‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঐক্যের আলোকে সংস্কার শেষে আসুন আমরা নির্বাচনে যাই’

গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯: ৫৮
Thumbnail image
গাজীপুরে জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু করেছিলাম, তা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বইঠার ঘটনা ম্লান করে দিয়েছিল। সেই ২৮ অক্টোবর থেকে ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের এ দেশীয় সেবাদাস দেশের মসনদে বারবার বসার চেষ্টা করেছে। ২০০৬ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমরা একটি কালো অধ্যায় পার করেছি। এই সময়ে কারও গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না, রাজনৈতিক অধিকার ছিল না, ভোটাধিকার ছিল না, ধর্মীয় মূল্যবোধ পায়ের নিচে পিষে ফেলা হয়েছিল।’

আজ শুক্রবার সকালে গাজীপুর সদরের ভবানীপুর মুক্তিযোদ্ধা কলেজ মাঠে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গাজীপুর জেলা শাখার কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মিয়া গোলাম পরওয়ার এসব কথা বলেন।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘আমরা একটি কালো যুগ পার করেছি বিগত ১৮টি বছর। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে প্রকাশ্য দিবালোকে খুনি সন্ত্রাসী ফ্যাসিস্ট সমস্ত গুম, হত্যাকাণ্ড, রিমান্ড, ক্রসফায়ারের মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনার নির্দেশে পল্টনে লগি-বইঠা দিয়ে আমাদের সাতজন তরুণ নেতাকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁদের মৃতদেহের ওপর উঠে ঘৃণ্য উল্লাস করেছিল তারা। আমরা সেই ইতিহাস ভুলে যাইনি।’

অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে অর্থনীতিতে চলেছিল লুটপাট, জুডিশিয়ারি অঙ্গনে কোনো ন্যায়বিচার ছিল না, শাসনক্ষমতা এই শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগ সিন্ডিকেট করে তছনছ করে দিয়েছিল। কত মানুষ শহীদ হয়েছে, কত মানুষ আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ কারা বরণ করেছে। কত শিশু, কত বৃদ্ধ, কত মা আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলে কান্না করেছে। অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে এ জনপদকে রক্ষা করার জন্য দোয়া করেছে। আমরা জানি না কোন শহীদ বা কার হাতকে আল্লাহ কবুল করেছেন। গত ৫ আগস্ট আসমান থেকে আল্লাহর রহমতের ধারা বর্ষিত হয়েছে।’

জামায়াত নেতা পরওয়ার বলেন, ‘এই স্বৈরাচার কত মানুষকে হত্যা করল, কত নেতা-কর্মীকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে দিল। বিগত ’১৪, ’১৮, ’২৪ সালে তিনটা ভোট আমরা দিতে পারিনি। রাজনৈতিক দলের আন্দোলনকে গুম করে, নিষিদ্ধ করে আর নির্যাতন করে বিরোধী আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।’

শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে জামায়াতের সেক্রেটারি বলেন, ‘আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টের বিদায় দেখেছি। কিন্তু এইভাবে জনতার রুদ্র রোষে কাউকে পালিয়ে যেতে দেখিনি। এত দাম্ভিক এত অহংকারী, এই ১৭, ১৮ বছরে ওনার মেজাজটা কী ছিল? ওকে মারো, ওকে ধরো, ওকে নিষিদ্ধ করো, ওকে গুলি করো, আয়নাঘরে নাও, রিমান্ডে নাও, রাজনৈতিক অধিকার নেই, ভোটাধিকার নেই। এত অহংকার, এত দাম্ভিকতা আল্লাহতায়ালা কখনো পছন্দ করেন না। আমরা মনে মনে এটা কামনা করতাম, নিশ্চয়ই আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত অপেক্ষা করছে।’

সাবেক এই এমপি বলেন, ‘আমাদের বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে বৃদ্ধ বয়সে কারাগারে নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে, তাঁদের ফাঁসি দিয়েছে। মিথ্যা মামলা, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা ট্রাইব্যুনাল, মিথ্যা বিচারক, সাজানো রায় দিয়ে ইতিহাসের বর্বরতম জুডিশিয়াল কিলিং করে আমাদের নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। বিদেশ থেকে রায় লিখে দেওয়া হয়েছে। সেই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হচ্ছে শেখ হাসিনা।’ তিনি বলেন, ‘যে ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিল আলেমদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য, আল্লাহর কী বিচার, এখন সেই ট্রাইব্যুনালেই তার বিচারের আয়োজন চলছে। দুই শর ওপর মামলা হয়ে গেছে ট্রাইব্যুনালে। রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে, ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে।’

গাজীপুরে জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাজীপুরে জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। ছবি: আজকের পত্রিকা

মিয়া গোলাম পরওয়ার আরও বলেন, ‘তিনি এখন ভারতে পালিয়ে গিয়েছেন। সেখান থেকেও তিনি ষড়যন্ত্র করছেন। একজন আন্তর্জাতিক খুনি ও সব খুনের মাস্টারমাইন্ডকে ভারত আশ্রয় দিয়ে জেনেভা কনভেনশন এবং সকল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে। তাহলে আমরা এটা বলতে বাধ্য, এত বছরের জুলুম নির্যাতন, লুটপাট খুনের পেছনে তাদেরও হাত ছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতকে চিঠি দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য। তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

জুলাই বিপ্লবের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক পরওয়ার বলেন, ‘এ আন্দোলনে ২ হাজার ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে, ৪০ হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। এই যে ত্যাগ, এই যে আত্মদান, রক্তদান, যারা চলে গেল তারা তো বিজয় দেখে যেতে পারল না। তাদের স্ত্রী-সন্তান-শিশুরা কাঁদে, আহতরা হাসপাতালে, মুক্তির স্বাদ তারা দেখতে পারছে না। যারা আত্মত্যাগ করে গেল, তাদের রক্তের এই ঋণ, এই ত্যাগ আমাদের শোধ করতে হবে। আমরা সবাই তাদের রক্তের কাছে ঋণী আছি। তা শোধ করার একটাই উপায় তা হচ্ছে, তারা যে ইনসাফপূর্ণ একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য রক্ত দিয়েছিল, সেই স্বাধীন, সোনার, সমৃদ্ধ, নিরাপদ, কল্যাণ রাষ্ট্রের বাংলাদেশ আমাদের গড়তে হবে। তাহলেই শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করা যাবে। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা এই নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। কিন্তু সেখানেও অন্তরায়। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ঐক্যের চেতনা ছিল, কোনো ষড়যন্ত্র কোনো লোভ নতুন করে এই অগ্রযাত্রাকে মাঝে মাঝে যেন বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।’

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিলাম, নেতৃত্ব দিয়েছি, রক্ত দিয়েছি, শহীদ হয়েছি; তাদের কাছে আমার মিনতি, জুলাই অভ্যুত্থানের যে চেতনা, এই ঐক্যের আলোকে আসুন এটাকে জাতীয় ঐক্যের পরিবেশ তৈরি করে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেই সংস্কারটুকু করে আমরা নির্বাচনে যাই।’

জেলা জামায়াতের আমির ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ড. মো. সামিউল হক ফারুকী, কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য মো. আবুল হাশেম খান, গাজীপুর মহানগর আমির অধ্যাপক মুহা. জামাল উদ্দিন প্রমুখ। এ ছাড়া জুলাই আগস্ট আন্দোলনে আহত পোশাককর্মী মুকুল কুমার দত্ত এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত