কাক ডাকা ভোরে পান্তা খেয়ে ভ্যানে আইসক্রিমের খালি বাক্স নিয়ে তারাগঞ্জ সদরে আইসক্রিমের কারখানায় যান বৃদ্ধ আজিজুল ইসলাম। আইসক্রিম বিক্রি শেষে লাভের টাকা দিয়ে বাজার সদাই কিনে ফিরবেন বাড়িতে। কিন্তু একটি আইসক্রিমও বিক্রি হয়নি তাঁর। পথে ডাম্প ট্রাক তাঁর আইসক্রিমের ভ্যানটি পিষ্ট করে দেয়। গুরুতর আহত আজিজুল এখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক দিয়ে দিনে শতাধিক বালুবাহী ডাম্প ট্রাক চলাচল করে। এসব ট্রাকের অধিকাংশগুলোর নম্বর রেজিস্ট্রেশন ও রোড পারমিটের কাগজপত্র নেই। নেই চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স। দিন-রাত হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ও চেকপোস্ট অতিক্রম করে এসব যানবাহন চলাচল করছে। বেপরোয়া চলাচলে ঘটছে দুর্ঘটনা।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের রহিমাপুর হাজীপাড়া গ্রামের আজিজুল ইসলামের বাড়ি। সহায় সম্বল বলতে বসতভিটার ৩ শতক জমি। আজিজুল র্দীঘদিন ধরে আইসক্রিম, খাজা ও আমড়া বিক্রি করেন। এ আয়ে স্ত্রী, বৃদ্ধ শ্বশুর ও প্রতিবন্ধী এক ছেলের মুখে আহার জোটে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ফায়ার সার্ভিস ও আজিজুলের পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিনের মতো আজ রোববার সকালে আজিজুল ইসলাম সকাল সাড়ে ৬টায় নিজ বাড়ি থেকে আইসক্রিমের খালি ভ্যান নিয়ে বের হন। তারাগঞ্জের সদরের একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি থেকে আইসক্রিম নিয়ে তা বিক্রির জন্য সকাল ৮টার দিকে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক দিয়ে সৈয়দপুরের দিকে যাচ্ছিলেন।
মহাসড়কের পুরাতন চৌপথী পার হয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কার্যালয়ের সামনে আসলে রংপুর থেকে ছেড়ে আসা সৈয়দপুরগামী একটি ডাম্প ট্রাক আজিজুল ইসলামের আইসক্রিমের গাড়ির পেছনে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে আজিজুল ইসলাম ছিটকে সড়কে পরে যান।
ডাম্প ট্রাকটি তাঁর আইসক্রিমের গাড়িটি টেনে হিঁচড়ে প্রায় ২০০ মিটার নিয়ে গেলে ট্রাকটি আর এগোতে না পারায় চালক সড়কে ট্রাক রেখে পালিয়ে যান। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একদল কর্মী ঘটনাস্থলে ছুটে এসে আজিজুল ইসলামকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান।
প্রত্যক্ষদর্শী ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের পলাশ ইসলাম বলেন, ‘ভাই, আইসক্রিমওয়ালার কোনো দোষ নাই। উনি ওনার সাইট দিয়ে ধীরে ধীরে যাচ্ছিল। পেছন থেকে বেপরোয়াভাবে ডাম্প ট্রাকটি এসে আইসক্রিমের ভ্যানে লাগে দেয়। আইসক্রিমওয়ালা আকাশে চটকি উঠে সড়কে পরে। আমি ও শুভ রায় জমিতে পানি দেওয়া ছেড়ে দৌড়ে আসি। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়। লোকটা কথা বলতে পারছিল না। তাই পরিবারকে খবর দেওয়া হয় নাই।’
দুপুর ১২টার দিকে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে বেড খালি না থাকায় মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন আজিজুল ইসলাম। কোনো কথা বলতে পারছেন না। পাশে হাউমাউ করে কাঁদছেন স্ত্রী মাহামুদা বেগম ও শ্বশুর মাহাতাব আলী।
আজিজুলের স্ত্রী মাহামুদা বেগম বলেন, ‘এক ছেলে কানা, বৃদ্ধ বাপসহ মোর পাঁচজনের সংসার। আইসক্রিমের গাড়ি কোনায় হামার সম্বল। ওকনা চলে আইসক্রিম বেচেয়া হামরা বাঁচি আছি। মরণে ট্রাক তাক পিষি (পিষ্ট) করি দেইল, মোর স্বামীটাক আধ মরা করিল। এখন হামরা কি করি চলমো। ডাক্টার স্বামীক রংপুর নিগার কইছে, কিন্তু হামার তো টাকা নাই। কেমন করি ওক রংপুর নিগাও, কি দিয়া চিকিৎসা করে কন?’
আজিজুলের স্ত্রী আরও বলেন, ‘মোর স্বামীর কোনো দোষ নাই, ট্রাক কোনো হুইসাল না দিয়া পেছন থাকি ধাক্কা মারছে। গাড়িখান পুলিশ ফাড়িত নিয়া গেইছে। মুই এর ন্যায্য বিচার চাও। মোর স্বামীর চিকিৎসা চাও।’
তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসক নাসরিন সুলতানা রিয়া বলেন, ‘আজিজুল ইসলামের দাঁত ভেঙে গেছে, মাথায় বেশ কয়েকটি সেলাই পড়েছে। বুকে ও মাথায় আঘাত পাওয়া কথা বলতে পারছে না। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে রংপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেছি।’
তারাগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শরীফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া আইসক্রিমের ভ্যানটি ও ডাম্প ট্রাকটি উদ্ধার করে থানায় আনা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।