আসিফ সালেহ
একটি দেশের আর্থসামাজিক বা সামগ্রিক উন্নয়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে প্রায় পাঁচ দশক ধরে কাজ করে চলেছে ব্র্যাক।
ব্র্যাকের সৃষ্টি স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের স্বপ্ন নিয়ে। বাংলাদেশ ও ব্র্যাক একেবারেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আজ ব্র্যাক যে এতটা বিস্তৃত, সুবিন্যস্ত, তার বড় কারণ—আমরা সব সময় দেশ ও মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচিগুলো সাজিয়েছি। যুগের সঙ্গে মানুষের সমস্যার যে রকম পরিবর্তন হয়েছে, চাহিদারও রূপান্তর ঘটেছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলতেন, মানুষের সমস্যা সব সময়ই থাকবে, তাই মানুষকে কেন্দ্র করেই তার মোকাবিলার পথ খুঁজতে হবে। তাই ব্র্যাক যে সমাধানগুলো নিয়ে আসে তা খুবই বাস্তবানুগ, প্রয়োগযোগ্য এবং সফলভাবে কার্যকর। গত শতকের সত্তরের দশকে আমাদের মনোযোগ ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণে। আশির দশকে ছিল টিকাদান কর্মসূচি এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানো। নব্বইয়ের দশকে ছিল শিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে আসা। এ রকম বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন বিষয় বড় করেছি।
এখন হাতে নিয়েছি তরুণ প্রজন্মের আত্মোন্নয়নের কাজ। এখন দেখছি যে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে ব্র্যাককে বড় পরিসরে কাজ করতে হবে। আগামী দশকগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তন প্রাধান্য পাবে। এখানে কোনো মডেল তৈরি করা যায় কি না, সেটি নিয়ে কাজ করব। মোদ্দা কথা হলো, স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর মূল্যবোধগুলো আমাদের সংগঠন-প্রতিষ্ঠানে দিয়ে গেছেন; পাশাপাশি আমাদের কিছু পন্থা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এগুলোকে শক্ত খুঁটি হিসেবে ধরে নতুন নতুন ক্ষেত্রে আমরা আগামী দিনগুলোয় কাজ করব।
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের কার্যক্রম সরকারের বিকল্প নয়, বরং অবশ্যই সহায়ক। সরকারকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সহায়তা করার লক্ষ্যে ব্র্যাক ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চার লাখ পরিবারকে অতি দারিদ্র্য থেকে দূরে রাখার লক্ষ্য নিয়েছিল। এই লক্ষ্যমাত্রা একই সময়ের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রার ২১ দশমিক ৪ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল বা গত চার বছরে ব্র্যাক ৩ লাখ ১৪ হাজার ২১৭টি পরিবারকে অতি দারিদ্র্য জয়ে সক্ষম করে তুলেছে। ২০১৬ সালে গৃহীত পাঁচ বছরের কৌশলগত পরিকল্পনায় ব্র্যাক আটটি কর্মসূচির মাধ্যমে এসডিজি অর্জনে তার করণীয় নির্ধারণ করে। এগুলো হচ্ছে চরম দারিদ্র্য দূর করা, আর্থিক ক্ষমতায়ন, শোভন কাজের জন্য নিয়োগযোগ্য দক্ষতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, জেন্ডার সমতা, শিক্ষার মান উন্নয়ন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নত পুষ্টি এবং দরিদ্রবান্ধব নগর উন্নয়ন। ব্র্যাক এখন দেশের সবচেয়ে নিম্নবিত্ত ও বঞ্চিত নারী-পুরুষের ভেতরের দুই কোটি মানুষের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ সব সময়ই বলতেন, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত ও চাহিদা অনুসারে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সেবা পৌঁছে দিতে হবে। সে অনুযায়ী ব্র্যাকের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্র্যাক ছাড়া অনেক এনজিওই বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর। এই সেক্টর দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জায়গা। বিদেশি সাহায্য কমে যাওয়ায় এরা হুমকির মুখে পড়েছে বলে তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়নকাজও ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে বেসরকারি উন্নয়নচিন্তায় পরিবর্তন প্রয়োজন আছে। তবে মোটাদাগে বলতে গেলে যত দ্রুত পরিবর্তন আসা উচিত, তত তাড়াতাড়ি আসছে না। এখানে নেতৃত্বের অভাব আছে। এটা পরিবর্তন করা জরুরি। আগামী দশকে বা পরবর্তী সময়ে আমাদের কাজটা হবে, মূলত যেসব নতুন ধরনের সমস্যা আবির্ভূত হচ্ছে, সেগুলো মোকাবিলা করা। যদি বলি শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের কথা, তাহলে দেখব এসব সেবার জন্য মানুষের বড় অংশ যাচ্ছে বেসরকারি খাতের কাছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কম, কিন্তু মানসম্মত সেবা পাচ্ছে না, সে কারণে মানুষ ব্যক্তি খাতে যাচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার একেকটা মর্মান্তিক গল্প শুনছি। এ জায়গায় সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ দরকার। এটা মুনাফাতাড়িত নয়। এখানে চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া।
এ সেবার জন্য মানুষ টাকা দিতে রাজি। এ অর্থ দিয়ে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান ধরে রাখতে পারব। এ রকম অনেক সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের পেছনে আরও উদ্যোগ যুক্ত হওয়া উচিত। সামগ্রিকভাবে এনজিও খাতকে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। আশার দিক হলো, তরুণেরা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে ভাবছেন। উদ্যোগও নিয়েছেন। একটা উদাহরণ দিই। আমাদের ছোট একটা সাহায্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল ভূমিজ নামে একটি সংগঠন, যারা পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করে। তারা এনজিও নয়। তারা এটাকে একটা সামাজিক ব্যবসা হিসেবেই দেখছে। এসব জায়গায় কোনো ব্যক্তি খাত আসবে না। এখানে আসলে কোনো মুনাফা নেই। মুনাফা পেতে অনেক বছর লাগবে। এ কাজ করতে গিয়ে ভূমিজ হয়তো কিছু অনুদান পাচ্ছে। অনুদানের ওপর তাদের একটা কর দিতে হচ্ছে। যেহেতু তারা এনজিও নয়। তারা কিছু জায়গায় মেইনটেন্যান্সের কাজ নিচ্ছে, পাবলিক টয়লেট করে দিচ্ছে। কিছু জায়গায় বাজার সমিতির সঙ্গে কথা বলে টয়লেটগুলো উন্নত করছে। এখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ব্যবসা—দুটো মিলে তরুণ প্রজন্মের সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। এসব জায়গায় অনেক সুযোগ রয়েছে। তরুণেরা এগিয়ে এলে ব্র্যাক যেমন তাঁদের সহায়তা করবে, সরকারেরও সহায়তা করা উচিত। এখানেই বড় ভবিষ্যৎ আছে, যেখানে সামাজিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা হবে, অর্থায়নেরও চিন্তা করতে হবে না, সরকারও মনে করতে পারবে যে এটা যেহেতু মুনাফাতাড়িত নয়, সেহেতু জনগণের কল্যাণও নিশ্চিত হবে।
আগামী ১০ বছরে আমরা ব্র্যাককে একটি স্থবির সংগঠন হিসেবে দেখতে চাই না, যেটি আমাদের প্রতিষ্ঠাতাও চাইতেন না। আমরা দেখতে চাই ব্র্যাক হবে একটি গতিশীল সংস্থা, যেটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। আকারে বড় হলেও এটি যেন দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। এর সামষ্টিক নেতৃত্ব আছে। এটি কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। এখানে নতুন মানদণ্ড তৈরির একটা সংস্কৃতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ যাতে মনে করতে পারে, ব্র্যাক সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান নিয়ে আসতে পারে। আমরা যদি উদ্ভাবনগুলো নিয়ে আসতে পারি। সেগুলো যদি আমরা সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, আমার কাছে মনে হয়, সেটি হবে সবচেয়ে বড় সাফল্য।
তবে আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা, তরুণদের নিয়ে অনেক বেশি কাজ করব। তারুণ্যের সুবিধা আমরা আর বেশি দিন পাব না। ২০৩৩ সাল পর্যন্ত থাকবে। প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি বাড়ানোসহ নানা কারণে এখন তরুণদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। আমি মনে করি, তরুণেরা যাতে মনে করেন, ব্র্যাক তাঁদের সংগঠন। তাঁদের ধারণাগুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাঁদের জন্য কাজ করে। ব্র্যাক তরুণদের প্রিয় একটা সংগঠন যেন হতে পারে।
শেষটায় বলতে চাই, আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে শিক্ষায়। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে অনেক কাজ করেছি। আমাদের আসলে কাজ করতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে। বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে মানসম্পন্ন মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রয়োজন ও চাহিদা আছে। এখানে আমাদের ভয়াবহ দুরবস্থা। বেশির ভাগই বেসরকারি বিদ্যালয়ের ওপর নির্ভরশীল। সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। একটা ডিগ্রি নেব, চাকরিতে ঢুকব, চাকরি শেষে অবসর নেব। ক্যারিয়ারের শুরুতে একটা টানেলের মধ্যে ঢুকব, রিটায়ারমেন্ট করে টানেল থেকে বের হব—ওই ধারণা পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আপনার একজীবনে তিন-চার রকমের ক্যারিয়ার হবে। আপনি হয়তো পার্টটাইম এখানে-ওখানে কাজ করবেন। ২০১০ থেকে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ঢের পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবর্তনের গতিটা ক্রমেই বাড়ছে। টেকনিক্যাল স্কিলের চেয়ে লার্নিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কত দ্রুত শিখতে পারছি, কত দ্রুত অভিযোজন করতে পারছি। এর মূলটা হবে প্রথম ১২ বছরের শিক্ষায়—প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে। ভিত্তি ঠিক না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে বিশ্লেষণ সক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং সফট স্কিলস খুব দরকার। এসব জায়গায় কাজ হচ্ছে না। এখন সরকার নতুন একটা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করছে। আমরা আশা করছি, এ পাঠ্যক্রমে এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে।
বর্তমান অর্থনীতিতে অনেক ধরনের কাজের সুযোগ আছে। যেহেতু বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে অনেক বেশি সংযুক্ত। সে কারণেও বিকল্প উপায়গুলো অনুসন্ধান করা জরুরি। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমন্বয় করা গেলে অনেক দূর যাওয়া যাবে। বাংলাদেশের বড় শক্তি হলো বিশাল জনসংখ্যা। এ জনসংখ্যা যদি কিছুটা দক্ষ হয়, তাহলে ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারব। আমার কাছে এখন উন্নত দেশ হওয়ার চেয়ে বড় বিষয় হলো, আমরা যেন মধ্যম আয়ের ফাঁদে না পড়ি। এ জায়গায় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশই কিন্তু আটকে গেছে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, অনেক মানুষ আছে। আগামী দিনগুলোয় আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদাগুলো অনেক বাড়বে। অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড় হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার উপযোগী জনগোষ্ঠীকে গড়ে তুলতে পারলে আমরা বিশ্ববাজারের দিকেও এগোতে পারব।
আসিফ সালেহ, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক
একটি দেশের আর্থসামাজিক বা সামগ্রিক উন্নয়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে প্রায় পাঁচ দশক ধরে কাজ করে চলেছে ব্র্যাক।
ব্র্যাকের সৃষ্টি স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের স্বপ্ন নিয়ে। বাংলাদেশ ও ব্র্যাক একেবারেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আজ ব্র্যাক যে এতটা বিস্তৃত, সুবিন্যস্ত, তার বড় কারণ—আমরা সব সময় দেশ ও মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচিগুলো সাজিয়েছি। যুগের সঙ্গে মানুষের সমস্যার যে রকম পরিবর্তন হয়েছে, চাহিদারও রূপান্তর ঘটেছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলতেন, মানুষের সমস্যা সব সময়ই থাকবে, তাই মানুষকে কেন্দ্র করেই তার মোকাবিলার পথ খুঁজতে হবে। তাই ব্র্যাক যে সমাধানগুলো নিয়ে আসে তা খুবই বাস্তবানুগ, প্রয়োগযোগ্য এবং সফলভাবে কার্যকর। গত শতকের সত্তরের দশকে আমাদের মনোযোগ ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণে। আশির দশকে ছিল টিকাদান কর্মসূচি এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানো। নব্বইয়ের দশকে ছিল শিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে আসা। এ রকম বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন বিষয় বড় করেছি।
এখন হাতে নিয়েছি তরুণ প্রজন্মের আত্মোন্নয়নের কাজ। এখন দেখছি যে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে ব্র্যাককে বড় পরিসরে কাজ করতে হবে। আগামী দশকগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তন প্রাধান্য পাবে। এখানে কোনো মডেল তৈরি করা যায় কি না, সেটি নিয়ে কাজ করব। মোদ্দা কথা হলো, স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর মূল্যবোধগুলো আমাদের সংগঠন-প্রতিষ্ঠানে দিয়ে গেছেন; পাশাপাশি আমাদের কিছু পন্থা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এগুলোকে শক্ত খুঁটি হিসেবে ধরে নতুন নতুন ক্ষেত্রে আমরা আগামী দিনগুলোয় কাজ করব।
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের কার্যক্রম সরকারের বিকল্প নয়, বরং অবশ্যই সহায়ক। সরকারকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সহায়তা করার লক্ষ্যে ব্র্যাক ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চার লাখ পরিবারকে অতি দারিদ্র্য থেকে দূরে রাখার লক্ষ্য নিয়েছিল। এই লক্ষ্যমাত্রা একই সময়ের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রার ২১ দশমিক ৪ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল বা গত চার বছরে ব্র্যাক ৩ লাখ ১৪ হাজার ২১৭টি পরিবারকে অতি দারিদ্র্য জয়ে সক্ষম করে তুলেছে। ২০১৬ সালে গৃহীত পাঁচ বছরের কৌশলগত পরিকল্পনায় ব্র্যাক আটটি কর্মসূচির মাধ্যমে এসডিজি অর্জনে তার করণীয় নির্ধারণ করে। এগুলো হচ্ছে চরম দারিদ্র্য দূর করা, আর্থিক ক্ষমতায়ন, শোভন কাজের জন্য নিয়োগযোগ্য দক্ষতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, জেন্ডার সমতা, শিক্ষার মান উন্নয়ন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নত পুষ্টি এবং দরিদ্রবান্ধব নগর উন্নয়ন। ব্র্যাক এখন দেশের সবচেয়ে নিম্নবিত্ত ও বঞ্চিত নারী-পুরুষের ভেতরের দুই কোটি মানুষের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ সব সময়ই বলতেন, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত ও চাহিদা অনুসারে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সেবা পৌঁছে দিতে হবে। সে অনুযায়ী ব্র্যাকের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্র্যাক ছাড়া অনেক এনজিওই বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর। এই সেক্টর দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জায়গা। বিদেশি সাহায্য কমে যাওয়ায় এরা হুমকির মুখে পড়েছে বলে তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়নকাজও ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে বেসরকারি উন্নয়নচিন্তায় পরিবর্তন প্রয়োজন আছে। তবে মোটাদাগে বলতে গেলে যত দ্রুত পরিবর্তন আসা উচিত, তত তাড়াতাড়ি আসছে না। এখানে নেতৃত্বের অভাব আছে। এটা পরিবর্তন করা জরুরি। আগামী দশকে বা পরবর্তী সময়ে আমাদের কাজটা হবে, মূলত যেসব নতুন ধরনের সমস্যা আবির্ভূত হচ্ছে, সেগুলো মোকাবিলা করা। যদি বলি শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের কথা, তাহলে দেখব এসব সেবার জন্য মানুষের বড় অংশ যাচ্ছে বেসরকারি খাতের কাছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কম, কিন্তু মানসম্মত সেবা পাচ্ছে না, সে কারণে মানুষ ব্যক্তি খাতে যাচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার একেকটা মর্মান্তিক গল্প শুনছি। এ জায়গায় সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ দরকার। এটা মুনাফাতাড়িত নয়। এখানে চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া।
এ সেবার জন্য মানুষ টাকা দিতে রাজি। এ অর্থ দিয়ে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান ধরে রাখতে পারব। এ রকম অনেক সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের পেছনে আরও উদ্যোগ যুক্ত হওয়া উচিত। সামগ্রিকভাবে এনজিও খাতকে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। আশার দিক হলো, তরুণেরা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে ভাবছেন। উদ্যোগও নিয়েছেন। একটা উদাহরণ দিই। আমাদের ছোট একটা সাহায্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল ভূমিজ নামে একটি সংগঠন, যারা পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করে। তারা এনজিও নয়। তারা এটাকে একটা সামাজিক ব্যবসা হিসেবেই দেখছে। এসব জায়গায় কোনো ব্যক্তি খাত আসবে না। এখানে আসলে কোনো মুনাফা নেই। মুনাফা পেতে অনেক বছর লাগবে। এ কাজ করতে গিয়ে ভূমিজ হয়তো কিছু অনুদান পাচ্ছে। অনুদানের ওপর তাদের একটা কর দিতে হচ্ছে। যেহেতু তারা এনজিও নয়। তারা কিছু জায়গায় মেইনটেন্যান্সের কাজ নিচ্ছে, পাবলিক টয়লেট করে দিচ্ছে। কিছু জায়গায় বাজার সমিতির সঙ্গে কথা বলে টয়লেটগুলো উন্নত করছে। এখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ব্যবসা—দুটো মিলে তরুণ প্রজন্মের সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। এসব জায়গায় অনেক সুযোগ রয়েছে। তরুণেরা এগিয়ে এলে ব্র্যাক যেমন তাঁদের সহায়তা করবে, সরকারেরও সহায়তা করা উচিত। এখানেই বড় ভবিষ্যৎ আছে, যেখানে সামাজিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা হবে, অর্থায়নেরও চিন্তা করতে হবে না, সরকারও মনে করতে পারবে যে এটা যেহেতু মুনাফাতাড়িত নয়, সেহেতু জনগণের কল্যাণও নিশ্চিত হবে।
আগামী ১০ বছরে আমরা ব্র্যাককে একটি স্থবির সংগঠন হিসেবে দেখতে চাই না, যেটি আমাদের প্রতিষ্ঠাতাও চাইতেন না। আমরা দেখতে চাই ব্র্যাক হবে একটি গতিশীল সংস্থা, যেটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। আকারে বড় হলেও এটি যেন দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। এর সামষ্টিক নেতৃত্ব আছে। এটি কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। এখানে নতুন মানদণ্ড তৈরির একটা সংস্কৃতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ যাতে মনে করতে পারে, ব্র্যাক সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান নিয়ে আসতে পারে। আমরা যদি উদ্ভাবনগুলো নিয়ে আসতে পারি। সেগুলো যদি আমরা সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, আমার কাছে মনে হয়, সেটি হবে সবচেয়ে বড় সাফল্য।
তবে আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা, তরুণদের নিয়ে অনেক বেশি কাজ করব। তারুণ্যের সুবিধা আমরা আর বেশি দিন পাব না। ২০৩৩ সাল পর্যন্ত থাকবে। প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি বাড়ানোসহ নানা কারণে এখন তরুণদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। আমি মনে করি, তরুণেরা যাতে মনে করেন, ব্র্যাক তাঁদের সংগঠন। তাঁদের ধারণাগুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাঁদের জন্য কাজ করে। ব্র্যাক তরুণদের প্রিয় একটা সংগঠন যেন হতে পারে।
শেষটায় বলতে চাই, আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে শিক্ষায়। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে অনেক কাজ করেছি। আমাদের আসলে কাজ করতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে। বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে মানসম্পন্ন মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রয়োজন ও চাহিদা আছে। এখানে আমাদের ভয়াবহ দুরবস্থা। বেশির ভাগই বেসরকারি বিদ্যালয়ের ওপর নির্ভরশীল। সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। একটা ডিগ্রি নেব, চাকরিতে ঢুকব, চাকরি শেষে অবসর নেব। ক্যারিয়ারের শুরুতে একটা টানেলের মধ্যে ঢুকব, রিটায়ারমেন্ট করে টানেল থেকে বের হব—ওই ধারণা পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আপনার একজীবনে তিন-চার রকমের ক্যারিয়ার হবে। আপনি হয়তো পার্টটাইম এখানে-ওখানে কাজ করবেন। ২০১০ থেকে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ঢের পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবর্তনের গতিটা ক্রমেই বাড়ছে। টেকনিক্যাল স্কিলের চেয়ে লার্নিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কত দ্রুত শিখতে পারছি, কত দ্রুত অভিযোজন করতে পারছি। এর মূলটা হবে প্রথম ১২ বছরের শিক্ষায়—প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে। ভিত্তি ঠিক না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে বিশ্লেষণ সক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং সফট স্কিলস খুব দরকার। এসব জায়গায় কাজ হচ্ছে না। এখন সরকার নতুন একটা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করছে। আমরা আশা করছি, এ পাঠ্যক্রমে এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে।
বর্তমান অর্থনীতিতে অনেক ধরনের কাজের সুযোগ আছে। যেহেতু বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে অনেক বেশি সংযুক্ত। সে কারণেও বিকল্প উপায়গুলো অনুসন্ধান করা জরুরি। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমন্বয় করা গেলে অনেক দূর যাওয়া যাবে। বাংলাদেশের বড় শক্তি হলো বিশাল জনসংখ্যা। এ জনসংখ্যা যদি কিছুটা দক্ষ হয়, তাহলে ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারব। আমার কাছে এখন উন্নত দেশ হওয়ার চেয়ে বড় বিষয় হলো, আমরা যেন মধ্যম আয়ের ফাঁদে না পড়ি। এ জায়গায় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশই কিন্তু আটকে গেছে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, অনেক মানুষ আছে। আগামী দিনগুলোয় আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদাগুলো অনেক বাড়বে। অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড় হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার উপযোগী জনগোষ্ঠীকে গড়ে তুলতে পারলে আমরা বিশ্ববাজারের দিকেও এগোতে পারব।
আসিফ সালেহ, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪