ফজলুল কবির
বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে, মনের অজান্তেই হাত বা কার্সর চলে যায় স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া আইকনে। শপিং করতে বা শপিংয়ে যাওয়ার আগে বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য ই-কমার্স সাইটগুলোয় বা তেমন দক্ষ না হলে নিদেনপক্ষে গুগলে ঢুঁ মারাটা তো আজকের দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘরের মধ্যেই আস্ত সিনেমা হল ঢুকে পড়ার গল্প তো এখন পুরোনো। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব সত্যিই এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কার হাতের? নিজের হাতের দিকে না তাকিয়ে বরং সত্যিকারের হাতটি খুঁজুন। ভেবে দেখুন আদতে কতগুলো আইকনে আপনার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে না চাইতেই।
হ্যাঁ, ১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব? এক কথায় উত্তর দেওয়ার সুযোগ নেই।
একটু বুঝে নেওয়া যাক বিষয়টি। থ্রি-ডব্লিউ-এর নেতৃত্বাধীন আজকের ইন্টারনেট জমানার শুরুর সময় গণতন্ত্রবাদী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা স্তরের মানুষ বেশ আশা দেখেছিল। অনেকে তো একে একেবারে বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। বলা হচ্ছিল, তথ্য কুক্ষিগত করার চল শেষ হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে ছিল নিরাপত্তার ধোঁয়াটে বিষয়াদিও। কিন্তু এর একটিও কি দেখা গেছে? নাকি সময়ের সঙ্গে এই সবকিছুকেই মানুষ গুটিকয় কিছু করপোরেশনের হাতে বন্দী হতে দেখছে?
বর্তমান দুনিয়ায় থ্রি-ডব্লিউ ও ইন্টারনেট আদতে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমার্থক হয়ে উঠেছে, যেখানে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্যের দুনিয়াকে বন্দী অবস্থায় আমরা দেখি। আর এটি করা হয়েছে ধীরে ও কৌশলী ধারায়। ডিজিটাল রেভল্যুশন নামে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি যে ইন্টারনেটের যাত্রা, তা আর বিপ্লব হয়ে ওঠেনি সাধারণের জন্য। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন এটি আনতে পারেনি। অথচ এর যাত্রাবিন্দুতে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা বহু মানুষ একে তাদের সম্ভাব্য হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ভেবেছিল, পুঁজির মালিক হিসেবে গুটিকয়ের যে শাসন, তাকে তারা এর মাধ্যমে ভেঙে দিতে পারবে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরীক্ষাগার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করে ইন্টারনেট। আজ এই ইন্টারনেটই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, শিক্ষা, বিনোদন, ব্যবসা ইত্যাদির সবচেয়ে সহজ পথ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া শাসনের কাঠামোকে হটাতে পারেনি, বরং তাকে আরও কেন্দ্রীভূত করেছে। ইন্টারনেটের যাত্রা শুরুর সে সময়ে মার্কিন সমাজবিদ ডেনিয়েল বেল শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজের বদলে তথ্য-সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্নের কতটা অর্জন হয়েছে। ইউরোপের সার্ন পরীক্ষাগার থেকে বিশ্বভ্রমণে বেরোনো ইন্টারনেট এখনো তার ভ্রমণ অক্ষুণ্ন রেখেছে। তবে তা মুখ্যত করপোরেট পুঁজির হাত ধরে। তার পরনে মুক্তমত ও তথ্যের স্বাধীনতার খোলস থাকলেও ভেতরে আছে একচেটিয়াকরণের হাড়-মাংস।
এর আদলটিও অন্য যেকোনো পুঁজিবাদী কাঠামোর মেনে চলা তিনটি মূলনীতিকেই অনুসরণ করে। প্রথমত, এটি পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে আড়াল করে; দ্বিতীয়ত, গুটিকয় করপোরেট খেলোয়াড়ের জন্যই শুধু প্রতিযোগিতার ভূমিটি উন্মুক্ত রাখে এবং তৃতীয়ত, সাধারণ জনতা বলতে যাদের বোঝায়, তাদের সামনে প্রভাববলয়ে ঢোকার পথটি সম্ভাব্য সব বাধা দিয়ে আকীর্ণ করে তাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার ‘মহান আদর্শ’ মেনে চলার ফুসলানি দেয়। এটি তিন শ্রেণির মানুষের জন্য তিনটি ভিন্ন সম্ভাবনার কথা বলে।
প্রথমত, এটি জ্ঞানপিপাসু শ্রেণিকে নিজের দিকে টেনে নেয়। বলা হয়, ইন্টারনেট হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগার, যেখানে এসে জড়ো হতে থাকবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো জ্ঞান। উইকিপিডিয়ার মতো উন্মুক্ত বিশ্বকোষগুলো এই সম্ভাবনার একটি বাস্তব উদাহরণ হিসেবে সামনে হাজির থাকে। সত্যিই তো, আজ যেকোনো কিছু জানার জন্য ইন্টারনেটে একটু ঢুঁ মারলেই তো চলছে। তাহলে কথা তো অসত্য নয়।
দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা বা আশঙ্কা সামনে আনা হয়, তা হলো নিরাপত্তা। মূলত রক্ষণশীল ও সামরিক-মনস্কদের লক্ষ্য করেই এই ‘নিরাপত্তা’ কার্ডটি খেলা হয়। দক্ষ রাষ্ট্রের মতো করেই জনমানসে এই ইন্টারনেটকে একটি প্রতিরক্ষা বর্ম হিসেবে হাজির করা হয়। বলা হয়, সবকিছু ভেঙে পড়লে এই ইন্টারনেটই বিকল্প যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। আজ ইন্টারনেট একধরনের সর্বজনীন হয়ে ওঠার পর এর আবার নানা ধরনও তৈরি করা হয়েছে। গড়ে উঠছে সাইবার আর্মিও।
আর তৃতীয় সম্ভাবনা হিসেবে ‘গণতন্ত্রের’ কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এটি মূলত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা লোকজনের জন্য এক উৎকৃষ্ট বড়ি। এই তিন সম্ভাব্যতাই আবার একটি অভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। আর তা হলো—ভয়। মুফতে পাওয়া ‘জ্ঞানকোষ’ হারানো, ‘গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব হওয়া এবং অতি অবশ্যই সামরিক ভয়। যে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এর জন্ম হয়েছিল, সেই স্নায়ুযুদ্ধ কখনোই মানুষের পিছু ছাড়েনি। আর আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এই সামরিক ভয়কে তো বাস্তব করে তুলেছে। তথ্যহীনতা বা তথ্যের প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় বা ভয় মানুষকে বিস্তর ‘অপতথ্যের’ ভয়ের দুনিয়ায় আজ নিয়ে এসেছে।
পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠার কারণেই কিনা, এরও রয়েছে পুঁজির মতোই ক্ষুধা। প্রতিনিয়তই সে নিজেকে বাড়িয়ে তুলছে। প্রবৃদ্ধির দৌড়ে কিন্তু ইন্টারনেট নিজেই হাজির। সেটা কেমন? ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতি মিনিটে ভিডিও আপলোডের পরিমাণ কততে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানেন? মিনিটে ৫০০ ঘণ্টা।
কী আছে এই প্রতি মিনিটের ৫০০ ঘণ্টা আপলোড হওয়া ভিডিওগুলোতে? তথ্য। হ্যাঁ, তথ্যই আছে। কোনটি সত্য বা কোনটি মিথ্যা, সে মীমাংসা পরে। মূল কথা হলো, তথ্য আছে এসবের মধ্যে, সে এবার সিনেমা, নাটক, মিম, কৌতুক, তথ্যচিত্র, টিউটোরিয়াল—যে আঙ্গিকেই হোক না কেন। আদতে গত ৩০ বছরের ইন্টারনেট-জীবন মানুষকে এক তথ্যের সাগরে নিয়ে এসেছে। এই তথ্যের সমুদ্রের মধ্য থেকে কোনটি সে নেবে, আর কোনটি নেবে না—তা নির্বাচন করাটা এক কঠিন বিষয় হয়ে উঠেছে। তার চেয়ে বেশি যা কঠিন হয়েছে, তা হলো মার্কিন কবি ও অ্যাকটিভিস্ট জন পেরি বারলো ঘোষিত সাইবার স্পেসের স্বাধীনতা। ১৯৯৫ সালে তিনি এই সাইবার স্পেসের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বাণিজ্যিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। ফলে বারলো ঘোষিত স্বাধীনতা যেন বলতে না-বলতেই হাতে চলে এল।
আজকের প্রযুক্তি দুনিয়ায় মহিরুহ হয়ে ওঠা চার প্রতিষ্ঠান—আমাজন, গুগল, মেটা ও অ্যাপলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে সেই ক্ষণিকের স্বাধীনতা কতটা হৃত হয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের ব্যবসায় দাঁড়ানোর পরই এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোকে কিনতে শুরু করে। কতটা? জন্মের পর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাপল মোট ১২৩টি ছোট-বড় কোম্পানিকে কিনেছে। এর মধ্যে ২৭টি ছিল নিজ ঘরানার প্রতিষ্ঠান। বাকি সবই তার জন্য নতুন ক্ষেত্র। আমাজন এ ক্ষেত্রে নিজের ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ৪০টি। আর নতুন ধারার কিনেছে ৭১টি। গুগল শুধু সার্চ ইঞ্জিনই কিনেছে ৮১টি। আর নতুন ধারার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিনেছে ১৮৭টি। এই দৌড়ে ফেসবুক বা হালের মেটা কিছুটা পিছিয়ে আছে। তারা নিজ ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ২৮টি, আর নতুন ধারার ৭৭টি। এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে অন্যদের বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করেছে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠেছে একচেটিয়া। আর নতুন ধারার প্রতিষ্ঠান কিনে তারা নিজেদের ‘অস্ত্রাগার’ সমৃদ্ধ করেছে। প্রতিটি নতুন ধারার প্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়ে তারা একইভাবে সংশ্লিষ্ট ধারায় নতুন কারও বেড়ে ওঠার পথকে রুদ্ধ করেছে।
এ তো গেল ২০২১ সাল পর্যন্ত হিসাব, যা জানাল ওয়াশিংটন পোস্ট। জেফ বেজোসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু নিজেদেরও এই মহলে ঢুকে পড়া আটকাতে পারেনি। তারা জানিয়েছে, ইন্টারনেট-দুনিয়ায় নিজেকে একচেটিয়া করে তুলতে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বেজোস যে বিনিয়োগ শুরু করেন, সে পথ ধরেই ওয়াশিংটন পোস্টও তাঁর থলিতে গিয়ে জমা হয়। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ হাজার ওয়েবসাইটের মধ্যে অর্ধেকেরই হোস্টিং অথোরিটি চলে আসে বেজোসের হাতে। সে যাক। ২০২১ সালের পর কী হলো? ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানাচ্ছে, ২০২১ সালে টেক-জায়ান্টরা অন্য কোম্পানি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। পরিমাণটা কত? ২৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার!
এগুলো যে মানুষের জীবনকে সহজ করেনি, এমন নয়। করেছে। বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে এসব প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু আলাপটি প্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে নয়; বরং এর কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে। যে তথ্যের প্রাপ্যতার জন্য মানুষ এত কিছুর সঙ্গে নিজের সমন্বয় করল, তা হাতছাড়া হওয়া নিয়ে। সাইবার স্পেসের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, কীভাবে—সে প্রশ্নটি মগজ থেকে একেবারে উধাও হওয়া নিয়েই বরং এ প্রশ্ন। মানুষ এখন চূড়ান্ত ভোক্তায় পরিণত হয়েছে। তথ্য বলতে যে নিরাকার একটি বস্তুকে মানুষ বোঝে, তা এখন নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মূল সূত্র এখন সে। অথচ এই তথ্য-দুনিয়ার নিয়ন্তারা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেকি ‘গণতন্ত্রপনা’ দিয়ে এই অস্পৃশ্য ব্যাপারটি আবার আড়াল করা যাচ্ছে সহজেই।
কতটা? ইন্টারনেট বস্তুটি যে মার্কিন মুলুক থেকে যাত্রা করেছিল ধীরে ধীরে, তার অধিকর্তাদের একচেটিয়াপনা থামানোর পথ খুঁজে এখন রীতিমতো হয়রান মার্কিন আইনসভা ও বিচার বিভাগই। চিরাচরিত পুঁজির কারবারিরাও এখন এই নয়া দুনিয়ায় নিজের জায়গাটি করে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। করবেন না কেন? ২০২১ সালে অনলাইনে পণ্য বিক্রি হয়েছে কত জানেন? ৪ লাখ ২০০ কোটি ডলারের। আরেকটু হলেই তা জার্মান অর্থনীতিকে (সাড়ে ৪ লাখ কোটি ডলার) ছাড়িয়ে যেত।
মজার বিষয় হলো, এই এত এত একচেটিয়া গল্পের পরও, এত কিছু সামনে থাকার পরও, ইন্টারনেট বস্তুটি কিন্তু সামনে সটান এগিয়ে যাচ্ছে এক ‘নিরপেক্ষতার’ মুখোশ পরে। এর পেছনে এর ভেতরে থাকা সম্ভাবনার শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে কেন্দ্রে থাকা গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও। সম্ভাবনাটি হচ্ছে, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর, প্রযুক্তির মালিকানা বুঝে নেওয়ার। আর পৃষ্ঠপোষকতা? সেটা স্বয়ং রাষ্ট্রের এবং পুঁজির তো বটেই। রাষ্ট্র এটি একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আবার অক্ষতও রাখতে চায়।
একটু বুঝে নেওয়া যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর সত্যিকারের দুনিয়ায় মানুষ বিস্তর বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন কারও বাড়িতে না গিয়েও ঈদের শুভেচ্ছা জানানো যাচ্ছে, চাইলে অনলাইন সালাম ও সালামি আদান-প্রদানও চলছে হরদম। এ জন্য কারও সংস্পর্শে আসার প্রয়োজনই পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে ফিরতে অনায়াসে মোবাইল স্ক্রিনে একটি লাভ ইমো, লাইক, স্যাড ইত্যাদি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের উপস্থিতি। শুভেচ্ছাবার্তা লিখতে আলসেমি লাগলেও সমস্যা নেই, অজস্র ডিজিটাল কার্ড তৈরি আছে; খুঁজতেও হবে না। সাজেশনে আসবে, বেছে নিয়ে একটা দিলেই হলো। যাকে পাঠানো হলো, তার মানসিক পরিস্থিতি যেমন বিবেচ্য নয়, তেমনি যে পাঠাচ্ছে তারও মানসিক অবস্থা এখানে একেবারে ঊহ্য। তাহলে সয়াবিন তেল বা অন্য যেকোনো ইস্যুতে জনদুর্ভোগের বেলায় কী ঘটছে? এ সম্পর্কিত খবরের তলায় একটি অ্যাংরি ইমো বা বেশি খেপে গেলে একটা স্ট্যাটাস, একটা প্রোফাইল পিকচার বা এমন যেকোনো কিছু দিলেই দায়িত্ব চুকে গেল। এতে তেলের দাম না কমলেও, ওয়াসার পানি পরিষ্কার না হলেও, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ না হলেও এমনকি কিছুই না হলেও কাজটি কিন্তু হয়ে গেল। এবার পাশ ফিরে আরামে ঘুমানো যেতেই পারে। এমন মোক্ষম একটি প্রতিরক্ষা বর্মকে তবে রাষ্ট্র কেন হাতছাড়া করবে? মাঝেমধ্যে একটু বকে দিলেও একে রক্ষায়, একে বেড়ে উঠতে দিতে রাষ্ট্র বরং সব রকম চেষ্টা করবে। এ কারণেই মার্কিন সিনেট থেকে শুনানি শেষে মার্ক জাকারবার্গ হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে পারেন। তিনি জানেন, বিশ্বের সব সিনেটই তাঁকে পাশে চায়।
প্রযুক্তি মোগলদের সুরক্ষায় অন্য পুঁজিপতিরাও সদা তৎপর। তারা তাদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ধসিয়ে না দিয়ে নিজেরাই একেকটি সাম্রাজ্য গড়ায় বরং মন দিচ্ছে। কারণ, এটাই পুঁজির ধর্ম। দুর্বলের সবল হয়ে ওঠায় সবলদের বিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকবে কেন? থাকার কথা নয়, নেইও। ফলে ইন্টারনেট ক্যাপিটালিজম ভাঙা নয়, বরং একে আরও দৃঢ় করতেই তারা বেশি নিবিষ্ট। উভয়েরই প্রয়োজন এক বিপুল ভোক্তা শ্রেণি। প্রচলিত পুঁজিপতিরা তাই নিজেদের পছন্দমতো একেকটি ভার্চুয়াল মিত্র খুঁজে নিয়েছে ও নিচ্ছে। যার সঙ্গে যার মিল হয় আরকি! ফলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তো বটেই একাধিক খাত মিলিয়ে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে গুগল, ফেসবুক বা মেটা, অ্যাপল, আমাজন, ইউটিউব, এয়ারবিএনবি, পেপাল, নেটফ্লিক্স, আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান। এমনকি জুড়ি খুঁজে দেওয়ার মতো বিষয়েও তৈরি হচ্ছে নানা ম্যাচমেকার প্ল্যাটফর্ম, যাদের কিছু কিছু এরই মধ্যে নিজেদের ভিত শক্ত করে একচেটিয়া বাণিজ্যের দিকেই এগোচ্ছে।
এহেন একচেটিয়া ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বসে তাই যতই সমাজ বদল বা স্বাধীনতার গল্প ও তর্ক হোক না কেন, তা দিন শেষে পণ্য হিসেবেই বিক্রি করছে সাম্রাজ্যপতিরা। ব্যক্তি ও তার তাবৎ অনুভূতি ও ক্রিয়া আজ ভোক্তা ও পণ্যে পুনঃ পুনঃ রূপায়ণের চক্রে আবদ্ধ, যেন নিজের লেজকেই গিলে খাওয়া সেই সাপ সে। পুরাণ নয়, এ আজকের দিনের নিদারুণ বাস্তবতা।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:
বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে, মনের অজান্তেই হাত বা কার্সর চলে যায় স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া আইকনে। শপিং করতে বা শপিংয়ে যাওয়ার আগে বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য ই-কমার্স সাইটগুলোয় বা তেমন দক্ষ না হলে নিদেনপক্ষে গুগলে ঢুঁ মারাটা তো আজকের দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘরের মধ্যেই আস্ত সিনেমা হল ঢুকে পড়ার গল্প তো এখন পুরোনো। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব সত্যিই এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কার হাতের? নিজের হাতের দিকে না তাকিয়ে বরং সত্যিকারের হাতটি খুঁজুন। ভেবে দেখুন আদতে কতগুলো আইকনে আপনার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে না চাইতেই।
হ্যাঁ, ১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব? এক কথায় উত্তর দেওয়ার সুযোগ নেই।
একটু বুঝে নেওয়া যাক বিষয়টি। থ্রি-ডব্লিউ-এর নেতৃত্বাধীন আজকের ইন্টারনেট জমানার শুরুর সময় গণতন্ত্রবাদী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা স্তরের মানুষ বেশ আশা দেখেছিল। অনেকে তো একে একেবারে বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। বলা হচ্ছিল, তথ্য কুক্ষিগত করার চল শেষ হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে ছিল নিরাপত্তার ধোঁয়াটে বিষয়াদিও। কিন্তু এর একটিও কি দেখা গেছে? নাকি সময়ের সঙ্গে এই সবকিছুকেই মানুষ গুটিকয় কিছু করপোরেশনের হাতে বন্দী হতে দেখছে?
বর্তমান দুনিয়ায় থ্রি-ডব্লিউ ও ইন্টারনেট আদতে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমার্থক হয়ে উঠেছে, যেখানে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্যের দুনিয়াকে বন্দী অবস্থায় আমরা দেখি। আর এটি করা হয়েছে ধীরে ও কৌশলী ধারায়। ডিজিটাল রেভল্যুশন নামে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি যে ইন্টারনেটের যাত্রা, তা আর বিপ্লব হয়ে ওঠেনি সাধারণের জন্য। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন এটি আনতে পারেনি। অথচ এর যাত্রাবিন্দুতে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা বহু মানুষ একে তাদের সম্ভাব্য হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ভেবেছিল, পুঁজির মালিক হিসেবে গুটিকয়ের যে শাসন, তাকে তারা এর মাধ্যমে ভেঙে দিতে পারবে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরীক্ষাগার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করে ইন্টারনেট। আজ এই ইন্টারনেটই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, শিক্ষা, বিনোদন, ব্যবসা ইত্যাদির সবচেয়ে সহজ পথ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া শাসনের কাঠামোকে হটাতে পারেনি, বরং তাকে আরও কেন্দ্রীভূত করেছে। ইন্টারনেটের যাত্রা শুরুর সে সময়ে মার্কিন সমাজবিদ ডেনিয়েল বেল শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজের বদলে তথ্য-সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্নের কতটা অর্জন হয়েছে। ইউরোপের সার্ন পরীক্ষাগার থেকে বিশ্বভ্রমণে বেরোনো ইন্টারনেট এখনো তার ভ্রমণ অক্ষুণ্ন রেখেছে। তবে তা মুখ্যত করপোরেট পুঁজির হাত ধরে। তার পরনে মুক্তমত ও তথ্যের স্বাধীনতার খোলস থাকলেও ভেতরে আছে একচেটিয়াকরণের হাড়-মাংস।
এর আদলটিও অন্য যেকোনো পুঁজিবাদী কাঠামোর মেনে চলা তিনটি মূলনীতিকেই অনুসরণ করে। প্রথমত, এটি পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে আড়াল করে; দ্বিতীয়ত, গুটিকয় করপোরেট খেলোয়াড়ের জন্যই শুধু প্রতিযোগিতার ভূমিটি উন্মুক্ত রাখে এবং তৃতীয়ত, সাধারণ জনতা বলতে যাদের বোঝায়, তাদের সামনে প্রভাববলয়ে ঢোকার পথটি সম্ভাব্য সব বাধা দিয়ে আকীর্ণ করে তাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার ‘মহান আদর্শ’ মেনে চলার ফুসলানি দেয়। এটি তিন শ্রেণির মানুষের জন্য তিনটি ভিন্ন সম্ভাবনার কথা বলে।
প্রথমত, এটি জ্ঞানপিপাসু শ্রেণিকে নিজের দিকে টেনে নেয়। বলা হয়, ইন্টারনেট হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগার, যেখানে এসে জড়ো হতে থাকবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো জ্ঞান। উইকিপিডিয়ার মতো উন্মুক্ত বিশ্বকোষগুলো এই সম্ভাবনার একটি বাস্তব উদাহরণ হিসেবে সামনে হাজির থাকে। সত্যিই তো, আজ যেকোনো কিছু জানার জন্য ইন্টারনেটে একটু ঢুঁ মারলেই তো চলছে। তাহলে কথা তো অসত্য নয়।
দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা বা আশঙ্কা সামনে আনা হয়, তা হলো নিরাপত্তা। মূলত রক্ষণশীল ও সামরিক-মনস্কদের লক্ষ্য করেই এই ‘নিরাপত্তা’ কার্ডটি খেলা হয়। দক্ষ রাষ্ট্রের মতো করেই জনমানসে এই ইন্টারনেটকে একটি প্রতিরক্ষা বর্ম হিসেবে হাজির করা হয়। বলা হয়, সবকিছু ভেঙে পড়লে এই ইন্টারনেটই বিকল্প যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। আজ ইন্টারনেট একধরনের সর্বজনীন হয়ে ওঠার পর এর আবার নানা ধরনও তৈরি করা হয়েছে। গড়ে উঠছে সাইবার আর্মিও।
আর তৃতীয় সম্ভাবনা হিসেবে ‘গণতন্ত্রের’ কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এটি মূলত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা লোকজনের জন্য এক উৎকৃষ্ট বড়ি। এই তিন সম্ভাব্যতাই আবার একটি অভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। আর তা হলো—ভয়। মুফতে পাওয়া ‘জ্ঞানকোষ’ হারানো, ‘গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব হওয়া এবং অতি অবশ্যই সামরিক ভয়। যে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এর জন্ম হয়েছিল, সেই স্নায়ুযুদ্ধ কখনোই মানুষের পিছু ছাড়েনি। আর আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এই সামরিক ভয়কে তো বাস্তব করে তুলেছে। তথ্যহীনতা বা তথ্যের প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় বা ভয় মানুষকে বিস্তর ‘অপতথ্যের’ ভয়ের দুনিয়ায় আজ নিয়ে এসেছে।
পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠার কারণেই কিনা, এরও রয়েছে পুঁজির মতোই ক্ষুধা। প্রতিনিয়তই সে নিজেকে বাড়িয়ে তুলছে। প্রবৃদ্ধির দৌড়ে কিন্তু ইন্টারনেট নিজেই হাজির। সেটা কেমন? ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতি মিনিটে ভিডিও আপলোডের পরিমাণ কততে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানেন? মিনিটে ৫০০ ঘণ্টা।
কী আছে এই প্রতি মিনিটের ৫০০ ঘণ্টা আপলোড হওয়া ভিডিওগুলোতে? তথ্য। হ্যাঁ, তথ্যই আছে। কোনটি সত্য বা কোনটি মিথ্যা, সে মীমাংসা পরে। মূল কথা হলো, তথ্য আছে এসবের মধ্যে, সে এবার সিনেমা, নাটক, মিম, কৌতুক, তথ্যচিত্র, টিউটোরিয়াল—যে আঙ্গিকেই হোক না কেন। আদতে গত ৩০ বছরের ইন্টারনেট-জীবন মানুষকে এক তথ্যের সাগরে নিয়ে এসেছে। এই তথ্যের সমুদ্রের মধ্য থেকে কোনটি সে নেবে, আর কোনটি নেবে না—তা নির্বাচন করাটা এক কঠিন বিষয় হয়ে উঠেছে। তার চেয়ে বেশি যা কঠিন হয়েছে, তা হলো মার্কিন কবি ও অ্যাকটিভিস্ট জন পেরি বারলো ঘোষিত সাইবার স্পেসের স্বাধীনতা। ১৯৯৫ সালে তিনি এই সাইবার স্পেসের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বাণিজ্যিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। ফলে বারলো ঘোষিত স্বাধীনতা যেন বলতে না-বলতেই হাতে চলে এল।
আজকের প্রযুক্তি দুনিয়ায় মহিরুহ হয়ে ওঠা চার প্রতিষ্ঠান—আমাজন, গুগল, মেটা ও অ্যাপলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে সেই ক্ষণিকের স্বাধীনতা কতটা হৃত হয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের ব্যবসায় দাঁড়ানোর পরই এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোকে কিনতে শুরু করে। কতটা? জন্মের পর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাপল মোট ১২৩টি ছোট-বড় কোম্পানিকে কিনেছে। এর মধ্যে ২৭টি ছিল নিজ ঘরানার প্রতিষ্ঠান। বাকি সবই তার জন্য নতুন ক্ষেত্র। আমাজন এ ক্ষেত্রে নিজের ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ৪০টি। আর নতুন ধারার কিনেছে ৭১টি। গুগল শুধু সার্চ ইঞ্জিনই কিনেছে ৮১টি। আর নতুন ধারার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিনেছে ১৮৭টি। এই দৌড়ে ফেসবুক বা হালের মেটা কিছুটা পিছিয়ে আছে। তারা নিজ ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ২৮টি, আর নতুন ধারার ৭৭টি। এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে অন্যদের বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করেছে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠেছে একচেটিয়া। আর নতুন ধারার প্রতিষ্ঠান কিনে তারা নিজেদের ‘অস্ত্রাগার’ সমৃদ্ধ করেছে। প্রতিটি নতুন ধারার প্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়ে তারা একইভাবে সংশ্লিষ্ট ধারায় নতুন কারও বেড়ে ওঠার পথকে রুদ্ধ করেছে।
এ তো গেল ২০২১ সাল পর্যন্ত হিসাব, যা জানাল ওয়াশিংটন পোস্ট। জেফ বেজোসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু নিজেদেরও এই মহলে ঢুকে পড়া আটকাতে পারেনি। তারা জানিয়েছে, ইন্টারনেট-দুনিয়ায় নিজেকে একচেটিয়া করে তুলতে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বেজোস যে বিনিয়োগ শুরু করেন, সে পথ ধরেই ওয়াশিংটন পোস্টও তাঁর থলিতে গিয়ে জমা হয়। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ হাজার ওয়েবসাইটের মধ্যে অর্ধেকেরই হোস্টিং অথোরিটি চলে আসে বেজোসের হাতে। সে যাক। ২০২১ সালের পর কী হলো? ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানাচ্ছে, ২০২১ সালে টেক-জায়ান্টরা অন্য কোম্পানি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। পরিমাণটা কত? ২৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার!
এগুলো যে মানুষের জীবনকে সহজ করেনি, এমন নয়। করেছে। বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে এসব প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু আলাপটি প্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে নয়; বরং এর কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে। যে তথ্যের প্রাপ্যতার জন্য মানুষ এত কিছুর সঙ্গে নিজের সমন্বয় করল, তা হাতছাড়া হওয়া নিয়ে। সাইবার স্পেসের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, কীভাবে—সে প্রশ্নটি মগজ থেকে একেবারে উধাও হওয়া নিয়েই বরং এ প্রশ্ন। মানুষ এখন চূড়ান্ত ভোক্তায় পরিণত হয়েছে। তথ্য বলতে যে নিরাকার একটি বস্তুকে মানুষ বোঝে, তা এখন নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মূল সূত্র এখন সে। অথচ এই তথ্য-দুনিয়ার নিয়ন্তারা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেকি ‘গণতন্ত্রপনা’ দিয়ে এই অস্পৃশ্য ব্যাপারটি আবার আড়াল করা যাচ্ছে সহজেই।
কতটা? ইন্টারনেট বস্তুটি যে মার্কিন মুলুক থেকে যাত্রা করেছিল ধীরে ধীরে, তার অধিকর্তাদের একচেটিয়াপনা থামানোর পথ খুঁজে এখন রীতিমতো হয়রান মার্কিন আইনসভা ও বিচার বিভাগই। চিরাচরিত পুঁজির কারবারিরাও এখন এই নয়া দুনিয়ায় নিজের জায়গাটি করে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। করবেন না কেন? ২০২১ সালে অনলাইনে পণ্য বিক্রি হয়েছে কত জানেন? ৪ লাখ ২০০ কোটি ডলারের। আরেকটু হলেই তা জার্মান অর্থনীতিকে (সাড়ে ৪ লাখ কোটি ডলার) ছাড়িয়ে যেত।
মজার বিষয় হলো, এই এত এত একচেটিয়া গল্পের পরও, এত কিছু সামনে থাকার পরও, ইন্টারনেট বস্তুটি কিন্তু সামনে সটান এগিয়ে যাচ্ছে এক ‘নিরপেক্ষতার’ মুখোশ পরে। এর পেছনে এর ভেতরে থাকা সম্ভাবনার শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে কেন্দ্রে থাকা গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও। সম্ভাবনাটি হচ্ছে, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর, প্রযুক্তির মালিকানা বুঝে নেওয়ার। আর পৃষ্ঠপোষকতা? সেটা স্বয়ং রাষ্ট্রের এবং পুঁজির তো বটেই। রাষ্ট্র এটি একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আবার অক্ষতও রাখতে চায়।
একটু বুঝে নেওয়া যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর সত্যিকারের দুনিয়ায় মানুষ বিস্তর বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন কারও বাড়িতে না গিয়েও ঈদের শুভেচ্ছা জানানো যাচ্ছে, চাইলে অনলাইন সালাম ও সালামি আদান-প্রদানও চলছে হরদম। এ জন্য কারও সংস্পর্শে আসার প্রয়োজনই পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে ফিরতে অনায়াসে মোবাইল স্ক্রিনে একটি লাভ ইমো, লাইক, স্যাড ইত্যাদি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের উপস্থিতি। শুভেচ্ছাবার্তা লিখতে আলসেমি লাগলেও সমস্যা নেই, অজস্র ডিজিটাল কার্ড তৈরি আছে; খুঁজতেও হবে না। সাজেশনে আসবে, বেছে নিয়ে একটা দিলেই হলো। যাকে পাঠানো হলো, তার মানসিক পরিস্থিতি যেমন বিবেচ্য নয়, তেমনি যে পাঠাচ্ছে তারও মানসিক অবস্থা এখানে একেবারে ঊহ্য। তাহলে সয়াবিন তেল বা অন্য যেকোনো ইস্যুতে জনদুর্ভোগের বেলায় কী ঘটছে? এ সম্পর্কিত খবরের তলায় একটি অ্যাংরি ইমো বা বেশি খেপে গেলে একটা স্ট্যাটাস, একটা প্রোফাইল পিকচার বা এমন যেকোনো কিছু দিলেই দায়িত্ব চুকে গেল। এতে তেলের দাম না কমলেও, ওয়াসার পানি পরিষ্কার না হলেও, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ না হলেও এমনকি কিছুই না হলেও কাজটি কিন্তু হয়ে গেল। এবার পাশ ফিরে আরামে ঘুমানো যেতেই পারে। এমন মোক্ষম একটি প্রতিরক্ষা বর্মকে তবে রাষ্ট্র কেন হাতছাড়া করবে? মাঝেমধ্যে একটু বকে দিলেও একে রক্ষায়, একে বেড়ে উঠতে দিতে রাষ্ট্র বরং সব রকম চেষ্টা করবে। এ কারণেই মার্কিন সিনেট থেকে শুনানি শেষে মার্ক জাকারবার্গ হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে পারেন। তিনি জানেন, বিশ্বের সব সিনেটই তাঁকে পাশে চায়।
প্রযুক্তি মোগলদের সুরক্ষায় অন্য পুঁজিপতিরাও সদা তৎপর। তারা তাদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ধসিয়ে না দিয়ে নিজেরাই একেকটি সাম্রাজ্য গড়ায় বরং মন দিচ্ছে। কারণ, এটাই পুঁজির ধর্ম। দুর্বলের সবল হয়ে ওঠায় সবলদের বিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকবে কেন? থাকার কথা নয়, নেইও। ফলে ইন্টারনেট ক্যাপিটালিজম ভাঙা নয়, বরং একে আরও দৃঢ় করতেই তারা বেশি নিবিষ্ট। উভয়েরই প্রয়োজন এক বিপুল ভোক্তা শ্রেণি। প্রচলিত পুঁজিপতিরা তাই নিজেদের পছন্দমতো একেকটি ভার্চুয়াল মিত্র খুঁজে নিয়েছে ও নিচ্ছে। যার সঙ্গে যার মিল হয় আরকি! ফলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তো বটেই একাধিক খাত মিলিয়ে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে গুগল, ফেসবুক বা মেটা, অ্যাপল, আমাজন, ইউটিউব, এয়ারবিএনবি, পেপাল, নেটফ্লিক্স, আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান। এমনকি জুড়ি খুঁজে দেওয়ার মতো বিষয়েও তৈরি হচ্ছে নানা ম্যাচমেকার প্ল্যাটফর্ম, যাদের কিছু কিছু এরই মধ্যে নিজেদের ভিত শক্ত করে একচেটিয়া বাণিজ্যের দিকেই এগোচ্ছে।
এহেন একচেটিয়া ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বসে তাই যতই সমাজ বদল বা স্বাধীনতার গল্প ও তর্ক হোক না কেন, তা দিন শেষে পণ্য হিসেবেই বিক্রি করছে সাম্রাজ্যপতিরা। ব্যক্তি ও তার তাবৎ অনুভূতি ও ক্রিয়া আজ ভোক্তা ও পণ্যে পুনঃ পুনঃ রূপায়ণের চক্রে আবদ্ধ, যেন নিজের লেজকেই গিলে খাওয়া সেই সাপ সে। পুরাণ নয়, এ আজকের দিনের নিদারুণ বাস্তবতা।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে