রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক ঘেঁষা পোদ্দারপাড়া মাঠে আলু ও তামাক তুলে বর্গা নেওয়া ৯০ শতক জমিতে আউশ ধান চাষ করেছেন ফকিরপাড়া গ্রামের কৃষক মোলায়েম খাঁ। ধানের ফলনও দেখে ভেবেছিলেন বর্গা আর খরচের টাকা বাদ দিয়ে ধানেও মোটা লাভ থাকবে। কিন্তু সেই আশা ফিকে হয়ে গেছে তাঁর। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় তলিয়ে যাওয়া আধা পাকা অপরিপক্ব ধান কেটে নিচ্ছেন তিনি।
কথা হলে মোলয়েম খাঁ বলেন, ‘ঈদের আগের দিন রাত থাকি বৃষ্টি হওছে। সেই বৃষ্টির পানিত চার দিন ধরি পুরো ধানখেত ডুবি আছলো। আধপাকা ধানের গাজি (গাছ) বেরাইছে। কষ্টের ধান পানিত ডুবি পচি যাওছে, কার পরানে সয়। ওই জন্য আধা পাকা ধান কাটুছুন। পানিত ডুবি থাকা এবার ধানোত বড় লস হওছে।’
মোলায়েম খাঁ জানান, ৯০ শতক জমি আউশ আবাদের জন্য ১৩ হাজার টাকায় বর্গা নেন। ধান চাষ থেকে কাটা পর্যন্ত তাঁর খরচ পড়ছে প্রায় ৪৭ হাজার টাকা। সম্পূর্ণ পাকা অবস্থায় ধান ঘরে তুলতে পারলে ৯০ মণ ধান পেতেন। প্রতি মণ ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করলে ৭২ হাজার টাকা হতো। তাঁর ধান পরিপক্ব হতে আরও ১২ থেকে ১৫ দিন লাগত। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ধানখেত ডুবে তাঁর ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা তাঁর লোকসান হবে।
শুধু মোলায়েম খাঁ নয়, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তারাগঞ্জের অনেক কৃষকের আউশ ধান পানির নিচে চার দিন ধরে ডুবে আছে। কোনো কোনো খেতের ধান একেবারে নুয়ে পড়েছে, সেগুলোতে ধান থেকে গাছ বের হচ্ছে। এ অবস্থায় কৃষকেরা কোমর পানি মাড়িয়ে অপরিপক্ব ধানখেত থেকে কেটে নিচ্ছেন।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তারাগঞ্জের মংলাডুব, পোদ্দারপাড়া, ঘনিরামপুর, যমুনেশ্বরী নদীর ঘেঁষা তেরমাইল, বরাতি, বালাপাড়া, কাচনা মাঠ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, একরে পর একর ধানখেত তলিয়ে আছে। পানি কমে যেসব ধানখেত মাথা বের করেছে, সেগুলো কেটে কলার ভেলায় করে উঁচু স্থানে নিচ্ছেন কৃষকেরা।
দুপুর ১২টায় তেরমাইল মাঠে কথা হয় জগদীশপুর গ্রামের কৃষক একরামুল হকের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুই একর জমির ধান পানির নিচে। নদীর পানি না কমি বাড়ছে। জানি না এবার ধান পামো কি না। ২০১৭ সালের মতন যদি এবারও খড় কোনাও না পাই তাইলে মোর কমর ভাঙি যাইবে।’
ওই মাঠের পাশের মাঠ ঘনিরামপুর। সেখানে কোমরপানিতে ধান কাটছিলেন ঘনিরামপুর গ্রামের কৃষক জয়নাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘৪০ শতক জমির ধান শ্যাষ। এই গলাত আর ধান পাওয়া যাইবে না। গরুর খাওয়ার জন্যে কাটি নিগাওছু। আর দুই একদিন থাকলে ধানগাছগুলা পচি যাইবে।’
মংলাডুবের মাঠে ইদ্রিস উদ্দিনের ডুবে যাওয়া ধানখেত কাটার জন্য শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন দোলাপাড়া গ্রামের ইদ্রিস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘২৫ শতক ভুইয়ের ধান চুক্তিতে কাটা এবার ৩ হাজার ৮০০ টাকা। পানিত ডুবি আছে জন্যে সেই ধান কাটা এখন চাওছে তিন হাজার ৫০০ টাকা। তাও কৃষাণ পাওয়া যাওছে না।’
সেখানে কথা হলে ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের দিনমজুর ইউসুফ আলী বলেন, ‘ভাই শুকনা জমির ৫০ শতকের ধান কাটতে যে সময় লাগে। পানি ডুবা ২০ শতক জমির ধান কাটতে তাঁর থাকে বেশি সময় লাগে। এই জন্যে দাম বেশি চাই, তাও হামার লস থাকে। গৃহস্থের দিকে দেখি ধান কাটি দেই।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, তারাগঞ্জ এবারে ৭ হাজার ৭৬০ হেক্টরে বোরো ও ১ হাজার ৬০ হেক্টরে আউশ ধানের চাষ হয়েছে। টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিচু এলাকার আউশ ধান তলিয়ে গেছে।
তারাগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা ধীবা রানী রায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, পানিতে ডুবে যাওয়া আউশের মাঠগুলো ঘুরে দেখেছি। রোববার পর্যন্ত যদি ডুবে যাওয়া খেত থেকে পানি নেমে না যায়, তাহলে কিছুটা ক্ষতি হতে পারে।