হুসাইন আহমদ
তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনে কয়েক দশকের মধ্যে এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আর হয়নি। দুই দশকের শাসনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ক্ষমতার ভিত পোক্ত হলেও ভয়াবহ ভূমিকম্প ও আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিসহ নানা কারণে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারগলুকেই এগিয়ে রেখেছিলেন বিশ্লেষকেরা। প্রাক-নির্বাচনী জরিপের ফলাফলও তাঁর বিপক্ষেই ছিল। কিন্তু ১৪ মের ভোটে সব জল্পনা-পূর্বাভাস মিথ্যা প্রমাণিত করেছেন এরদোয়ান। তিনি ভোট পেয়েছেন ৪৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ, আর কিলিচদারগলু পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ ভোট। কোনো প্রার্থী অর্ধেকের বেশি ভোট না পাওয়ায় দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ২৮ মে আবার ভোট হবে।
২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এরদোয়ান ক্রমেই ক্ষমতা পোক্ত করে ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হন। চার বছরের মাথায় এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পরিধি আরও বাড়ান তিনি। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে নিজে নির্বাহী প্রেসিডেন্ট বনে যান এরদোয়ান। নিজ সমর্থকদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের সহায়তায় বিশাল রাজপ্রাসাদে থেকে তিনি দেশ চালান। তাঁর চরম কর্তৃত্ববাদী শাসন নিয়ে সমালোচনাও বিস্তর।
এরদোয়ানের ক্যারিশমা যে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তা এই ভোটে স্পষ্ট। তাঁর দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টির নেতৃত্বে ইসলামভিত্তিক জোটের ভিত কি তাহলে আরও জোরদার হলো? কারণ, নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্ম ও গোষ্ঠী রাজনীতিকে হাতিয়ার করে বিরোধী জোটকে আক্রমণ করেছেন তিনি। যেখানে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারগলু নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং চরম কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘দ্বিধাবিভক্ত’ দেশকে ঐকবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু, তাতে কাজ হয়নি।
প্রথম পর্বের ভোটের ফলকে এরদোয়ানের জন্য ‘বড় সাফল্য’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। জনগণের ভোটে মূল্যস্ফীতিসহ বিপর্যস্ত অর্থনীতির কোনো প্রতিফলন যে ঘটেনি, তার কারণ বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ভোটে পরিস্থিতি পাল্টানো সুযোগ আছে কি না—তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।
বেইকজ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আহমেত হান বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এরদোয়ান ভোটারদের বোঝাতে পেরেছেন যে মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত অর্থনীতির চেয়ে তুর্কি আত্মপরিচয়, জাতীয় গৌরব ও নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভোটে তার প্রতিফলন মিলেছে।
তাঁর মতে, ভোটারদের মগজ ধোলাইয়ের কৌশল হিসেবে ‘সবচেয়ে বড়’ যুদ্ধজাহাজ কেনা, ইলেকট্রিক কার চালু ও রুশনির্মিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বিশাল বিশাল নতুন প্রকল্পের আলোচনা সামনে এনেছেন এরদোয়ান। পাশাপাশি আতঙ্কবাজিকেও হাতিয়ার করেছেন তিনি।
ভোটের প্রচারে বিভক্তির রাজনীতিকে কৌশল হিসেবে নেন এরদোয়ান ও তাঁর সমর্থকেরা। একের পর এক প্রচারণায় গিয়ে তিনি দাবি করেন, বিরোধীরা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) ও ২০১৬ সালের সহিংস অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী ধর্মীয় গোষ্ঠী গুলেন সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করছে। যদিও এসব দাবির পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ তিনি হাজির করতে পারেননি।
গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কের দক্ষিণে ভয়াবহ জোড়া ভূমিকম্পে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। মূলত এই কারণে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর দিকে ছিল বিষাদমাখা। বিরোধীরা ‘সন্ত্রাসী’দের সঙ্গে গাঁট বেঁধেছে এবং ‘বিচ্যুত’ এলজিবিটি গোষ্ঠীর সঙ্গে ‘অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ছে’ দাবি করে এরদোয়ান সেই পরিস্থিতিতে উসকে দেন। ‘রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা’ হচ্ছে বলে নির্বাচনের রাতে ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোলেইমান সইলু সেই আগুনে ঘি ঢালেন। অথচ, মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই বিরোধীদের সমাবেশে সরকার-সমর্থকদের হামলায় কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়। এসব কোনো কিছুই ভোটে এরদোয়ানের বিপক্ষে যায়নি; অর্থনীতির দুরবস্থাও না।
তুরস্কে জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপক বেড়ে যাওয়ার কারণে এরদোয়ান জনসমর্থন হারাবেন বলে মনে করা হয়েছিল। কারণ, তাঁর খাপছাড়া অর্থনৈতিক নীতির কারণেই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। তুরস্কে দীর্ঘ মেয়াদে সুদের হার কমিয়ে রাখার ফলে মূল্যস্ফীতি খুবই উচ্চ; খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। সরকারি হিসাবে, গত মাসে তুরস্কে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় একগুচ্ছ পণ্যের দাম ১০৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
পেঁয়াজের দাম এত বেড়েছিল যে এটা নির্বাচনী প্রচারণায় আলোচিত ইস্যু হয়ে যায়। এমনকি গত মাসে নির্বাচনী প্রচারণায় কিলিচদারগলু পেঁয়াজ নিয়ে একটি ভিডিও ছাড়েন। সেখানে তিনি বলেন, ‘এখন এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০ লিরা। এরদোয়ান টিকে থাকলে এটা ১০০ লিরা হবে।’
জবাবে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে এরদোয়ান বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ। মুষ্ঠাঘাত করে পেঁয়াজকে ভর্তা বানিয়ে কীভাবে খেতে হয়, তা আমরা জানি। এই দেশে পেঁয়াজ, আলু বা শসার দাম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তুরস্কে আমরা সব সমস্যার সমাধান করেছি আগেই।’
এরদোয়ানের ‘খাপছাড়া অর্থনৈতিক নীতির’ ফলে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারীকে তুরস্কের বাজার ছাড়তে হয়েছিল, তাঁরা বিরোধীদের জয়ের আশায় দিন গুনছিলেন। কিন্তু ভাবগতিক উল্টে যাওয়ায় এরই মধ্যে অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। প্রথম পর্বের ভোটে এরদোয়ানের শক্তিশালী অবস্থানের পর তুরস্কের মুদ্রা লিরার রেকর্ড দরপতন হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত এরদোয়ান থাকলে কী হবে, সেই উদ্বেগে বাজারে সতর্ক ঘণ্টাও বেজেছে। আন্তর্জাতিক ঋণমাণ সংস্থাগুলোর বলেছে, এরদোয়ান ক্ষমতায় বহাল থেকে যদি তাঁর ‘অটেকসই’ অর্থনৈতিক নীতিই চালু রাখেন, তাহলে নতুন করে লিরা বিক্রির হিড়িক পড়বে। অর্থাৎ তুরস্কের মুদ্রার ব্যাপক দরপতনের শঙ্কা আছে।
এই উদ্বেগের প্রতিফলনও দেখা গেছে এর মধ্যে। ভোটের অপ্রত্যাশিত ফলের পর ১৫ মে দিনের শুরুতে ডলারের বিপরীতে লিরা দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ দর হারায়। তুরস্কের প্রধান পুঁজিবাজার ৬ শতাংশ সূচক হারায়। এরদোয়ানের ফের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনায় তুরস্কের সম্পদের দাম কমেছে। ঋণখেলাপি ঠেকাতে দেশটির বিমা খরচ দুই দিনে লাফিয়ে বেড়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই ইনস্যুরেন্সের ব্যয় শুক্রবার ৫০৬ ভিত্তি পয়েন্ট থেকে বেড়ে মঙ্গলবার ৬৪৬ ভিত্তি পয়েন্টে উঠেছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, তুরস্ক বিশ্বের ১৯তম বৃহৎ অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে তুরস্ক ব্যাপক ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি ফাঁপা চাহিদা তৈরি করা হয়। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, লিরার দরপতন ঠেকাতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে এযাবৎ ১৭৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিনিয়োগকারীরা কিলিচদারগলুর ওপর বাজি ধরেছিলেন, তা উল্টে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রাক-নির্বাচনী জরিপে এগিয়ে থাকা কিলিচদারগলু জয়ী হলে এরদোয়ান আমলের ‘বৈরী নীতি’ পাল্টে দেবেন বলে তাঁদের বিশ্বাস ছিল। সে ‘আশার গুড়ে বালি’ হয়েছে বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এরদোয়ানের হারের সম্ভাবনাকে ক্ষীণই বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের লিয়াম পিচ বলছেন, ‘তুরস্কে বিরোধীদের জয় ও প্রচলিত অর্থনীতি নির্ধারণে ফিরে আসার সম্ভাবনা উবে গেছে। তার বদলে এমন বাস্তব ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে যে এরদোয়ানের জয় তুরস্কে সামষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে। এতে মারাত্মক তারল্য সংকটের ঝুঁকির পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংক খাত ও সার্বভৌম ঋণ পরিস্থিতি আরও বাজে হতে পারে।’
তবে প্রথম পর্বের ভোটের ফলাফল হতাশাজনক হলেও কিলিচদারগলু যে হাল ছাড়বেন না, তা স্পষ্ট। তবে দ্বিতীয় দফার ভোটে জিততে হলে পুরো বিরোধী জোটকে অর্থনীতির সামগ্রিক বিতর্কেই আবারও নজর দিতে হবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আহমেত। তিনি বলেন, ‘এটাই তাঁদের একমাত্র সুযোগ।’
এরদোয়ানের আরও পাঁচ বছরের শাসনের সম্ভাবনায় বাজারের ‘বিরূপ প্রতিক্রিয়া’ ভালোভাবে তুলে ধরতে পারলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।
তুরস্ক কোন পথে যাবে—রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির বাড়তে থাকা অন্তরঙ্গতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির গাড্ডায় পড়া অর্থনীতি, দুর্বল পুঁজিবাজার ও বিশ্বের সর্বনিম্ন সুদের হারের পরিণতি কী হবে, তা ২৮ মের ভোট নির্ধারণ করবে।
এরদোয়ান সংবিধান পরিবর্তন করে আদালত ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ নানা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে আঙুলের ইশারায় চালাচ্ছেন। সেই সংবিধানের সঙ্গে তাঁর ‘তোষণমূলক’ রাষ্ট্রব্যবস্থা এবার পরীক্ষার মুখে। দ্বিতীয় দফার ভোটে এরদোয়ান জিতলে চলমান ‘স্বৈরতন্ত্রের ব্র্যান্ড’ আরও মজবুত হবে। আর বিরোধী শিবিরের জয় হলে তা ‘গণতান্ত্রিক শাসন’ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে তুরস্কে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ তৈরি করতে পারে বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর পর্যবেক্ষণ।
তবে তুর্কিরা যে এখনই গণতন্ত্রের আশা ছেড়ে দেয়নি, তা ভোটের ফলে স্পষ্ট। কারণ, ১৪ নভেম্বর যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে ৮৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। যেকোনো বিবেচনায় ভোট পড়ার এই হার দারুণ। অতি উত্তেজনার মধ্যেও ভোটের দিনে কোনো সহিংস কোনো ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনে অনিয়মের গুরুতর অভিযোগও ছিল না।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স ও ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস
তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনে কয়েক দশকের মধ্যে এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আর হয়নি। দুই দশকের শাসনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ক্ষমতার ভিত পোক্ত হলেও ভয়াবহ ভূমিকম্প ও আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিসহ নানা কারণে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারগলুকেই এগিয়ে রেখেছিলেন বিশ্লেষকেরা। প্রাক-নির্বাচনী জরিপের ফলাফলও তাঁর বিপক্ষেই ছিল। কিন্তু ১৪ মের ভোটে সব জল্পনা-পূর্বাভাস মিথ্যা প্রমাণিত করেছেন এরদোয়ান। তিনি ভোট পেয়েছেন ৪৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ, আর কিলিচদারগলু পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ ভোট। কোনো প্রার্থী অর্ধেকের বেশি ভোট না পাওয়ায় দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ২৮ মে আবার ভোট হবে।
২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এরদোয়ান ক্রমেই ক্ষমতা পোক্ত করে ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হন। চার বছরের মাথায় এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পরিধি আরও বাড়ান তিনি। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে নিজে নির্বাহী প্রেসিডেন্ট বনে যান এরদোয়ান। নিজ সমর্থকদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের সহায়তায় বিশাল রাজপ্রাসাদে থেকে তিনি দেশ চালান। তাঁর চরম কর্তৃত্ববাদী শাসন নিয়ে সমালোচনাও বিস্তর।
এরদোয়ানের ক্যারিশমা যে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তা এই ভোটে স্পষ্ট। তাঁর দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টির নেতৃত্বে ইসলামভিত্তিক জোটের ভিত কি তাহলে আরও জোরদার হলো? কারণ, নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্ম ও গোষ্ঠী রাজনীতিকে হাতিয়ার করে বিরোধী জোটকে আক্রমণ করেছেন তিনি। যেখানে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারগলু নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং চরম কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘দ্বিধাবিভক্ত’ দেশকে ঐকবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু, তাতে কাজ হয়নি।
প্রথম পর্বের ভোটের ফলকে এরদোয়ানের জন্য ‘বড় সাফল্য’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। জনগণের ভোটে মূল্যস্ফীতিসহ বিপর্যস্ত অর্থনীতির কোনো প্রতিফলন যে ঘটেনি, তার কারণ বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ভোটে পরিস্থিতি পাল্টানো সুযোগ আছে কি না—তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।
বেইকজ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আহমেত হান বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এরদোয়ান ভোটারদের বোঝাতে পেরেছেন যে মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত অর্থনীতির চেয়ে তুর্কি আত্মপরিচয়, জাতীয় গৌরব ও নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভোটে তার প্রতিফলন মিলেছে।
তাঁর মতে, ভোটারদের মগজ ধোলাইয়ের কৌশল হিসেবে ‘সবচেয়ে বড়’ যুদ্ধজাহাজ কেনা, ইলেকট্রিক কার চালু ও রুশনির্মিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বিশাল বিশাল নতুন প্রকল্পের আলোচনা সামনে এনেছেন এরদোয়ান। পাশাপাশি আতঙ্কবাজিকেও হাতিয়ার করেছেন তিনি।
ভোটের প্রচারে বিভক্তির রাজনীতিকে কৌশল হিসেবে নেন এরদোয়ান ও তাঁর সমর্থকেরা। একের পর এক প্রচারণায় গিয়ে তিনি দাবি করেন, বিরোধীরা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) ও ২০১৬ সালের সহিংস অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী ধর্মীয় গোষ্ঠী গুলেন সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করছে। যদিও এসব দাবির পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ তিনি হাজির করতে পারেননি।
গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কের দক্ষিণে ভয়াবহ জোড়া ভূমিকম্পে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। মূলত এই কারণে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর দিকে ছিল বিষাদমাখা। বিরোধীরা ‘সন্ত্রাসী’দের সঙ্গে গাঁট বেঁধেছে এবং ‘বিচ্যুত’ এলজিবিটি গোষ্ঠীর সঙ্গে ‘অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ছে’ দাবি করে এরদোয়ান সেই পরিস্থিতিতে উসকে দেন। ‘রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা’ হচ্ছে বলে নির্বাচনের রাতে ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোলেইমান সইলু সেই আগুনে ঘি ঢালেন। অথচ, মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই বিরোধীদের সমাবেশে সরকার-সমর্থকদের হামলায় কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়। এসব কোনো কিছুই ভোটে এরদোয়ানের বিপক্ষে যায়নি; অর্থনীতির দুরবস্থাও না।
তুরস্কে জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপক বেড়ে যাওয়ার কারণে এরদোয়ান জনসমর্থন হারাবেন বলে মনে করা হয়েছিল। কারণ, তাঁর খাপছাড়া অর্থনৈতিক নীতির কারণেই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। তুরস্কে দীর্ঘ মেয়াদে সুদের হার কমিয়ে রাখার ফলে মূল্যস্ফীতি খুবই উচ্চ; খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। সরকারি হিসাবে, গত মাসে তুরস্কে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় একগুচ্ছ পণ্যের দাম ১০৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
পেঁয়াজের দাম এত বেড়েছিল যে এটা নির্বাচনী প্রচারণায় আলোচিত ইস্যু হয়ে যায়। এমনকি গত মাসে নির্বাচনী প্রচারণায় কিলিচদারগলু পেঁয়াজ নিয়ে একটি ভিডিও ছাড়েন। সেখানে তিনি বলেন, ‘এখন এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০ লিরা। এরদোয়ান টিকে থাকলে এটা ১০০ লিরা হবে।’
জবাবে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে এরদোয়ান বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ। মুষ্ঠাঘাত করে পেঁয়াজকে ভর্তা বানিয়ে কীভাবে খেতে হয়, তা আমরা জানি। এই দেশে পেঁয়াজ, আলু বা শসার দাম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তুরস্কে আমরা সব সমস্যার সমাধান করেছি আগেই।’
এরদোয়ানের ‘খাপছাড়া অর্থনৈতিক নীতির’ ফলে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারীকে তুরস্কের বাজার ছাড়তে হয়েছিল, তাঁরা বিরোধীদের জয়ের আশায় দিন গুনছিলেন। কিন্তু ভাবগতিক উল্টে যাওয়ায় এরই মধ্যে অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। প্রথম পর্বের ভোটে এরদোয়ানের শক্তিশালী অবস্থানের পর তুরস্কের মুদ্রা লিরার রেকর্ড দরপতন হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত এরদোয়ান থাকলে কী হবে, সেই উদ্বেগে বাজারে সতর্ক ঘণ্টাও বেজেছে। আন্তর্জাতিক ঋণমাণ সংস্থাগুলোর বলেছে, এরদোয়ান ক্ষমতায় বহাল থেকে যদি তাঁর ‘অটেকসই’ অর্থনৈতিক নীতিই চালু রাখেন, তাহলে নতুন করে লিরা বিক্রির হিড়িক পড়বে। অর্থাৎ তুরস্কের মুদ্রার ব্যাপক দরপতনের শঙ্কা আছে।
এই উদ্বেগের প্রতিফলনও দেখা গেছে এর মধ্যে। ভোটের অপ্রত্যাশিত ফলের পর ১৫ মে দিনের শুরুতে ডলারের বিপরীতে লিরা দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ দর হারায়। তুরস্কের প্রধান পুঁজিবাজার ৬ শতাংশ সূচক হারায়। এরদোয়ানের ফের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনায় তুরস্কের সম্পদের দাম কমেছে। ঋণখেলাপি ঠেকাতে দেশটির বিমা খরচ দুই দিনে লাফিয়ে বেড়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই ইনস্যুরেন্সের ব্যয় শুক্রবার ৫০৬ ভিত্তি পয়েন্ট থেকে বেড়ে মঙ্গলবার ৬৪৬ ভিত্তি পয়েন্টে উঠেছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, তুরস্ক বিশ্বের ১৯তম বৃহৎ অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে তুরস্ক ব্যাপক ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি ফাঁপা চাহিদা তৈরি করা হয়। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, লিরার দরপতন ঠেকাতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে এযাবৎ ১৭৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিনিয়োগকারীরা কিলিচদারগলুর ওপর বাজি ধরেছিলেন, তা উল্টে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রাক-নির্বাচনী জরিপে এগিয়ে থাকা কিলিচদারগলু জয়ী হলে এরদোয়ান আমলের ‘বৈরী নীতি’ পাল্টে দেবেন বলে তাঁদের বিশ্বাস ছিল। সে ‘আশার গুড়ে বালি’ হয়েছে বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এরদোয়ানের হারের সম্ভাবনাকে ক্ষীণই বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের লিয়াম পিচ বলছেন, ‘তুরস্কে বিরোধীদের জয় ও প্রচলিত অর্থনীতি নির্ধারণে ফিরে আসার সম্ভাবনা উবে গেছে। তার বদলে এমন বাস্তব ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে যে এরদোয়ানের জয় তুরস্কে সামষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে। এতে মারাত্মক তারল্য সংকটের ঝুঁকির পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংক খাত ও সার্বভৌম ঋণ পরিস্থিতি আরও বাজে হতে পারে।’
তবে প্রথম পর্বের ভোটের ফলাফল হতাশাজনক হলেও কিলিচদারগলু যে হাল ছাড়বেন না, তা স্পষ্ট। তবে দ্বিতীয় দফার ভোটে জিততে হলে পুরো বিরোধী জোটকে অর্থনীতির সামগ্রিক বিতর্কেই আবারও নজর দিতে হবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আহমেত। তিনি বলেন, ‘এটাই তাঁদের একমাত্র সুযোগ।’
এরদোয়ানের আরও পাঁচ বছরের শাসনের সম্ভাবনায় বাজারের ‘বিরূপ প্রতিক্রিয়া’ ভালোভাবে তুলে ধরতে পারলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।
তুরস্ক কোন পথে যাবে—রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির বাড়তে থাকা অন্তরঙ্গতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির গাড্ডায় পড়া অর্থনীতি, দুর্বল পুঁজিবাজার ও বিশ্বের সর্বনিম্ন সুদের হারের পরিণতি কী হবে, তা ২৮ মের ভোট নির্ধারণ করবে।
এরদোয়ান সংবিধান পরিবর্তন করে আদালত ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ নানা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে আঙুলের ইশারায় চালাচ্ছেন। সেই সংবিধানের সঙ্গে তাঁর ‘তোষণমূলক’ রাষ্ট্রব্যবস্থা এবার পরীক্ষার মুখে। দ্বিতীয় দফার ভোটে এরদোয়ান জিতলে চলমান ‘স্বৈরতন্ত্রের ব্র্যান্ড’ আরও মজবুত হবে। আর বিরোধী শিবিরের জয় হলে তা ‘গণতান্ত্রিক শাসন’ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে তুরস্কে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ তৈরি করতে পারে বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর পর্যবেক্ষণ।
তবে তুর্কিরা যে এখনই গণতন্ত্রের আশা ছেড়ে দেয়নি, তা ভোটের ফলে স্পষ্ট। কারণ, ১৪ নভেম্বর যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে ৮৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। যেকোনো বিবেচনায় ভোট পড়ার এই হার দারুণ। অতি উত্তেজনার মধ্যেও ভোটের দিনে কোনো সহিংস কোনো ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনে অনিয়মের গুরুতর অভিযোগও ছিল না।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স ও ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১৯ ঘণ্টা আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে