মাহবুব কামাল
যমুনা সেতুর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু) নির্মাণকাজ যখন চলছিল, তখন এই সেতুর স্বপ্ন কে দেখেছিলেন, তা নিয়ে একেকজন একেকজনের নাম বলেছিলেন। কেউ বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুই সেতুটির স্বপ্নদ্রষ্টা, কেউ ভাসানীর নাম করেছিলেন, কেউবা বলেছিলেন আইয়ুব খান ইত্যাদি। প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁদের কেউই সঠিক ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করতে পারেননি। আসলে এই সেতুর স্বপ্ন প্রথম কে দেখেছিলেন, তাঁকে আমরা চিনি না। হতে পারে সেটা হাজার বছর আগের কথা। এক মাঝি পাড়ি দিচ্ছিলেন যমুনা, মাঝনদীতে উঠেছিল ঝড়, উথাল-পাতাল ঢেউ, প্রাণপণ সংগ্রামে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন প্রিয় জীবন ও ততোধিক প্রিয় তাঁর জীবিকার অবলম্বন নৌকা এবং ঝড়ের তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর মনে মনে বলেছিলেন, আহা, এই নদীর ওপর যদি একটি পুল (সেতু) থাকত!
গণতন্ত্রের বয়স কত আমরা জানি, কম-বেশি দুই হাজার বছর। মতবাদটির বিবর্তন ও পরিশীলন-প্রক্রিয়া চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী এবং আজ, এই মুহূর্তে এথেন্সের সেই গণতন্ত্র খোল-নলচেই পাল্টে ফেলেছে। তো যমুনা সেতুর প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টার মতো গণতন্ত্রের স্বপ্ন প্রথম দেখেছিলেন কে? তিনিও নিশ্চয়ই অতি প্রাচীন এক ব্যক্তি। হতে পারে তিনি আদিম সাম্যবাদী যুগের এক বাসিন্দা। সবাই মিলে পশু শিকার করার পর যখন দেখেছিলেন শক্তিমান দু-একজনই খেয়ে চলেছে সব আর তাঁর ও তাঁর মতো অনেকের ভাগে কিছুই নেই, থাকলেও তা উচ্ছিষ্ট—তিনি তখন হয়তো ভেবেছিলেন, ইশ্, কে কতটা খাবে সেই সিদ্ধান্তের জন্য যদি সবার মতামত নেওয়ার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে কাজ করেও এভাবে না খেয়ে থাকতে হতো না তাঁকে।
হ্যাঁ, গণতন্ত্র এক অতি প্রাচীন ধারণা। আমলাতন্ত্র অবশ্য এর চেয়েও প্রাচীন। তবে চরিত্রগতভাবে আমলাতন্ত্র এখনো অবিকল থাকলেও এর চেয়ে কম বয়সী গণতন্ত্রের গায়ে মরিচা ধরেছে। যে মর্মকথার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল গণতন্ত্র, মতবাদটির চর্চা হচ্ছে পৃথিবীর যেসব দেশে, সেগুলোর কোনোটাতেই তা সর্বাংশে প্রতিফলিত হচ্ছে না। হয়তো মতবাদটির প্রয়োগ পদ্ধতিতেই থেকে যাচ্ছে কোনো গলদ, যার কারণে দুধের আশায় এর বাঁট টানছি যখন, বের হচ্ছে গরল।
বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। নব্বইয়ে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গণতন্ত্রচর্চা করব বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম সবাই; কিন্তু ৩৩ বছর পর ফাইনাল ব্যালান্সশিটে কী দেখছি? ছোট করে বললে, পেয়েছি হাজারের হিসাবে মৃত্যু, আরও পেয়েছি এমপি হিসেবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে, দেখেছি ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনী ছুটেছে বঙ্গভবনের দিকে। বস্তুত আমরা যাকে এখন গণতন্ত্র নামে ডাকছি, তার আসল নাম উচ্ছৃঙ্খলতা। গণতন্ত্রের মর্মবস্তুতে নিশ্চয়ই কোনো গলদ কিংবা বিচ্যুতি নেই, অতঃপর নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্ত টানা চলে যে প্রয়োগের দোষেই দেশে দেশে মরিচা ধরছে এর গায়ে।
অবশ্য গণতন্ত্রের মর্মবস্তুতে যে কোনো গলদ নেই, এটা বলার সময় ‘নিশ্চয়ই’ বলাটা ভুল হলো। কিছু ধাঁধা তো আছেই। যেমন দুর্নীতিপরায়ণ অথচ যোগ্য এমন মানুষদের নিয়োগব্যবস্থা ভালো, নাকি অযোগ্যদের নির্বাচনব্যবস্থা—এটা এক বিতর্ক বৈকি। আরও একটি প্যারাডক্স এমন যে যখন বলি গণতন্ত্রটা বড় বেশি গণতান্ত্রিক, তখন অপশক্তিকে দমন করার উদ্যোগ নেওয়ার সময় মনে হতেই পারে গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়ে যাবে তাতে। অথচ অপশক্তিকে দমন না করলে সুশাসন নিশ্চিত করা যায় না। আবার এমনও বলা যেতে পারে, পৃথিবীর কেউই এতটা জ্ঞানী বা সৎ নয়, যতটা জ্ঞান বা সততা থাকলে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে তাকে ভোট দিয়ে বিশ্বাস করা চলে। যেসব কারণে মানুষের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, তার একটি রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গলাভ। ভোট তো রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে বিজয়ীর এই সঙ্গলাভেরই মিডিয়েটর। এটাও বা বলতে ছাড়ছি কেন, গণতন্ত্রের শত্রু শুধু স্বৈরতন্ত্র নয়, এই শত্রু আসলে বল্গাহীন স্বাধীনতাও।
আমরা এখন অধিক গণতন্ত্র, না স্বল্প—এই বিতর্কে ঢুকব না। আমরা বলব উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের কথা। পাঠক যেন সন্দেহ না করেন যে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র বলতে মাহাথির-লি কুয়ানের মডেলকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আমাদের এই উপমহাদেশে মাহাথির-লি কুয়ানের সীমিত গণতন্ত্র যে খাটে না, এ কথা অমর্ত্য সেন অনেক আগেই নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলা-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের মানুষ চরিত্রগতভাবে আর্গুমেন্টেটিভ, অর্থাৎ তর্কপ্রিয়। পেট অভুক্ত থাকলেও কথা চালিয়ে যেতে তারা স্বচ্ছন্দবোধ করে। উপজেলা, এমনকি গ্রামপর্যায়েও দেখা যাবে, এক কাপ চায়ের বেশি কিছু না খেয়েই স্টলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে যাচ্ছে মানুষ, অন্য কাস্টমারকে বসার সুযোগ করে দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন দোকানি, শুনছে না কেউ। সীমিত গণতন্ত্র এই মানুষদের স্বভাবের সঙ্গে যায় না।
আমরা আগেই বলেছি, বর্তমানে যে গণতন্ত্র চালু রেখেছি আমরা, তা ফলদায়ক হচ্ছে না। তবে কি প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর), অর্থাৎ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের গণতন্ত্রে শিফট করা উচিত? সত্য বৈকি, এখনকার ওয়েস্টমিনস্টার-টাইপ গণতন্ত্রে অনেক শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে, পিআর সিস্টেমে তা নেই। সেই ফাঁকিটা ধরিয়ে দেওয়া যাক। গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো শাসনটা হতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই। আরও সুন্দর করে বললে, সংখ্যালঘিষ্ঠের মর্মবস্তু ধারণ করা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নামই গণতন্ত্র। তো ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে সরকারটি সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত না-ও হতে পারে। থিওরিটিক্যালি কথাটা প্রতিষ্ঠা করা যাক। ৩০০ আসনের আমাদের পার্লামেন্টের ১৫১টিতে একটি দলের প্রার্থীদের সবাই প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে মাত্র এক ভোট বেশি পাওয়ার পর যদি বাকি ১৪৯টিতে দলটি একটি ভোটও না পায়, সে ক্ষেত্রেও সেই দল সরকার গঠন করার যোগ্যতা অর্জন করবে। অতঃপর সরকারটি কি জনমতের ভিত্তিতে গঠিত হলো?
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমান ভোট পেয়েও (৪১ দশমিক ৪০ ও ৪০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ) বিএনপির আসন ১৯৩, আওয়ামী লীগের মাত্র ৬২। আবার দেখুন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেল ২৭টি, অথচ বিএনপি ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে পেল জাতীয় পার্টির চেয়ে মাত্র ৩টি আসন বেশি।
বলতে অসুবিধা কোথায়, বর্তমান সিস্টেমে পরাজিতের ভোট পচে যায়, তার হিসাব কেউ রাখে না, আর পিআর পদ্ধতিতে সব ভোটেরই গুরুত্ব থাকে। বামপন্থীরা এ দেশে এককভাবে (নৌকা অথবা ধানের শীষের সাহায্য ছাড়া) ভোট করলে কোনো আসন পায় না। কিন্তু তারা কি সারা দেশে ১ শতাংশ ভোটও পায় না? যদি পায়, তাহলে তো পিআর সিস্টেমে তাদের আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩। এই সিস্টেমে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নিশ্চিত হয় বলেই তার চর্চা হচ্ছে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে। ইংল্যান্ডেও লেবার ও কনজারভেটিভরা পালা করে ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করছে বলে তৃতীয় ধারার লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা দাবি করছে পিআর সিস্টেমে শিফট করার। কারণ তারা ভোট পায়, আসন পায় না। ইউরোপে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নিশ্চিত করতেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুয়ের অধিক প্রার্থী থাকলে বিজয়ী হতে হলে যেকোনো একজনকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হয়। তা না হলে বেশি ভোটপ্রাপ্ত প্রথম দুজনকে আবারও লড়তে হয়। বলা নিষ্প্রয়োজন, দ্বিতীয় দফায় দুজনের যেকোনো একজন অর্ধেকের বেশি ভোট পাবেনই কি পাবেন। কূটতার্কিকেরা অবশ্য বলতে পারেন, প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা যদি ইভেন অর্থাৎ জোড় হয়, সে ক্ষেত্রে তো টাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে!
আমরা বলছি না, পিআর সিস্টেমকেই অবলম্বন করতে হবে। তবে এই গণতন্ত্রের সুফলটা একটু দেখুন। এই সিস্টেমে কোয়ালিশন সরকারের সম্ভাবনা বেশি থাকে, যা বাংলাদেশে কয়েক টার্ম চালু থাকলে রাজনীতিকদের কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতার পরিবর্তন ঘটতে পারে। দ্বিতীয়ত, ১৫১ আসনকে মাথায় রেখে নির্বাচন করার প্রবণতা হ্রাস পাবে এতে, রাজনৈতিক দলগুলো সে ক্ষেত্রে গোটা বাংলাদেশকেই মাথায় রাখতে বাধ্য হবে। বগুড়া আমার, গোপালগঞ্জ তোমার—এভাবে হিসাব করলে সর্ববাংলাদেশি চিন্তার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তৃতীয়ত, সারা দেশেই ভোটে এগিয়ে থাকতে হবে—এমন বাধ্যবাধকতা থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। রাজনীতিটাও তখন করতে হবে ঠিকঠাক। পাঠক লক্ষ করুন, শহীদ চান্দু নামের আধুনিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি বগুড়ায় স্থাপিত বলে ২০০৮ সালের পর থেকে সেখানে একটিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হয়তো ভাবেন, বগুড়ায় তো ভোট অ্যামনেও পাব না, ত্যামনেও পাব না—ওখানে এত আয়োজনের দরকার কী! পিআর সিস্টেমে যদি বগুড়ায় ১০০ ভোটও পাওয়া যায়, সেটাও কি চূড়ান্ত ফলাফলশিটে যুক্ত হবে না?
আমরা এতক্ষণ গণতন্ত্রের একটি প্রতিষ্ঠিত মডেল নিয়ে কথা বললাম। অন্য প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলো নিয়েও কথা হতে পারে; নতুন কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করা যায় কি না, সেটাও ভাবা যেতে পারে। আমরা বাঙালি অথবা তাম্রবর্ণের বলে সভ্যতাকে দেওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই কি নেই আমাদের? সাদাদের ওপর কতকাল আর নির্ভরতা? তো আমাদের জন্য উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র কোনটা, সেটা পণ্ডিতজনেরা ভাবুন, রাজনীতিকদের মাথায় এই ঘিলু আছে বলে মনে হয় না। অথবা ঘিলু থাকলেও বোঁচকা নিয়ে টানাটানি করতেই সেটা প্রয়োগ করার সময় শেষ হয়ে যায়।
উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের সত্যিকার রূপটি কী হওয়া উচিত, সেটা যেহেতু স্কলারদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো, সেহেতু আমরা গণতন্ত্র নিয়েই অন্য রকম কিছু কথা বলে শেষ করব। প্রথমত, নির্বাচন কিন্তু লক্ষ্য নয়, এটা উপায় আর লক্ষ্য হচ্ছে ভালো থাকা। নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে আমরা সেই লক্ষ্যেই পৌঁছাতে চাই। কিন্তু এ দেশের মানুষের মগজ কায়দা করে এমনভাবে ধোলাই করা হয়েছে যে মনে হয় নির্বাচনটাই বুঝি লক্ষ্য। খেয়াল করুন, ভালো থাকার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দেশে অনেক সাংবিধানিক সংস্থা রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর মাত্র একটি—নির্বাচন কমিশন নিয়েই বিরোধী রাজনীতিকদের যত তত্ত্বকথা। এখন আবার চলছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি বাদ দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন। যা-ই হোক, নির্বাচন হলো গণতন্ত্রচর্চার একমাত্র পদ্ধতি, অথচ রাজনীতিকেরা গণতন্ত্রকে নির্বাচনসর্বস্ব করে ফেলেছেন। ঘরের বউকে কড়া শাসনে রেখে অথবা বিনা কারণে কাউকে অপদস্থ করার পর বক্তৃতার মঞ্চে গণতন্ত্রের জয়গান করতে তাই কোনোই অসুবিধা হয় না এ দেশে। দীর্ঘদিনের মগজ ধোলাই-প্রক্রিয়া শেষে সাধারণ মানুষও এখন মনে করে ভোট দিতে না পারলেই গণতন্ত্রের ইজ্জত যায়, অন্য কোনোভাবে নয়। আর তাই তাদের কাছে ভোটাধিকার হরণ মানে সতীত্ব হরণের মতোই লজ্জাকর। তারা বলতে পারছে না, মেয়ের নাকের জায়গায় নাক নেই, ঠোঁটের জায়গায় নেই ঠোঁট, সেই মেয়েকে মা সুন্দর বলতে চাইলে বলুক, পাড়া-পড়শি আমরা কেন বলতে যাব? এই গণতন্ত্র মোটেও সুন্দর নয়।
দেখুন, আমাদের অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণ হয়েছে যে নব্বইয়ের পর থেকে নতুন সরকার মানে নতুন উপদ্রব। তারপরও ভোট দিতেই হবে এবং সেটা ইমিডিয়েট পাস্ট সরকারি দলের বিরুদ্ধেই। তা না হলে আমি যে একটা দামি ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তা প্রমাণ হয় না! বরিশালের লোকেরা বলে থাকেন, এমপি সাহেব কী করতে আছে করুক, ইলেকশন আহুক, এইবার আর টাকামু না। ‘টাকামু না’ মানে এমপি সাহেবের মার্কায় সিল মারবেন না।
শেষ কথা, বুদ্ধিমানেরা সরকারের ধরন নিয়ে মাথা ঘামায়, আঁতেলরা মনে করে যে সরকার যত কম শাসন করে সেই সরকার ততো ভালো, আর সাধারণ মানুষ চায় সেই সরকার, যেটা সুশাসন দিতে পারে। গ্রামের মানুষ কী করে? দুধ দোহানোর সময় যদি গাভি শান্ত থাকে, তাহলে তাকে আরও বেশি করে ভালোবাসে আর যদি দু-চারটা লাথি-টাথি মারে, সে ক্ষেত্রেও মাইন্ড করে না, কারণ লাথির বদলে সে পাচ্ছে দুধ। এখানে গাভি মানে সরকার, শান্ত থাকার অর্থ পূর্ণ গণতন্ত্র আর দুধ হলো সুশাসন।
লেখক: সাংবাদিক
যমুনা সেতুর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু) নির্মাণকাজ যখন চলছিল, তখন এই সেতুর স্বপ্ন কে দেখেছিলেন, তা নিয়ে একেকজন একেকজনের নাম বলেছিলেন। কেউ বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুই সেতুটির স্বপ্নদ্রষ্টা, কেউ ভাসানীর নাম করেছিলেন, কেউবা বলেছিলেন আইয়ুব খান ইত্যাদি। প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁদের কেউই সঠিক ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করতে পারেননি। আসলে এই সেতুর স্বপ্ন প্রথম কে দেখেছিলেন, তাঁকে আমরা চিনি না। হতে পারে সেটা হাজার বছর আগের কথা। এক মাঝি পাড়ি দিচ্ছিলেন যমুনা, মাঝনদীতে উঠেছিল ঝড়, উথাল-পাতাল ঢেউ, প্রাণপণ সংগ্রামে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন প্রিয় জীবন ও ততোধিক প্রিয় তাঁর জীবিকার অবলম্বন নৌকা এবং ঝড়ের তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর মনে মনে বলেছিলেন, আহা, এই নদীর ওপর যদি একটি পুল (সেতু) থাকত!
গণতন্ত্রের বয়স কত আমরা জানি, কম-বেশি দুই হাজার বছর। মতবাদটির বিবর্তন ও পরিশীলন-প্রক্রিয়া চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী এবং আজ, এই মুহূর্তে এথেন্সের সেই গণতন্ত্র খোল-নলচেই পাল্টে ফেলেছে। তো যমুনা সেতুর প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টার মতো গণতন্ত্রের স্বপ্ন প্রথম দেখেছিলেন কে? তিনিও নিশ্চয়ই অতি প্রাচীন এক ব্যক্তি। হতে পারে তিনি আদিম সাম্যবাদী যুগের এক বাসিন্দা। সবাই মিলে পশু শিকার করার পর যখন দেখেছিলেন শক্তিমান দু-একজনই খেয়ে চলেছে সব আর তাঁর ও তাঁর মতো অনেকের ভাগে কিছুই নেই, থাকলেও তা উচ্ছিষ্ট—তিনি তখন হয়তো ভেবেছিলেন, ইশ্, কে কতটা খাবে সেই সিদ্ধান্তের জন্য যদি সবার মতামত নেওয়ার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে কাজ করেও এভাবে না খেয়ে থাকতে হতো না তাঁকে।
হ্যাঁ, গণতন্ত্র এক অতি প্রাচীন ধারণা। আমলাতন্ত্র অবশ্য এর চেয়েও প্রাচীন। তবে চরিত্রগতভাবে আমলাতন্ত্র এখনো অবিকল থাকলেও এর চেয়ে কম বয়সী গণতন্ত্রের গায়ে মরিচা ধরেছে। যে মর্মকথার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল গণতন্ত্র, মতবাদটির চর্চা হচ্ছে পৃথিবীর যেসব দেশে, সেগুলোর কোনোটাতেই তা সর্বাংশে প্রতিফলিত হচ্ছে না। হয়তো মতবাদটির প্রয়োগ পদ্ধতিতেই থেকে যাচ্ছে কোনো গলদ, যার কারণে দুধের আশায় এর বাঁট টানছি যখন, বের হচ্ছে গরল।
বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। নব্বইয়ে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গণতন্ত্রচর্চা করব বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম সবাই; কিন্তু ৩৩ বছর পর ফাইনাল ব্যালান্সশিটে কী দেখছি? ছোট করে বললে, পেয়েছি হাজারের হিসাবে মৃত্যু, আরও পেয়েছি এমপি হিসেবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে, দেখেছি ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনী ছুটেছে বঙ্গভবনের দিকে। বস্তুত আমরা যাকে এখন গণতন্ত্র নামে ডাকছি, তার আসল নাম উচ্ছৃঙ্খলতা। গণতন্ত্রের মর্মবস্তুতে নিশ্চয়ই কোনো গলদ কিংবা বিচ্যুতি নেই, অতঃপর নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্ত টানা চলে যে প্রয়োগের দোষেই দেশে দেশে মরিচা ধরছে এর গায়ে।
অবশ্য গণতন্ত্রের মর্মবস্তুতে যে কোনো গলদ নেই, এটা বলার সময় ‘নিশ্চয়ই’ বলাটা ভুল হলো। কিছু ধাঁধা তো আছেই। যেমন দুর্নীতিপরায়ণ অথচ যোগ্য এমন মানুষদের নিয়োগব্যবস্থা ভালো, নাকি অযোগ্যদের নির্বাচনব্যবস্থা—এটা এক বিতর্ক বৈকি। আরও একটি প্যারাডক্স এমন যে যখন বলি গণতন্ত্রটা বড় বেশি গণতান্ত্রিক, তখন অপশক্তিকে দমন করার উদ্যোগ নেওয়ার সময় মনে হতেই পারে গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়ে যাবে তাতে। অথচ অপশক্তিকে দমন না করলে সুশাসন নিশ্চিত করা যায় না। আবার এমনও বলা যেতে পারে, পৃথিবীর কেউই এতটা জ্ঞানী বা সৎ নয়, যতটা জ্ঞান বা সততা থাকলে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে তাকে ভোট দিয়ে বিশ্বাস করা চলে। যেসব কারণে মানুষের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, তার একটি রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গলাভ। ভোট তো রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে বিজয়ীর এই সঙ্গলাভেরই মিডিয়েটর। এটাও বা বলতে ছাড়ছি কেন, গণতন্ত্রের শত্রু শুধু স্বৈরতন্ত্র নয়, এই শত্রু আসলে বল্গাহীন স্বাধীনতাও।
আমরা এখন অধিক গণতন্ত্র, না স্বল্প—এই বিতর্কে ঢুকব না। আমরা বলব উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের কথা। পাঠক যেন সন্দেহ না করেন যে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র বলতে মাহাথির-লি কুয়ানের মডেলকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আমাদের এই উপমহাদেশে মাহাথির-লি কুয়ানের সীমিত গণতন্ত্র যে খাটে না, এ কথা অমর্ত্য সেন অনেক আগেই নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলা-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের মানুষ চরিত্রগতভাবে আর্গুমেন্টেটিভ, অর্থাৎ তর্কপ্রিয়। পেট অভুক্ত থাকলেও কথা চালিয়ে যেতে তারা স্বচ্ছন্দবোধ করে। উপজেলা, এমনকি গ্রামপর্যায়েও দেখা যাবে, এক কাপ চায়ের বেশি কিছু না খেয়েই স্টলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে যাচ্ছে মানুষ, অন্য কাস্টমারকে বসার সুযোগ করে দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন দোকানি, শুনছে না কেউ। সীমিত গণতন্ত্র এই মানুষদের স্বভাবের সঙ্গে যায় না।
আমরা আগেই বলেছি, বর্তমানে যে গণতন্ত্র চালু রেখেছি আমরা, তা ফলদায়ক হচ্ছে না। তবে কি প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর), অর্থাৎ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের গণতন্ত্রে শিফট করা উচিত? সত্য বৈকি, এখনকার ওয়েস্টমিনস্টার-টাইপ গণতন্ত্রে অনেক শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে, পিআর সিস্টেমে তা নেই। সেই ফাঁকিটা ধরিয়ে দেওয়া যাক। গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো শাসনটা হতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই। আরও সুন্দর করে বললে, সংখ্যালঘিষ্ঠের মর্মবস্তু ধারণ করা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নামই গণতন্ত্র। তো ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে সরকারটি সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত না-ও হতে পারে। থিওরিটিক্যালি কথাটা প্রতিষ্ঠা করা যাক। ৩০০ আসনের আমাদের পার্লামেন্টের ১৫১টিতে একটি দলের প্রার্থীদের সবাই প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে মাত্র এক ভোট বেশি পাওয়ার পর যদি বাকি ১৪৯টিতে দলটি একটি ভোটও না পায়, সে ক্ষেত্রেও সেই দল সরকার গঠন করার যোগ্যতা অর্জন করবে। অতঃপর সরকারটি কি জনমতের ভিত্তিতে গঠিত হলো?
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমান ভোট পেয়েও (৪১ দশমিক ৪০ ও ৪০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ) বিএনপির আসন ১৯৩, আওয়ামী লীগের মাত্র ৬২। আবার দেখুন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেল ২৭টি, অথচ বিএনপি ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে পেল জাতীয় পার্টির চেয়ে মাত্র ৩টি আসন বেশি।
বলতে অসুবিধা কোথায়, বর্তমান সিস্টেমে পরাজিতের ভোট পচে যায়, তার হিসাব কেউ রাখে না, আর পিআর পদ্ধতিতে সব ভোটেরই গুরুত্ব থাকে। বামপন্থীরা এ দেশে এককভাবে (নৌকা অথবা ধানের শীষের সাহায্য ছাড়া) ভোট করলে কোনো আসন পায় না। কিন্তু তারা কি সারা দেশে ১ শতাংশ ভোটও পায় না? যদি পায়, তাহলে তো পিআর সিস্টেমে তাদের আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩। এই সিস্টেমে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নিশ্চিত হয় বলেই তার চর্চা হচ্ছে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে। ইংল্যান্ডেও লেবার ও কনজারভেটিভরা পালা করে ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করছে বলে তৃতীয় ধারার লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা দাবি করছে পিআর সিস্টেমে শিফট করার। কারণ তারা ভোট পায়, আসন পায় না। ইউরোপে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নিশ্চিত করতেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুয়ের অধিক প্রার্থী থাকলে বিজয়ী হতে হলে যেকোনো একজনকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হয়। তা না হলে বেশি ভোটপ্রাপ্ত প্রথম দুজনকে আবারও লড়তে হয়। বলা নিষ্প্রয়োজন, দ্বিতীয় দফায় দুজনের যেকোনো একজন অর্ধেকের বেশি ভোট পাবেনই কি পাবেন। কূটতার্কিকেরা অবশ্য বলতে পারেন, প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা যদি ইভেন অর্থাৎ জোড় হয়, সে ক্ষেত্রে তো টাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে!
আমরা বলছি না, পিআর সিস্টেমকেই অবলম্বন করতে হবে। তবে এই গণতন্ত্রের সুফলটা একটু দেখুন। এই সিস্টেমে কোয়ালিশন সরকারের সম্ভাবনা বেশি থাকে, যা বাংলাদেশে কয়েক টার্ম চালু থাকলে রাজনীতিকদের কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতার পরিবর্তন ঘটতে পারে। দ্বিতীয়ত, ১৫১ আসনকে মাথায় রেখে নির্বাচন করার প্রবণতা হ্রাস পাবে এতে, রাজনৈতিক দলগুলো সে ক্ষেত্রে গোটা বাংলাদেশকেই মাথায় রাখতে বাধ্য হবে। বগুড়া আমার, গোপালগঞ্জ তোমার—এভাবে হিসাব করলে সর্ববাংলাদেশি চিন্তার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তৃতীয়ত, সারা দেশেই ভোটে এগিয়ে থাকতে হবে—এমন বাধ্যবাধকতা থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। রাজনীতিটাও তখন করতে হবে ঠিকঠাক। পাঠক লক্ষ করুন, শহীদ চান্দু নামের আধুনিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি বগুড়ায় স্থাপিত বলে ২০০৮ সালের পর থেকে সেখানে একটিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হয়তো ভাবেন, বগুড়ায় তো ভোট অ্যামনেও পাব না, ত্যামনেও পাব না—ওখানে এত আয়োজনের দরকার কী! পিআর সিস্টেমে যদি বগুড়ায় ১০০ ভোটও পাওয়া যায়, সেটাও কি চূড়ান্ত ফলাফলশিটে যুক্ত হবে না?
আমরা এতক্ষণ গণতন্ত্রের একটি প্রতিষ্ঠিত মডেল নিয়ে কথা বললাম। অন্য প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলো নিয়েও কথা হতে পারে; নতুন কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করা যায় কি না, সেটাও ভাবা যেতে পারে। আমরা বাঙালি অথবা তাম্রবর্ণের বলে সভ্যতাকে দেওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই কি নেই আমাদের? সাদাদের ওপর কতকাল আর নির্ভরতা? তো আমাদের জন্য উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র কোনটা, সেটা পণ্ডিতজনেরা ভাবুন, রাজনীতিকদের মাথায় এই ঘিলু আছে বলে মনে হয় না। অথবা ঘিলু থাকলেও বোঁচকা নিয়ে টানাটানি করতেই সেটা প্রয়োগ করার সময় শেষ হয়ে যায়।
উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের সত্যিকার রূপটি কী হওয়া উচিত, সেটা যেহেতু স্কলারদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো, সেহেতু আমরা গণতন্ত্র নিয়েই অন্য রকম কিছু কথা বলে শেষ করব। প্রথমত, নির্বাচন কিন্তু লক্ষ্য নয়, এটা উপায় আর লক্ষ্য হচ্ছে ভালো থাকা। নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে আমরা সেই লক্ষ্যেই পৌঁছাতে চাই। কিন্তু এ দেশের মানুষের মগজ কায়দা করে এমনভাবে ধোলাই করা হয়েছে যে মনে হয় নির্বাচনটাই বুঝি লক্ষ্য। খেয়াল করুন, ভালো থাকার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দেশে অনেক সাংবিধানিক সংস্থা রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর মাত্র একটি—নির্বাচন কমিশন নিয়েই বিরোধী রাজনীতিকদের যত তত্ত্বকথা। এখন আবার চলছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি বাদ দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন। যা-ই হোক, নির্বাচন হলো গণতন্ত্রচর্চার একমাত্র পদ্ধতি, অথচ রাজনীতিকেরা গণতন্ত্রকে নির্বাচনসর্বস্ব করে ফেলেছেন। ঘরের বউকে কড়া শাসনে রেখে অথবা বিনা কারণে কাউকে অপদস্থ করার পর বক্তৃতার মঞ্চে গণতন্ত্রের জয়গান করতে তাই কোনোই অসুবিধা হয় না এ দেশে। দীর্ঘদিনের মগজ ধোলাই-প্রক্রিয়া শেষে সাধারণ মানুষও এখন মনে করে ভোট দিতে না পারলেই গণতন্ত্রের ইজ্জত যায়, অন্য কোনোভাবে নয়। আর তাই তাদের কাছে ভোটাধিকার হরণ মানে সতীত্ব হরণের মতোই লজ্জাকর। তারা বলতে পারছে না, মেয়ের নাকের জায়গায় নাক নেই, ঠোঁটের জায়গায় নেই ঠোঁট, সেই মেয়েকে মা সুন্দর বলতে চাইলে বলুক, পাড়া-পড়শি আমরা কেন বলতে যাব? এই গণতন্ত্র মোটেও সুন্দর নয়।
দেখুন, আমাদের অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণ হয়েছে যে নব্বইয়ের পর থেকে নতুন সরকার মানে নতুন উপদ্রব। তারপরও ভোট দিতেই হবে এবং সেটা ইমিডিয়েট পাস্ট সরকারি দলের বিরুদ্ধেই। তা না হলে আমি যে একটা দামি ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তা প্রমাণ হয় না! বরিশালের লোকেরা বলে থাকেন, এমপি সাহেব কী করতে আছে করুক, ইলেকশন আহুক, এইবার আর টাকামু না। ‘টাকামু না’ মানে এমপি সাহেবের মার্কায় সিল মারবেন না।
শেষ কথা, বুদ্ধিমানেরা সরকারের ধরন নিয়ে মাথা ঘামায়, আঁতেলরা মনে করে যে সরকার যত কম শাসন করে সেই সরকার ততো ভালো, আর সাধারণ মানুষ চায় সেই সরকার, যেটা সুশাসন দিতে পারে। গ্রামের মানুষ কী করে? দুধ দোহানোর সময় যদি গাভি শান্ত থাকে, তাহলে তাকে আরও বেশি করে ভালোবাসে আর যদি দু-চারটা লাথি-টাথি মারে, সে ক্ষেত্রেও মাইন্ড করে না, কারণ লাথির বদলে সে পাচ্ছে দুধ। এখানে গাভি মানে সরকার, শান্ত থাকার অর্থ পূর্ণ গণতন্ত্র আর দুধ হলো সুশাসন।
লেখক: সাংবাদিক
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪