মারুফ ইসলাম
হঠাৎ করেই ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ ধরনের সংঘর্ষ ও উত্তেজনা অবশ্য নতুন নয়। অতীতেও বেশ কয়েকবার ভারত ও চীনা সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। মাঝে কিছু সময় পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সম্প্রতি পুনরায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে এ দুটি দেশের সীমান্তরেখায়। কিন্তু কেন? সেই সুলুক সন্ধান করছেন বিশ্লেষকেরা।
গত ৯ ডিসেম্বর ভারতের অরুণাচল প্রদেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) ভারতীয় ও চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে কেউ নিহত না হলেও বেশ কয়েকজন সৈন্য আহত হন। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর মতে, প্রায় ২০ জন ভারতীয় সৈন্য গুরুতর আহত হয়েছেন। চীনা সৈন্যদের মধ্যে আহতের সংখ্যা জানা যায়নি।
এই সংঘর্ষের পর থেকেই মূলত ভারত-চীন সীমান্তের এলএসি আলোচনায় উঠে এসেছে। চীন কেন এই অঞ্চল দখলে নিতে চায়, অন্যদিকে ভারত কেন তার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চায় না—এসবই মূলত আলোচনার বিষয়।
অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং সেক্টরের এলএসি বরাবর কিছু এলাকায় ‘মতবিরোধপূর্ণ’ ক্ষেত্র রয়েছে। এসব এলাকায় উভয় পক্ষই নিয়ন্ত্রণ দাবি করে নিয়মিত টহল দেয়। ২০০৬ সাল থেকে এই প্রবণতা বেড়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সেনারা এলএসির সঙ্গে যুক্তকারী তাওয়াং সেক্টরে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ দাবি করেন এবং ভারতীয় সেনাদের চ্যালেঞ্জ করে বসেন। এরপরই মূলত সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই সময় চীনের অন্তত ৬০০ সৈন্য টহল দিচ্ছিল। ভারতের সৈন্যসংখ্যা জানা যায়নি।
বলে রাখা প্রয়োজন, অরুণাচল প্রদেশকে ভারতীয় একটি রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করে দিল্লি। কিন্তু বেইজিং এই অঞ্চলের প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার দক্ষিণ তিব্বত বলে দাবি করে।
এর আগে এই অঞ্চলে সর্বশেষ সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষটি ঘটেছিল ২০২০ সালের জুনে। ওই সময় গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর চীনের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিল ৪০ জনের বেশি। এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর প্যাংগং লেকের দক্ষিণ তীরসহ বেশ কয়েকটি সীমান্তসংলগ্ন স্থানে দুই দেশের সেনারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ওই ঘটনার পর দুই দেশের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
অতীতে ভারতের গালওয়ান নদীর উপত্যকা ঘিরে আরও একবার ভারত-চীন বাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। ১৯৬২ সালে সংক্ষিপ্ত সীমান্ত যুদ্ধের পরে চীন এটি দখল করেছিল। ভারত দাবি করে, উপত্যকাটি তাদের কাছে পরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চীনরা এখনো সেটির দখল অব্যাহত রেখেছে। গত ২৫ মে চীনের রাষ্ট্রপরিচালিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস বলেছে, গালওয়ান উপত্যকাটি চীনের অঞ্চল।
গত ৯ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের পর ভারতের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে চীন। দেশটির পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের মুখপাত্র লং শাওহুয়া বলেছেন, ‘চীনা সৈন্যরা সেখানে নিয়মিত টহল দিচ্ছিল। কিন্তু ভারতের সৈন্যরা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেছিল, যার ফলে সংঘর্ষটি বেধেছিল।’
তবে চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি স্পষ্টভাবে চীনকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, ‘চীন একতরফাভাবে সীমান্ত অস্থিতিশীল করে তুলছে। পিএলএ সৈন্যরা তাওয়াং সেক্টরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল বলেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে।’
যাহোক, এসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যেই ভারতীয় কমান্ডাররা চীনা প্রতিপক্ষের সঙ্গে পতাকা বৈঠক করেন। বিরোধপূর্ণ এলাকায় যাতে ‘শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য কাঠামোবদ্ধ ব্যবস্থা’ মেনে চলা হয়, সে ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা করেছেন তাঁরা।
চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক রয়েছে। লং শাওহুয়া দাবি করেছেন, স্থিতিশীল করতে চীনা সৈন্যরাই ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সেনারা পেশাদার, দৃঢ় ও মানসম্মত। তারাই পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে।’
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিভাগের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দুই পক্ষই কূটনৈতিক ও সামরিক চ্যানেলের মাধ্যমে সীমান্ত বিষয়ে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে। আমার জানামতে, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।’
তবে পরিস্থিতি কত দিন স্বাভাবিক থাকবে, সেটিই এখন প্রশ্ন। কারণ, অতীত ইতিহাস বলছে, এই অঞ্চলে দুটি দেশের সীমান্তরক্ষীরা বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে এবং উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। তার মানে, ভবিষ্যতেও কি এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি শান্ত করবেন?
ভারত ও চীনের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। তবে বিরোধের শিকড় রয়েছে এলএসি ঘিরে। সুতরাং এলএসি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ, এই রেখাই মূলত চীন ও ভারতকে আলাদা করেছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এলএসি সম্পর্কে দুই দেশের সেনাদের মধ্যেই স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। তারা নিজস্ব ধারণার ওপর টহল দিচ্ছে এবং যখন-তখন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছরের অক্টোবরে জিয়াংজি অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক চীনা সেনা টহল দিচ্ছিল। কিন্তু ভারতীয় সেনারা মনে করে এই অঞ্চলে তাদের। এই ধারণা থেকে তারা বেশ কয়েকজন চীনা সৈন্যকে আটক করে রেখেছিল।
এলএসি সম্পর্কে ভারতীয় সেনাদের যে স্পষ্ট ধারণা নেই, সেটি স্বীকার করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৯ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের পরে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, এলএসি কোথায় রয়েছে তা সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার কারণে সৈন্যদের (দুই দেশের) মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।
ভারত-চীন সীমান্তের এলএসি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। পশ্চিম ভাগটি লাদাখের ভারতীয় ভূখণ্ডকে ঘিরে রেখেছে। মধ্যভাগটি ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করেছে। আর পূর্বাঞ্চলটি অরুণাচল প্রদেশের রাজ্যসীমাকে বিভক্ত করেছে।
গত কয়েক বছরে চীনের পিএলএ সেনারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ করেছে পশ্চিম ভাগে। অর্থাৎ লাদাখ অঞ্চলে। তবে মধ্য ও পূর্ব ভাগেও মাঝে মাঝে সীমানা লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ করেছে চীনা সৈন্যরা। দিল্লি অভিযোগ করে বলেছে, গত দুই বছরে এলএসির মধ্য ভাগ অর্থাৎ উত্তরাখন্ডের সীমা ভেদ করে প্রচুর চীনা সেনা অনুপ্রবেশ করেছে।
চীনা সৈন্যদের এসব অনুপ্রবেশ রোধ করা ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে স্বীকার করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সেনাবাহিনী ও ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের (আইটিবিপি) মধ্যে আরও ভালো অপারেশনাল সমন্বয়ের প্রয়োজন। কারণ, উভয় বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের ‘গুরুতর অভাব’ রয়েছে।
এলএসি পরিচালনায় এই দুই সংস্থার মধ্যে কে প্রধান ভূমিকায় থাকবে, সেটি নিয়েও দীর্ঘ দিন ধরে বিতর্ক রয়েছে। সরকার চায়, এলএসি পরিচালনায় বড় ভূমিকা পালন করুক আইটিবিপি। আর সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করুক সেনাবাহিনী।
তবে ভারত সরকার চাইলেও এ কাজ করতে পারছে না। কারণ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডি এস হুদা আইটিবিপিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি মামলা করেছেন। তাঁর যুক্তি, এলএসি ইস্যুতে সেনা কর্মকর্তারাই চীনের সঙ্গে সমস্ত বৈঠকে প্রধান ভূমিকা রাখে এবং সীমান্তসংকট সেনাবাহিনীই সামলায়।
দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে না পারলেও এলএসি নিয়ন্ত্রণে অস্ত্র-সরঞ্জামের মজুত বাড়িয়েছে ভারত। দূরপাল্লার মনুষ্যবিহীন আকাশযান, উচ্চ প্রযুক্তির নজরদারি ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার, হালকা মেশিন গান, অ্যাসল্ট রাইফেল, রকেট লাঞ্চার এবং অত্যাধুনিক এম-৭৭৭ অস্ত্র মজুত করেছে।
এ ছাড়া এলএসির সমান্তরালে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছে ভারত। এটি অরুণাচল ফ্রন্টিয়ার হাইওয়ে নামে পরিচিত। এটি একটি সংযোগ প্রকল্প। এই প্রকল্পের কারণেও চীনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। কারণ চীন চায় না, ভারত তার সীমান্তে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করুক।
সম্প্রতি ভারত সীমান্ত ঘিরে চীনের ক্ষোভের অন্যতম কারণ ভারতীয় সেনাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বলেই মনে করছেন বেশির ভাগ বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে দৌলত বেগ ওল্ডির রাস্তা, বিশ্বের উচ্চতম এয়ারস্ট্রিপ এবং গালওয়ান উপত্যকার পশ্চিম দিকে শ্যাওক নদীর পার্শ্ববর্তী রাস্তা নির্মাণ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি চীন।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক পি স্টোবদান বলেছেন, ‘সীমান্তের পাশ দিয়ে ছুটে চলা রাস্তাগুলোই চীনা সৈন্যদের অনুপ্রবেশের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। বাড়িয়ে তুলেছে উত্তেজনা।’
সাম্প্রতিক উত্তেজনার পেছনে অন্য একটি কারণ অবশ্য খুঁজে পেয়েছেন ডেনমার্কে নিযুক্ত ভারতে রাষ্ট্রদূত ও চীন-ভারত সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ যোগেশ গুপ্ত। তিনি বলেছেন, এলএসি থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে উত্তরাখন্ড প্রদেশে গত অক্টোবরে ভারতীয় ও মার্কিন সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়া করেছে। এ মহড়া সম্ভবত ভালোভাবে নেয়নি চীন।
তবে এসব কারণ ছাড়াও ‘জাতীয়তাবাদী মনোভাব’ এই সংঘর্ষের পেছনে অন্যতম অনুঘটক বলে মনে করেন চীনের লানঝু ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজের সাবেক ডিন ইয়াং শু। তিনি বলেছেন, ‘ক্রমশ বেড়ে চলা জাতীয়তাবাদী মনোভাব সাম্প্রতিক সংঘর্ষকে উসকে দিয়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয়তাবাদ তীব্রভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনী প্রতিশোধ নিতে চায়; কারণ, ১৯৬২ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ক্ষত এখনো শুকায়নি তাদের।’
ইয়াং শু আরও বলেছেন, ‘বেইজিং ও নয়াদিল্লির নেতৃত্ব যদি অযৌক্তিক মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে এলএসি বরাবর আরও ঝগড়া, সংঘর্ষ ও উত্তেজনা বাড়বে।’
এ উত্তেজনার আসলে শেষ কোথায়, আপাতত কেউ জানে না তার সদুত্তর।
সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট, দ্য ইকোনমিস্ট, এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
হঠাৎ করেই ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ ধরনের সংঘর্ষ ও উত্তেজনা অবশ্য নতুন নয়। অতীতেও বেশ কয়েকবার ভারত ও চীনা সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। মাঝে কিছু সময় পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সম্প্রতি পুনরায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে এ দুটি দেশের সীমান্তরেখায়। কিন্তু কেন? সেই সুলুক সন্ধান করছেন বিশ্লেষকেরা।
গত ৯ ডিসেম্বর ভারতের অরুণাচল প্রদেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) ভারতীয় ও চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে কেউ নিহত না হলেও বেশ কয়েকজন সৈন্য আহত হন। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর মতে, প্রায় ২০ জন ভারতীয় সৈন্য গুরুতর আহত হয়েছেন। চীনা সৈন্যদের মধ্যে আহতের সংখ্যা জানা যায়নি।
এই সংঘর্ষের পর থেকেই মূলত ভারত-চীন সীমান্তের এলএসি আলোচনায় উঠে এসেছে। চীন কেন এই অঞ্চল দখলে নিতে চায়, অন্যদিকে ভারত কেন তার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চায় না—এসবই মূলত আলোচনার বিষয়।
অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং সেক্টরের এলএসি বরাবর কিছু এলাকায় ‘মতবিরোধপূর্ণ’ ক্ষেত্র রয়েছে। এসব এলাকায় উভয় পক্ষই নিয়ন্ত্রণ দাবি করে নিয়মিত টহল দেয়। ২০০৬ সাল থেকে এই প্রবণতা বেড়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সেনারা এলএসির সঙ্গে যুক্তকারী তাওয়াং সেক্টরে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ দাবি করেন এবং ভারতীয় সেনাদের চ্যালেঞ্জ করে বসেন। এরপরই মূলত সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই সময় চীনের অন্তত ৬০০ সৈন্য টহল দিচ্ছিল। ভারতের সৈন্যসংখ্যা জানা যায়নি।
বলে রাখা প্রয়োজন, অরুণাচল প্রদেশকে ভারতীয় একটি রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করে দিল্লি। কিন্তু বেইজিং এই অঞ্চলের প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার দক্ষিণ তিব্বত বলে দাবি করে।
এর আগে এই অঞ্চলে সর্বশেষ সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষটি ঘটেছিল ২০২০ সালের জুনে। ওই সময় গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর চীনের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিল ৪০ জনের বেশি। এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর প্যাংগং লেকের দক্ষিণ তীরসহ বেশ কয়েকটি সীমান্তসংলগ্ন স্থানে দুই দেশের সেনারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ওই ঘটনার পর দুই দেশের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
অতীতে ভারতের গালওয়ান নদীর উপত্যকা ঘিরে আরও একবার ভারত-চীন বাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। ১৯৬২ সালে সংক্ষিপ্ত সীমান্ত যুদ্ধের পরে চীন এটি দখল করেছিল। ভারত দাবি করে, উপত্যকাটি তাদের কাছে পরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চীনরা এখনো সেটির দখল অব্যাহত রেখেছে। গত ২৫ মে চীনের রাষ্ট্রপরিচালিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস বলেছে, গালওয়ান উপত্যকাটি চীনের অঞ্চল।
গত ৯ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের পর ভারতের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে চীন। দেশটির পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের মুখপাত্র লং শাওহুয়া বলেছেন, ‘চীনা সৈন্যরা সেখানে নিয়মিত টহল দিচ্ছিল। কিন্তু ভারতের সৈন্যরা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেছিল, যার ফলে সংঘর্ষটি বেধেছিল।’
তবে চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি স্পষ্টভাবে চীনকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, ‘চীন একতরফাভাবে সীমান্ত অস্থিতিশীল করে তুলছে। পিএলএ সৈন্যরা তাওয়াং সেক্টরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল বলেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে।’
যাহোক, এসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যেই ভারতীয় কমান্ডাররা চীনা প্রতিপক্ষের সঙ্গে পতাকা বৈঠক করেন। বিরোধপূর্ণ এলাকায় যাতে ‘শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য কাঠামোবদ্ধ ব্যবস্থা’ মেনে চলা হয়, সে ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা করেছেন তাঁরা।
চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক রয়েছে। লং শাওহুয়া দাবি করেছেন, স্থিতিশীল করতে চীনা সৈন্যরাই ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সেনারা পেশাদার, দৃঢ় ও মানসম্মত। তারাই পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে।’
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিভাগের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দুই পক্ষই কূটনৈতিক ও সামরিক চ্যানেলের মাধ্যমে সীমান্ত বিষয়ে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে। আমার জানামতে, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।’
তবে পরিস্থিতি কত দিন স্বাভাবিক থাকবে, সেটিই এখন প্রশ্ন। কারণ, অতীত ইতিহাস বলছে, এই অঞ্চলে দুটি দেশের সীমান্তরক্ষীরা বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে এবং উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। তার মানে, ভবিষ্যতেও কি এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি শান্ত করবেন?
ভারত ও চীনের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। তবে বিরোধের শিকড় রয়েছে এলএসি ঘিরে। সুতরাং এলএসি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ, এই রেখাই মূলত চীন ও ভারতকে আলাদা করেছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এলএসি সম্পর্কে দুই দেশের সেনাদের মধ্যেই স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। তারা নিজস্ব ধারণার ওপর টহল দিচ্ছে এবং যখন-তখন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছরের অক্টোবরে জিয়াংজি অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক চীনা সেনা টহল দিচ্ছিল। কিন্তু ভারতীয় সেনারা মনে করে এই অঞ্চলে তাদের। এই ধারণা থেকে তারা বেশ কয়েকজন চীনা সৈন্যকে আটক করে রেখেছিল।
এলএসি সম্পর্কে ভারতীয় সেনাদের যে স্পষ্ট ধারণা নেই, সেটি স্বীকার করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৯ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের পরে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, এলএসি কোথায় রয়েছে তা সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার কারণে সৈন্যদের (দুই দেশের) মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।
ভারত-চীন সীমান্তের এলএসি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। পশ্চিম ভাগটি লাদাখের ভারতীয় ভূখণ্ডকে ঘিরে রেখেছে। মধ্যভাগটি ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করেছে। আর পূর্বাঞ্চলটি অরুণাচল প্রদেশের রাজ্যসীমাকে বিভক্ত করেছে।
গত কয়েক বছরে চীনের পিএলএ সেনারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ করেছে পশ্চিম ভাগে। অর্থাৎ লাদাখ অঞ্চলে। তবে মধ্য ও পূর্ব ভাগেও মাঝে মাঝে সীমানা লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ করেছে চীনা সৈন্যরা। দিল্লি অভিযোগ করে বলেছে, গত দুই বছরে এলএসির মধ্য ভাগ অর্থাৎ উত্তরাখন্ডের সীমা ভেদ করে প্রচুর চীনা সেনা অনুপ্রবেশ করেছে।
চীনা সৈন্যদের এসব অনুপ্রবেশ রোধ করা ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে স্বীকার করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সেনাবাহিনী ও ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের (আইটিবিপি) মধ্যে আরও ভালো অপারেশনাল সমন্বয়ের প্রয়োজন। কারণ, উভয় বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের ‘গুরুতর অভাব’ রয়েছে।
এলএসি পরিচালনায় এই দুই সংস্থার মধ্যে কে প্রধান ভূমিকায় থাকবে, সেটি নিয়েও দীর্ঘ দিন ধরে বিতর্ক রয়েছে। সরকার চায়, এলএসি পরিচালনায় বড় ভূমিকা পালন করুক আইটিবিপি। আর সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করুক সেনাবাহিনী।
তবে ভারত সরকার চাইলেও এ কাজ করতে পারছে না। কারণ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডি এস হুদা আইটিবিপিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি মামলা করেছেন। তাঁর যুক্তি, এলএসি ইস্যুতে সেনা কর্মকর্তারাই চীনের সঙ্গে সমস্ত বৈঠকে প্রধান ভূমিকা রাখে এবং সীমান্তসংকট সেনাবাহিনীই সামলায়।
দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে না পারলেও এলএসি নিয়ন্ত্রণে অস্ত্র-সরঞ্জামের মজুত বাড়িয়েছে ভারত। দূরপাল্লার মনুষ্যবিহীন আকাশযান, উচ্চ প্রযুক্তির নজরদারি ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার, হালকা মেশিন গান, অ্যাসল্ট রাইফেল, রকেট লাঞ্চার এবং অত্যাধুনিক এম-৭৭৭ অস্ত্র মজুত করেছে।
এ ছাড়া এলএসির সমান্তরালে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছে ভারত। এটি অরুণাচল ফ্রন্টিয়ার হাইওয়ে নামে পরিচিত। এটি একটি সংযোগ প্রকল্প। এই প্রকল্পের কারণেও চীনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। কারণ চীন চায় না, ভারত তার সীমান্তে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করুক।
সম্প্রতি ভারত সীমান্ত ঘিরে চীনের ক্ষোভের অন্যতম কারণ ভারতীয় সেনাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বলেই মনে করছেন বেশির ভাগ বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে দৌলত বেগ ওল্ডির রাস্তা, বিশ্বের উচ্চতম এয়ারস্ট্রিপ এবং গালওয়ান উপত্যকার পশ্চিম দিকে শ্যাওক নদীর পার্শ্ববর্তী রাস্তা নির্মাণ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি চীন।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক পি স্টোবদান বলেছেন, ‘সীমান্তের পাশ দিয়ে ছুটে চলা রাস্তাগুলোই চীনা সৈন্যদের অনুপ্রবেশের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। বাড়িয়ে তুলেছে উত্তেজনা।’
সাম্প্রতিক উত্তেজনার পেছনে অন্য একটি কারণ অবশ্য খুঁজে পেয়েছেন ডেনমার্কে নিযুক্ত ভারতে রাষ্ট্রদূত ও চীন-ভারত সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ যোগেশ গুপ্ত। তিনি বলেছেন, এলএসি থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে উত্তরাখন্ড প্রদেশে গত অক্টোবরে ভারতীয় ও মার্কিন সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়া করেছে। এ মহড়া সম্ভবত ভালোভাবে নেয়নি চীন।
তবে এসব কারণ ছাড়াও ‘জাতীয়তাবাদী মনোভাব’ এই সংঘর্ষের পেছনে অন্যতম অনুঘটক বলে মনে করেন চীনের লানঝু ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজের সাবেক ডিন ইয়াং শু। তিনি বলেছেন, ‘ক্রমশ বেড়ে চলা জাতীয়তাবাদী মনোভাব সাম্প্রতিক সংঘর্ষকে উসকে দিয়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয়তাবাদ তীব্রভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনী প্রতিশোধ নিতে চায়; কারণ, ১৯৬২ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ক্ষত এখনো শুকায়নি তাদের।’
ইয়াং শু আরও বলেছেন, ‘বেইজিং ও নয়াদিল্লির নেতৃত্ব যদি অযৌক্তিক মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে এলএসি বরাবর আরও ঝগড়া, সংঘর্ষ ও উত্তেজনা বাড়বে।’
এ উত্তেজনার আসলে শেষ কোথায়, আপাতত কেউ জানে না তার সদুত্তর।
সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট, দ্য ইকোনমিস্ট, এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১৯ ঘণ্টা আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে