অনলাইন ডেস্ক
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশাল বিক্ষোভে কেঁপে ওঠে সুরিনামের রাজধানী প্যারামারিবো। দক্ষিণ আমেরিকার সাবেক এই ডাচ উপনিবেশটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেলেও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সরকারি দুর্নীতি, ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।
এটি সহজেই অনুমেয়, ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি চাপিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আইএমএফের এই মাগনা উপদেশ দীর্ঘকাল ধরেই পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর দুর্দশা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার নিদান হিসেবে বিশেষায়িত হয়ে আছে।
আইএমএফের ঋণ ও ঋণ পুনর্গঠন কর্মসূচি সুরিনামের প্রেসিডেন্ট চ্যান সান্তোখির অনেক সন্দেহজনক অর্জনের মধ্যে একটি। ২০২০ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর স্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি স্ট্যাটসোলির তত্ত্বাবধায়ক বোর্ডসহ বিভিন্ন লাভজনক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রতাবিরোধী বিক্ষোভের দুই মাস পর গত এপ্রিলে রাজধানী পারমারিবোতে যখন পৌঁছাই, তখন সুরিনামের একজন অধিকারকর্মী, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ আহিলিয়া ওয়েলেসের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন এবং পুলিশের অ্যাকশনে নিজেও পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, তাঁর পাশের লোকটিই টিয়ার শেল হাতে নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়ে মেরেছিল। সেদিনই তিনি বুঝেছিলেন সুরিনামের মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ।
সেই সব দিনের ঘটনাগুলো বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনের মাঠে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও বোতল নিক্ষেপ করে। এরপর শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন।
ওই ঘটনায় পারামারিবোর মার্কিন দূতাবাস একটি বিবৃতি দিয়েছিল। তারা বিবৃতিতে প্রকারান্তরে প্রতিবাদকারীদেরই ভর্ৎসনা করেছে। ‘সুরিনামের জাতীয় পরিষদ ভবনে হামলা এবং সংশ্লিষ্ট সহিংসতাকে গণতন্ত্রের ওপর অগ্রহণযোগ্য আক্রমণ’ বলে নিন্দা করে মার্কিন দূতাবাস। বিবৃতির ভাষা ছিল এমন—সুরিনাম এমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রয়েছে যেখানে প্রেসিডেন্টের প্রতি ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য দেওয়া এবং সরকারের সমালোচনা করা বড় ধরনের অপরাধ।
বৈশ্বিক শক্তিগুলো জনগণের এই অসন্তোষ ও ক্ষোভকে এমনভাবে চিত্রায়িত করে যে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, অন্যায় অবিচারমূলক অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে মানুষের জীবন ধ্বংস করার চেয়েও ‘সহিংস’ আচরণ।
ওয়েলেস আমাকে বলেছিলেন, উত্তর সুরিনামের একটি জেলায় তিনি শিক্ষকতার চাকরি করেন। তাঁর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। কারণ পরিবারের জন্য খাবার জোটাতে তারা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্য শিক্ষার্থীদের অনেকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুলে আসছে। নিজের সামর্থ্য থাকা অবধি তিনি সেই শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে খাবার আনতেন।
প্রেসিডেন্ট সান্তোখির আরেকটি উদ্যোগ হলো শিক্ষকদের বেতন কমানো। এটি এমন একটি নীতি, যা আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবসম্মত নয়। উদারবাদী ঐকমত্যের যেন একটি অংশ যে, একটি জাতির তরুণ সমাজকে শিক্ষিত করা এবং ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করার জন্য যাঁরা কাজ করেন তাঁদেরও নিজের খাবার জোটানোর সামর্থ্যটুকু থাকতে নেই!
গত ২৭ এপ্রিল পারমারিবো শহরের ঔপনিবেশিক কেন্দ্রে শিক্ষকদের প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সেখানে তাঁদের ক্ষোভ খুব স্পষ্ট ছিল। তাঁরা অনেক কিছুই বলছিলেন। কিন্তু একটি শব্দই কানে বাজে—শিক্ষকদের একটি ইউনিয়নের আবেগপূর্ণ দাপ্তরিক বিবৃতিতে ‘আন্ডারওয়াটার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে, প্রবল বর্ষণ ও বন্যার কারণে দেশের বেশির ভাগ অংশই তখন তলিয়ে গেছে। স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক লোক বাড়িতে পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। সবাই তখন প্রশাসনের উদাসীনতার অভিযোগ করছিলেন।
ওই সময় বাইরে বের হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ঘরে বসে থাকারও উপায় নেই। কারণ আমি এসেছি একটি কাজ নিয়ে। রিকি নামে একজন বয়স্ক আফ্রো-সুরিনামি লোক আমাকে তাঁর জরাজীর্ণ গাড়িতে লিফট দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তাঁর এই উদারতায় সাড়া দিতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। রাস্তায় নামতেই গাড়ির দরজা দিয়ে হুড়হুড় করে পানি ঢুকতে লাগল। রিকি মরিয়া হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এরপর সরকার, আবহাওয়া ও আইএফমকে অভিশাপ বর্ষণ শুরু হলো। রিকির মতে, এরা চায় না দেশের মানুষের গ্যাস, রুটি বা প্রয়োজনীয় কিছু কেনার সামর্থ্য থাকুক!
বন্যার পানি কিছুটা নেমে গেলে রিকি ও আমি সুরিনামের উপনিবেশবিরোধী আইকন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিরোধ যোদ্ধা আন্তন ডি কমের জন্মস্থান পরিদর্শনে যাই। ১৯৩৪ সালে তাঁর রচনা ‘উই স্লেভস অব সুরিনাম’-এ ডি কম লিখেছেন কীভাবে সতেরো শতকের শুরুতে ঔপনিবেশিক সুরিনামে, ‘শ্বেতাঙ্গরা নির্বিবাদে সম্পদের পাহাড় গড়ত’, যখন ক্রীতদাসেরা ছিল ‘ব্যক্তিগত অস্থাবর সম্পদ’। সেটি ছিল এমন এক পরিস্থিতি, যেটি বর্ণনা করতে সুরিনামবাসী একটি প্রবাদ ব্যবহার করত: ‘পাখির ঠোঁটে বসে তেলাপোকা তো তার অধিকার জাহির করতে পারে না!’
ডি কমের সাবেক বাসভবন থেকে রাস্তাজুড়ে একটি নীল পটভূমিতে আইএমএফ ‘গ্যাং’য়ের নিন্দা জানিয়ে আঁকা হয়েছে সাদা গ্রাফিতি।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মার্কিন আধিপত্যবাদী বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় সুরিনাম প্রথম বা শেষ দেশ নয়। পুঁজিবাদ নিজেই একটি ক্রীতদাস বানানোর শক্তি। সুরিনামে একের পর এক ভয়াবহ বন্যা খুবই উপযুক্ত রূপক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কীভাবে একটি জাতি অভিজাতদের অত্যাচারে ডুবে যেতে পারে!
যখন দাসপ্রথা, ঔপনিবেশিকতা এবং সেই সমস্ত ন্যক্কারজনক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে অতীতের ব্যাপার বলে মনে করা হয়, তখন শুধু সুরিনামে নয়, বৈশ্বিক দক্ষিণের (বিশ্বের অনুন্নত অঞ্চল) অন্যান্য দেশেরও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে একটি অস্বস্তিকর সমান্তরাল মিল দেখা যায়।
২০১৭ সালে তিউনিসিয়াও আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে। এক বছরের মধ্যে তিউনিসীয়রা আইএমএফের নিদান মতে ‘অর্থনৈতিক সংস্কারের’ পরিণতি ভোগ করতে শুরু করে। একপর্যায়ে উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে কৃচ্ছ্রতাবিরোধী অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে। পতন ঘটে সরকারের।
এ নিয়ে তিউনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক করিনা মুলিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি দেখেছিলেন যে তিউনিসিয়া উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ে ‘ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বৈশিষ্ট্যযুক্ত অনেক কাঠামোগত ধারাবাহিকতা’ বহন করে চলেছে। অথচ এই ঔপনিবেশিকতার শেষ হয়েছিল সেই ১৯৫৬ সালে।
মুলিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিশিষ্ট (নব্য) ঔপনিবেশিক-পুঁজিবাদী শক্তিগুলো নিজেরাই যেখানে “নব্য উদারনৈতিক উন্নয়ন” নিয়ে ঠেলাঠেলির মধ্যে আছে, তাদের এই নীতিই তিউনিসিয়ার টুঁটি চেপে ধরেছিল। কিন্তু এটি তারা করেছিল “আন্তর্জাতিক সুবিধার জন্য এবং একটি স্থানীয় মূলধনের অংশ” হিসেবে।’
মেক্সিকোও বৈশ্বিক পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ার অভিজ্ঞতা ভালোই পেয়েছে। যেমন—১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে দেশটিতে আইএমএফ ও মার্কিন ঋণের শর্তগুলো মেক্সিকোর জনগণকে ভয়ানকভাবে ভুগিয়েছে। উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (নাফটা), যা তাত্ত্বিকভাবে কৃষি ভর্তুকির অনুমোদন দেয়, তা শুধু মেক্সিকোর ধনী এবং নাফটার ক্ষমতাধর অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়েছে।
বিশেষ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা নোংরা পক্ষপাতের পথ প্রশস্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ভর্তুকিতে উৎপাদিত খাদ্যশস্য মেক্সিকোর বাজারে একপ্রকার খালাস করার কারণে মেক্সিকোর লাখ লাখ কৃষকের জীবন তছনছ হয়ে গেছে। নাফটার দ্বৈতনীতির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এটিকে বলা যেতে পারে ‘কাঠামোগত সহিংসতা’।
‘মুক্তবাণিজ্য’ বা সাধারণভাবে স্বাধীনতার নামে বহুত হয়েছে! এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে সুরিনাম। বন্যার পানি নামছে, কিন্তু মানুষ ডুবে যাচ্ছে বঞ্চনার বানে।
আল জাজিরায় প্রকাশিত বেলেন ফার্নান্দেজের নিবন্ধ, অনুবাদ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশাল বিক্ষোভে কেঁপে ওঠে সুরিনামের রাজধানী প্যারামারিবো। দক্ষিণ আমেরিকার সাবেক এই ডাচ উপনিবেশটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেলেও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সরকারি দুর্নীতি, ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।
এটি সহজেই অনুমেয়, ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি চাপিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আইএমএফের এই মাগনা উপদেশ দীর্ঘকাল ধরেই পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর দুর্দশা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার নিদান হিসেবে বিশেষায়িত হয়ে আছে।
আইএমএফের ঋণ ও ঋণ পুনর্গঠন কর্মসূচি সুরিনামের প্রেসিডেন্ট চ্যান সান্তোখির অনেক সন্দেহজনক অর্জনের মধ্যে একটি। ২০২০ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর স্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি স্ট্যাটসোলির তত্ত্বাবধায়ক বোর্ডসহ বিভিন্ন লাভজনক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রতাবিরোধী বিক্ষোভের দুই মাস পর গত এপ্রিলে রাজধানী পারমারিবোতে যখন পৌঁছাই, তখন সুরিনামের একজন অধিকারকর্মী, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ আহিলিয়া ওয়েলেসের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন এবং পুলিশের অ্যাকশনে নিজেও পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, তাঁর পাশের লোকটিই টিয়ার শেল হাতে নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়ে মেরেছিল। সেদিনই তিনি বুঝেছিলেন সুরিনামের মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ।
সেই সব দিনের ঘটনাগুলো বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনের মাঠে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও বোতল নিক্ষেপ করে। এরপর শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন।
ওই ঘটনায় পারামারিবোর মার্কিন দূতাবাস একটি বিবৃতি দিয়েছিল। তারা বিবৃতিতে প্রকারান্তরে প্রতিবাদকারীদেরই ভর্ৎসনা করেছে। ‘সুরিনামের জাতীয় পরিষদ ভবনে হামলা এবং সংশ্লিষ্ট সহিংসতাকে গণতন্ত্রের ওপর অগ্রহণযোগ্য আক্রমণ’ বলে নিন্দা করে মার্কিন দূতাবাস। বিবৃতির ভাষা ছিল এমন—সুরিনাম এমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রয়েছে যেখানে প্রেসিডেন্টের প্রতি ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য দেওয়া এবং সরকারের সমালোচনা করা বড় ধরনের অপরাধ।
বৈশ্বিক শক্তিগুলো জনগণের এই অসন্তোষ ও ক্ষোভকে এমনভাবে চিত্রায়িত করে যে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, অন্যায় অবিচারমূলক অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে মানুষের জীবন ধ্বংস করার চেয়েও ‘সহিংস’ আচরণ।
ওয়েলেস আমাকে বলেছিলেন, উত্তর সুরিনামের একটি জেলায় তিনি শিক্ষকতার চাকরি করেন। তাঁর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। কারণ পরিবারের জন্য খাবার জোটাতে তারা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্য শিক্ষার্থীদের অনেকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুলে আসছে। নিজের সামর্থ্য থাকা অবধি তিনি সেই শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে খাবার আনতেন।
প্রেসিডেন্ট সান্তোখির আরেকটি উদ্যোগ হলো শিক্ষকদের বেতন কমানো। এটি এমন একটি নীতি, যা আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবসম্মত নয়। উদারবাদী ঐকমত্যের যেন একটি অংশ যে, একটি জাতির তরুণ সমাজকে শিক্ষিত করা এবং ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করার জন্য যাঁরা কাজ করেন তাঁদেরও নিজের খাবার জোটানোর সামর্থ্যটুকু থাকতে নেই!
গত ২৭ এপ্রিল পারমারিবো শহরের ঔপনিবেশিক কেন্দ্রে শিক্ষকদের প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সেখানে তাঁদের ক্ষোভ খুব স্পষ্ট ছিল। তাঁরা অনেক কিছুই বলছিলেন। কিন্তু একটি শব্দই কানে বাজে—শিক্ষকদের একটি ইউনিয়নের আবেগপূর্ণ দাপ্তরিক বিবৃতিতে ‘আন্ডারওয়াটার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে, প্রবল বর্ষণ ও বন্যার কারণে দেশের বেশির ভাগ অংশই তখন তলিয়ে গেছে। স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক লোক বাড়িতে পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। সবাই তখন প্রশাসনের উদাসীনতার অভিযোগ করছিলেন।
ওই সময় বাইরে বের হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ঘরে বসে থাকারও উপায় নেই। কারণ আমি এসেছি একটি কাজ নিয়ে। রিকি নামে একজন বয়স্ক আফ্রো-সুরিনামি লোক আমাকে তাঁর জরাজীর্ণ গাড়িতে লিফট দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তাঁর এই উদারতায় সাড়া দিতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। রাস্তায় নামতেই গাড়ির দরজা দিয়ে হুড়হুড় করে পানি ঢুকতে লাগল। রিকি মরিয়া হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এরপর সরকার, আবহাওয়া ও আইএফমকে অভিশাপ বর্ষণ শুরু হলো। রিকির মতে, এরা চায় না দেশের মানুষের গ্যাস, রুটি বা প্রয়োজনীয় কিছু কেনার সামর্থ্য থাকুক!
বন্যার পানি কিছুটা নেমে গেলে রিকি ও আমি সুরিনামের উপনিবেশবিরোধী আইকন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিরোধ যোদ্ধা আন্তন ডি কমের জন্মস্থান পরিদর্শনে যাই। ১৯৩৪ সালে তাঁর রচনা ‘উই স্লেভস অব সুরিনাম’-এ ডি কম লিখেছেন কীভাবে সতেরো শতকের শুরুতে ঔপনিবেশিক সুরিনামে, ‘শ্বেতাঙ্গরা নির্বিবাদে সম্পদের পাহাড় গড়ত’, যখন ক্রীতদাসেরা ছিল ‘ব্যক্তিগত অস্থাবর সম্পদ’। সেটি ছিল এমন এক পরিস্থিতি, যেটি বর্ণনা করতে সুরিনামবাসী একটি প্রবাদ ব্যবহার করত: ‘পাখির ঠোঁটে বসে তেলাপোকা তো তার অধিকার জাহির করতে পারে না!’
ডি কমের সাবেক বাসভবন থেকে রাস্তাজুড়ে একটি নীল পটভূমিতে আইএমএফ ‘গ্যাং’য়ের নিন্দা জানিয়ে আঁকা হয়েছে সাদা গ্রাফিতি।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মার্কিন আধিপত্যবাদী বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় সুরিনাম প্রথম বা শেষ দেশ নয়। পুঁজিবাদ নিজেই একটি ক্রীতদাস বানানোর শক্তি। সুরিনামে একের পর এক ভয়াবহ বন্যা খুবই উপযুক্ত রূপক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কীভাবে একটি জাতি অভিজাতদের অত্যাচারে ডুবে যেতে পারে!
যখন দাসপ্রথা, ঔপনিবেশিকতা এবং সেই সমস্ত ন্যক্কারজনক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে অতীতের ব্যাপার বলে মনে করা হয়, তখন শুধু সুরিনামে নয়, বৈশ্বিক দক্ষিণের (বিশ্বের অনুন্নত অঞ্চল) অন্যান্য দেশেরও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে একটি অস্বস্তিকর সমান্তরাল মিল দেখা যায়।
২০১৭ সালে তিউনিসিয়াও আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে। এক বছরের মধ্যে তিউনিসীয়রা আইএমএফের নিদান মতে ‘অর্থনৈতিক সংস্কারের’ পরিণতি ভোগ করতে শুরু করে। একপর্যায়ে উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে কৃচ্ছ্রতাবিরোধী অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে। পতন ঘটে সরকারের।
এ নিয়ে তিউনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক করিনা মুলিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি দেখেছিলেন যে তিউনিসিয়া উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ে ‘ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বৈশিষ্ট্যযুক্ত অনেক কাঠামোগত ধারাবাহিকতা’ বহন করে চলেছে। অথচ এই ঔপনিবেশিকতার শেষ হয়েছিল সেই ১৯৫৬ সালে।
মুলিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিশিষ্ট (নব্য) ঔপনিবেশিক-পুঁজিবাদী শক্তিগুলো নিজেরাই যেখানে “নব্য উদারনৈতিক উন্নয়ন” নিয়ে ঠেলাঠেলির মধ্যে আছে, তাদের এই নীতিই তিউনিসিয়ার টুঁটি চেপে ধরেছিল। কিন্তু এটি তারা করেছিল “আন্তর্জাতিক সুবিধার জন্য এবং একটি স্থানীয় মূলধনের অংশ” হিসেবে।’
মেক্সিকোও বৈশ্বিক পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ার অভিজ্ঞতা ভালোই পেয়েছে। যেমন—১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে দেশটিতে আইএমএফ ও মার্কিন ঋণের শর্তগুলো মেক্সিকোর জনগণকে ভয়ানকভাবে ভুগিয়েছে। উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (নাফটা), যা তাত্ত্বিকভাবে কৃষি ভর্তুকির অনুমোদন দেয়, তা শুধু মেক্সিকোর ধনী এবং নাফটার ক্ষমতাধর অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়েছে।
বিশেষ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা নোংরা পক্ষপাতের পথ প্রশস্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ভর্তুকিতে উৎপাদিত খাদ্যশস্য মেক্সিকোর বাজারে একপ্রকার খালাস করার কারণে মেক্সিকোর লাখ লাখ কৃষকের জীবন তছনছ হয়ে গেছে। নাফটার দ্বৈতনীতির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এটিকে বলা যেতে পারে ‘কাঠামোগত সহিংসতা’।
‘মুক্তবাণিজ্য’ বা সাধারণভাবে স্বাধীনতার নামে বহুত হয়েছে! এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে সুরিনাম। বন্যার পানি নামছে, কিন্তু মানুষ ডুবে যাচ্ছে বঞ্চনার বানে।
আল জাজিরায় প্রকাশিত বেলেন ফার্নান্দেজের নিবন্ধ, অনুবাদ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১৭ ঘণ্টা আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে