শেখ রোকন
একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে সুপেয় পানির উৎস তথা নদ-নদীর দখল নিয়ে। যদিও যুদ্ধ যাতে না বাধে, তার জন্য করণীয় সম্পর্কে আপ্তবাক্য নেই বললেই চলে। কারণ, পানি বা নদী নিয়ে সংকটের ধরন যেমন, তেমনি সমাধানেরও সর্বজনীন ফর্মুলা নেই। প্রতিটি নদীর চরিত্র যেমন স্বতন্ত্র, সেটা ঘিরে সংকটের চরিত্রও স্বতন্ত্র। কিন্তু বলতে গেলে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘ওয়াটার ডিপ্লোমেসি’ বা পানি কূটনীতি ধারণাটি জন্ম। পানি বিরোধের তুলনায় পানি কূটনীতি অনেক নবীন।
পেছনে তাকালে দেখা যাবে, পানি বা নদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ থাকলেও ‘যুদ্ধ’ কমই হয়েছে। নদীর অধিকার নিয়ে আপত্তি ও বিরোধ বিভিন্ন দেশেই আছে। কিন্তু ধ্রুপদি অর্থে ‘যুদ্ধ’ বলতে যা বোঝায়, সেটা সর্বশেষ ঘটেছিল সাড়ে চার হাজার বছর আগে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার দুই নগররাষ্ট্র লাগাস ও উম্মা যুদ্ধে জড়িয়েছিল দজলা নদীর একটি শাখার দখল নিয়ে। পানি নিয়ে বরং আলোচনা বেশি হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, এর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গত ৬০ বছরে আন্তর্জাতিক নদীবিষয়ক ১৮০০ দফা ‘আলোচনা’ হয়েছে। যদিও এসব আলোচনা কতটা অর্থহীন হতে পারে, বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কে জানে?
পরিস্থিতি ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। নদীর পানির ব্যবহার পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে যত বৈচিত্র্যপূর্ণ হচ্ছে, নদী নিয়ে আন্তরাষ্ট্রীয়, এমনকি রাষ্ট্রের ভেতরে আন্তরাজ্য বা আন্ত-অঞ্চল বিরোধ তত বহুমাত্রিক হচ্ছে। আলোচনার সংখ্যা বাড়লেও সেখানকার পরিবেশ ক্রমেই উষ্ণ ও জটিল হয়ে উঠছে। জাতিসংঘই বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনা সভায় বৈরীভাব প্রবল হচ্ছে; নাম ধরে অভিযোগ থেকে সামরিক ব্যবস্থার হুমকি পর্যন্ত উঠে আসছে।
শুধু আলোচনার পরিবেশ তেতে ওঠার কারণে নয়; দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিস্তৃত নদী অববাহিকাগুলোর সংখ্যা ও সংকট দেখলে অবিশ্বাস করা কঠিন যে নদী নিয়ে যুদ্ধ লেগে যেতেই পারে। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বে বর্তমানে ৩১৩টি আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকা রয়েছে। যেমন এ অঞ্চলের গঙ্গা অববাহিকায় রয়েছে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ এবং ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চীন, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশ।
ভূপৃষ্ঠে দৃশ্যমান নদীর বাইরেও ভূগর্ভে আছে ‘অ্যাকুইফার’ বা সুপেয় পানির আধার। বাংলায় অনেকে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর বলেন। আগে মনে করা হতো, স্তরটি নির্দিষ্ট এলাকায় স্থির ও সীমিত। কিন্তু পরে প্রমাণ হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানিস্তর রীতিমতো প্রবহমান। ভূপৃষ্ঠের নদীর মতোই এর প্রবাহ ‘রিচার্জ’ হয়। যে কারণে ‘অ্যাকুইফার’ বাংলায় হতে পারে ‘ভূতল নদী’। যা হোক, যখন ভূতল নদীর সচলতা প্রমাণ হয়েছে, তখন এটাও আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বে ৬ শতাধিক ‘ট্রান্সবাউন্ডারি অ্যাকুইফার’ আছে।
জাতিসংঘ মনে করে, আন্তরাষ্ট্রীয় নদীর মতো আন্তরাষ্ট্রীয় ভূতল নদী নিয়েও সদস্যদেশগুলোর মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। সে কারণে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস ১৯৯৭’ বা ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ’ নদ-নদীর পাশাপাশি ভূতল নদী নিয়েও বিধিবিধান প্রস্তাব করেছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২১ মে সনদটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১০৬ ভোটে গৃহীত হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় চীন, তুরস্ক ও বুরুন্ডি। ভারত ও পাকিস্তান ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশ সনদের পক্ষে ভোট দেয়। ‘ভাটির দেশের রক্ষাকবচ’ হিসেবে পরিচিত এ সনদের ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ৩৫টি সদস্যদেশের আইনসভায় অনুসমর্থনের ৯০ দিন পর এটি কার্যকর হবে। ২০১৪ সালের ১৯ মে ভিয়েতনাম ৩৫তম দেশ হিসেবে সনদটি অনুসমর্থন করে। সেই হিসাবে ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে সনদটি কার্যকর হয়। বিস্ময়করভাবে, পক্ষে ভোট দিলেও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ এখনো সনদটি অনুসমর্থন করেনি। যদিও এ ক্ষেত্রে ভূতল নদীর বিষয়টি নিয়ে ‘আরও বোঝাপড়া’ করার কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। মূল কারণ বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
বস্তুত, পানি কূটনীতির এমন অনেক বিস্ময়কর ও রহস্যজনক ঘটনাস্থল বাংলাদেশ। ‘মহাভারতে’ বলা হয়েছে, ‘যা মহাভারতে আছে তা অন্যত্র থাকতে পারে, যা এতে নেই তা আর কোথাও নেই’। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে অভিন্ন বা আন্তসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক নদীগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা যেন পানি কূটনীতির রীতিমতো মহাভারত। যেমন অভিন্ন নদীগুলোর ‘পানিবণ্টন’ নিয়ে যত দিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা চলছে, তা বিশ্বে বিরল। দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে স্বীকৃত অভিন্ন নদী ৫৪টি। এর বাইরে আরও সমানসংখ্যক অস্বীকৃত অভিন্ন নদী আছে। এর মধ্যে তিস্তা নিয়ে আলোচনা চলছে সেই ১৯৫৩ সাল থেকে। গত ৭০ বছরে আলোচনা করে কোনো সমাধানে আসা যায়নি। গঙ্গা নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে অবশ্য ২৫ বছর লেগেছিল। সেই চুক্তির মেয়াদও ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই দুই নদীবিষয়ক আলোচনার মধ্যে কম সময়েরটিই যদি ধরি, তাহলেও স্বীকৃত ৫৪ অভিন্ন নদীর জন্য ৫৪টি চুক্তি করতে ১ হাজার ৩৫০ বছর লেগে যাওয়ার কথা! যে কারণে অনেকে বলে আসছি, অভিন্ন নদীগুলোর জন্য একটি অভিন্ন ফর্মুলাভিত্তিক চুক্তি প্রয়োজন। আর স্থায়ী চুক্তির বদলে মেয়াদি চুক্তির বিপদ কী হতে পারে, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে আসার পথে টের পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া অভিন্ন নদীগুলোতে ভারত যেরকম একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার এবং ড্যাম বা ব্যারাজ নির্মাণ করছে, এর নজিরও বিশ্বে কম। আর ভূতল নদী দুই দেশের পানি কূটনীতির আওতায় আসবে কি না, সেই প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
আসলে বিভিন্ন নদীকে আড়াআড়ি ভাগ করে ১৯৪৭ সালে যেভাবে সীমানা নির্ধারণ হয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে নজিরবিহীন। বিশ্বের কোথাও আর এভাবে নদী কেটে সীমান্ত নির্ধারণ হয় না। যেমন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত নির্ধারণ করেছে রিও গ্রান্ডে নদী। সুইডেন-ফিনল্যান্ড সীমান্ত নির্ধারণ করেছে টর্ন নদী। চীন-রাশিয়া সীমান্ত নির্ধারণ করেছে আমুর নদী। এমনকি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নাফ নদী এবং ভারত-মিয়ানমারের মধ্যে তিয়াও নদ সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত বা তৎকালীন ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই ধ্রুপদি নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছিল। এতে অনিবার্যভাবেই ভাটির দেশ উজানের দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য।
তাহলে বাংলাদেশের জন্য করণীয় কী? এটা ঠিক, নদীতে যদি সীমান্তরেখা আড়াআড়ি বসে, তাহলে পানি কূটনীতি সহজ হয় না। ডাচ জার্নাল ‘ডিপ্লোম্যাটিকা’ এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বলে থাকে। প্রথমত, নদীপ্রবাহ যেহেতু গতিশীল এবং এর বাষ্পীভবন ও বৃষ্টির মাধ্যমে পুনর্ভরন ঘটে; এখানে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, নদীপ্রবাহ যেহেতু একই সঙ্গে একাধিক দেশের সীমারেখায় অবস্থান করতে পারে, সাগর কিংবা বনের মতো, এ ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের প্রথাগত ধারণা অচল। তৃতীয়ত, দেশভেদে নদীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা মাত্রা। সেটা অন্য দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। যেমন গঙ্গা ভারতের কাছে দেবীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। প্রতিবেশী দেশের কাছে সেই আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নাও থাকতে পারে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ পানি কূটনীতির তিনটি মাত্রা আছে। প্রথমত, এখানে প্রথাগত কূটনীতি চলবে না। কারণ নদী হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ, অন্যদিকে কূটনীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়। এই দুইয়ের মিশ্রণ ছাড়াও বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন, ঐতিহাসিক অবস্থানও যোগ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নদী যেহেতু বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহ, বিষয়টিকে নিছক পানিবণ্টনের ধারায় দেখলে চলবে না। নদীর নিজের প্রতিবেশগত অস্তিত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন তিস্তার ক্ষেত্রে শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে পানিপ্রবাহ ৫ থেকে ৬ হাজার কিউসেক। ভারতে যেমন গজলডোবা ব্যারাজ, তেমনই বাংলাদেশে রয়েছে ডালিয়া ব্যারাজ। দুই ব্যারাজের পানি প্রত্যাহারের সক্ষমতা ২৩ হাজার কিউসেক। পানিবণ্টন সম্ভব হলেও খোদ তিস্তার কী হবে?
তৃতীয়ত, পানি কূটনীতির ক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক তথ্য ও বৈজ্ঞানিক উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে যে অভিন্ন নদীগুলো একদা অভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। অভিন্ন অর্থনীতি, পরিবহন ও উৎপাদনব্যবস্থার অংশ ছিল। ফলে অভিন্ন নদীগুলোতে বাংলাদেশেরও অভিন্ন অধিকার আছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা এবং এর সুফল ভাগাভাগির প্রশ্ন অবশ্য বাংলাদেশ ও ভারতে ক্রমান্বয়ে জোরালো হচ্ছে। কিন্তু ভাটির দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরই না ব্যবস্থাপনা ও সুফল ভাগাভাগির প্রশ্ন।
লেখক: মহাসচিব, রিভারাইন পিপল
একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে সুপেয় পানির উৎস তথা নদ-নদীর দখল নিয়ে। যদিও যুদ্ধ যাতে না বাধে, তার জন্য করণীয় সম্পর্কে আপ্তবাক্য নেই বললেই চলে। কারণ, পানি বা নদী নিয়ে সংকটের ধরন যেমন, তেমনি সমাধানেরও সর্বজনীন ফর্মুলা নেই। প্রতিটি নদীর চরিত্র যেমন স্বতন্ত্র, সেটা ঘিরে সংকটের চরিত্রও স্বতন্ত্র। কিন্তু বলতে গেলে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘ওয়াটার ডিপ্লোমেসি’ বা পানি কূটনীতি ধারণাটি জন্ম। পানি বিরোধের তুলনায় পানি কূটনীতি অনেক নবীন।
পেছনে তাকালে দেখা যাবে, পানি বা নদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ থাকলেও ‘যুদ্ধ’ কমই হয়েছে। নদীর অধিকার নিয়ে আপত্তি ও বিরোধ বিভিন্ন দেশেই আছে। কিন্তু ধ্রুপদি অর্থে ‘যুদ্ধ’ বলতে যা বোঝায়, সেটা সর্বশেষ ঘটেছিল সাড়ে চার হাজার বছর আগে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার দুই নগররাষ্ট্র লাগাস ও উম্মা যুদ্ধে জড়িয়েছিল দজলা নদীর একটি শাখার দখল নিয়ে। পানি নিয়ে বরং আলোচনা বেশি হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, এর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গত ৬০ বছরে আন্তর্জাতিক নদীবিষয়ক ১৮০০ দফা ‘আলোচনা’ হয়েছে। যদিও এসব আলোচনা কতটা অর্থহীন হতে পারে, বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কে জানে?
পরিস্থিতি ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। নদীর পানির ব্যবহার পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে যত বৈচিত্র্যপূর্ণ হচ্ছে, নদী নিয়ে আন্তরাষ্ট্রীয়, এমনকি রাষ্ট্রের ভেতরে আন্তরাজ্য বা আন্ত-অঞ্চল বিরোধ তত বহুমাত্রিক হচ্ছে। আলোচনার সংখ্যা বাড়লেও সেখানকার পরিবেশ ক্রমেই উষ্ণ ও জটিল হয়ে উঠছে। জাতিসংঘই বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনা সভায় বৈরীভাব প্রবল হচ্ছে; নাম ধরে অভিযোগ থেকে সামরিক ব্যবস্থার হুমকি পর্যন্ত উঠে আসছে।
শুধু আলোচনার পরিবেশ তেতে ওঠার কারণে নয়; দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিস্তৃত নদী অববাহিকাগুলোর সংখ্যা ও সংকট দেখলে অবিশ্বাস করা কঠিন যে নদী নিয়ে যুদ্ধ লেগে যেতেই পারে। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বে বর্তমানে ৩১৩টি আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকা রয়েছে। যেমন এ অঞ্চলের গঙ্গা অববাহিকায় রয়েছে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ এবং ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চীন, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশ।
ভূপৃষ্ঠে দৃশ্যমান নদীর বাইরেও ভূগর্ভে আছে ‘অ্যাকুইফার’ বা সুপেয় পানির আধার। বাংলায় অনেকে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর বলেন। আগে মনে করা হতো, স্তরটি নির্দিষ্ট এলাকায় স্থির ও সীমিত। কিন্তু পরে প্রমাণ হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানিস্তর রীতিমতো প্রবহমান। ভূপৃষ্ঠের নদীর মতোই এর প্রবাহ ‘রিচার্জ’ হয়। যে কারণে ‘অ্যাকুইফার’ বাংলায় হতে পারে ‘ভূতল নদী’। যা হোক, যখন ভূতল নদীর সচলতা প্রমাণ হয়েছে, তখন এটাও আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বে ৬ শতাধিক ‘ট্রান্সবাউন্ডারি অ্যাকুইফার’ আছে।
জাতিসংঘ মনে করে, আন্তরাষ্ট্রীয় নদীর মতো আন্তরাষ্ট্রীয় ভূতল নদী নিয়েও সদস্যদেশগুলোর মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। সে কারণে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস ১৯৯৭’ বা ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ’ নদ-নদীর পাশাপাশি ভূতল নদী নিয়েও বিধিবিধান প্রস্তাব করেছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২১ মে সনদটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১০৬ ভোটে গৃহীত হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় চীন, তুরস্ক ও বুরুন্ডি। ভারত ও পাকিস্তান ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশ সনদের পক্ষে ভোট দেয়। ‘ভাটির দেশের রক্ষাকবচ’ হিসেবে পরিচিত এ সনদের ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ৩৫টি সদস্যদেশের আইনসভায় অনুসমর্থনের ৯০ দিন পর এটি কার্যকর হবে। ২০১৪ সালের ১৯ মে ভিয়েতনাম ৩৫তম দেশ হিসেবে সনদটি অনুসমর্থন করে। সেই হিসাবে ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে সনদটি কার্যকর হয়। বিস্ময়করভাবে, পক্ষে ভোট দিলেও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ এখনো সনদটি অনুসমর্থন করেনি। যদিও এ ক্ষেত্রে ভূতল নদীর বিষয়টি নিয়ে ‘আরও বোঝাপড়া’ করার কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। মূল কারণ বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
বস্তুত, পানি কূটনীতির এমন অনেক বিস্ময়কর ও রহস্যজনক ঘটনাস্থল বাংলাদেশ। ‘মহাভারতে’ বলা হয়েছে, ‘যা মহাভারতে আছে তা অন্যত্র থাকতে পারে, যা এতে নেই তা আর কোথাও নেই’। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে অভিন্ন বা আন্তসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক নদীগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা যেন পানি কূটনীতির রীতিমতো মহাভারত। যেমন অভিন্ন নদীগুলোর ‘পানিবণ্টন’ নিয়ে যত দিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা চলছে, তা বিশ্বে বিরল। দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে স্বীকৃত অভিন্ন নদী ৫৪টি। এর বাইরে আরও সমানসংখ্যক অস্বীকৃত অভিন্ন নদী আছে। এর মধ্যে তিস্তা নিয়ে আলোচনা চলছে সেই ১৯৫৩ সাল থেকে। গত ৭০ বছরে আলোচনা করে কোনো সমাধানে আসা যায়নি। গঙ্গা নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে অবশ্য ২৫ বছর লেগেছিল। সেই চুক্তির মেয়াদও ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই দুই নদীবিষয়ক আলোচনার মধ্যে কম সময়েরটিই যদি ধরি, তাহলেও স্বীকৃত ৫৪ অভিন্ন নদীর জন্য ৫৪টি চুক্তি করতে ১ হাজার ৩৫০ বছর লেগে যাওয়ার কথা! যে কারণে অনেকে বলে আসছি, অভিন্ন নদীগুলোর জন্য একটি অভিন্ন ফর্মুলাভিত্তিক চুক্তি প্রয়োজন। আর স্থায়ী চুক্তির বদলে মেয়াদি চুক্তির বিপদ কী হতে পারে, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে আসার পথে টের পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া অভিন্ন নদীগুলোতে ভারত যেরকম একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার এবং ড্যাম বা ব্যারাজ নির্মাণ করছে, এর নজিরও বিশ্বে কম। আর ভূতল নদী দুই দেশের পানি কূটনীতির আওতায় আসবে কি না, সেই প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
আসলে বিভিন্ন নদীকে আড়াআড়ি ভাগ করে ১৯৪৭ সালে যেভাবে সীমানা নির্ধারণ হয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে নজিরবিহীন। বিশ্বের কোথাও আর এভাবে নদী কেটে সীমান্ত নির্ধারণ হয় না। যেমন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত নির্ধারণ করেছে রিও গ্রান্ডে নদী। সুইডেন-ফিনল্যান্ড সীমান্ত নির্ধারণ করেছে টর্ন নদী। চীন-রাশিয়া সীমান্ত নির্ধারণ করেছে আমুর নদী। এমনকি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নাফ নদী এবং ভারত-মিয়ানমারের মধ্যে তিয়াও নদ সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত বা তৎকালীন ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই ধ্রুপদি নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছিল। এতে অনিবার্যভাবেই ভাটির দেশ উজানের দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য।
তাহলে বাংলাদেশের জন্য করণীয় কী? এটা ঠিক, নদীতে যদি সীমান্তরেখা আড়াআড়ি বসে, তাহলে পানি কূটনীতি সহজ হয় না। ডাচ জার্নাল ‘ডিপ্লোম্যাটিকা’ এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বলে থাকে। প্রথমত, নদীপ্রবাহ যেহেতু গতিশীল এবং এর বাষ্পীভবন ও বৃষ্টির মাধ্যমে পুনর্ভরন ঘটে; এখানে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, নদীপ্রবাহ যেহেতু একই সঙ্গে একাধিক দেশের সীমারেখায় অবস্থান করতে পারে, সাগর কিংবা বনের মতো, এ ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের প্রথাগত ধারণা অচল। তৃতীয়ত, দেশভেদে নদীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা মাত্রা। সেটা অন্য দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। যেমন গঙ্গা ভারতের কাছে দেবীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। প্রতিবেশী দেশের কাছে সেই আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নাও থাকতে পারে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ পানি কূটনীতির তিনটি মাত্রা আছে। প্রথমত, এখানে প্রথাগত কূটনীতি চলবে না। কারণ নদী হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ, অন্যদিকে কূটনীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়। এই দুইয়ের মিশ্রণ ছাড়াও বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন, ঐতিহাসিক অবস্থানও যোগ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নদী যেহেতু বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহ, বিষয়টিকে নিছক পানিবণ্টনের ধারায় দেখলে চলবে না। নদীর নিজের প্রতিবেশগত অস্তিত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন তিস্তার ক্ষেত্রে শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে পানিপ্রবাহ ৫ থেকে ৬ হাজার কিউসেক। ভারতে যেমন গজলডোবা ব্যারাজ, তেমনই বাংলাদেশে রয়েছে ডালিয়া ব্যারাজ। দুই ব্যারাজের পানি প্রত্যাহারের সক্ষমতা ২৩ হাজার কিউসেক। পানিবণ্টন সম্ভব হলেও খোদ তিস্তার কী হবে?
তৃতীয়ত, পানি কূটনীতির ক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক তথ্য ও বৈজ্ঞানিক উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে যে অভিন্ন নদীগুলো একদা অভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। অভিন্ন অর্থনীতি, পরিবহন ও উৎপাদনব্যবস্থার অংশ ছিল। ফলে অভিন্ন নদীগুলোতে বাংলাদেশেরও অভিন্ন অধিকার আছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা এবং এর সুফল ভাগাভাগির প্রশ্ন অবশ্য বাংলাদেশ ও ভারতে ক্রমান্বয়ে জোরালো হচ্ছে। কিন্তু ভাটির দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরই না ব্যবস্থাপনা ও সুফল ভাগাভাগির প্রশ্ন।
লেখক: মহাসচিব, রিভারাইন পিপল
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪