ফজলুল কবির
আহমদ নাসেরের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে উদ্গ্রীব এই ব্যক্তি তালেবানকে ভয় পান। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ অভিবাসী ভিসা পেতে আবেদনও করেছেন ৩০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি। এই শঙ্কাটা স্বাভাবিকও। কিন্তু তিনি কি এক ভয় থেকে আরেক মহাভয়ের কাছে আশ্রয় নিতে চাইছেন?
এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেওয়াটা এই মুহূর্তে নাসেরের মতো লোকেদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভয় এমনই। কিন্তু প্রশ্নটি জরুরি। নিঃসন্দেহে। আজ ১১ সেপ্টেম্বর। বিশ্বের ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি হয়েছিল আজকের এই দিনে। দুই দশক আগে আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র বা টুইন টাওয়ারে এবং ওয়াশিংটনে পেন্টাগন ভবনে তিরের মতো এসে আছড়ে পড়েছিল তিনটি উড়োজাহাজ। তাসের ঘরের মতো ধসে পড়েছিল সব। মুহূর্তের মধ্যে একটি সাদাসিধে দিন পরিণত হয় এক ভয়াবহ দিনে, যা গোটা বিশ্বে অনেকটা মহামারির মতো ছড়িয়ে দিয়েছে যুদ্ধের বাস্তবতা। আজও সেই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসেনি বিশ্ব।
৯/১১ হামলায় মোট ২ হাজার ৯৯৬ জন নিহত হয়েছিল। সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সে হামলায়। কিন্তু সেই বোবা বিস্ময়ই শেষ ছিল না। গোটা বিশ্বের মানুষ ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর দেখল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মার্কিন কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে ‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। তখনো হয়তো মানুষ বোঝেনি ঠিক কী এবং কত ব্যাপক পরিসরে ঘটতে যাচ্ছে? কিন্তু আজ মানুষ জানে ৯/১১ গত দুই দশকে আফগানিস্তান তো বটেই বিশ্বের বহু দেশের ইতিহাসের গতিপথই বদলে দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুক্তরাষ্ট্র সে ঘোষিত যুদ্ধই সন্ত্রাসকে পরিণত করেছে এক ভয়াবহ রপ্তানি পণ্যে, যার আছে নিজস্ব মুনাফার সমীকরণও।
সেদিনের সেই ২,৯৯৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর জবাব শুধু নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই পায়নি কিংবা একটি প্রজন্মের মধ্য দিয়েও এই গল্পের যবনিকা পড়েনি। বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর মূল্য চুকিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে? ব্রাউন ইউনিভার্সিটি কস্টস অব ওয়ার প্রোজেক্ট নামের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, শুধু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৩ লাখ ৬৩ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। একই সঙ্গে এই উল্লেখও করা হয়েছে যে, এই সংখ্যা শুধু সরাসরি গুলিতে নিহতদের। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট নানা কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ধরলে তা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে বহু আগেই।
একটু খোলাসা করা যাক। আজ যে আফগানরা দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন, তাঁরা তালেবান নিয়ে ভীত। তাঁরা যে জীবনের স্বপ্ন দেখেন, সেই জীবনের পথে তাঁরা তালেবানকে বাধা মনে করেন। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। যে কারও নিজের স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া করার অধিকার আছে। তালেবান যদি সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার আওতার বাইরে চলে যাওয়া, বা তাকে রুখে দাঁড়ানো—যেকোনো একটি করাই উচিত। কিন্তু যখন এই তালেবান থেকে বাঁচতে তাঁরা এমন এক জায়গায় আশ্রয় খোঁজেন, যে কিনা আরও বেশি মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ, তবে প্রশ্ন উঠবেই।
গত ২৯ আগস্ট কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের বাইরে হওয়া আইএস হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আইএস ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায়। সাফল্য নিয়ে বেশ গদগদ বক্তব্যও দেয়। কিন্তু সে হামলায় যে বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল, তা বেমালুম চেপে যায়। শুধু বেসামরিক নয় নিহত ১০ জনের মধ্যে সাতজনই ছিল নিরীহ নারী ও শিশু। অর্থাৎ, একটি সামরিক হামলার দায় চোকাতে প্রাণ দিতে হলো বেসামরিক সাধারণ মানুষকে। এই ঘটনাই ঘটেছে গত দুই দশকে হরদম। ইরাকের আবু গারিব কারাগারের বীভৎস নির্যাতনের কথা তো কেউ ভোলেনি। রাসায়নিক অস্ত্রের দোহাই দিয়ে দেশটিতে চালানো মার্কিন হামলায় কত অজস্র বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
এই যে নিরীহ মানুষকে সামরিক হামলায় হত্যা করা, এটিই দেশে দেশে বুনে দিয়েছে নয়া সন্ত্রাসের বীজ। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়া—যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, এই একই বাস্তবতা দেখা যাবে। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের’ কথা বলে, ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে কোনো একটি গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে উদ্ধারকর্তা হিসেবে প্রবেশ করেছে। গণতন্ত্রসহ নানা চটকদার ধারণা সেখানে রপ্তানি করতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষ তার সেই ব্যবস্থাপত্রকে সন্দেহ করেছে, যখন সে দেখেছে এই একই শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে সামরিক শাসন, কট্টরবাদ ইত্যাদিকে নিজেই পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্ধারকর্তা তো নয়ই, দখলদার হিসেবে দেখেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র প্রযোজিত সব যুদ্ধ ও (উদ্ধার) অভিযানকে দেখেছে আগ্রাসন হিসেবে। ফলে পুরো পশ্চিমা বিশ্বকেই তারা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর সেই সূত্রে আধুনিক সময়ের বিজ্ঞান ও জ্ঞানকাঠামোকে তারা শত্রু জ্ঞান করেছে। তাদের এই অবস্থানের কারণে আজ কোটি কোটি মানুষ ভুক্তভোগী।
গেল দুই দশকের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ আদতে গোটা বিশ্বে এক ভয়াবহ রপ্তানি পণ্য হিসেবে সন্ত্রাসকে হাজির করেছে। এ থেকে বাদ যায়নি পশ্চিমা দেশও। একের পর এক আত্মঘাতী হামলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের হামলার সাক্ষী হতে হয়েছে তাকে। বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে গোটা বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজারের বেশি। তার আগের বছর ছিল ৩২ হাজার। এই নিহতের দল কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে আর সীমাবদ্ধ নেই। সুদূর নাইজেরিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এই মৃতেরা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও বাদ যায়নি।
এই দুই দশকে সন্ত্রাস নির্মূল নয়, বরং ভবঘুরে হয়েছে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে তারা গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এই গোষ্ঠীগুলো ৯/১১ মাপের বড় কোনো হামলা করতে পারেনি। কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত লক্ষ্যকে অসার প্রমাণ করে চলেছে। যে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ দিয়ে এই বিস্তৃত যুদ্ধের শুরুর বিন্দুকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেই আল-কায়েদাও এমনকি নির্মূল হয়নি। বিশ্বের ১৭টি দেশে এই গোষ্ঠী নামে-বেনামে আজ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। জন্ম নিয়েছে ইসলামিক স্টেট। মানুষ জেনেছে আল-শাবাব, বোকো হারামসহ অজস্র গোষ্ঠীর নাম ও তাদের বিধ্বংসী কাজ সম্পর্কে। আর আঞ্চলিক ও বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট গোষ্ঠীর নাম নিতে গেলে শুধু তালিকাই দীর্ঘ হবে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জর্জ বুশের ঘোষণা করা সর্বাত্মক যুদ্ধ সারা বিশ্বকেই সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয়, শুধু যুক্তরাষ্ট্র প্রযোজিত বলেই দুই দশক ব্যপ্তির এই যুদ্ধের কারণে প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশে দেশে উদারবাদী রাজনীতিকেরা কোণঠাসা হয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রীয় চর্চা অনেকাংশেই কট্টরবাদের দিকে ছুটেছে। আজ গোটা বিশ্বে কট্টরবাদ, নয়া-রক্ষণশীলতা ও লোকরঞ্জনবাদের যে দাপট, তার মূলটি আদতে ওই ৯/১১ ও তার পরের দুই দশকের যুদ্ধের মধ্যেই রয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে যে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও ট্রাম্প সমর্থকদের যে হামলা হলো, তার মূলটিও এই দুই দশকের যুদ্ধ সমীকরণের সঙ্গেই যুক্ত। কারণ, এই যুদ্ধ ও তার প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়াই এর নেপথ্য শক্তি।
আরও পড়ুন:
আহমদ নাসেরের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে উদ্গ্রীব এই ব্যক্তি তালেবানকে ভয় পান। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ অভিবাসী ভিসা পেতে আবেদনও করেছেন ৩০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি। এই শঙ্কাটা স্বাভাবিকও। কিন্তু তিনি কি এক ভয় থেকে আরেক মহাভয়ের কাছে আশ্রয় নিতে চাইছেন?
এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেওয়াটা এই মুহূর্তে নাসেরের মতো লোকেদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভয় এমনই। কিন্তু প্রশ্নটি জরুরি। নিঃসন্দেহে। আজ ১১ সেপ্টেম্বর। বিশ্বের ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি হয়েছিল আজকের এই দিনে। দুই দশক আগে আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র বা টুইন টাওয়ারে এবং ওয়াশিংটনে পেন্টাগন ভবনে তিরের মতো এসে আছড়ে পড়েছিল তিনটি উড়োজাহাজ। তাসের ঘরের মতো ধসে পড়েছিল সব। মুহূর্তের মধ্যে একটি সাদাসিধে দিন পরিণত হয় এক ভয়াবহ দিনে, যা গোটা বিশ্বে অনেকটা মহামারির মতো ছড়িয়ে দিয়েছে যুদ্ধের বাস্তবতা। আজও সেই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসেনি বিশ্ব।
৯/১১ হামলায় মোট ২ হাজার ৯৯৬ জন নিহত হয়েছিল। সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সে হামলায়। কিন্তু সেই বোবা বিস্ময়ই শেষ ছিল না। গোটা বিশ্বের মানুষ ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর দেখল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মার্কিন কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে ‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। তখনো হয়তো মানুষ বোঝেনি ঠিক কী এবং কত ব্যাপক পরিসরে ঘটতে যাচ্ছে? কিন্তু আজ মানুষ জানে ৯/১১ গত দুই দশকে আফগানিস্তান তো বটেই বিশ্বের বহু দেশের ইতিহাসের গতিপথই বদলে দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুক্তরাষ্ট্র সে ঘোষিত যুদ্ধই সন্ত্রাসকে পরিণত করেছে এক ভয়াবহ রপ্তানি পণ্যে, যার আছে নিজস্ব মুনাফার সমীকরণও।
সেদিনের সেই ২,৯৯৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর জবাব শুধু নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই পায়নি কিংবা একটি প্রজন্মের মধ্য দিয়েও এই গল্পের যবনিকা পড়েনি। বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর মূল্য চুকিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে? ব্রাউন ইউনিভার্সিটি কস্টস অব ওয়ার প্রোজেক্ট নামের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, শুধু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৩ লাখ ৬৩ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। একই সঙ্গে এই উল্লেখও করা হয়েছে যে, এই সংখ্যা শুধু সরাসরি গুলিতে নিহতদের। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট নানা কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ধরলে তা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে বহু আগেই।
একটু খোলাসা করা যাক। আজ যে আফগানরা দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন, তাঁরা তালেবান নিয়ে ভীত। তাঁরা যে জীবনের স্বপ্ন দেখেন, সেই জীবনের পথে তাঁরা তালেবানকে বাধা মনে করেন। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। যে কারও নিজের স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া করার অধিকার আছে। তালেবান যদি সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার আওতার বাইরে চলে যাওয়া, বা তাকে রুখে দাঁড়ানো—যেকোনো একটি করাই উচিত। কিন্তু যখন এই তালেবান থেকে বাঁচতে তাঁরা এমন এক জায়গায় আশ্রয় খোঁজেন, যে কিনা আরও বেশি মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ, তবে প্রশ্ন উঠবেই।
গত ২৯ আগস্ট কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের বাইরে হওয়া আইএস হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আইএস ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায়। সাফল্য নিয়ে বেশ গদগদ বক্তব্যও দেয়। কিন্তু সে হামলায় যে বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল, তা বেমালুম চেপে যায়। শুধু বেসামরিক নয় নিহত ১০ জনের মধ্যে সাতজনই ছিল নিরীহ নারী ও শিশু। অর্থাৎ, একটি সামরিক হামলার দায় চোকাতে প্রাণ দিতে হলো বেসামরিক সাধারণ মানুষকে। এই ঘটনাই ঘটেছে গত দুই দশকে হরদম। ইরাকের আবু গারিব কারাগারের বীভৎস নির্যাতনের কথা তো কেউ ভোলেনি। রাসায়নিক অস্ত্রের দোহাই দিয়ে দেশটিতে চালানো মার্কিন হামলায় কত অজস্র বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
এই যে নিরীহ মানুষকে সামরিক হামলায় হত্যা করা, এটিই দেশে দেশে বুনে দিয়েছে নয়া সন্ত্রাসের বীজ। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়া—যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, এই একই বাস্তবতা দেখা যাবে। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের’ কথা বলে, ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে কোনো একটি গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে উদ্ধারকর্তা হিসেবে প্রবেশ করেছে। গণতন্ত্রসহ নানা চটকদার ধারণা সেখানে রপ্তানি করতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষ তার সেই ব্যবস্থাপত্রকে সন্দেহ করেছে, যখন সে দেখেছে এই একই শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে সামরিক শাসন, কট্টরবাদ ইত্যাদিকে নিজেই পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্ধারকর্তা তো নয়ই, দখলদার হিসেবে দেখেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র প্রযোজিত সব যুদ্ধ ও (উদ্ধার) অভিযানকে দেখেছে আগ্রাসন হিসেবে। ফলে পুরো পশ্চিমা বিশ্বকেই তারা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর সেই সূত্রে আধুনিক সময়ের বিজ্ঞান ও জ্ঞানকাঠামোকে তারা শত্রু জ্ঞান করেছে। তাদের এই অবস্থানের কারণে আজ কোটি কোটি মানুষ ভুক্তভোগী।
গেল দুই দশকের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ আদতে গোটা বিশ্বে এক ভয়াবহ রপ্তানি পণ্য হিসেবে সন্ত্রাসকে হাজির করেছে। এ থেকে বাদ যায়নি পশ্চিমা দেশও। একের পর এক আত্মঘাতী হামলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের হামলার সাক্ষী হতে হয়েছে তাকে। বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে গোটা বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজারের বেশি। তার আগের বছর ছিল ৩২ হাজার। এই নিহতের দল কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে আর সীমাবদ্ধ নেই। সুদূর নাইজেরিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এই মৃতেরা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও বাদ যায়নি।
এই দুই দশকে সন্ত্রাস নির্মূল নয়, বরং ভবঘুরে হয়েছে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে তারা গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এই গোষ্ঠীগুলো ৯/১১ মাপের বড় কোনো হামলা করতে পারেনি। কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত লক্ষ্যকে অসার প্রমাণ করে চলেছে। যে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ দিয়ে এই বিস্তৃত যুদ্ধের শুরুর বিন্দুকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেই আল-কায়েদাও এমনকি নির্মূল হয়নি। বিশ্বের ১৭টি দেশে এই গোষ্ঠী নামে-বেনামে আজ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। জন্ম নিয়েছে ইসলামিক স্টেট। মানুষ জেনেছে আল-শাবাব, বোকো হারামসহ অজস্র গোষ্ঠীর নাম ও তাদের বিধ্বংসী কাজ সম্পর্কে। আর আঞ্চলিক ও বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট গোষ্ঠীর নাম নিতে গেলে শুধু তালিকাই দীর্ঘ হবে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জর্জ বুশের ঘোষণা করা সর্বাত্মক যুদ্ধ সারা বিশ্বকেই সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয়, শুধু যুক্তরাষ্ট্র প্রযোজিত বলেই দুই দশক ব্যপ্তির এই যুদ্ধের কারণে প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশে দেশে উদারবাদী রাজনীতিকেরা কোণঠাসা হয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রীয় চর্চা অনেকাংশেই কট্টরবাদের দিকে ছুটেছে। আজ গোটা বিশ্বে কট্টরবাদ, নয়া-রক্ষণশীলতা ও লোকরঞ্জনবাদের যে দাপট, তার মূলটি আদতে ওই ৯/১১ ও তার পরের দুই দশকের যুদ্ধের মধ্যেই রয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে যে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও ট্রাম্প সমর্থকদের যে হামলা হলো, তার মূলটিও এই দুই দশকের যুদ্ধ সমীকরণের সঙ্গেই যুক্ত। কারণ, এই যুদ্ধ ও তার প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়াই এর নেপথ্য শক্তি।
আরও পড়ুন:
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
২০ ঘণ্টা আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে