মাহবুবুর রহমান
বর্তমানে যুদ্ধের ময়দান আর খোলা মাঠে নেই। মাঠ পেরিয়ে শহরে শহরে যুদ্ধ এখন নিয়মিত ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেনের কথাই ধরা যাক। গত এপ্রিলে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেছিলেন, ‘মারিউপোল শহরটির অস্তিত্ব আর নেই।’ রাশিয়ার আক্রমণের সাত সপ্তাহের মধ্যেই বোমা, গোলা ও রকেট হামলায় আজভ সাগরের তীরবর্তী শহরটি রাশিয়ার দখলে চলে যায়। এর এক মাস পরই শহরটির পতন হয়। মারিউপোলের মেয়র জানিয়েছেন, ১ হাজার ৩০০ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা গেছে, শহরটির অর্ধেক এলাকাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সংকটে পড়েছে শহরটির ৪ লাখ জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই।
সামরিক ও নিরাপত্তা জার্নাল টেক্সাস ন্যাশনাল সিকিউরিটি রিভিউয়ে লন্ডনের কিংস কলেজের শিক্ষক ও ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হুগো স্ট্যানফোর্ড-টাক লিখেছেন, ‘মারিউপোলের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা হয়ে থাকবে। শহরে যুদ্ধ করার বিষয়টি জেনারেলরা সব সময়ই অবজ্ঞা করেছেন, এড়িয়ে গেছেন।’ তবে জেনারেলরা না চাইলেও এখন শহরে যুদ্ধ করতে হচ্ছে এবং এই নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা অতীত থেকে শিখছেন এবং আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
গত জুলাইয়ে ব্রিটেনের চিফ অব জেনারেল স্টাফ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এমন লড়াইয়ে রত ছিল, যেখানে খুবই নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতের যুদ্ধে শহরই রণক্ষেত্র হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে মার্কিন মিলিটারি একাডেমিতে দেওয়া এক ভাষণে মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই শহরে যুদ্ধের উপযোগী হয়ে উঠতে হবে।’ তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, সব মিলিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে ছদ্মবেশ থেকে শুরু করে যানবাহন এবং অন্যান্য সরঞ্জামেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।
এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, শহরের রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা এবং এ নিয়ে বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলোর ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এক অর্থে, সেনাবাহিনীগুলো নিকট ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধগুলোর কেন্দ্রবিন্দুই ছিল শহর। ২০২০ সালে আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছিল নাগরনো-কারাবাখের শহর শুশা, ২০১৪ সালে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কা শহরে আইএসের বিজয় এবং দুই বছর পর ওই দুই শহরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের হাতে জিহাদিদের পতন শহুরে যুদ্ধের অন্যতম উদাহরণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনের শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ করেছে এবং এর মাধ্যমে মারিউপোল, দনবাসের সেভেরোদোনেৎস্ক এবং লিসিশানস্ক দখলে নিয়েছে। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে ইউক্রেন আশা করেছিল তারা দক্ষিণাঞ্চলের শহর খেরসন পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
এই প্রবণতার আরেকটি বড় কারণ হলো—২১ শতক শুরুর আগ পর্যন্ত শহরের তুলনায় গ্রামে মানুষ বেশি বাস করত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করে শহরে। ২০৫০ সালের মধ্যে তা মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ পৌঁছাবে। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় এই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, তাইওয়ানের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই বাস করে শহরে। ফলে তাইওয়ানে আক্রমণ করলে চীনকে তাইওয়ানের শহরাঞ্চলেই যুদ্ধ করতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের শহরগুলো ক্রমেই আকারে বড় হয়ে উঠছে। বাড়ছে শহুরে জনসংখ্যাও। ১৯৫০ সালেই নিউইয়র্ক ও টোকিও মেগাসিটির খ্যাতি অর্জন করে। সে সময় শহর দুটির বাসিন্দা ছিল ১ কোটিরও বেশি। সম্প্রতি জাতিসংঘ ‘২৩০০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা’-শীর্ষক এক প্রতিবেদনে সতর্ক করেছে, সাধারণ শহরগুলোও দ্রুত মেগাসিটিতে পরিণত হবে।
প্রাচীনকালে শহরের আশপাশে যুদ্ধ হলেও ভেতরে হয়েছে খুবই অল্প। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি কিং ইকোনমিস্টকে বলেছেন, ‘শহরগুলোর আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। অতীতে শহরগুলোর যুদ্ধে শহরবাসীও যুক্ত হতো। সে সময় আক্রমণকারীরা শহরের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করত এবং শহরের ওপর তাণ্ডব চালাত। যেমন, ৮০ বছর আগে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ সৈন্য, আর শহরটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ। বিপরীতে, বর্তমানে শহরের জনসংখ্যার তুলনায় সেনাবাহিনীর আকার খুবই ছোট হয়। যেমন, ২০১৬ সালে ১৭ লাখ মানুষের শহরের নিয়ন্ত্রণে নিতে যুদ্ধ শুরু করেছিল মাত্র ১ লাখের কাছাকাছি সৈন্য।
ধ্বংসাত্মক প্রবণতা এবং বর্বরতার জন্য বর্তমানের শহুরে যুদ্ধের কুখ্যাতি রয়েছে। নির্মাণাধীন এলাকাগুলোয় সৈন্যদের লুকানোর প্রচুর জায়গা থাকে এবং এই প্রবণতার কারণে প্রায়ই খুবই অল্প দূরত্বের ব্যবধানে দুই বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ ছাড়া শহুরে যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রায়ই বুবি ট্র্যাপ এবং ল্যান্ড মাইন ব্যবহার করে বড় বড় দালান ধসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শহরে যুদ্ধরত সৈনিকদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, যা সৈন্যদের মানসিক অবস্থাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বনভূমিতে যুদ্ধের সময়ও একইরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে শহরে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সর্বদা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু বন বা খোলা প্রান্তরে যুদ্ধ হলে এমন হয় না। ফলে শহরে যুদ্ধ করাটা সব সময়ই কঠিন। একজন ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তাকে ‘কোথায় লড়াই করতে পছন্দ করবেন’—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘একটি শহরকে ধ্বংস করার কোনো অনুমতিই আমার নেই।’
কংক্রিটের জঙ্গল
অ্যান্থনি কিংয়ের মতে, ছোট আকারের সেনাবাহিনী কর্তৃক শহর আক্রমণের ফলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঘটে তা হলো—‘স্থানীয় ভূখণ্ড দখলের’ মাধ্যমেই তা অনেক সময় শেষ হয়ে যায়। আবার অনেক সময় কিছু অবকাঠামো দখলে নেওয়া হলেও যুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তবে এর বিপরীত দিকও রয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর আর্মড ডিভিশনের সাবেক ব্রিগেড অধিনায়ক পিটার মনসুর বলেন, ‘অনেক সময় একটি মাত্র দালান দখল করতে গিয়েও পুরো একটি ব্রিগেড নাই হয়ে যেতে পারে।’
আধুনিক বিস্ফোরক অস্ত্রগুলো ইউরোপের সমভূমিতে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই অস্ত্রগুলো কোনো জনবহুল এলাকায় ব্যবহারের ফলে হতাহত প্রতি দশজনের নয়জনই হয় বেসামরিক নাগরিক। সাম্প্রতিক সময়েই এর বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। রুশ বাহিনী কর্তৃক এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার কেবল মারিউপোল, সেভেরোদোনেৎস্কসহ ইউক্রেনের আরও অনেক ছোট শহরই ধ্বংস করেনি, ধ্বংস করেছে সিরিয়ার আলেপ্পো এবং চেচনিয়ার গ্রোজনিকেও।
এমনকি একটি সর্বাধুনিক বোমা একটি শহরকে সম্পূর্ণরূপে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। ইরাকের মসুলে মার্কিন বিমান হামলায় ভবনগুলোতে নির্ভুলভাবে আঘাত করেছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা পালিয়ে যেতে শুরু করায় মার্কিন বাহিনী তাদের ধাওয়া করে বোমা বর্ষণ করতে থাকে। এর ফলে পুরো শহর বোমার আঘাতে জর্জরিত হয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর মেজর অ্যামোস ফক্স এই হামলার বিষয়ে বলেছিলেন, বোমাগুলো একের পর এক বিভিন্ন দালানে আঘাত করে। এর ফলে সেই সময় মসুলে ১০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক লোক প্রাণ হারায়। এই প্রাণহানির এক-তৃতীয়াংশই ঘটেছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট দ্বারা।
কোনো একটি শহরে যুদ্ধের সময় শহরটির বাসিন্দারা নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে বসে থাকেন না। মার্কিন থিংকট্যাংক মেডিসন পলিসি ফোরামের আরবান ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের চেয়ারপারসন ও সাবেক মেজর জন স্পেনসার গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ আক্রমণের কয়েক দিনের মাথায় ইউক্রেনের শহরবাসীদের সামরিক পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন। গত জুন মাসে তিনি কিয়েভ পরিদর্শনকালে জেনেছিলেন কীভাবে স্থানীয় একটি মাত্র ব্রিগেড বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকেদের সহায়তায় কেবল একে-৪৭ রাইফেলের সহায়তায় তাদের শহরটির সুরক্ষা দিয়েছিল। সে সময় শহরটির বাসিন্দারা নিজেরাই ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হয়ে গোয়েন্দার কাজ করেছে। তাঁর শহরটির ভেতরে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যাওয়ার নাম করে রাশিয়ার সৈন্যদের অবস্থান চিহ্নিত করে তা ইউক্রেনের সৈন্যদের জানিয়ে দিত।
ইকোনমিস্ট বলছে, আধুনিক শহরগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, শহরের ভূগর্ভস্থ যোগাযোগ প্রসারিত করা। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গবেষক মার্কো বুমার জানিয়েছেন, কীভাবে প্রতিরোধ যোদ্ধারা মসুলের সিঙ্কহোল এবং গুহাগুলো ব্যবহার করে নতুন সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। বেশ কিছু সুড়ঙ্গ এতটাই চওড়া ছিল যে, সেখান দিয়ে অনায়াসে যানবাহন চলাচল সম্ভব হতো। খালি হাত থেকে শুরু করে বোরিং মেশিন ব্যবহার করে এসব সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। অধিকাংশ সুড়ঙ্গেই আবাসন, হাসপাতাল এবং উত্তম বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ছিল। গত বছরই ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, তারা গাজায় অন্তত ১০০ কিলোমিটার এমন সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে দিয়েছে। সর্বশেষ, ইউক্রেনের মারিউপোলের আজভস্টাল কারখানায়ও সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ইউক্রেনের বাহিনী দীর্ঘ সময় শক্ত অবস্থান বজায় রেখেছিল।
পশ্চিমারা দীর্ঘদিন ধরে যেসব নতুন প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে আসছে সেগুলো অনেকাংশেই ভূপৃষ্ঠের নিচে কাজ করে না। যেমন, স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে নজরদারি। ভূপৃষ্ঠের নিচে তো বটেই ওপরও অনেক সময় এসব প্রযুক্তি যথাযথ কাজ করতে পারে না।
এ বিষয়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গ্যাল হারশ ইকোনমিস্টকে বলেছেন, আধুনিক শহরের উঁচু উঁচু ভবনের মধ্যবর্তী ‘শহুরে গিরিখাতে’ সামরিক রেডিও সংকেত বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ শহরগুলো নানা ধরনের রেডিও এবং টেলিভিশন তরঙ্গে ভরপুর। গ্যাল হারশ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো—এ রকম জনবহুল জটিল এলাকায়, আমাদের যা দেখানো হয় আমরা কেবল তাই দেখতে পাই। আমরা এমন কিছু দেখতে পারি না, যা শত্রু বাহিনী আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখছে।’
মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল লিয়াম কলিন্সের দাবি, এ ধরনের অসুবিধাগুলো আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে যে—কেন মার্কিন সেনাবাহিনী এখন অবধি শহুরে যুদ্ধ সম্পর্কে চিন্তা করা থেকে দূরে রয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে যুদ্ধ চিন্তা, তা শহুরে যুদ্ধের মডেলের সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা যেন আবারও উপসাগরীয় যুদ্ধের মতোই ভবিষ্যতের যুদ্ধে লড়তে চাই।’
এখন সশস্ত্রগুলো বাহিনী বুঝতে পেরেছে, শহুরে যুদ্ধ আরও নিয়মিত হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর গতিপ্রকৃতি কেমন হতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এবং কীভাবে সেই যুদ্ধে জয়লাভ করা যাবে, সেই উপায় নিয়েও ভাবছে। এই বিষয় নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জেমস বাউডার সতর্ক করে বলেছেন, ‘আগামী দিনগুলোতে সৈন্যদের জন্য খোলা জায়গায় যুদ্ধ করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। বহুমুখী সেন্সর-স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে নজরদারি অতি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব আগ্নেয়াস্ত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তা ক্রমেই আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।’
জেনারেল বাউডারের মতে, সৈন্যদের শহরের মধ্যে চলাচলের সময় নজিরবিহীন বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। আগামী দিনের যুদ্ধে শহরগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে তা কেবল শহরগুলোর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মূল্যের জন্য নয় বরং সেখানে নিজেদের তুলনামূলক নিরাপদে রাখার সুবিধা থাকার কারণেই সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ ছাড়া প্রতিপক্ষ বাহিনী কর্তৃক শহরে তাদের শত্রুদের খুঁজে বের করা এবং আক্রমণ করার ক্ষমতা দুইই হ্রাস পাবে। ঠিক এই কৌশলের কারণেই তাল্লিন, রিগা ও ভিলনিয়াসের মতো তুলনামূলক ছোট শহরগুলো ন্যাটো বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। সেখান থেকে রাশিয়ার সরবরাহ ব্যবস্থা ও রুশ বাহিনীর ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হবে।
যা হোক, বর্তমানে অন্য কৌশলগত বিষয়গুলো আলোচনার পাশাপাশি যুদ্ধকৌশল নিয়েও ভাবছে সেনাবাহিনীগুলো। যাদের শহরে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের কাছ থেকে শিখছে অন্য দেশগুলো। ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্থপতি ইয়াল উইজম্যান জানিয়েছেন, কীভাবে ২০০২ সালে ফিলিস্তিনের নাবলুসে ইসরায়েলি সৈন্যরা ‘ওয়াকিং থ্রো দ্য ওয়ালস’ কৌশল ব্যবহার করেছিল। যে পদ্ধতিতে গতানুগতিক দরজা-জানালা কিংবা পরিচিত রাস্তা ব্যবহার না করে বরং সরাসরি অন্য কোনো পথ ব্যবহার করা হয়। ১৯ শতকে প্যারিস যুদ্ধের সময় ফরাসি বাহিনী এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করেছিল।
ইসরায়েলের সেনাপ্রধান জেনারেল আভিভ কোহাভি উইজম্যানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি শহরের গলি-ঘুপচিগুলোকে কেবল একটি ফাঁকা জায়গা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন, যেমনটা করে থাকেন অন্যান্য স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ?’ জবাবে উইজম্যান বলেছিলেন, ‘শত্রু যদি কোনো ফাঁকা জায়গাকে প্রথাগত পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে তবে আমি এই ব্যাখ্যা মানতে চাই না এবং ফাঁদেও পড়তে চাই না।’ যার ফলাফল উত্তরাধুনিক যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে শহর এবং এই যুদ্ধে শহরের ধারণা হলো তা কেবল একটি জায়গা নয় বরং তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্র।
বর্তমানে যুদ্ধের ময়দান আর খোলা মাঠে নেই। মাঠ পেরিয়ে শহরে শহরে যুদ্ধ এখন নিয়মিত ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেনের কথাই ধরা যাক। গত এপ্রিলে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেছিলেন, ‘মারিউপোল শহরটির অস্তিত্ব আর নেই।’ রাশিয়ার আক্রমণের সাত সপ্তাহের মধ্যেই বোমা, গোলা ও রকেট হামলায় আজভ সাগরের তীরবর্তী শহরটি রাশিয়ার দখলে চলে যায়। এর এক মাস পরই শহরটির পতন হয়। মারিউপোলের মেয়র জানিয়েছেন, ১ হাজার ৩০০ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা গেছে, শহরটির অর্ধেক এলাকাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সংকটে পড়েছে শহরটির ৪ লাখ জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই।
সামরিক ও নিরাপত্তা জার্নাল টেক্সাস ন্যাশনাল সিকিউরিটি রিভিউয়ে লন্ডনের কিংস কলেজের শিক্ষক ও ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হুগো স্ট্যানফোর্ড-টাক লিখেছেন, ‘মারিউপোলের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা হয়ে থাকবে। শহরে যুদ্ধ করার বিষয়টি জেনারেলরা সব সময়ই অবজ্ঞা করেছেন, এড়িয়ে গেছেন।’ তবে জেনারেলরা না চাইলেও এখন শহরে যুদ্ধ করতে হচ্ছে এবং এই নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা অতীত থেকে শিখছেন এবং আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
গত জুলাইয়ে ব্রিটেনের চিফ অব জেনারেল স্টাফ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এমন লড়াইয়ে রত ছিল, যেখানে খুবই নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতের যুদ্ধে শহরই রণক্ষেত্র হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে মার্কিন মিলিটারি একাডেমিতে দেওয়া এক ভাষণে মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই শহরে যুদ্ধের উপযোগী হয়ে উঠতে হবে।’ তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, সব মিলিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে ছদ্মবেশ থেকে শুরু করে যানবাহন এবং অন্যান্য সরঞ্জামেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।
এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, শহরের রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা এবং এ নিয়ে বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলোর ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এক অর্থে, সেনাবাহিনীগুলো নিকট ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধগুলোর কেন্দ্রবিন্দুই ছিল শহর। ২০২০ সালে আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছিল নাগরনো-কারাবাখের শহর শুশা, ২০১৪ সালে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কা শহরে আইএসের বিজয় এবং দুই বছর পর ওই দুই শহরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের হাতে জিহাদিদের পতন শহুরে যুদ্ধের অন্যতম উদাহরণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনের শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ করেছে এবং এর মাধ্যমে মারিউপোল, দনবাসের সেভেরোদোনেৎস্ক এবং লিসিশানস্ক দখলে নিয়েছে। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে ইউক্রেন আশা করেছিল তারা দক্ষিণাঞ্চলের শহর খেরসন পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
এই প্রবণতার আরেকটি বড় কারণ হলো—২১ শতক শুরুর আগ পর্যন্ত শহরের তুলনায় গ্রামে মানুষ বেশি বাস করত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করে শহরে। ২০৫০ সালের মধ্যে তা মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ পৌঁছাবে। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় এই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, তাইওয়ানের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই বাস করে শহরে। ফলে তাইওয়ানে আক্রমণ করলে চীনকে তাইওয়ানের শহরাঞ্চলেই যুদ্ধ করতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের শহরগুলো ক্রমেই আকারে বড় হয়ে উঠছে। বাড়ছে শহুরে জনসংখ্যাও। ১৯৫০ সালেই নিউইয়র্ক ও টোকিও মেগাসিটির খ্যাতি অর্জন করে। সে সময় শহর দুটির বাসিন্দা ছিল ১ কোটিরও বেশি। সম্প্রতি জাতিসংঘ ‘২৩০০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা’-শীর্ষক এক প্রতিবেদনে সতর্ক করেছে, সাধারণ শহরগুলোও দ্রুত মেগাসিটিতে পরিণত হবে।
প্রাচীনকালে শহরের আশপাশে যুদ্ধ হলেও ভেতরে হয়েছে খুবই অল্প। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি কিং ইকোনমিস্টকে বলেছেন, ‘শহরগুলোর আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। অতীতে শহরগুলোর যুদ্ধে শহরবাসীও যুক্ত হতো। সে সময় আক্রমণকারীরা শহরের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করত এবং শহরের ওপর তাণ্ডব চালাত। যেমন, ৮০ বছর আগে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ সৈন্য, আর শহরটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ। বিপরীতে, বর্তমানে শহরের জনসংখ্যার তুলনায় সেনাবাহিনীর আকার খুবই ছোট হয়। যেমন, ২০১৬ সালে ১৭ লাখ মানুষের শহরের নিয়ন্ত্রণে নিতে যুদ্ধ শুরু করেছিল মাত্র ১ লাখের কাছাকাছি সৈন্য।
ধ্বংসাত্মক প্রবণতা এবং বর্বরতার জন্য বর্তমানের শহুরে যুদ্ধের কুখ্যাতি রয়েছে। নির্মাণাধীন এলাকাগুলোয় সৈন্যদের লুকানোর প্রচুর জায়গা থাকে এবং এই প্রবণতার কারণে প্রায়ই খুবই অল্প দূরত্বের ব্যবধানে দুই বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ ছাড়া শহুরে যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রায়ই বুবি ট্র্যাপ এবং ল্যান্ড মাইন ব্যবহার করে বড় বড় দালান ধসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শহরে যুদ্ধরত সৈনিকদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, যা সৈন্যদের মানসিক অবস্থাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বনভূমিতে যুদ্ধের সময়ও একইরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে শহরে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সর্বদা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু বন বা খোলা প্রান্তরে যুদ্ধ হলে এমন হয় না। ফলে শহরে যুদ্ধ করাটা সব সময়ই কঠিন। একজন ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তাকে ‘কোথায় লড়াই করতে পছন্দ করবেন’—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘একটি শহরকে ধ্বংস করার কোনো অনুমতিই আমার নেই।’
কংক্রিটের জঙ্গল
অ্যান্থনি কিংয়ের মতে, ছোট আকারের সেনাবাহিনী কর্তৃক শহর আক্রমণের ফলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঘটে তা হলো—‘স্থানীয় ভূখণ্ড দখলের’ মাধ্যমেই তা অনেক সময় শেষ হয়ে যায়। আবার অনেক সময় কিছু অবকাঠামো দখলে নেওয়া হলেও যুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তবে এর বিপরীত দিকও রয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর আর্মড ডিভিশনের সাবেক ব্রিগেড অধিনায়ক পিটার মনসুর বলেন, ‘অনেক সময় একটি মাত্র দালান দখল করতে গিয়েও পুরো একটি ব্রিগেড নাই হয়ে যেতে পারে।’
আধুনিক বিস্ফোরক অস্ত্রগুলো ইউরোপের সমভূমিতে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই অস্ত্রগুলো কোনো জনবহুল এলাকায় ব্যবহারের ফলে হতাহত প্রতি দশজনের নয়জনই হয় বেসামরিক নাগরিক। সাম্প্রতিক সময়েই এর বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। রুশ বাহিনী কর্তৃক এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার কেবল মারিউপোল, সেভেরোদোনেৎস্কসহ ইউক্রেনের আরও অনেক ছোট শহরই ধ্বংস করেনি, ধ্বংস করেছে সিরিয়ার আলেপ্পো এবং চেচনিয়ার গ্রোজনিকেও।
এমনকি একটি সর্বাধুনিক বোমা একটি শহরকে সম্পূর্ণরূপে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। ইরাকের মসুলে মার্কিন বিমান হামলায় ভবনগুলোতে নির্ভুলভাবে আঘাত করেছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা পালিয়ে যেতে শুরু করায় মার্কিন বাহিনী তাদের ধাওয়া করে বোমা বর্ষণ করতে থাকে। এর ফলে পুরো শহর বোমার আঘাতে জর্জরিত হয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর মেজর অ্যামোস ফক্স এই হামলার বিষয়ে বলেছিলেন, বোমাগুলো একের পর এক বিভিন্ন দালানে আঘাত করে। এর ফলে সেই সময় মসুলে ১০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক লোক প্রাণ হারায়। এই প্রাণহানির এক-তৃতীয়াংশই ঘটেছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট দ্বারা।
কোনো একটি শহরে যুদ্ধের সময় শহরটির বাসিন্দারা নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে বসে থাকেন না। মার্কিন থিংকট্যাংক মেডিসন পলিসি ফোরামের আরবান ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের চেয়ারপারসন ও সাবেক মেজর জন স্পেনসার গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ আক্রমণের কয়েক দিনের মাথায় ইউক্রেনের শহরবাসীদের সামরিক পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন। গত জুন মাসে তিনি কিয়েভ পরিদর্শনকালে জেনেছিলেন কীভাবে স্থানীয় একটি মাত্র ব্রিগেড বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকেদের সহায়তায় কেবল একে-৪৭ রাইফেলের সহায়তায় তাদের শহরটির সুরক্ষা দিয়েছিল। সে সময় শহরটির বাসিন্দারা নিজেরাই ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হয়ে গোয়েন্দার কাজ করেছে। তাঁর শহরটির ভেতরে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যাওয়ার নাম করে রাশিয়ার সৈন্যদের অবস্থান চিহ্নিত করে তা ইউক্রেনের সৈন্যদের জানিয়ে দিত।
ইকোনমিস্ট বলছে, আধুনিক শহরগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, শহরের ভূগর্ভস্থ যোগাযোগ প্রসারিত করা। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গবেষক মার্কো বুমার জানিয়েছেন, কীভাবে প্রতিরোধ যোদ্ধারা মসুলের সিঙ্কহোল এবং গুহাগুলো ব্যবহার করে নতুন সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। বেশ কিছু সুড়ঙ্গ এতটাই চওড়া ছিল যে, সেখান দিয়ে অনায়াসে যানবাহন চলাচল সম্ভব হতো। খালি হাত থেকে শুরু করে বোরিং মেশিন ব্যবহার করে এসব সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। অধিকাংশ সুড়ঙ্গেই আবাসন, হাসপাতাল এবং উত্তম বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ছিল। গত বছরই ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, তারা গাজায় অন্তত ১০০ কিলোমিটার এমন সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে দিয়েছে। সর্বশেষ, ইউক্রেনের মারিউপোলের আজভস্টাল কারখানায়ও সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ইউক্রেনের বাহিনী দীর্ঘ সময় শক্ত অবস্থান বজায় রেখেছিল।
পশ্চিমারা দীর্ঘদিন ধরে যেসব নতুন প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে আসছে সেগুলো অনেকাংশেই ভূপৃষ্ঠের নিচে কাজ করে না। যেমন, স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে নজরদারি। ভূপৃষ্ঠের নিচে তো বটেই ওপরও অনেক সময় এসব প্রযুক্তি যথাযথ কাজ করতে পারে না।
এ বিষয়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গ্যাল হারশ ইকোনমিস্টকে বলেছেন, আধুনিক শহরের উঁচু উঁচু ভবনের মধ্যবর্তী ‘শহুরে গিরিখাতে’ সামরিক রেডিও সংকেত বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ শহরগুলো নানা ধরনের রেডিও এবং টেলিভিশন তরঙ্গে ভরপুর। গ্যাল হারশ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো—এ রকম জনবহুল জটিল এলাকায়, আমাদের যা দেখানো হয় আমরা কেবল তাই দেখতে পাই। আমরা এমন কিছু দেখতে পারি না, যা শত্রু বাহিনী আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখছে।’
মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল লিয়াম কলিন্সের দাবি, এ ধরনের অসুবিধাগুলো আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে যে—কেন মার্কিন সেনাবাহিনী এখন অবধি শহুরে যুদ্ধ সম্পর্কে চিন্তা করা থেকে দূরে রয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে যুদ্ধ চিন্তা, তা শহুরে যুদ্ধের মডেলের সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা যেন আবারও উপসাগরীয় যুদ্ধের মতোই ভবিষ্যতের যুদ্ধে লড়তে চাই।’
এখন সশস্ত্রগুলো বাহিনী বুঝতে পেরেছে, শহুরে যুদ্ধ আরও নিয়মিত হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর গতিপ্রকৃতি কেমন হতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এবং কীভাবে সেই যুদ্ধে জয়লাভ করা যাবে, সেই উপায় নিয়েও ভাবছে। এই বিষয় নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জেমস বাউডার সতর্ক করে বলেছেন, ‘আগামী দিনগুলোতে সৈন্যদের জন্য খোলা জায়গায় যুদ্ধ করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। বহুমুখী সেন্সর-স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে নজরদারি অতি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব আগ্নেয়াস্ত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তা ক্রমেই আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।’
জেনারেল বাউডারের মতে, সৈন্যদের শহরের মধ্যে চলাচলের সময় নজিরবিহীন বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। আগামী দিনের যুদ্ধে শহরগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে তা কেবল শহরগুলোর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মূল্যের জন্য নয় বরং সেখানে নিজেদের তুলনামূলক নিরাপদে রাখার সুবিধা থাকার কারণেই সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ ছাড়া প্রতিপক্ষ বাহিনী কর্তৃক শহরে তাদের শত্রুদের খুঁজে বের করা এবং আক্রমণ করার ক্ষমতা দুইই হ্রাস পাবে। ঠিক এই কৌশলের কারণেই তাল্লিন, রিগা ও ভিলনিয়াসের মতো তুলনামূলক ছোট শহরগুলো ন্যাটো বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। সেখান থেকে রাশিয়ার সরবরাহ ব্যবস্থা ও রুশ বাহিনীর ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হবে।
যা হোক, বর্তমানে অন্য কৌশলগত বিষয়গুলো আলোচনার পাশাপাশি যুদ্ধকৌশল নিয়েও ভাবছে সেনাবাহিনীগুলো। যাদের শহরে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের কাছ থেকে শিখছে অন্য দেশগুলো। ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্থপতি ইয়াল উইজম্যান জানিয়েছেন, কীভাবে ২০০২ সালে ফিলিস্তিনের নাবলুসে ইসরায়েলি সৈন্যরা ‘ওয়াকিং থ্রো দ্য ওয়ালস’ কৌশল ব্যবহার করেছিল। যে পদ্ধতিতে গতানুগতিক দরজা-জানালা কিংবা পরিচিত রাস্তা ব্যবহার না করে বরং সরাসরি অন্য কোনো পথ ব্যবহার করা হয়। ১৯ শতকে প্যারিস যুদ্ধের সময় ফরাসি বাহিনী এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করেছিল।
ইসরায়েলের সেনাপ্রধান জেনারেল আভিভ কোহাভি উইজম্যানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি শহরের গলি-ঘুপচিগুলোকে কেবল একটি ফাঁকা জায়গা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন, যেমনটা করে থাকেন অন্যান্য স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ?’ জবাবে উইজম্যান বলেছিলেন, ‘শত্রু যদি কোনো ফাঁকা জায়গাকে প্রথাগত পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে তবে আমি এই ব্যাখ্যা মানতে চাই না এবং ফাঁদেও পড়তে চাই না।’ যার ফলাফল উত্তরাধুনিক যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে শহর এবং এই যুদ্ধে শহরের ধারণা হলো তা কেবল একটি জায়গা নয় বরং তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্র।
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
২ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৬ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৮ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৯ দিন আগে