অনলাইন ডেস্ক
ইউক্রেন যুদ্ধে বেশ দীর্ঘস্থায়ী এবং ধারণার চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হলেও অগ্রগতির মুখ দেখেছে রাশিয়া। এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষিত অন্যতম লক্ষ্য—লুহানস্ক প্রদেশকে ইউক্রেনের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই শান্তি চুক্তি না হলে আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী দনেৎস্কও রাশিয়া এবং তাদের মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করার কোনো মানেই হয় না। কারণ, রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি এবং অনেক ক্ষেত্রে হয়তো বেশিও। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার না হারার কারণ এটি নয়। রাশিয়ার বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পরামর্শদাতা সের্গেই কারাগানভের মতে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ দেশটির ‘অস্তিত্বের’ প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কারাগানভ বলেন, এই যুদ্ধের বিষয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—রাশিয়া অন্যতম বিশ্বশক্তি। বিশ্বে সে তার মতো প্রভাব বলয় তৈরি করতে চায়। এ যুদ্ধে রাশিয়া হারলে রাশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। তাই রাশিয়া কোনোভাবেই হার মেনে নেবে না। এটা পশ্চিমাদের বুঝতে হবে।
কারাগানভের মতে, যুদ্ধ শুরুর সময় ইউক্রেনের সঙ্গে ন্যাটোর যে ধরনের সম্পর্ক চলছিল, তা বিশেষভাবে রাশিয়ার জন্য উদ্বেগজনক ছিল। বিশেষ করে ন্যাটো যেভাবে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল ইউক্রেনকে, তাতে মনে হচ্ছিল যে, ইউক্রেন একটি ধারালো ফলা, যা রাশিয়ার হৃৎপিণ্ডের দিকে তাক করা। এই অবস্থায় ১৯৯০ এর দশকে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের আধিপত্যের চূড়ায় উঠেছিল। ফলে অর্থনৈতিক, নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমের যে ক্ষয়, তা এখন তাকে বেশি পোড়াচ্ছে। এতে সৃষ্ট সংকটগুলো কিন্তু না পশ্চিমে, না বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমাধান হয়নি। এটিই ছিল এ যুদ্ধের ধ্রুপদি প্রেক্ষাপট। এদিকে, ২১ শতকের প্রথম দশকের শেষ থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমের যুদ্ধংদেহী মনোভাব বাড়তে থাকে। ফলে তখন থেকেই মস্কোর সঙ্গে পশ্চিমের একটি সংঘাত আসন্ন বলে মনে হচ্ছিল। মস্কো এ ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে নিজে থেকেই এই সংঘাতের শর্তাবলি নির্ধারণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
এই সংঘাত অধিকাংশ পশ্চিমা অভিজাতের জন্য এক অস্তিত্বের লড়াই উল্লেখ করে কারাগানভ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এর পেছনে তাদের ব্যর্থতা আছে। আছে গণমানুষের দিক থেকে তাদের অনাস্থার বাস্তবতাও। তাই জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যেতে তাদের দরকার ছিল একটি শত্রুর। এবং সেই শত্রুই হলো রাশিয়া। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে উদারবাদী বিশ্বায়নের নামে জারি করা সাম্রাজ্যবাদী কাঠামো ধসে গেলে শুধু বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা অভিজাতরাই নয়, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশই আর টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে না। তাই এই যুদ্ধ কোনোভাবেই শুধু ইউক্রেনের বিষয় নয়। বরং ইউক্রেন ও তার জনগণকে পশ্চিমা অভিজাতরা নিজেদের শৌর্যকে অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে কামানের গোলা হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিপরীতে রাশিয়ার কাছে এই যুদ্ধ কেবল তার অভিজাত গোষ্ঠীকে রক্ষা নয়, বরং দেশটির অস্তিত্বের জন্যই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই এই যুদ্ধে রাশিয়ার কোনোভাবেই হারা চলবে না বলে মনে করেন কারাগানভ। তাঁর মতে, এ কারণেই খুব বেশি সহিংসতার আশ্রয় না নিয়েও রাশিয়া জিতবে বলে আশা করা যায়। যদিও মানুষ কিন্তু মরছে।
এই যুদ্ধ ও ক্ষয়ের জন্য এক ধরনের পীড়নও বোধ করেন কারাগানভ। তিনি বলেন, ‘গত ২৫ বছর ধরে এমন একটি যুদ্ধের শঙ্কা ছিল আমার মধ্যে। আমি এটি থামাতে পারিনি। এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।’
কিন্তু কারাগানভ যে কথা বলছেন, তার সমালোচনাও আছে। তিনি এই যুদ্ধকে পশ্চিমাদের ‘রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন’ করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হিসেবে বর্ণনা করলেও, পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্লেষকেরা একে দেখছেন ভিন্নভাবে। তাঁরা বলছেন, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই রাশিয়া বরং বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এই যুদ্ধকে সামনে রেখে, ইউক্রেনে চলা ধ্বংসযজ্ঞকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বরং নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পশ্চিম রাশিয়াকে আগামী বহু বছর ‘বড় হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করবে।
এই প্রসঙ্গ সামনে এনে এই যুদ্ধকে ‘ভুল’ হিসেবে ভাবতে রাজি কি-না, প্রশ্ন করলে কারাগানভ বলেন, গত দেড় দশক ধরেই রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসের ঘটনায় তাই খুব বেশি কিছু হারানোর নেই। তিনি বলেন, ‘এখন দ্বিতীয় কোনো ভাবনা ছাড়াই পশ্চিম থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে। বরং আমরা পশ্চিমে কী ঘটে তা দেখার অপেক্ষায় আছি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক দূরত্বের কথা বিবেচনায় বলতে গেলে পশ্চিম থেকে যত দূরে থাকব, ততই আমরা ভালো থাকব। অন্তত পরের এক-দুই দশক। এর পর আশা করা যায় কিছু বদল আসবে। পশ্চিমা অভিজাতদের মধ্যে কিছু বদল আসবে। আবার আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। তবে এটা এখনই করতে গিয়ে আমরা দ্রুত বর্ধনশীল বাকি বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফলতে পারি না, যেখানে পশ্চিম ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। সেটা হবে আত্মহত্যার শামিল। একেবারের সরাসরি দ্বৈরথে যাওয়াটা ঠিক ছিল, নাকি ভুল, তার মীমাংসা একমাত্র ইতিহাসই করতে পারে।’
কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এরই মধ্যে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেন সার্জ শ্মেম্যান। উদাহরণ হিসেবে তিনি রাশিয়া থেকে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া, খেলা বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকাদের এই যুদ্ধের কারণে ভোগান্তিতে পড়া ইত্যাদির কথা তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে রাশিয়ার ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ভ্লাদিমির পুতিন ধ্বংস করছেন বলে একটি মত চাউর হয়েছে উল্লেখ করে কারাগানভ কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি এসব ঘটনাকে রাশিয়ার জন্য ভালো কিছু বলে বিবেচনা করছেন কি-না, করলে কেন?
জবাবে কারাগানভ যা বলেছেন, তাতে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক কাঠামোয় প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার আকাঙ্ক্ষাই প্রবল হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে, একটা ন্যায্য ও স্থিতিশীল বিশ্বকাঠামোয় নিজের শক্ত অবস্থান তৈরির লড়াই এটি। এ যুদ্ধ রাশিয়ার কাছে উন্নত ও গৌরবময় সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য লড়াই। তিনি বলেন, ‘এমন একটা যুদ্ধ কিছু না হারিয়ে জয় করা সম্ভব নয়। তবে এর কারণে কয়েক লাখ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের রাশিয়া ছেড়ে যাওয়াটা দুঃখজনক। যদিও আমি জানি, আপনিও একমত হবেন যে, তারা সুখে নেই। তাদের কেউ কেউ ফিরে আসবে আশা করি। রুশ সংস্কৃতি বা রাশিয়ার যেকোনো কিছুকে খারিজ করাটা পশ্চিমাদের সমস্যা। এটা অনেকটা তাদের নিজের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও খ্রিষ্টীয় নৈতিকতাকে খারিজ করার মতোই।’
তবে সংঘাত রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে বলে স্বীকার করেছেন সের্গেই কারাগানভ। নিজের বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্যেও তিনি বরাবরই এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন উল্লেখ করে কারাগানভ বলেন, রাশিয়ায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অন্য অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থানে আছে। খারিজ করার সংস্কৃতি রুশদের মধ্যে নেই। রাশিয়া বরং ভবিষ্যতের চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। একই সঙ্গে সম্ভাব্য পারমাণবিক সংঘাত নিয়েও উদ্বিগ্ন, যা মানবসভ্যতার ইতিহাসেই ইতি টেনে দিতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিকে গত শতকের ৬০-এর দশকের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সঙ্গে তুলনা করে কারাগানভ বলেন, ‘মুশকিল হচ্ছে বিপরীত পক্ষে কেনেডির মতো দক্ষ কোনো লোক এবার নেই।’
মোদ্দা কথা, কারাগানভ নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে পশ্চিমাদের খারিজ করার সংস্কৃতিকে এই সংকটের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মতে, এই যুদ্ধের কারণে সাধারণ রুশদের কষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমারা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ায় একটা বিদ্রোহের আবহ তৈরি করতে চায়। কিন্তু এসব করে উল্টো ফল হচ্ছে বলে দাবি কারাগানভের। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে একটা লাভ হয়েছে যে, রাশিয়ায় পশ্চিমা মূল্যবোধ নিয়ে থাকা লোকেরা অন্য দেশে চলে গেছে। এতে পশ্চিমাবান্ধব উপাদান থেকে মুক্ত হচ্ছে রাশিয়া। তবে, এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতি বিতাড়ন রাশিয়ার উদ্দেশ্য নয়। বরং এর ফলে ভবিষ্যতে রাশিয়াই হয়ে উঠবে অন্যতম অঞ্চল, যেখানে ইউরোপের সংস্কৃতি ও এর যাবতীয় সম্পদ ও মূল্যবোধের দেখা মিলবে।
রাশিয়া বারবার করে এ যুদ্ধে জয়ের কথা বলছে নিজের অস্তিত্ব টেকানোর প্রশ্নে। কিন্তু এই জয় আসলে কীসে নির্ধারিত হবে জানতে চাইলে সের্গেই কারাগানভ বলেন, ‘লক্ষ্যটা আদতে পরিবর্তনশীল। তবে ন্যূনতম লক্ষ্য হচ্ছে, দনবাসকে কিয়েভের ক্ষমতাকাঠামো থেকে মুক্ত করা। এটি এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তারপরই আসছে ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল মুক্ত করার প্রশ্ন। আর তার পর রাশিয়ার লক্ষ্য হয়তো থাকবে, কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোর নিরস্ত্রীকরণ।’
কারাগানভ বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিম আরোপিত বিশ্ব ব্যবস্থা পতনের মধ্য দিয়ে একটি ন্যায্য ও মুক্ত বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে যাত্রার ছোট্ট একটি পদক্ষেপ। সেই বিশ্ব ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র হবে ইউরেশিয়া, যেখানে রয়েছে মহান সভ্যতার ইতিহাস, যাকে শত শত বছর ধরে অবদমনে বাধ্য করা হয়েছে। এখানে রাশিয়া বিশ্ব সভ্যতাগুলো মধ্যে সংযোগ সাধনের এক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই কাঠামোয় ভারসাম্য রক্ষার কাজটি রাশিয়া করতে পারে। দুটি ভূমিকাই রাশিয়া পালন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
ইউক্রেন যুদ্ধে বেশ দীর্ঘস্থায়ী এবং ধারণার চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হলেও অগ্রগতির মুখ দেখেছে রাশিয়া। এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষিত অন্যতম লক্ষ্য—লুহানস্ক প্রদেশকে ইউক্রেনের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই শান্তি চুক্তি না হলে আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী দনেৎস্কও রাশিয়া এবং তাদের মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করার কোনো মানেই হয় না। কারণ, রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি এবং অনেক ক্ষেত্রে হয়তো বেশিও। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার না হারার কারণ এটি নয়। রাশিয়ার বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পরামর্শদাতা সের্গেই কারাগানভের মতে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ দেশটির ‘অস্তিত্বের’ প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কারাগানভ বলেন, এই যুদ্ধের বিষয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—রাশিয়া অন্যতম বিশ্বশক্তি। বিশ্বে সে তার মতো প্রভাব বলয় তৈরি করতে চায়। এ যুদ্ধে রাশিয়া হারলে রাশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। তাই রাশিয়া কোনোভাবেই হার মেনে নেবে না। এটা পশ্চিমাদের বুঝতে হবে।
কারাগানভের মতে, যুদ্ধ শুরুর সময় ইউক্রেনের সঙ্গে ন্যাটোর যে ধরনের সম্পর্ক চলছিল, তা বিশেষভাবে রাশিয়ার জন্য উদ্বেগজনক ছিল। বিশেষ করে ন্যাটো যেভাবে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল ইউক্রেনকে, তাতে মনে হচ্ছিল যে, ইউক্রেন একটি ধারালো ফলা, যা রাশিয়ার হৃৎপিণ্ডের দিকে তাক করা। এই অবস্থায় ১৯৯০ এর দশকে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের আধিপত্যের চূড়ায় উঠেছিল। ফলে অর্থনৈতিক, নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমের যে ক্ষয়, তা এখন তাকে বেশি পোড়াচ্ছে। এতে সৃষ্ট সংকটগুলো কিন্তু না পশ্চিমে, না বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমাধান হয়নি। এটিই ছিল এ যুদ্ধের ধ্রুপদি প্রেক্ষাপট। এদিকে, ২১ শতকের প্রথম দশকের শেষ থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমের যুদ্ধংদেহী মনোভাব বাড়তে থাকে। ফলে তখন থেকেই মস্কোর সঙ্গে পশ্চিমের একটি সংঘাত আসন্ন বলে মনে হচ্ছিল। মস্কো এ ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে নিজে থেকেই এই সংঘাতের শর্তাবলি নির্ধারণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
এই সংঘাত অধিকাংশ পশ্চিমা অভিজাতের জন্য এক অস্তিত্বের লড়াই উল্লেখ করে কারাগানভ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এর পেছনে তাদের ব্যর্থতা আছে। আছে গণমানুষের দিক থেকে তাদের অনাস্থার বাস্তবতাও। তাই জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যেতে তাদের দরকার ছিল একটি শত্রুর। এবং সেই শত্রুই হলো রাশিয়া। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে উদারবাদী বিশ্বায়নের নামে জারি করা সাম্রাজ্যবাদী কাঠামো ধসে গেলে শুধু বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা অভিজাতরাই নয়, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশই আর টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে না। তাই এই যুদ্ধ কোনোভাবেই শুধু ইউক্রেনের বিষয় নয়। বরং ইউক্রেন ও তার জনগণকে পশ্চিমা অভিজাতরা নিজেদের শৌর্যকে অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে কামানের গোলা হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিপরীতে রাশিয়ার কাছে এই যুদ্ধ কেবল তার অভিজাত গোষ্ঠীকে রক্ষা নয়, বরং দেশটির অস্তিত্বের জন্যই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই এই যুদ্ধে রাশিয়ার কোনোভাবেই হারা চলবে না বলে মনে করেন কারাগানভ। তাঁর মতে, এ কারণেই খুব বেশি সহিংসতার আশ্রয় না নিয়েও রাশিয়া জিতবে বলে আশা করা যায়। যদিও মানুষ কিন্তু মরছে।
এই যুদ্ধ ও ক্ষয়ের জন্য এক ধরনের পীড়নও বোধ করেন কারাগানভ। তিনি বলেন, ‘গত ২৫ বছর ধরে এমন একটি যুদ্ধের শঙ্কা ছিল আমার মধ্যে। আমি এটি থামাতে পারিনি। এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।’
কিন্তু কারাগানভ যে কথা বলছেন, তার সমালোচনাও আছে। তিনি এই যুদ্ধকে পশ্চিমাদের ‘রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন’ করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হিসেবে বর্ণনা করলেও, পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্লেষকেরা একে দেখছেন ভিন্নভাবে। তাঁরা বলছেন, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই রাশিয়া বরং বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এই যুদ্ধকে সামনে রেখে, ইউক্রেনে চলা ধ্বংসযজ্ঞকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বরং নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পশ্চিম রাশিয়াকে আগামী বহু বছর ‘বড় হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করবে।
এই প্রসঙ্গ সামনে এনে এই যুদ্ধকে ‘ভুল’ হিসেবে ভাবতে রাজি কি-না, প্রশ্ন করলে কারাগানভ বলেন, গত দেড় দশক ধরেই রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসের ঘটনায় তাই খুব বেশি কিছু হারানোর নেই। তিনি বলেন, ‘এখন দ্বিতীয় কোনো ভাবনা ছাড়াই পশ্চিম থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে। বরং আমরা পশ্চিমে কী ঘটে তা দেখার অপেক্ষায় আছি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক দূরত্বের কথা বিবেচনায় বলতে গেলে পশ্চিম থেকে যত দূরে থাকব, ততই আমরা ভালো থাকব। অন্তত পরের এক-দুই দশক। এর পর আশা করা যায় কিছু বদল আসবে। পশ্চিমা অভিজাতদের মধ্যে কিছু বদল আসবে। আবার আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। তবে এটা এখনই করতে গিয়ে আমরা দ্রুত বর্ধনশীল বাকি বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফলতে পারি না, যেখানে পশ্চিম ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। সেটা হবে আত্মহত্যার শামিল। একেবারের সরাসরি দ্বৈরথে যাওয়াটা ঠিক ছিল, নাকি ভুল, তার মীমাংসা একমাত্র ইতিহাসই করতে পারে।’
কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এরই মধ্যে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেন সার্জ শ্মেম্যান। উদাহরণ হিসেবে তিনি রাশিয়া থেকে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া, খেলা বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকাদের এই যুদ্ধের কারণে ভোগান্তিতে পড়া ইত্যাদির কথা তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে রাশিয়ার ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ভ্লাদিমির পুতিন ধ্বংস করছেন বলে একটি মত চাউর হয়েছে উল্লেখ করে কারাগানভ কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি এসব ঘটনাকে রাশিয়ার জন্য ভালো কিছু বলে বিবেচনা করছেন কি-না, করলে কেন?
জবাবে কারাগানভ যা বলেছেন, তাতে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক কাঠামোয় প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার আকাঙ্ক্ষাই প্রবল হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে, একটা ন্যায্য ও স্থিতিশীল বিশ্বকাঠামোয় নিজের শক্ত অবস্থান তৈরির লড়াই এটি। এ যুদ্ধ রাশিয়ার কাছে উন্নত ও গৌরবময় সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য লড়াই। তিনি বলেন, ‘এমন একটা যুদ্ধ কিছু না হারিয়ে জয় করা সম্ভব নয়। তবে এর কারণে কয়েক লাখ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের রাশিয়া ছেড়ে যাওয়াটা দুঃখজনক। যদিও আমি জানি, আপনিও একমত হবেন যে, তারা সুখে নেই। তাদের কেউ কেউ ফিরে আসবে আশা করি। রুশ সংস্কৃতি বা রাশিয়ার যেকোনো কিছুকে খারিজ করাটা পশ্চিমাদের সমস্যা। এটা অনেকটা তাদের নিজের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও খ্রিষ্টীয় নৈতিকতাকে খারিজ করার মতোই।’
তবে সংঘাত রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে বলে স্বীকার করেছেন সের্গেই কারাগানভ। নিজের বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্যেও তিনি বরাবরই এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন উল্লেখ করে কারাগানভ বলেন, রাশিয়ায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অন্য অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থানে আছে। খারিজ করার সংস্কৃতি রুশদের মধ্যে নেই। রাশিয়া বরং ভবিষ্যতের চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। একই সঙ্গে সম্ভাব্য পারমাণবিক সংঘাত নিয়েও উদ্বিগ্ন, যা মানবসভ্যতার ইতিহাসেই ইতি টেনে দিতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিকে গত শতকের ৬০-এর দশকের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সঙ্গে তুলনা করে কারাগানভ বলেন, ‘মুশকিল হচ্ছে বিপরীত পক্ষে কেনেডির মতো দক্ষ কোনো লোক এবার নেই।’
মোদ্দা কথা, কারাগানভ নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে পশ্চিমাদের খারিজ করার সংস্কৃতিকে এই সংকটের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মতে, এই যুদ্ধের কারণে সাধারণ রুশদের কষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমারা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ায় একটা বিদ্রোহের আবহ তৈরি করতে চায়। কিন্তু এসব করে উল্টো ফল হচ্ছে বলে দাবি কারাগানভের। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে একটা লাভ হয়েছে যে, রাশিয়ায় পশ্চিমা মূল্যবোধ নিয়ে থাকা লোকেরা অন্য দেশে চলে গেছে। এতে পশ্চিমাবান্ধব উপাদান থেকে মুক্ত হচ্ছে রাশিয়া। তবে, এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতি বিতাড়ন রাশিয়ার উদ্দেশ্য নয়। বরং এর ফলে ভবিষ্যতে রাশিয়াই হয়ে উঠবে অন্যতম অঞ্চল, যেখানে ইউরোপের সংস্কৃতি ও এর যাবতীয় সম্পদ ও মূল্যবোধের দেখা মিলবে।
রাশিয়া বারবার করে এ যুদ্ধে জয়ের কথা বলছে নিজের অস্তিত্ব টেকানোর প্রশ্নে। কিন্তু এই জয় আসলে কীসে নির্ধারিত হবে জানতে চাইলে সের্গেই কারাগানভ বলেন, ‘লক্ষ্যটা আদতে পরিবর্তনশীল। তবে ন্যূনতম লক্ষ্য হচ্ছে, দনবাসকে কিয়েভের ক্ষমতাকাঠামো থেকে মুক্ত করা। এটি এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তারপরই আসছে ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল মুক্ত করার প্রশ্ন। আর তার পর রাশিয়ার লক্ষ্য হয়তো থাকবে, কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোর নিরস্ত্রীকরণ।’
কারাগানভ বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিম আরোপিত বিশ্ব ব্যবস্থা পতনের মধ্য দিয়ে একটি ন্যায্য ও মুক্ত বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে যাত্রার ছোট্ট একটি পদক্ষেপ। সেই বিশ্ব ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র হবে ইউরেশিয়া, যেখানে রয়েছে মহান সভ্যতার ইতিহাস, যাকে শত শত বছর ধরে অবদমনে বাধ্য করা হয়েছে। এখানে রাশিয়া বিশ্ব সভ্যতাগুলো মধ্যে সংযোগ সাধনের এক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই কাঠামোয় ভারসাম্য রক্ষার কাজটি রাশিয়া করতে পারে। দুটি ভূমিকাই রাশিয়া পালন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
কোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
১৬ ঘণ্টা আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৪ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৮ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
১১ দিন আগে