কে এই হরদীপ সিং, কানাডায় তাঁর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় গোয়েন্দার নাম কেন

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১: ১২

শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজার হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকার জড়িত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা। তবে ট্রুডোর এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ অভিহিত করেছে ভারত।

এ ঘটনার জেরে ভারতীয় এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে কানাডা। পাল্টা জবাবে কানাডার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে দিল্লি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ভারত। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন বেশ নাজুক। কিন্তু কে এই হরদীপ সিং? যাকে ঘিরে ভারত-কানাডার সম্পর্কের টানাপোড়েন তুঙ্গে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) এর নামই বা এখানে জড়াচ্ছে কেন? 

হরদীপ সিংয়ের পরিচয়
জানা গেছে, হরদীপ সিংয়ের জন্ম ১৯৭৭ সালে পাঞ্জাবের জলন্ধরের ভরসিংহপুর গ্রামে। প্রাথমিক জীবনে পাইপ মেরামতের কাজ করতেন। সেখান থেকেই ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বিশিষ্ট শিখ নেতা হয়ে ওঠেন। হরদীপ শুধু শিখ সম্প্রদায়ের নেতাই নন, শিখদের জন্য একটি পৃথক খালিস্তানি রাষ্ট্র গঠনের সংগঠকও ছিলেন।

১৯৮০ এর দশকে খালিস্তান আন্দোলন গণমাধ্যমে আসে, তবে শিখ এবং পাঞ্জাবের সার্বভৌমত্বের দাবির সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময়। কিন্তু ভারতে শিখদের এই আন্দোলনকে দমন করা হয়। শিখ সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেওয়া হয়। ফলে ১৯৯৭ সালে কানাডায় পাড়ি জমান তিনি। 

খালিস্তান টাইগার ফোর্সের সঙ্গে কথিত যোগসূত্রের জন্য ২০২০ সালে হরদীপ সিংকে ‘সন্ত্রাসী’ ঘোষণা করে ভারত সরকার। তার সমর্থকদের দাবি, খালিস্তান আন্দালনে যুক্ত হওয়ার জন্য আগেও বহুবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল হরদীপ সিংকে। 

যেভাবে খুন হন হরদীপ
ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন বলেছে, হরদীপ সিং নিজ্জার নিজেই হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে গত গ্রীষ্মে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়েছিলেন। ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, মৃত্যুর আগে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনে ভারতে বেসরকারি গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন হরদীপ সিং নিজ্জার।

একাধিক সূত্র কানাডার গ্লোবাল নিউজকে জানায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে হরদীপকে হত্যার আগে বারবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বার্নাবির স্পাইস রেডিও ১২০০-এএমের সঙ্গে গত ১৮ মে একটি সাক্ষাৎকারেও হরদীপ এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন। 

এরপরই গত ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় একটি শিখ উপাসনালয়ের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয় নিজারকে। ভ্যাঙ্কুভার থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্বে সারে শহরে গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারার গাড়ি পার্কিংয়ে নিজের গাড়িতে বসা নিজারকে গুলি করে হত্যা করে মুখোশ পরা দুই বন্দুকধারী।  

ট্রুডোর প্রতিক্রিয়া
সম্প্রতি জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন ট্রুডো। এরই ধারাবিহিকতায় গতকাল সোমবার হাউস অব কমনসে বক্তৃতার সময় ট্রুডো বলেন, ‘কানাডার মাটিতে একজন কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটি আমাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন, যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। এমন ঘটনা মুক্ত, স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক সমাজের পরিপন্থী।’

হরদীপের এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যু কানাডার শিখ সম্প্রদায়কে গভীরভাবে শোকাহত করেছে। গত সপ্তাহে তাঁর শেষকৃত্যে হাজারো সমর্থকেরা এসেছিল। গতকাল সোমবার ট্রুডোর বক্তব্যর পর তাঁরা ভারতের কনস্যুলেট অফিসের সামনে বিক্ষোভও করেছেন।  

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) কানাডিয়ান শাখার প্রধান পবন কুমার রাইকে বহিস্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করে অনেকটা ট্রুডোর বক্তব্যরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। 

ভারতীয় গোয়েন্দার নাম আসার কারণ 
এদিকে কানাডার সংবাদ সংস্থা গ্লোবাল নিউজ ‘র’ এর বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। সংবাদ সংস্থাটির প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ২০০৯ সালে অর্থ এবং ভুল তথ্য দিয়ে ‘র’ কানাডিয়ান রাজনীতিবিদদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। 

পাঞ্জাবে বড় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনার অভিযোগে ২০১৮ সালে ভারত সরকার হরদীপের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দাখিল করে। তবে এ পর্যন্ত হরদীপের বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসী হামলার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি নিজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট জানিয়ে ট্রুডোকে চিঠি লিখেছেন। 

হরদীপের হত্যার পর ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় শিখদের গুরুদ্বার কাউন্সিলের মুখপাত্র মনিন্দর সিং গ্লোবাল নিউজকে বলেছিলেন, হত্যার হুমকির পর থেকে হরদীপ পরিবারের সঙ্গে ছিলেন না। তিনি, হরদীপ এবং অন্য তিন শিখ নেতাকে ২০২২ সালের জুলাই মাসে হত্যার হুমকির বিষয়ে সতর্ক করেছিল রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ। তবে এ বিষয়ে এখন আর মুখ খুলছে না কানাডার পুলিশ। 

গতকাল সোমবার পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতেও সক্ষম হয়নি পুলিশ। তবে সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে। তাঁদের মধ্যে দুইজন হত্যাকাণ্ডের স্থান থেকে টয়োটা ক্যামরি গাড়ি নিয়ে পালিয়েছিলেন। 

কানাডার জননিরাপত্তা মন্ত্রী ডমিনিক লেব্ল্যাঙ্ক অটোয়ায় সাংবাদিকদের বলেছেন, কুইবেক কোর্ট অব আপিলের বিচারপতি মেরি-জোসি হোগ এ ঘটনায় তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি প্রাপ্ত আলামত অনুযায়ীই কাজ করবেন। এখানে নতুন উত্থাপিত গোয়েন্দা তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এদিকে এক বিবৃতিতে ‘শিখস ফর জাস্টিস’ কানাডায় ভারতীয় হাইকমিশনার সঞ্জয় ভার্মাকে বহিষ্কারের জন্য ট্রুডোকে অনুরোধ করেছে। এ মানবাধিকার সংগঠন খালিস্তানকে সমর্থন করে। এ বিষয়ে অটোয়াতে অবস্থিত ভারতীয় কনস্যুলেট মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত