বাণিজ্যিক বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যই দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে লাইব্রেরির সামনের দীর্ঘ লাইনে। তার অধীত বিষয়ের মনোযোগী পাঠের জন্য নয়, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পদে চাকরি পাওয়ার জন্য।
আগে চাই অনুধাবন
নিও-লিবারেল অর্থনীতির যুগে ভালো শিক্ষা এবং দক্ষতা আসলে কিনে নিতে হয় চড়া দামে। উন্নত দেশে এই বিপণনে এক ধরনের আভিজাত্য এসেছে। টাকার বিনিময়ে ভালো পণ্য কেনার মতোই ভালো শিক্ষা কেনা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা আটকে আছে এখনো ফটকা বাজারে। তাই রাজনৈতিক প্রয়োজনে সাক্ষরতা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি, বরং তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত সাধারণের শিক্ষার মান। পাশাপাশি তৈরি আছে ধনবানের জন্য স্কুল। মাসে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সেই স্কুলে পড়ে তাঁদের সন্তানেরা। বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখন দুয়োরানি, ইংরেজি সুয়োরানির কাছে সে হেরে ভূত হয়েছে অনেক আগে। কাজেই মুখে কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষানীতির কথা বললেও, সর্বস্তরের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা চালু করাকে স্লোগান হিসেবে নিলেও, আমাদের, যাদেরই সক্ষমতা আছে, লক্ষ্য ইংরেজি শিক্ষায় সন্তানকে শিক্ষিত করা, শিক্ষা শেষে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। যিনি সেটি আপাতত পারছেন না, তিনি মুক্তি খুঁজছেন বিসিএস চাকরিতে।
শুধু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিয়েই একটি রাষ্ট্র চলবে কি না, সেই অনুধাবন স্পষ্ট করেই রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাদর্শন নিয়ে নতুন চিন্তা শুরু হোক।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পত্রিকায় প্রথম যেদিন দেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন, চাবির গোছা ও ব্যাগের স্তূপ; আপ্লুত হয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সেই লাইন। কিন্তু এর জন্য লাইব্রেরি কেন? তবে কি বিসিএস পরীক্ষায় এমন সব প্রশ্ন আসছে আজকাল, যার জন্য লাইব্রেরিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পড়তে হচ্ছে? জানলাম, না, তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি বিসিএস পরীক্ষায়। দ্বিতীয় অনুসন্ধানে জানলাম, মনোযোগ দিয়ে বিসিএস গাইড থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে এত দীর্ঘ লাইন। কিন্তু লাইব্রেরি কেন? উত্তরটি অবশ্য একটু বেদনাদায়ক। অধিকাংশ শিক্ষার্থী হলে পড়াশোনার পরিবেশ পান না, তাই সাতসকালেই চলে আসেন লাইব্রেরিতে। সব বিভাগের শিক্ষার্থীই এখন একই ধারায় পড়াশোনা করছেন। সবার ধ্যান-জ্ঞান বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। লাইব্রেরির কর্মকর্তারা জানালেন, শিক্ষার্থীরা বই তোলেন না লাইব্রেরি থেকে। ধাক্কা খাবার মতোই খবর। সবাই যদি একই লক্ষ্যে একই ধরনের পড়াশোনা করেন, তবে এত বিভাগের কী প্রয়োজন? কবে থেকেই-বা এই প্রবণতা চালু হলো? ভাবলাম, নিশ্চয়ই এটি সাম্প্রতিক কোনো প্রবণতা! স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান অধিকারীদের সাক্ষাৎকার ছাপা হতো পত্রিকায়। তখন সেই অদম্য মেধাবীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ চাইতেন ডাক্তার হতে। ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতেন কেউ কেউ। আশির দশকে এক-আধজন সামরিক কর্মকর্তাও হতে চাইতেন। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করতে চান, এমন তেমন দেখিনি। তাই কৌতূহল নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখলাম, না, এটি মোটেই সাম্প্রতিক প্রবণতা নয় বরং আইসিএস, সিএসপি মেধাবী শিক্ষার্থীদের পছন্দের চাকরি এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল বহুকাল আগে থেকেই। এমনকি অত্যুক্তি হবে না যদি বলি, এ প্রবণতা এই উপমহাদেশের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাদর্শনের ধারাবাহিকতা।
‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি উপমহাদেশের আবহমান ধারা থেকে ভিন্ন নয়। প্রাচীন ভারতবর্ষে শিক্ষার অধিকার ছিল ব্রাহ্মণ এবং রাজপুরুষদের। রাজ্য শাসনই ছিল সেই শিক্ষার উদ্দেশ্য। শিক্ষায় সাধারণের প্রবেশগম্যতাও ছিল সীমিত। অবশ্য শিক্ষায় অংশগ্রহণ সামন্তযুগের ইউরোপেও রাজপুরুষদের জন্য বরাদ্দ ছিল। যাজকশ্রেণির হাতে ছিল সে শিক্ষার ভার। ইংরেজ ভারতবর্ষ দখলে নেওয়ার পরে, মূলত তাদেরই প্রয়োজনে, এ দেশে পাশ্চাত্য ধারায় আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার প্রচলন শুরু। পাশ্চাত্য মিশনারি, বণিকশ্রেণি এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের হাতেই এই শিক্ষার সূচনা। সেই শিক্ষাদানের পেছনে ব্রিটিশ সরকারের মূল অভিপ্রায় ছিল এ দেশ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের কাজটি নির্বিঘ্ন করার জন্য একদল সমর্থক ও লাঠিয়াল তৈরি করা, যাদের ত্বক ভারতীয়, কিন্তু এ শিক্ষার ভেতর দিয়ে তাদের মন হয়ে উঠবে ব্রিটিশ। ১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশমালা, ১৮৩৫ সালের মেকলের প্রতিবেদন, ১৮৩৮ সালের উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষাবিষয়ক জরিপ, ১৮৫৭ সালের চার্লস উডের ডেসপ্যাচ, ১৮৮২ সালে উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন নিয়োগ এবং শেষে ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বর্তমান রূপটি দেওয়া হয়। একদিকে চার্লস উডের শিক্ষাবিষয়ক ডেসপ্যাচে কলিকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন আর হান্টারের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় শিক্ষা কমিশন উচ্চবিদ্যালয়ের পরিবর্তে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছিল। নীতি হিসেবে সর্বজনীন শিক্ষাদান ব্রিটিশ সরকার কখনো গ্রহণ করেনি, তবে উচ্চশিক্ষার প্রসারে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ সম্ভাবনার কথা ভেবে উচ্চশিক্ষা সংকোচন আর প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় এলিটরা সেই প্রস্তাবে কান দেননি। শিক্ষা ইংরেজ আমলে মুষ্টিমেয়র উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার উপলক্ষই থেকে যায়। শিক্ষার দর্শন হয়ে ওঠে—‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’।
ভারত বিভাগের পরে, পাকিস্তান রাষ্ট্রেও শিক্ষা ইংরেজ আমলের মতো সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রায় একচেটিয়া দখলে চলে যায়। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। পশ্চিম পাকিস্তানে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হতে থাকে। গুণগত দিক থেকেও পশ্চিম পাকিস্তানে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানের ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার। শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের পাশাপাশি শ্রেণিবিভক্তির কাজটিও অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক করা হয়। পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে (১৯৪৭) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দ্রুত একটি এলিট শ্রেণি তৈরি করতে হবে। ১৯৪৬ সালে, ভারত বিভক্তি নিয়ে যখন দর-কষাকষি চলছিল, তখনই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার প্রয়াস নেয় এবং পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর একদম চেপে বসে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি নয়া উপনিবেশে পরিণত হয় পাকিস্তান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে মার্কিন নয়া সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্ভুক্তি পাকিস্তানি নেতাদের ইচ্ছায় হয়েছিল। সই হয়েছিল সিয়েটো ও সেন্টোর মতো সামরিক চুক্তি। ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য প্রয়োজন একটি অনুগত ও দক্ষ প্রশাসন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমলে এই শক্তির জোগান পাওয়া যেত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) নামের আমলাতন্ত্রে। একইভাবে পাকিস্তানে গড়ে তোলা হলো সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি), যারা মার্কিনদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে শিখল। ব্রিটিশ আমলের মতো পাকিস্তান আমলেও শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য হয়ে উঠল দেশের মধ্যেই নয়া উপনিবেশ গড়ে তোলা। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শিক্ষা সম্মেলনেও আগের শিক্ষানীতি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য হয়ে উঠল সিএসপি হওয়া, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের প্রবেশগম্যতা ছিল খুবই সীমিত। ১৯৫২ সালে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে যে শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি গঠিত হয়, সেখানে বেশ কিছু ভালো সুপারিশ থাকলেও পাকিস্তানের ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার তাগিদ থেকে শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলে আরও তিনটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল—১৯৫৯ সালের শরীফ কমিশন, ১৯৬৬ সালের হামুদুর রহমান কমিশন এবং ১৯৬৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন নূর খাঁ কমিশন। প্রতিটি শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য একই—মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যে শিক্ষার সব সুযোগ নানা কৌশলে সীমাবদ্ধ রাখা। স্কুলে অবৈজ্ঞানিক পন্থায় ধর্মশিক্ষা, প্রথম শ্রেণি থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি সাহিত্যের পরিবর্তে ফাংশনাল ইংলিশ নামে কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়। পাশাপাশি চালু করা হয় ব্যয়বহুল মডেল স্কুল, ক্যাডেট কলেজ ও মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানে মূল ধারার স্কুলের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষে দুই থেকে ৪০০ গুণ বেশি ব্যয় করা হতে থাকে। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি ও জিইয়ে রাখার প্রকল্প হিসেবেই এসব শিক্ষা সংকোচন নীতি নেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলজুড়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং সংকোচন নীতির বীজ বপন করে চারা তৈরির কাজ সম্পন্ন হতে দেখি, যার লিগেসি বাংলাদেশ এড়াতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয় শিক্ষানীতিগুলোর পাঠ থেকে।
বিসিএসমুখী শিক্ষা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান আমলের সরকারি কর্মকর্তা, যাঁরা পাকিস্তান সরকারকে সেবা দিয়েছেন, তাঁরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে আত্তীকৃত হন। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের প্রতিপত্তি শুরুর দিকে একটু হ্রাস পেয়েছিল। নতুন যে বিসিএস কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের সম্পর্কে জনধারণা তৈরি হয় যে পাকিস্তান আমল থেকে এসে আমলাতন্ত্রে আত্তীকৃত সিএসপি কর্মকর্তাদের মতো নয় তাঁদের মান। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে যেহেতু নামে-বেনামে সামরিক শাসন চলেছে দীর্ঘকাল, এই কালপর্বে, বেশ বড় সময়জুড়ে সিভিল ব্যুরোক্রেসির তুলনায় সামরিক ব্যুরোক্রেসি অধিকতর আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পরে ফের সিভিল ব্যুরোক্রেসি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়তে থাকে। অবধারিতভাবে সরকারি এসব কর্মকর্তাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে কাজ করিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ক্ষমতাবান শ্রেণি এই আমলাতন্ত্র। এখনো সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় যেতে চান; কিন্তু সরকারি চাকরিতে ঢুকে বিদেশে ট্রেনিং এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বহু বছর ধরেই সরকারি কর্মকর্তাদের। এই প্রায়োগিক বাস্তবতার পাশাপাশি রাষ্ট্রের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতিও জড়িত এই বাস্তবতা নির্মাণে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন যে শিক্ষানীতি প্রস্তাব করেছিল, সেখানে সমাজতন্ত্র অভিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা এবং অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। শিক্ষাবিষয়ক চাকরিকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার প্রস্তাব ছিল, যেন সবচেয়ে যোগ্য শিক্ষার্থীরা সেখানে যোগ দিতে চায়। সব ভবিষ্যৎ নাগরিকের অন্তর্ভুক্তিমূলক সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শিক্ষানীতি প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব শিক্ষানীতিতে ক্রমে সাম্প্রদায়িকতা ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা স্পষ্ট হয়। মানসম্মত শিক্ষা এবং মানসম্মত শিক্ষায় সাধারণের প্রবেশগম্যতার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানসম্মত প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষা, গবেষণাধর্মী উচ্চশিক্ষার বিষয়টি ক্রমেই সাধারণের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ধনিক শ্রেণি মানসম্মত শিক্ষা কিনে নিতে পারছে। দেশে পছন্দ না হলে বিদেশ থেকে শিক্ষা কিনতে পারছে। কিন্তু দেশে ক্রমাগত শিক্ষায় বরাদ্দ কমে যাচ্ছে, যা গবেষণাধর্মী উচ্চশিক্ষার পরিসরকে ক্রমাগত সংকুচিত করে দিচ্ছে।
এ বছর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা গত বছরের চেয়ে কম। গত অর্থবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। অর্থাৎ ক্রমাগতভাবে কমছে শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বরাদ্দ, যা বহু বছর ধরেই এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। কাজেই শিক্ষা, গবেষণা বা অন্যান্য পেশাগত কাজের উৎকর্ষ সাধনের অনিশ্চয়তার তুলনায় বিসিএস অনেক বেশি আকর্ষণীয় চাকরি। তাই বৈজ্ঞানিক কিংবা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা সাংবাদিক হওয়ার চেয়ে বিসিএসকেই সার মনে করা হচ্ছে।
শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাব্যবস্থার ঔপনিবেশিক অতীত, সাম্প্রদায়িক বাণিজ্যিক বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যই দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে লাইব্রেরির সামনের দীর্ঘ লাইনে। তার অধীত বিষয়ের মনোযোগী পাঠের জন্য নয়, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পদে চাকরি পাওয়ার জন্য।
আগে চাই অনুধাবন
নিও-লিবারেল অর্থনীতির যুগে ভালো শিক্ষা এবং দক্ষতা আসলে কিনে নিতে হয় চড়া দামে। উন্নত দেশে এই বিপণনে এক ধরনের আভিজাত্য এসেছে। টাকার বিনিময়ে ভালো পণ্য কেনার মতোই ভালো শিক্ষা কেনা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা আটকে আছে এখনো ফটকা বাজারে। তাই রাজনৈতিক প্রয়োজনে সাক্ষরতা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি, বরং তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত সাধারণের শিক্ষার মান। পাশাপাশি তৈরি আছে ধনবানের জন্য স্কুল। মাসে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সেই স্কুলে পড়ে তাঁদের সন্তানেরা। বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখন দুয়োরানি, ইংরেজি সুয়োরানির কাছে সে হেরে ভূত হয়েছে অনেক আগে। কাজেই মুখে কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষানীতির কথা বললেও, সর্বস্তরের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা চালু করাকে স্লোগান হিসেবে নিলেও, আমাদের, যাদেরই সক্ষমতা আছে, লক্ষ্য ইংরেজি শিক্ষায় সন্তানকে শিক্ষিত করা, শিক্ষা শেষে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। যিনি সেটি আপাতত পারছেন না, তিনি মুক্তি খুঁজছেন বিসিএস চাকরিতে।
শুধু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিয়েই একটি রাষ্ট্র চলবে কি না, সেই অনুধাবন স্পষ্ট করেই রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাদর্শন নিয়ে নতুন চিন্তা শুরু হোক।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪