লুৎফর রহমান রিটন
ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ চাই, সে বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূরের একটি দেশে আমার যাপিত জীবন, সাম্প্রতিক ভৌগোলিক অবস্থান, পরিপার্শ্ব এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাটা তুলে ধরতে হবে।
০২. ২২ বছর হতে চলল কানাডায় থিতু হয়েছি। তার আগেই ইংল্যান্ড-জার্মানি-ফ্রান্স-আমেরিকা-জাপানসহ পৃথিবীর নানা দেশের নানা শহরে সপরিবারে ভ্রমণ এবং স্বল্পকালীন অবস্থানের সুবাদে একটা বিষয় জানা হয়ে গিয়েছিল, আর তা হচ্ছে স্বদেশনিবাসী এবং বিদেশপ্রবাসী বাঙালিদের একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য অংশই বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী। আবার এই বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী বাঙালিদের সিংহভাগই ইংরেজি জানা।
আড়াই কলম ইংরেজি জানা বাঙালিদের বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষের কারণ খুঁজতে গিয়ে লক্ষ করেছি—জামায়াত-বিএনপিজাত পাকিস্তানিদের ছানাপোনারা বংশানুক্রমিকভাবেই উত্তরাধিকারটি বহন করছে। কিন্তু তার বাইরে আপাতশিক্ষিত একটা এলিট শ্রেণির সদস্যরাও একই রোগে আক্রান্ত। এই শ্রেণিটা নীরব ঘাতকের মতো। সরাসরি জামায়াতি না হলেও এরা প্রধানত বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী, তারপর শেখ হাসিনাবিরোধী এবং দিন শেষে প্রচণ্ড আওয়ামীবিরোধী। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীবিরোধিতা করতে করতে একপর্যায়ে ওরা জামায়াতিদের কোলে গিয়ে সমর্পিত হয়।
নিজের অবস্থান আরেকটি মহাদেশে হলেও জাতীয় নির্বাচনে ওরা জামায়াত-বিএনপির রোলটাই প্লে করে। স্বদেশে থাকা আত্মীয়-পরিজনের কাছে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি এরা আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে বিএনপি, প্রয়োজনে জামায়াত প্রার্থীকে জয়ী করার নির্দেশ পাঠায়। আসুক বিএনপি, আসুক জামায়াত; কিন্তু আওয়ামী লীগকে ঠেকাতেই হবে। প্রয়োজনে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে হবে; কিন্তু আওয়ামী লীগকে ঠেকাও।
আপাতশিক্ষিত এলিট শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী স্বদেশনিবাসী এবং বিদেশপ্রবাসীদের অধিকাংশই ধনাঢ্য। পরিপাটি পোশাক কিংবা ঝাঁ-চকচকে গাড়ি এবং অভিজাত এলাকায় দামি বাড়িতে এদের বসবাস। পেশায় এরা প্রায়শ সফল, সরকারি উচ্চ পদে আসীন অথবা বিশাল এনজিও কর্তা। প্রতিরাতে স্যুট-কোট-টাই, বাহারি পাঞ্জাবি কিংবা শাড়ি-টিপ-চশমা পরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক শোতে এরা উপস্থিত হয়। তারপর ইনিয়ে-বিনিয়ে গরু রচনাকে নদীতে নিয়ে না ফেলা পর্যন্ত এদের প্যারেড শেষ হয় না। প্রবাসেও সক্রিয় এদের প্রতিনিধিরা।
প্রবাসী বাঙালি পরিবারের একান্ত আড্ডা বা পার্টিতেও এরা পরস্পর ইংরেজিতে কথা বলে। এই শ্রেণির পালোয়ানরা তাদের বাতচিতের বিষয়বস্তু হিসেবে খুব দ্রুতই বাংলাদেশ-শেখ হাসিনা-আওয়ামী লীগ হয়ে শেষমেশ বঙ্গবন্ধুর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারপর্বে এসে সমাপ্ত হয়।বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কথা না বললে এদের আত্মার শান্তি হয় না। সলিড একটা ঘুম হয় না।
স্বদেশনিবাসী এবং বিদেশপ্রবাসী এলিট শ্রেণির প্রতিনিধিরা টুঙ্গিপাড়া নামের অখ্যাত একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা মৃত্তিকাসংলগ্ন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। শ্রেণিগত একটা দূরত্ব অনুভব করা বা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতে থাকা এই শ্রেণি তাই চিরশত্রুভাবাপন্ন বঙ্গবন্ধুর প্রতি।
এই শ্রেণির সঙ্গে আরেকটি শ্রেণির খুব মিল। এরাও শিক্ষিত, ইংরেজিতে পক্ব-দক্ষ। দর্শন-রাজনীতি, ধর্ম-ইতিহাস, সাহিত্য-পেইন্টিংস, মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-ফুকো-দেরিদা, ন্যারেটিভ-রিকনসিলিয়েশন-হেজিমনি থিওরি কপচানোতেও অতিশয় দক্ষ। দিন শেষে এরাও হাসিনা-আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষী। সরকারের সমালোচনা করা যেতেই পারে; কিন্তু অযৌক্তিক এত বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষ কেন?
আপাতশিক্ষিত ইংরেজি জানা বঙ্গীয় এলিট সোসাইটি এবং শিল্প ও দর্শনবোদ্ধা বঙ্গসন্তানদের এই দুই শ্রেণির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। খুব দ্রুতই আমি এদের সঙ্গ ত্যাগে কামিয়াব হই। প্রবাসী বাঙালিদের এ রকম আড্ডা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। তারপরও নিয়তি আমার পিছু ছাড়ে না। কী করে যেন মোলাকাত হয়ে যায় এদের সঙ্গে।
০৩. সেবা প্রকাশনীর বিখ্যাত অনুবাদক-লেখক রওশন জামিল ছিলেন ঢাকায় আমার মহল্লাকা বড়া ভাই। আমি থাকতাম ওয়ারীর হেয়ার স্ট্রিটে আর তিনি ঠাটারিবাজার বিসিসি রোডে। রওশন ভাই আমার বহু আগেই থিতু হয়েছেন নিউইয়র্কে। টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়। ফেসবুকে তাঁর স্ট্যাটাস দেখি নিয়মিত।
নিউইয়র্কপ্রবাসী আবেদিন কাদের একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিউজ প্রডিউসার ছিলেন। বিদ্বান মেধাবী এই মানুষ নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনিও মোটামুটি সক্রিয়, ফেসবুকে। এই দুজন জ্ঞানী মানুষ আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।
বছর তিনেক আগে, রওশন জামিল ফেসবুকে নিজের একটি স্ট্যাটাসে লিখলেন, ‘বদরুদ্দীন উমরের বুদ্ধিজীবিতার বড় কৃতিত্ব, তিনি তাঁর বুঝের সঙ্গে আপস করেননি কখনো। ক্ষমতার খয়ের খাঁগিরি করেননি, যেটা তাঁর সমসাময়িকেরা কম-বেশি প্রায় সবাই করেছেন, করে যাচ্ছেন। বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অমত করতে পারি, কিন্তু তাঁর সততাকে সালাম ঠুকতেই হয়।’
শিক্ষিত এলিট বদরুদ্দীন উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা নিয়ে আমার দ্বিমত ছিল। আমি তাই মন্তব্যের ঘরে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম এইভাবে—‘বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অমত করতে পারি, কিন্তু তাঁর সততাকে সালাম ঠুকতেই হয়।—সততা?’
আবেদিন কাদের প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘Yes, honest, I consider him intellectually honest...’
সাধারণত ফেসবুকে আমি কোনো বাহাসেই অংশ নিই না। কম্পোজ বা টাইপিংয়ে আলস্যের কারণে এমনিতেই আমার প্রচুর পরিকল্পনা অলিখিতই থেকে যায়। যতটা সময় খরচ করে আমি একটা বাহাস করব, টাইপ করব, ততটা সময় ব্যয় করলে অনায়াসেই একটা ছড়া লেখা হয়ে যায়। আমি তাই দ্বিতীয়টাই প্রেফার করি। শামিল হই না তর্কে।
কিন্তু আবেদিন কাদেরের উত্তরটা, বিশেষ করে ‘I consider him intellectually honest’ বাক্যটির জবাব দেওয়া জরুরি মনে করে মূল স্ট্যাটাসদাতা রওশন জামিলকে ফোন করে বিষয়টা ব্যাখ্যা করি।
জনাব বদরুদ্দীন উমরের একটা আত্মকথা ধরনের স্মৃতিগদ্য ঢাকার ২০০০ কিংবা সাপ্তাহিক-এ খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। একটি পর্বে তিনি উনসত্তরের ঢাকার বিশেষ একটি দিনের বর্ণনা করছিলেন। নবাবপুর রোডের কম দামি হোটেলের গমগমে ভিড়ের আড্ডায় সাধারণ মধ্যবিত্ত নাগরিকদের চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার টুকরো টুকরো ঘটনার বয়ান তিনি করছিলেন।
নবাবপুর রোড থেকে জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ), বায়তুল মোকাররম স্টেডিয়াম অঞ্চলের বিপুল জনস্রোতের ডিটেইল একটি চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলছিলেন। সেদিনের বিকেলের উল্লেখযোগ্য প্রায় সবকিছুই উঠে এসেছিল তাঁর রচনায়, শুধু একটি বিষয় ছাড়া।সবকিছুই অবলোকন করেছিলেন তিনি সেই বিকেলের, শুধু একটি বিষয় ছাড়া। আর সেটা হচ্ছে—ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদের শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া। উনসত্তরের ২৩ ফেব্রুয়ারির সেই বিকেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল সেটা।
এত কিছু আমি কমেন্টে লিখতে অনাগ্রহী বলে টেলিফোনে রওশন জামিলকে খুলে বলেছিলাম। রওশন সে কথা উল্লেখ করেছিলেন তাঁর প্রত্যুত্তরের ঘরে– ‘কাল রিটনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওর আপত্তির জায়গা বদরুদ্দীন উমরের বৌদ্ধিক চর্চায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কৃতিত্ব না দেওয়া বা যেমন একটি দিনের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় বা তাঁর ডায়েরিধর্মী লেখায় সাধারণ সব ঘটনার কথা এসেছে, কিন্তু সেদিন যে শেখ মুজিবকে পল্টন ময়দানে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেওয়া হয়েছিল, সেই ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়নি; যা এ দেশের প্রেক্ষাপটে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। সে কারণে রিটন বলতে চাইছে, উমরের “মুজিববিদ্বেষ” তাঁর (উমরের) বৌদ্ধিক সততার পরিচয় দেয় না।’
রওশনের এই মন্তব্যের জবাবে আবেদিন লিখলেন, ‘সেটা রিটন বলতেই পারেন। কিন্তু তাতে উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। একজন মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জীবনের কোনো লেখায় উল্লেখ না করেও বৌদ্ধিকভাবে সৎ থাকতে পারেন।’
আবেদিনের জবাবের প্রত্যুত্তরে আমি শুধু লিখলাম, ‘মারহাবা!’ ‘কিন্তু তাতে উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না’ শোনার পরে ‘মারহাবা’ বলা ছাড়া কী আর বলতে পারতাম সংক্ষেপে!
০৪. কিছুদিন আগে নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকার একটা চমৎকার বুকশপে গিয়েছিলাম বন্ধু দিনু বিল্লাহর সঙ্গে। ওখানে একটা র্যাকে পেঙ্গুইন সাইজের ছোট্ট একটা বইয়ের দিকে তাকাতেই প্রচ্ছদে মুদ্রিত BANGLADESH শব্দটায় আমার চোখ আটকে গেল। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলাম।
বইটির নাম The essential guide to customs & culture BANGLADESH. বইটি CULTURE SMART সিরিজের একটি প্রকাশনা। প্রকাশিত হয়েছে লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে। লিখেছেন লেখক-সাংবাদিক ঊর্মি রহমান। আকর্ষণীয় মেকআপ গেটআপ-সমৃদ্ধ ১৬৮ পৃষ্ঠার চমৎকার এই বইয়ে ৯টি চ্যাপ্টারে বিভিন্নশিরোনামে অনেক এন্ট্রি আছে।
প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভুক্তি। আছে পাতায় পাতায় প্রাসঙ্গিক অনেক ছবি। যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনার সঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি আছে। কিন্তু সত্তরের নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিপুল বিজয় এবং ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কিংবা ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বর্ণনায় শেখ মুজিবের কোনো ছবি নেই। অথচ প্রফেসর ইউনূসের ছবি আছে গ্রামীণ ব্যাংকের বর্ণনায়।
বইটির সঙ্গে ব্যবহারের জন্য প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় ছবিগুলো সরবরাহ করেছেন কে? অনুমান করি, স্বয়ং লেখক নিশ্চয়ই। সেটাই হওয়ার কথা। তাই যদি হয়, তবে আমার প্রশ্ন—বঙ্গবন্ধুর ছবি কই? বাংলাদেশের পরিচিতিমূলক একটা গাইডবই বা পুস্তিকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাড়া কি পরিপূর্ণ হয়? হয় না। বাংলাদেশের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই যে মানুষের ছবি সবার আগে দীপ্যমান হয়ে ওঠে, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানের, বাংলাদেশের স্থপতির। পায়ে কাদামাটি মাখা যিনি উঠে এসেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মৃত্তিকা থেকে। বঙ্গবন্ধু ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিষয়ে তথাকথিত শিক্ষিতদের এই বিদ্বেষপ্রবণতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতেই হবে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে গেলে।
কোনো রূপকথার দেশ নয় আমার বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্রোতের ওপর জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশটির। চার বছরের মাথায় স্বাধীনতার বিরুদ্ধ পক্ষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর স্বাধীন বাংলাদেশ ইউটার্ন নিয়েছিল পাকিস্তানের দিকে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার একটা পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছিল। এরপর টানা একুশ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্বাসিত।
শেখ মুজিবুর রহমান নামটা প্রায় মুছেই ফেলা হয়েছিল ইতিহাস থেকে। সংবিধানকে কেটে-ছিঁড়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেওয়া হয়েছিল দায়মুক্তি। একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক-রাজাকার-আলবদরদের গাড়িতে উড়ছিল ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজ পতাকাটি।
একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। আবার একটা ইউটার্ন নেয় বাংলাদেশ। এবার স্বাধীনতার দিকে। মিনি পাকিস্তান পুনরায় বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। জাতির পিতার খুনিদের বিচারকাজ শুরু হয়। ধাপে ধাপে দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ায় আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন খুনিদের। সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে মোচন করা সম্ভব হয় বাংলাদেশের কপালে লেপ্টে থাকা কলঙ্কতিলকটি। কলঙ্কমুক্ত হয় বাংলাদেশ।
অতঃপর মানবতাবিরোধী বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীর বিচার এবং আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে আরেক দফা শুদ্ধ হয় বাংলাদেশ। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিনাশ হয় না। দালাল-রাজাকারদের ছানাপোনা সক্রিয় থাকে রাজনীতিতে। ফলে পরিস্থিতি মোটেও স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অনুকূলে থাকে না
একাত্তরের পরাজিত শক্তির ছানাপোনাদের সঙ্গে আড়াই কলম ইংরেজি জানা শিক্ষিত এলিট শ্রেণিটি সংহতি প্রকাশ করে প্রায়ই বিভিন্ন ব্যানারের আনুষ্ঠানিকতায়। স্যাটেলাইট টিভির রাতের টক শোগুলোতে তারা নানান থিওরি কপচায়। এদের পোশাকি নাম সুশীল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ এবং তার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ব্যাখ্যায় তারা শৃগালচাতুর্যে ‘ন্যারেটিভ-রিকনসিলিয়েশন-ডায়ালেক্ট-হেজিমনি’ ইত্যাকার শব্দের তুবড়ি ছুটিয়ে এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি করে যে তখন খুব সাধারণ মানুষের কাছে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’কেও মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র।
যে চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে—একাত্তরে পাকিস্তানি সৈনিকদের হত্যালীলা ও পৈশাচিক ধর্ষণকালে ধর্ষক পাকিস্তানি সৈন্যের প্রেমে আকুল বাঙালি মেয়েটি তার বাবার কাছে কান্নাকাটি করে বলছে, ‘বাবা, আমাকে সৈন্য এনে দাও...সৈন্য এনে দাও!’
একাত্তরের পরাজিত শক্তির ছানাপোনা এবং আড়াই কলম ইংরেজি জানা বাংলাদেশবিরোধী এই দুই শ্রেণিকে সঠিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রতিহত করার মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে আগামী দিনের বাংলাদেশকে।
একাত্তরের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ, পঁচাত্তরের পর পাকিস্তানের দিকে ক্ষিপ্রগতিতে ধাবমান বাংলাদেশ যে ছিয়ানব্বইয়ের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, সেই অগ্রযাত্রা মাঝখানে বছরকয়েক বিপর্যস্ত হয়ে পুনরায় সঠিক ট্র্যাকে চলমান। বাংলাদেশ এখন আর ‘বটমলেস বাস্কেট’ নয়।
আমি সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যে বাংলাদেশে একটি শিশুও অনাহারে থাকবে না। প্রত্যেক শিশুর পরনে পোশাক থাকবে। প্রত্যেক শিশু বাসযোগ্য ঘর পাবে। প্রত্যেক শিশু স্কুলে যাবে, অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাবে। যদি একটি শিশুও ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমুতে যায়, তাহলে আমাদের সমস্ত অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। একজন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে প্রত্যেক শিশুর পাঁচটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত দেখতে চাই আমি।
অটোয়া, ২০ জুলাই ২০২৩
লেখক: শিশুসাহিত্যিক
ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ চাই, সে বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূরের একটি দেশে আমার যাপিত জীবন, সাম্প্রতিক ভৌগোলিক অবস্থান, পরিপার্শ্ব এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাটা তুলে ধরতে হবে।
০২. ২২ বছর হতে চলল কানাডায় থিতু হয়েছি। তার আগেই ইংল্যান্ড-জার্মানি-ফ্রান্স-আমেরিকা-জাপানসহ পৃথিবীর নানা দেশের নানা শহরে সপরিবারে ভ্রমণ এবং স্বল্পকালীন অবস্থানের সুবাদে একটা বিষয় জানা হয়ে গিয়েছিল, আর তা হচ্ছে স্বদেশনিবাসী এবং বিদেশপ্রবাসী বাঙালিদের একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য অংশই বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী। আবার এই বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী বাঙালিদের সিংহভাগই ইংরেজি জানা।
আড়াই কলম ইংরেজি জানা বাঙালিদের বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষের কারণ খুঁজতে গিয়ে লক্ষ করেছি—জামায়াত-বিএনপিজাত পাকিস্তানিদের ছানাপোনারা বংশানুক্রমিকভাবেই উত্তরাধিকারটি বহন করছে। কিন্তু তার বাইরে আপাতশিক্ষিত একটা এলিট শ্রেণির সদস্যরাও একই রোগে আক্রান্ত। এই শ্রেণিটা নীরব ঘাতকের মতো। সরাসরি জামায়াতি না হলেও এরা প্রধানত বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী, তারপর শেখ হাসিনাবিরোধী এবং দিন শেষে প্রচণ্ড আওয়ামীবিরোধী। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীবিরোধিতা করতে করতে একপর্যায়ে ওরা জামায়াতিদের কোলে গিয়ে সমর্পিত হয়।
নিজের অবস্থান আরেকটি মহাদেশে হলেও জাতীয় নির্বাচনে ওরা জামায়াত-বিএনপির রোলটাই প্লে করে। স্বদেশে থাকা আত্মীয়-পরিজনের কাছে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি এরা আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে বিএনপি, প্রয়োজনে জামায়াত প্রার্থীকে জয়ী করার নির্দেশ পাঠায়। আসুক বিএনপি, আসুক জামায়াত; কিন্তু আওয়ামী লীগকে ঠেকাতেই হবে। প্রয়োজনে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে হবে; কিন্তু আওয়ামী লীগকে ঠেকাও।
আপাতশিক্ষিত এলিট শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী স্বদেশনিবাসী এবং বিদেশপ্রবাসীদের অধিকাংশই ধনাঢ্য। পরিপাটি পোশাক কিংবা ঝাঁ-চকচকে গাড়ি এবং অভিজাত এলাকায় দামি বাড়িতে এদের বসবাস। পেশায় এরা প্রায়শ সফল, সরকারি উচ্চ পদে আসীন অথবা বিশাল এনজিও কর্তা। প্রতিরাতে স্যুট-কোট-টাই, বাহারি পাঞ্জাবি কিংবা শাড়ি-টিপ-চশমা পরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক শোতে এরা উপস্থিত হয়। তারপর ইনিয়ে-বিনিয়ে গরু রচনাকে নদীতে নিয়ে না ফেলা পর্যন্ত এদের প্যারেড শেষ হয় না। প্রবাসেও সক্রিয় এদের প্রতিনিধিরা।
প্রবাসী বাঙালি পরিবারের একান্ত আড্ডা বা পার্টিতেও এরা পরস্পর ইংরেজিতে কথা বলে। এই শ্রেণির পালোয়ানরা তাদের বাতচিতের বিষয়বস্তু হিসেবে খুব দ্রুতই বাংলাদেশ-শেখ হাসিনা-আওয়ামী লীগ হয়ে শেষমেশ বঙ্গবন্ধুর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারপর্বে এসে সমাপ্ত হয়।বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কথা না বললে এদের আত্মার শান্তি হয় না। সলিড একটা ঘুম হয় না।
স্বদেশনিবাসী এবং বিদেশপ্রবাসী এলিট শ্রেণির প্রতিনিধিরা টুঙ্গিপাড়া নামের অখ্যাত একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা মৃত্তিকাসংলগ্ন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। শ্রেণিগত একটা দূরত্ব অনুভব করা বা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতে থাকা এই শ্রেণি তাই চিরশত্রুভাবাপন্ন বঙ্গবন্ধুর প্রতি।
এই শ্রেণির সঙ্গে আরেকটি শ্রেণির খুব মিল। এরাও শিক্ষিত, ইংরেজিতে পক্ব-দক্ষ। দর্শন-রাজনীতি, ধর্ম-ইতিহাস, সাহিত্য-পেইন্টিংস, মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-ফুকো-দেরিদা, ন্যারেটিভ-রিকনসিলিয়েশন-হেজিমনি থিওরি কপচানোতেও অতিশয় দক্ষ। দিন শেষে এরাও হাসিনা-আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষী। সরকারের সমালোচনা করা যেতেই পারে; কিন্তু অযৌক্তিক এত বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষ কেন?
আপাতশিক্ষিত ইংরেজি জানা বঙ্গীয় এলিট সোসাইটি এবং শিল্প ও দর্শনবোদ্ধা বঙ্গসন্তানদের এই দুই শ্রেণির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। খুব দ্রুতই আমি এদের সঙ্গ ত্যাগে কামিয়াব হই। প্রবাসী বাঙালিদের এ রকম আড্ডা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। তারপরও নিয়তি আমার পিছু ছাড়ে না। কী করে যেন মোলাকাত হয়ে যায় এদের সঙ্গে।
০৩. সেবা প্রকাশনীর বিখ্যাত অনুবাদক-লেখক রওশন জামিল ছিলেন ঢাকায় আমার মহল্লাকা বড়া ভাই। আমি থাকতাম ওয়ারীর হেয়ার স্ট্রিটে আর তিনি ঠাটারিবাজার বিসিসি রোডে। রওশন ভাই আমার বহু আগেই থিতু হয়েছেন নিউইয়র্কে। টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়। ফেসবুকে তাঁর স্ট্যাটাস দেখি নিয়মিত।
নিউইয়র্কপ্রবাসী আবেদিন কাদের একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিউজ প্রডিউসার ছিলেন। বিদ্বান মেধাবী এই মানুষ নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনিও মোটামুটি সক্রিয়, ফেসবুকে। এই দুজন জ্ঞানী মানুষ আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।
বছর তিনেক আগে, রওশন জামিল ফেসবুকে নিজের একটি স্ট্যাটাসে লিখলেন, ‘বদরুদ্দীন উমরের বুদ্ধিজীবিতার বড় কৃতিত্ব, তিনি তাঁর বুঝের সঙ্গে আপস করেননি কখনো। ক্ষমতার খয়ের খাঁগিরি করেননি, যেটা তাঁর সমসাময়িকেরা কম-বেশি প্রায় সবাই করেছেন, করে যাচ্ছেন। বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অমত করতে পারি, কিন্তু তাঁর সততাকে সালাম ঠুকতেই হয়।’
শিক্ষিত এলিট বদরুদ্দীন উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা নিয়ে আমার দ্বিমত ছিল। আমি তাই মন্তব্যের ঘরে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম এইভাবে—‘বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অমত করতে পারি, কিন্তু তাঁর সততাকে সালাম ঠুকতেই হয়।—সততা?’
আবেদিন কাদের প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘Yes, honest, I consider him intellectually honest...’
সাধারণত ফেসবুকে আমি কোনো বাহাসেই অংশ নিই না। কম্পোজ বা টাইপিংয়ে আলস্যের কারণে এমনিতেই আমার প্রচুর পরিকল্পনা অলিখিতই থেকে যায়। যতটা সময় খরচ করে আমি একটা বাহাস করব, টাইপ করব, ততটা সময় ব্যয় করলে অনায়াসেই একটা ছড়া লেখা হয়ে যায়। আমি তাই দ্বিতীয়টাই প্রেফার করি। শামিল হই না তর্কে।
কিন্তু আবেদিন কাদেরের উত্তরটা, বিশেষ করে ‘I consider him intellectually honest’ বাক্যটির জবাব দেওয়া জরুরি মনে করে মূল স্ট্যাটাসদাতা রওশন জামিলকে ফোন করে বিষয়টা ব্যাখ্যা করি।
জনাব বদরুদ্দীন উমরের একটা আত্মকথা ধরনের স্মৃতিগদ্য ঢাকার ২০০০ কিংবা সাপ্তাহিক-এ খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। একটি পর্বে তিনি উনসত্তরের ঢাকার বিশেষ একটি দিনের বর্ণনা করছিলেন। নবাবপুর রোডের কম দামি হোটেলের গমগমে ভিড়ের আড্ডায় সাধারণ মধ্যবিত্ত নাগরিকদের চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার টুকরো টুকরো ঘটনার বয়ান তিনি করছিলেন।
নবাবপুর রোড থেকে জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ), বায়তুল মোকাররম স্টেডিয়াম অঞ্চলের বিপুল জনস্রোতের ডিটেইল একটি চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলছিলেন। সেদিনের বিকেলের উল্লেখযোগ্য প্রায় সবকিছুই উঠে এসেছিল তাঁর রচনায়, শুধু একটি বিষয় ছাড়া।সবকিছুই অবলোকন করেছিলেন তিনি সেই বিকেলের, শুধু একটি বিষয় ছাড়া। আর সেটা হচ্ছে—ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদের শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া। উনসত্তরের ২৩ ফেব্রুয়ারির সেই বিকেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল সেটা।
এত কিছু আমি কমেন্টে লিখতে অনাগ্রহী বলে টেলিফোনে রওশন জামিলকে খুলে বলেছিলাম। রওশন সে কথা উল্লেখ করেছিলেন তাঁর প্রত্যুত্তরের ঘরে– ‘কাল রিটনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওর আপত্তির জায়গা বদরুদ্দীন উমরের বৌদ্ধিক চর্চায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কৃতিত্ব না দেওয়া বা যেমন একটি দিনের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় বা তাঁর ডায়েরিধর্মী লেখায় সাধারণ সব ঘটনার কথা এসেছে, কিন্তু সেদিন যে শেখ মুজিবকে পল্টন ময়দানে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেওয়া হয়েছিল, সেই ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়নি; যা এ দেশের প্রেক্ষাপটে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। সে কারণে রিটন বলতে চাইছে, উমরের “মুজিববিদ্বেষ” তাঁর (উমরের) বৌদ্ধিক সততার পরিচয় দেয় না।’
রওশনের এই মন্তব্যের জবাবে আবেদিন লিখলেন, ‘সেটা রিটন বলতেই পারেন। কিন্তু তাতে উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। একজন মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জীবনের কোনো লেখায় উল্লেখ না করেও বৌদ্ধিকভাবে সৎ থাকতে পারেন।’
আবেদিনের জবাবের প্রত্যুত্তরে আমি শুধু লিখলাম, ‘মারহাবা!’ ‘কিন্তু তাতে উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না’ শোনার পরে ‘মারহাবা’ বলা ছাড়া কী আর বলতে পারতাম সংক্ষেপে!
০৪. কিছুদিন আগে নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকার একটা চমৎকার বুকশপে গিয়েছিলাম বন্ধু দিনু বিল্লাহর সঙ্গে। ওখানে একটা র্যাকে পেঙ্গুইন সাইজের ছোট্ট একটা বইয়ের দিকে তাকাতেই প্রচ্ছদে মুদ্রিত BANGLADESH শব্দটায় আমার চোখ আটকে গেল। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলাম।
বইটির নাম The essential guide to customs & culture BANGLADESH. বইটি CULTURE SMART সিরিজের একটি প্রকাশনা। প্রকাশিত হয়েছে লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে। লিখেছেন লেখক-সাংবাদিক ঊর্মি রহমান। আকর্ষণীয় মেকআপ গেটআপ-সমৃদ্ধ ১৬৮ পৃষ্ঠার চমৎকার এই বইয়ে ৯টি চ্যাপ্টারে বিভিন্নশিরোনামে অনেক এন্ট্রি আছে।
প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভুক্তি। আছে পাতায় পাতায় প্রাসঙ্গিক অনেক ছবি। যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনার সঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি আছে। কিন্তু সত্তরের নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিপুল বিজয় এবং ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কিংবা ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বর্ণনায় শেখ মুজিবের কোনো ছবি নেই। অথচ প্রফেসর ইউনূসের ছবি আছে গ্রামীণ ব্যাংকের বর্ণনায়।
বইটির সঙ্গে ব্যবহারের জন্য প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় ছবিগুলো সরবরাহ করেছেন কে? অনুমান করি, স্বয়ং লেখক নিশ্চয়ই। সেটাই হওয়ার কথা। তাই যদি হয়, তবে আমার প্রশ্ন—বঙ্গবন্ধুর ছবি কই? বাংলাদেশের পরিচিতিমূলক একটা গাইডবই বা পুস্তিকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাড়া কি পরিপূর্ণ হয়? হয় না। বাংলাদেশের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই যে মানুষের ছবি সবার আগে দীপ্যমান হয়ে ওঠে, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানের, বাংলাদেশের স্থপতির। পায়ে কাদামাটি মাখা যিনি উঠে এসেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মৃত্তিকা থেকে। বঙ্গবন্ধু ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিষয়ে তথাকথিত শিক্ষিতদের এই বিদ্বেষপ্রবণতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতেই হবে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে গেলে।
কোনো রূপকথার দেশ নয় আমার বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্রোতের ওপর জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশটির। চার বছরের মাথায় স্বাধীনতার বিরুদ্ধ পক্ষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর স্বাধীন বাংলাদেশ ইউটার্ন নিয়েছিল পাকিস্তানের দিকে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার একটা পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছিল। এরপর টানা একুশ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্বাসিত।
শেখ মুজিবুর রহমান নামটা প্রায় মুছেই ফেলা হয়েছিল ইতিহাস থেকে। সংবিধানকে কেটে-ছিঁড়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেওয়া হয়েছিল দায়মুক্তি। একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক-রাজাকার-আলবদরদের গাড়িতে উড়ছিল ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজ পতাকাটি।
একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। আবার একটা ইউটার্ন নেয় বাংলাদেশ। এবার স্বাধীনতার দিকে। মিনি পাকিস্তান পুনরায় বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। জাতির পিতার খুনিদের বিচারকাজ শুরু হয়। ধাপে ধাপে দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ায় আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন খুনিদের। সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে মোচন করা সম্ভব হয় বাংলাদেশের কপালে লেপ্টে থাকা কলঙ্কতিলকটি। কলঙ্কমুক্ত হয় বাংলাদেশ।
অতঃপর মানবতাবিরোধী বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীর বিচার এবং আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে আরেক দফা শুদ্ধ হয় বাংলাদেশ। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিনাশ হয় না। দালাল-রাজাকারদের ছানাপোনা সক্রিয় থাকে রাজনীতিতে। ফলে পরিস্থিতি মোটেও স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অনুকূলে থাকে না
একাত্তরের পরাজিত শক্তির ছানাপোনাদের সঙ্গে আড়াই কলম ইংরেজি জানা শিক্ষিত এলিট শ্রেণিটি সংহতি প্রকাশ করে প্রায়ই বিভিন্ন ব্যানারের আনুষ্ঠানিকতায়। স্যাটেলাইট টিভির রাতের টক শোগুলোতে তারা নানান থিওরি কপচায়। এদের পোশাকি নাম সুশীল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ এবং তার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ব্যাখ্যায় তারা শৃগালচাতুর্যে ‘ন্যারেটিভ-রিকনসিলিয়েশন-ডায়ালেক্ট-হেজিমনি’ ইত্যাকার শব্দের তুবড়ি ছুটিয়ে এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি করে যে তখন খুব সাধারণ মানুষের কাছে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’কেও মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র।
যে চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে—একাত্তরে পাকিস্তানি সৈনিকদের হত্যালীলা ও পৈশাচিক ধর্ষণকালে ধর্ষক পাকিস্তানি সৈন্যের প্রেমে আকুল বাঙালি মেয়েটি তার বাবার কাছে কান্নাকাটি করে বলছে, ‘বাবা, আমাকে সৈন্য এনে দাও...সৈন্য এনে দাও!’
একাত্তরের পরাজিত শক্তির ছানাপোনা এবং আড়াই কলম ইংরেজি জানা বাংলাদেশবিরোধী এই দুই শ্রেণিকে সঠিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রতিহত করার মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে আগামী দিনের বাংলাদেশকে।
একাত্তরের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ, পঁচাত্তরের পর পাকিস্তানের দিকে ক্ষিপ্রগতিতে ধাবমান বাংলাদেশ যে ছিয়ানব্বইয়ের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, সেই অগ্রযাত্রা মাঝখানে বছরকয়েক বিপর্যস্ত হয়ে পুনরায় সঠিক ট্র্যাকে চলমান। বাংলাদেশ এখন আর ‘বটমলেস বাস্কেট’ নয়।
আমি সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যে বাংলাদেশে একটি শিশুও অনাহারে থাকবে না। প্রত্যেক শিশুর পরনে পোশাক থাকবে। প্রত্যেক শিশু বাসযোগ্য ঘর পাবে। প্রত্যেক শিশু স্কুলে যাবে, অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাবে। যদি একটি শিশুও ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমুতে যায়, তাহলে আমাদের সমস্ত অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। একজন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে প্রত্যেক শিশুর পাঁচটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত দেখতে চাই আমি।
অটোয়া, ২০ জুলাই ২০২৩
লেখক: শিশুসাহিত্যিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪