ফজলুল কবির
এক মাস পার না হতেই সবকিছুই যেন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা ছিল। জানা ছিল—এসব স্বাভাবিকতা পেয়ে যাবে, যেমন পেয়েছে এর আগে। সবকিছু অনেকটা চিত্রনাট্য মেনেই হয়েছে বলা যায়। কুমিল্লায় হামলা, চাঁদপুরে বিস্তার এবং সেভাবে এগোতে এগোতে এল রংপুরে। তারপর সবার সক্রিয় হয়ে ওঠা। এ এক দারুণ দৃশ্য। সেই নাসিরনগর থেকে শুরু করে সবশেষ রংপুর—কোথাও এই দৃশ্যের কোনো হেরফের হয়নি।
এসব দৃশ্যের পর নিয়ম মেনে প্রতিবাদ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। পেশাজীবী, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক নানা সংগঠন বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সবাই বেশ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতিবাদস্থলগুলোর দিকে তাকালে কিছু প্রশ্ন সামনে এসে যাবে। বিশেষত, প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলোর স্থান এবং প্রতিবাদী মুখগুলোর যে ধ্রুব প্রতিরূপ, তা বেশ গুরুতর প্রশ্ন তুলে দেয়।
রাজধানীর দিকে তাকালে এই প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলোর একটি বিশেষ চরিত্রের দেখা মিলবে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানের রাজনীতির প্রসঙ্গটি। এ নিয়ে এখানে কথা বলাটা প্রসঙ্গান্তর হয়ে যেতে পারে। তাই এড়িয়ে যাওয়া হলো।
রাজধানীতে এই কর্মসূচিগুলো মুখ্যত শাহবাগকেন্দ্রিক। সঙ্গে শহীদ মিনার, রাজু ভাস্কর্য, জাতীয় প্রেসক্লাব ইত্যাদি আছে। এই স্থানগুলোতে গেলে প্রতিদিনই সাম্প্রতিক হামলার প্রতিবাদে নানা ধারার প্রতিবাদ কর্মসূচির দেখা মিলবে। এর মধ্যে রয়েছে মানববন্ধন (এটি বেশ জনপ্রিয় কর্মসূচি), বিক্ষোভ সমাবেশ বা সমাবেশ, প্রতিবাদী শিল্প প্রদর্শনী, প্রতিবাদী গান-কবিতার আয়োজন, বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি পেশের আগে শোভাযাত্রা ইত্যাদি। ও হ্যাঁ, মশাল মিছিলও হয়েছিল বেশ কয়েকটি। মোমবাতি প্রজ্বালন, প্রতীকী অনশনসহ রয়েছে আরও বিচিত্র সব কর্মসূচি।
রাজধানীর বাইরে গেলেও এ ধরনের কর্মসূচির মধ্যে এই কয়েকটি ধরনই শুধু পাওয়া যাবে। তবে এলাকাভেদে এই ধরনের বৈচিত্র্যও কমে আসবে নিঃসন্দেহে। আর স্থানের প্রশ্ন উঠলে স্থানীয় প্রেসক্লাব, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রাঙ্গণকেই প্রতিবাদের স্থল হিসেবে বেছে নেওয়ার রেওয়াজ দৃশ্যমান।
রাজধানী বা রাজধানীর বাইরে এই গুটিকয় স্থানে গেলেই এখন একটা অসাম্প্রদায়িক আবহের দেখা মেলে। না, এ নিয়ে দুঃখ নেই। রাজু ভাস্কর্যে যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে সহিংসতাবিরোধী কনসার্ট হলো, তা তো আশাই জাগায়। সেখানে হাজির হাজারো তরুণ-যুবাসহ নানা বয়সী মানুষের জমায়েত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনসমাজের একমুখী গতিপথের বিরুদ্ধেই একটা আওয়াজ তৈরি করে। এটা আশাজাগানিয়া। কিন্তু এটিই দুঃখের কারণ হয়, যখন এই জমায়েতের একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার অস্বস্তিকর প্রশ্নটি সামনে আসে।
কিছু নির্দিষ্ট প্রতিবাদ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলেই আবদ্ধ হয়ে পড়াটা নিঃসন্দেহে প্রতিবাদী সেই ভাষার, সেই অবস্থানের পরিসরের সংকুচিত হয়ে পড়ার ইঙ্গিতবাহী। রাজু ভাস্কর্যের কনসার্টে যাঁরা যোগ দিলেন, বা যাঁরা না দিয়েও দূর থেকে সংহতি জানালেন, শাহবাগে প্রতিদিন যাঁরা আসছেন এবং প্রেসক্লাবে যারা রোজ রোজ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা তো গোটা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে আছেন বা থাকেন। কিন্তু এই স্থানগুলোতে আসার আগ পর্যন্ত ঠিক প্ল্যাকার্ডটি বা স্লোগানটি হাতে বা কণ্ঠে তুলে নেন না। চিৎকার করে বলেন না যে ‘এ ঠিক নয়, আমি মানি না।’ অথচ এই স্থানগুলোতে এলে তাঁরা ঠিকই কণ্ঠকে উচ্চগ্রামে তুলে ‘মানি না’ শব্দটি উচ্চারণ করছেন। দিচ্ছেন আরও কড়া কড়া সব স্লোগান। কিন্তু নিজ অঞ্চলে হওয়া হামলার সময় তাঁর কণ্ঠটি হয়তো ঠিকই রুদ্ধ ছিল।
তাহলে প্রতিবাদের যথার্থ সময়টি পেরিয়ে কেন প্রতিবাদ? এর উত্তর খুঁজতে হলে কয়েকটি অস্বস্তিকর বিষয়ের দিকে তাকাতে হবে। এর প্রথমটি অতি অবশ্যই নিরাপত্তা। নাগরিকদের পক্ষ থেকে প্রথম ধাক্কাতেই বা ঘটনাস্থলেই প্রতিবাদী পদক্ষেপটি না আসার কারণ নিঃসন্দেহে নিরাপত্তা। নাগরিকদের মনে সে সময় নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নটিই সবার আগে আসে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি দ্বিধা তৈরি করে, তা হলো প্রতিবাদে সঙ্গী পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে সংশয়। এই সংশয় সঠিক সময়ে প্রতিবাদ করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই নিরাপত্তা ও প্রতিবাদে সঙ্গী পাওয়াবিষয়ক সংশয়ের সঙ্গে যুক্ত আছে রাষ্ট্রপ্রকল্প। প্রশ্নটির উত্তরে তৃতীয় যে অস্বস্তিকর উত্তর সামনে আসে, তা হলো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কিছু বিষয়ের সুনির্দিষ্টায়ন। শুরুতেই যে ধরনগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার বৃত্তের মধ্যেই যেন সব প্রতিবাদ বন্দী হয়ে পড়েছে। সঙ্গে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
এ ক্ষেত্রে জনপরিসরে চলমান দুটি প্রবণতা বেশ স্পষ্টভাবে শনাক্ত হয়। এক. কোনো ঘটনা বা ঘটনাপ্রবাহের কারণে নিজের ভেতরে হওয়া বিরুদ্ধভাব নাগরিকেরা প্রথমেই গিলে ফেলার চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করে। নিজের ভেতরে হওয়া বিরুদ্ধভাব তাঁর ভেতরে এক অব্যাখ্যাত অস্বস্তির জন্ম দেয়। এই অস্বস্তি প্রতিমুহূর্তে তাঁকে বলে দেয়—‘শান্ত থাকো, তুমিও সংখ্যালঘু।’ কারণ, তাঁর দরজার বাইরে তখন অজস্র যুদ্ধংদেহী মানুষ সংখ্যা ও কণ্ঠের উচ্চতা দিয়ে নিজেদের ‘সংখ্যাগুরু’ হিসেবে ঘোষণা করছে। যদিও বাইরে থাকা সেই আপাত ‘সংখ্যাগুরুও’ জানে না, তারা আসলে কার হয়ে কী খেলছে।
দ্বিতীয় যে প্রবণতা, তাকে অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়া সিনড্রোম বলা যায়। এটা অনেকটা মুখ দেখানো বিষয়। ক্যামেরার সামনে মুখ দেখানোর লোভ তো বড় বড় তারকাও সংবরণ করতে পারেন না, সাধারণ মানুষের আর দোষ কী? ফলে এই প্রবণতা এখন মহামারির পর্যায়ে চলে গেছে। এটা হলো অনেকটা নিরাপদ বলয়ে থেকে টুকটাক প্রতিবাদ করা। এর লাভও আছে বেশ, চলতি ধারার সঙ্গেও থাকা যায়, আবার কিছু ফ্যান-ফলোয়ারও তৈরি হয়। ফলে বাস্তব জীবনে একজনের চর্চা যা-ই হোক না কেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই প্রচলিত ন্যায় ধারণার সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করেন। এটি একজন ব্যক্তির এমন ভাবমূর্তি তৈরি করে, যা হয়তো ঠিকঠাক তার প্রতিনিধিত্বও করে না।
এই প্রবণতার নির্মাতা কে?
এই যে প্রতিবাদের ধরন ও সাধারণের মধ্যে বিদ্যমান প্রবণতা—এর নির্মাতা আসলে কে? এর এক কথায় উত্তর—‘রাষ্ট্র’। রাষ্ট্র কাজটি কোনো ঘোষণা দিয়ে করে না। সে বলেও দেয় না যে এভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন বা ওই স্থানে সমবেত হোন। রাষ্ট্র এ-ও বলে দেয় না যে নিজ পাড়া-মহল্লা বা গ্রামে থেকে প্রতিবাদ করবেন না। এর কোনোটিই রাষ্ট্র উচ্চারণ করে না, প্রজ্ঞাপন দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে ঘোষণা করে না। কিন্তু তার পরও এটি রাষ্ট্রেরই নির্মাণ।
কীভাবে? এর জন্য রাষ্ট্রের হাতে আছে অগণিত পাঠশালা। প্রথমেই আছে আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত, আইনপ্রণেতা ও তাঁদের দেওয়া বক্তব্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তাঁদের কোলঘেঁষা রাজনীতির ধারা ইত্যাদি আছে সবচেয়ে ওপরের স্তরে, যাকে চোখে দেখা যায় বা যার কার্যক্রম অনুধাবন করা যায়। ফলে যেকোনো অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে নাগরিকদের এগুলোর শরণই নিতে দেখা যায়। এই শরণ নেওয়ার পর এই কাঠামোগুলোর আচরণ বা প্রতিক্রিয়া আদতে নির্ধারণ করে দেয়—কোন অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়া যাবে, আর কোনটির নয়। কোন প্রতিবাদ কতটা উচ্চগ্রামে হবে বা আদৌ হবে না—তাও এই পতিক্রিয়ার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। একটির প্রতিক্রিয়া অন্যটির সীমা নির্ধারণ করে দেয়। রাষ্ট্রের এই তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যায়-অন্যায়, আচার-অনাচার ইত্যাদির বহিরাবরণ ঠিক করে দেয়।
আর এই আচার-অনাচারের মনটি তৈরি করে শিক্ষাক্রম, পাঠদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা সম্পর্কিত রীতি-নীতি ইত্যাদি। আবার এই শিক্ষাক্রম, পাঠদান, রীতি-নীতি ইত্যাদি কে কতটা লঙ্ঘন করতে পারবে, তা দিয়েও জনপরিসরে একটা বার্তা দেওয়া হয়, যা আচার-অনাচারের মন নির্মাণের কাজটি করে। এর সঙ্গে যখন সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি সংগঠন এবং অতি অবশ্যই পরিবার যুক্ত হয়, তখন এই নির্মাতার রূপটিকে আর সহজে চিহ্নিত করা যায় না। আর এই খোলসের মধ্যে থেকেই ক্রমাগত উৎপাদন হয়ে চলে সেই সব ধারণা, যা রাষ্ট্রের কাঠামো ও তার শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকার মূল শর্ত।
এটি এমন এক সমন্বয়, যা ক্ষমতায় সম্পূর্ণ নতুন কাউকে বসিয়েও ঠিক বদলানো যায় না। ভাঙনপ্রবণ নদীর গভীরে থাকা চোরা স্রোতের সঙ্গেই শুধু এর তুলনা চলে। ওপরে শান্ত নদীর গভীরে থাকা এই চোরা স্রোতই খেয়ে ফেলে পাড়ের মাটি ও বাঁধন। গ্রাস করে একের পর এক ঘর-গেরস্থালি। আর সেই ভাঙন শুরু হলেই কেবল ক্ষয়টি সামনে আসে।
সাম্প্রদায়িক হামলা ও তার পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এই এত আলাপের মিল কোথায়? বাংলাদেশ তো বহুত্ববাদের কথা বলে। সরকার থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বারবার অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথাই বলে। সাম্প্রদায়িক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মোটাদাগে সবার কাছ থেকেই সবিস্ময় প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আর এখানেই হাজির হয় প্রশ্নটি। সাম্প্রদায়িক হামলার এই নজির যদি সত্য হয়, তবে বিস্ময় ঠিক খাপ খায় না। আবার বিস্ময়কে আমলে নিলে হামলার বাস্তবতা তো থাকার কথা নয়।
কিন্তু দুটোই হচ্ছে। অর্থাৎ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার যে বাণী, তা একটি শহুরে নাগরিক অভিলাষ মাত্র। এই অভিলাষ বাস্তব রূপ পায়নি। না হলে কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ তাৎক্ষণিকভাবে কুমিল্লাতেই হওয়ার কথা, তা চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বা রংপুর পর্যন্ত যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না। ওই একটি ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি এলাকায় এমন রাষ্ট্র গড়ার ইচ্ছা পোষণ করা ব্যক্তিরা প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে তেমনটা হয়নি। বরং, একটা ভয়ের আবহ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোকে দেখা গেছে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসতে, খবরের শরীর কাটছাঁট করতে, খবর গিলে ফেলতে। এমনকি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ত্বরিত পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সেখানেও দ্বিধা ছিল—কতটা এগোনো যাবে, কতটা যাবে না—এই নিয়ে।
অর্থাৎ, মূল ধারাটি নিয়ে সবাই সংশয়ে ছিল। প্রকৃতিগতভাবেই অধিকাংশ মানুষ মূলধারায় থাকতে চায়। তার সমাজবদ্ধ না হয়ে, জোট না বেঁধে কোনো উপায় নেই। তার বিবর্তনই হয়েছে এই পথ ধরে। ফলে তাকে দল পাকাতে হয়। যে দলে সংখ্যা বেশি, সেই দলেই ভিড়ে যাওয়ার প্রবণতা অধিকাংশের। এ কারণে একটা নিরাপদ আবহ তৈরির আগ পর্যন্ত এমনকি কাউকে ঘটনাস্থল থেকে সুদূর শাহবাগেও সমবেত হতে দেখা যায় না। অথচ, তখনো রংপুর ঘটেনি, ঘটেনি হাজীগঞ্জ। সবার মধ্যেই আরও বড় সংকট এড়ানোর লক্ষ্যে নীরবতা পালনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
কথা হলো, এই নীরবতা পালনের বার্তাটি ঠিক কে দিল? এই বার্তাই আচার-অনাচারের মনের নির্মাতা সেই প্রতিষ্ঠানগুলো দিল। যেগুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায়।
যখন নীরবতা ভাঙল, তখনো তা কিছু রীতি মেনেই ভাঙল। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা সংগঠন যখন প্রতিবাদে নামল, সমাজের নানা স্তরের পেশাজীবীরা যখন প্রতিবাদী বিবৃতি দিলেন, তখনো সেই একই রীতিই চোখে পড়ল। সুনির্দিষ্ট কিছু স্থান, সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য সামনে এল এবং এখনো আসছে। এও আরেক ধরনের আচারই বলা যায়। সুন্দরবন ধ্বংস হলে যেমন, রাজনীতিবিদ খুন হলে যেমন, অ্যাকটিভিস্ট গুম হলে যেমন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হলে যেমন, কর্মসংস্থানের দাবিও ঠিক তেমনভাবেই মঞ্চায়ন হয়। এও এক প্রকল্পিত ছক। এটিও নানা ঘটনায় নাগরিক প্রতিক্রিয়ার ধরনটি নির্ধারণ করে দেয়। এরও আছে জনপ্রিয় ও অজনপ্রিয় ধারা। এরও আছে মিডিয়াবান্ধব ও অবান্ধব ধারা। এটিও বলে দেয় প্রতিবাদের পথ ঠিক কতটা হাঁটা নিরাপদ, কতটা হাঁটাই দস্তুর। ফলে ঘুরেফিরে মূলধারা থেকে একটু বাইরে চলার ঝুঁকি নেওয়া লোকেরাও এমন একটি বৃত্ত পেয়ে যায়, যাকে ঘিরে স্বচ্ছন্দে দিনের পর দিন ঘুরপাক খাওয়া যায়। আর এই ঘুরপাকই আদতে ‘রাষ্ট্র’ নামের ঘড়িটিকে ঠিক রাখে, যে কিছু বিশেষ ধরনের অন্যায়ের দায়মুক্তি দেয় এবং বহুদিন ধরেই দিয়ে আসছে।
এক মাস পার না হতেই সবকিছুই যেন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা ছিল। জানা ছিল—এসব স্বাভাবিকতা পেয়ে যাবে, যেমন পেয়েছে এর আগে। সবকিছু অনেকটা চিত্রনাট্য মেনেই হয়েছে বলা যায়। কুমিল্লায় হামলা, চাঁদপুরে বিস্তার এবং সেভাবে এগোতে এগোতে এল রংপুরে। তারপর সবার সক্রিয় হয়ে ওঠা। এ এক দারুণ দৃশ্য। সেই নাসিরনগর থেকে শুরু করে সবশেষ রংপুর—কোথাও এই দৃশ্যের কোনো হেরফের হয়নি।
এসব দৃশ্যের পর নিয়ম মেনে প্রতিবাদ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। পেশাজীবী, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক নানা সংগঠন বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সবাই বেশ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতিবাদস্থলগুলোর দিকে তাকালে কিছু প্রশ্ন সামনে এসে যাবে। বিশেষত, প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলোর স্থান এবং প্রতিবাদী মুখগুলোর যে ধ্রুব প্রতিরূপ, তা বেশ গুরুতর প্রশ্ন তুলে দেয়।
রাজধানীর দিকে তাকালে এই প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলোর একটি বিশেষ চরিত্রের দেখা মিলবে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানের রাজনীতির প্রসঙ্গটি। এ নিয়ে এখানে কথা বলাটা প্রসঙ্গান্তর হয়ে যেতে পারে। তাই এড়িয়ে যাওয়া হলো।
রাজধানীতে এই কর্মসূচিগুলো মুখ্যত শাহবাগকেন্দ্রিক। সঙ্গে শহীদ মিনার, রাজু ভাস্কর্য, জাতীয় প্রেসক্লাব ইত্যাদি আছে। এই স্থানগুলোতে গেলে প্রতিদিনই সাম্প্রতিক হামলার প্রতিবাদে নানা ধারার প্রতিবাদ কর্মসূচির দেখা মিলবে। এর মধ্যে রয়েছে মানববন্ধন (এটি বেশ জনপ্রিয় কর্মসূচি), বিক্ষোভ সমাবেশ বা সমাবেশ, প্রতিবাদী শিল্প প্রদর্শনী, প্রতিবাদী গান-কবিতার আয়োজন, বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি পেশের আগে শোভাযাত্রা ইত্যাদি। ও হ্যাঁ, মশাল মিছিলও হয়েছিল বেশ কয়েকটি। মোমবাতি প্রজ্বালন, প্রতীকী অনশনসহ রয়েছে আরও বিচিত্র সব কর্মসূচি।
রাজধানীর বাইরে গেলেও এ ধরনের কর্মসূচির মধ্যে এই কয়েকটি ধরনই শুধু পাওয়া যাবে। তবে এলাকাভেদে এই ধরনের বৈচিত্র্যও কমে আসবে নিঃসন্দেহে। আর স্থানের প্রশ্ন উঠলে স্থানীয় প্রেসক্লাব, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রাঙ্গণকেই প্রতিবাদের স্থল হিসেবে বেছে নেওয়ার রেওয়াজ দৃশ্যমান।
রাজধানী বা রাজধানীর বাইরে এই গুটিকয় স্থানে গেলেই এখন একটা অসাম্প্রদায়িক আবহের দেখা মেলে। না, এ নিয়ে দুঃখ নেই। রাজু ভাস্কর্যে যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে সহিংসতাবিরোধী কনসার্ট হলো, তা তো আশাই জাগায়। সেখানে হাজির হাজারো তরুণ-যুবাসহ নানা বয়সী মানুষের জমায়েত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনসমাজের একমুখী গতিপথের বিরুদ্ধেই একটা আওয়াজ তৈরি করে। এটা আশাজাগানিয়া। কিন্তু এটিই দুঃখের কারণ হয়, যখন এই জমায়েতের একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার অস্বস্তিকর প্রশ্নটি সামনে আসে।
কিছু নির্দিষ্ট প্রতিবাদ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলেই আবদ্ধ হয়ে পড়াটা নিঃসন্দেহে প্রতিবাদী সেই ভাষার, সেই অবস্থানের পরিসরের সংকুচিত হয়ে পড়ার ইঙ্গিতবাহী। রাজু ভাস্কর্যের কনসার্টে যাঁরা যোগ দিলেন, বা যাঁরা না দিয়েও দূর থেকে সংহতি জানালেন, শাহবাগে প্রতিদিন যাঁরা আসছেন এবং প্রেসক্লাবে যারা রোজ রোজ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা তো গোটা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে আছেন বা থাকেন। কিন্তু এই স্থানগুলোতে আসার আগ পর্যন্ত ঠিক প্ল্যাকার্ডটি বা স্লোগানটি হাতে বা কণ্ঠে তুলে নেন না। চিৎকার করে বলেন না যে ‘এ ঠিক নয়, আমি মানি না।’ অথচ এই স্থানগুলোতে এলে তাঁরা ঠিকই কণ্ঠকে উচ্চগ্রামে তুলে ‘মানি না’ শব্দটি উচ্চারণ করছেন। দিচ্ছেন আরও কড়া কড়া সব স্লোগান। কিন্তু নিজ অঞ্চলে হওয়া হামলার সময় তাঁর কণ্ঠটি হয়তো ঠিকই রুদ্ধ ছিল।
তাহলে প্রতিবাদের যথার্থ সময়টি পেরিয়ে কেন প্রতিবাদ? এর উত্তর খুঁজতে হলে কয়েকটি অস্বস্তিকর বিষয়ের দিকে তাকাতে হবে। এর প্রথমটি অতি অবশ্যই নিরাপত্তা। নাগরিকদের পক্ষ থেকে প্রথম ধাক্কাতেই বা ঘটনাস্থলেই প্রতিবাদী পদক্ষেপটি না আসার কারণ নিঃসন্দেহে নিরাপত্তা। নাগরিকদের মনে সে সময় নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নটিই সবার আগে আসে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি দ্বিধা তৈরি করে, তা হলো প্রতিবাদে সঙ্গী পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে সংশয়। এই সংশয় সঠিক সময়ে প্রতিবাদ করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই নিরাপত্তা ও প্রতিবাদে সঙ্গী পাওয়াবিষয়ক সংশয়ের সঙ্গে যুক্ত আছে রাষ্ট্রপ্রকল্প। প্রশ্নটির উত্তরে তৃতীয় যে অস্বস্তিকর উত্তর সামনে আসে, তা হলো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কিছু বিষয়ের সুনির্দিষ্টায়ন। শুরুতেই যে ধরনগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার বৃত্তের মধ্যেই যেন সব প্রতিবাদ বন্দী হয়ে পড়েছে। সঙ্গে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
এ ক্ষেত্রে জনপরিসরে চলমান দুটি প্রবণতা বেশ স্পষ্টভাবে শনাক্ত হয়। এক. কোনো ঘটনা বা ঘটনাপ্রবাহের কারণে নিজের ভেতরে হওয়া বিরুদ্ধভাব নাগরিকেরা প্রথমেই গিলে ফেলার চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করে। নিজের ভেতরে হওয়া বিরুদ্ধভাব তাঁর ভেতরে এক অব্যাখ্যাত অস্বস্তির জন্ম দেয়। এই অস্বস্তি প্রতিমুহূর্তে তাঁকে বলে দেয়—‘শান্ত থাকো, তুমিও সংখ্যালঘু।’ কারণ, তাঁর দরজার বাইরে তখন অজস্র যুদ্ধংদেহী মানুষ সংখ্যা ও কণ্ঠের উচ্চতা দিয়ে নিজেদের ‘সংখ্যাগুরু’ হিসেবে ঘোষণা করছে। যদিও বাইরে থাকা সেই আপাত ‘সংখ্যাগুরুও’ জানে না, তারা আসলে কার হয়ে কী খেলছে।
দ্বিতীয় যে প্রবণতা, তাকে অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়া সিনড্রোম বলা যায়। এটা অনেকটা মুখ দেখানো বিষয়। ক্যামেরার সামনে মুখ দেখানোর লোভ তো বড় বড় তারকাও সংবরণ করতে পারেন না, সাধারণ মানুষের আর দোষ কী? ফলে এই প্রবণতা এখন মহামারির পর্যায়ে চলে গেছে। এটা হলো অনেকটা নিরাপদ বলয়ে থেকে টুকটাক প্রতিবাদ করা। এর লাভও আছে বেশ, চলতি ধারার সঙ্গেও থাকা যায়, আবার কিছু ফ্যান-ফলোয়ারও তৈরি হয়। ফলে বাস্তব জীবনে একজনের চর্চা যা-ই হোক না কেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই প্রচলিত ন্যায় ধারণার সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করেন। এটি একজন ব্যক্তির এমন ভাবমূর্তি তৈরি করে, যা হয়তো ঠিকঠাক তার প্রতিনিধিত্বও করে না।
এই প্রবণতার নির্মাতা কে?
এই যে প্রতিবাদের ধরন ও সাধারণের মধ্যে বিদ্যমান প্রবণতা—এর নির্মাতা আসলে কে? এর এক কথায় উত্তর—‘রাষ্ট্র’। রাষ্ট্র কাজটি কোনো ঘোষণা দিয়ে করে না। সে বলেও দেয় না যে এভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন বা ওই স্থানে সমবেত হোন। রাষ্ট্র এ-ও বলে দেয় না যে নিজ পাড়া-মহল্লা বা গ্রামে থেকে প্রতিবাদ করবেন না। এর কোনোটিই রাষ্ট্র উচ্চারণ করে না, প্রজ্ঞাপন দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে ঘোষণা করে না। কিন্তু তার পরও এটি রাষ্ট্রেরই নির্মাণ।
কীভাবে? এর জন্য রাষ্ট্রের হাতে আছে অগণিত পাঠশালা। প্রথমেই আছে আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত, আইনপ্রণেতা ও তাঁদের দেওয়া বক্তব্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তাঁদের কোলঘেঁষা রাজনীতির ধারা ইত্যাদি আছে সবচেয়ে ওপরের স্তরে, যাকে চোখে দেখা যায় বা যার কার্যক্রম অনুধাবন করা যায়। ফলে যেকোনো অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে নাগরিকদের এগুলোর শরণই নিতে দেখা যায়। এই শরণ নেওয়ার পর এই কাঠামোগুলোর আচরণ বা প্রতিক্রিয়া আদতে নির্ধারণ করে দেয়—কোন অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়া যাবে, আর কোনটির নয়। কোন প্রতিবাদ কতটা উচ্চগ্রামে হবে বা আদৌ হবে না—তাও এই পতিক্রিয়ার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। একটির প্রতিক্রিয়া অন্যটির সীমা নির্ধারণ করে দেয়। রাষ্ট্রের এই তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যায়-অন্যায়, আচার-অনাচার ইত্যাদির বহিরাবরণ ঠিক করে দেয়।
আর এই আচার-অনাচারের মনটি তৈরি করে শিক্ষাক্রম, পাঠদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা সম্পর্কিত রীতি-নীতি ইত্যাদি। আবার এই শিক্ষাক্রম, পাঠদান, রীতি-নীতি ইত্যাদি কে কতটা লঙ্ঘন করতে পারবে, তা দিয়েও জনপরিসরে একটা বার্তা দেওয়া হয়, যা আচার-অনাচারের মন নির্মাণের কাজটি করে। এর সঙ্গে যখন সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি সংগঠন এবং অতি অবশ্যই পরিবার যুক্ত হয়, তখন এই নির্মাতার রূপটিকে আর সহজে চিহ্নিত করা যায় না। আর এই খোলসের মধ্যে থেকেই ক্রমাগত উৎপাদন হয়ে চলে সেই সব ধারণা, যা রাষ্ট্রের কাঠামো ও তার শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকার মূল শর্ত।
এটি এমন এক সমন্বয়, যা ক্ষমতায় সম্পূর্ণ নতুন কাউকে বসিয়েও ঠিক বদলানো যায় না। ভাঙনপ্রবণ নদীর গভীরে থাকা চোরা স্রোতের সঙ্গেই শুধু এর তুলনা চলে। ওপরে শান্ত নদীর গভীরে থাকা এই চোরা স্রোতই খেয়ে ফেলে পাড়ের মাটি ও বাঁধন। গ্রাস করে একের পর এক ঘর-গেরস্থালি। আর সেই ভাঙন শুরু হলেই কেবল ক্ষয়টি সামনে আসে।
সাম্প্রদায়িক হামলা ও তার পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এই এত আলাপের মিল কোথায়? বাংলাদেশ তো বহুত্ববাদের কথা বলে। সরকার থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বারবার অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথাই বলে। সাম্প্রদায়িক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মোটাদাগে সবার কাছ থেকেই সবিস্ময় প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আর এখানেই হাজির হয় প্রশ্নটি। সাম্প্রদায়িক হামলার এই নজির যদি সত্য হয়, তবে বিস্ময় ঠিক খাপ খায় না। আবার বিস্ময়কে আমলে নিলে হামলার বাস্তবতা তো থাকার কথা নয়।
কিন্তু দুটোই হচ্ছে। অর্থাৎ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার যে বাণী, তা একটি শহুরে নাগরিক অভিলাষ মাত্র। এই অভিলাষ বাস্তব রূপ পায়নি। না হলে কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ তাৎক্ষণিকভাবে কুমিল্লাতেই হওয়ার কথা, তা চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বা রংপুর পর্যন্ত যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না। ওই একটি ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি এলাকায় এমন রাষ্ট্র গড়ার ইচ্ছা পোষণ করা ব্যক্তিরা প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে তেমনটা হয়নি। বরং, একটা ভয়ের আবহ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোকে দেখা গেছে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসতে, খবরের শরীর কাটছাঁট করতে, খবর গিলে ফেলতে। এমনকি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ত্বরিত পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সেখানেও দ্বিধা ছিল—কতটা এগোনো যাবে, কতটা যাবে না—এই নিয়ে।
অর্থাৎ, মূল ধারাটি নিয়ে সবাই সংশয়ে ছিল। প্রকৃতিগতভাবেই অধিকাংশ মানুষ মূলধারায় থাকতে চায়। তার সমাজবদ্ধ না হয়ে, জোট না বেঁধে কোনো উপায় নেই। তার বিবর্তনই হয়েছে এই পথ ধরে। ফলে তাকে দল পাকাতে হয়। যে দলে সংখ্যা বেশি, সেই দলেই ভিড়ে যাওয়ার প্রবণতা অধিকাংশের। এ কারণে একটা নিরাপদ আবহ তৈরির আগ পর্যন্ত এমনকি কাউকে ঘটনাস্থল থেকে সুদূর শাহবাগেও সমবেত হতে দেখা যায় না। অথচ, তখনো রংপুর ঘটেনি, ঘটেনি হাজীগঞ্জ। সবার মধ্যেই আরও বড় সংকট এড়ানোর লক্ষ্যে নীরবতা পালনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
কথা হলো, এই নীরবতা পালনের বার্তাটি ঠিক কে দিল? এই বার্তাই আচার-অনাচারের মনের নির্মাতা সেই প্রতিষ্ঠানগুলো দিল। যেগুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায়।
যখন নীরবতা ভাঙল, তখনো তা কিছু রীতি মেনেই ভাঙল। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা সংগঠন যখন প্রতিবাদে নামল, সমাজের নানা স্তরের পেশাজীবীরা যখন প্রতিবাদী বিবৃতি দিলেন, তখনো সেই একই রীতিই চোখে পড়ল। সুনির্দিষ্ট কিছু স্থান, সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য সামনে এল এবং এখনো আসছে। এও আরেক ধরনের আচারই বলা যায়। সুন্দরবন ধ্বংস হলে যেমন, রাজনীতিবিদ খুন হলে যেমন, অ্যাকটিভিস্ট গুম হলে যেমন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হলে যেমন, কর্মসংস্থানের দাবিও ঠিক তেমনভাবেই মঞ্চায়ন হয়। এও এক প্রকল্পিত ছক। এটিও নানা ঘটনায় নাগরিক প্রতিক্রিয়ার ধরনটি নির্ধারণ করে দেয়। এরও আছে জনপ্রিয় ও অজনপ্রিয় ধারা। এরও আছে মিডিয়াবান্ধব ও অবান্ধব ধারা। এটিও বলে দেয় প্রতিবাদের পথ ঠিক কতটা হাঁটা নিরাপদ, কতটা হাঁটাই দস্তুর। ফলে ঘুরেফিরে মূলধারা থেকে একটু বাইরে চলার ঝুঁকি নেওয়া লোকেরাও এমন একটি বৃত্ত পেয়ে যায়, যাকে ঘিরে স্বচ্ছন্দে দিনের পর দিন ঘুরপাক খাওয়া যায়। আর এই ঘুরপাকই আদতে ‘রাষ্ট্র’ নামের ঘড়িটিকে ঠিক রাখে, যে কিছু বিশেষ ধরনের অন্যায়ের দায়মুক্তি দেয় এবং বহুদিন ধরেই দিয়ে আসছে।
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে