ফজলুল কবির
শত বছর আগে চাণক্য বলে গেছেন, ‘অহংকারের মতো শত্রু আর হয় না।’ অবশ্য চাণক্য এ কথা বিশেষভাবে বলে না গেলেও হতো। এ সত্য তো সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই জানে। ব্যক্তি দিয়ে যেহেতু সমাজ-দেশ ইত্যাদি তৈরি হয়, সেহেতু দেশ বা রাষ্ট্রেরও তো এ কথা জানা থাকার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের কি জানা ছিল না? প্রশ্নটি উঠছে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের অবস্থা বিবেচনা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বৈশ্বিক পরাশক্তি সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ। যুদ্ধে সে সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে আমেরিকা তো বটেই, ইউরোপেরও নেতা হিসেবে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র। এই নেতৃত্ব গোটা বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, যেখানে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই দ্বিমেরু বিশ্ব কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে হাজির হয় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, যাদের শক্তির ভরকেন্দ্র হয়ে এখনো আছে ওয়াশিংটন।
এই হয়ে ওঠা কিন্তু ‘হঠাৎ পাওয়া’ কিছু ছিল না। বলা যায়, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ীই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমোড়লের আসনটিতে বসেছিল। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক রেডিও বার্তায় বলেন, ‘গণতন্ত্রের মহত্তম অস্ত্রে পরিণত হতে হবে আমেরিকাকে’। নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ তো বটেই, নিজেকে রক্ষার জন্যও যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি এই অস্ত্রে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। এর এক বছর পর যখন পার্ল হারবারে হামলা চালাল জাপান, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলো যুদ্ধকালীন উৎপাদনে সম্পূর্ণ নিয়োজিত হয়। আর এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল ডেট্রয়েটের গাড়ি উৎপাদনকারী কারখানাগুলো।
একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। হিস্ট্রি ডটকম ও ন্যাশনালডব্লিউডব্লিউ ২ মিউজিয়াম ডটওআরজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, পার্ল হারবার আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাঁকবদল করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে যায়। তাদের প্রতিটি কারখানা তো বটেই, প্রতিটি কর্মকাণ্ডই তখন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় বেকারত্ব, সামরিক-বেসামরিক মানুষের জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু। সেসব অন্য আলোচনার বিষয়। এখানে শুধু অস্ত্র নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ডেট্রয়েটের গাড়ি তৈরি কারখানাগুলো সে সময় রাতারাতি পরিণত হয় অস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানায়। ডেট্রয়েটের ওল্ডসমোবাইলে শুরু হয় কামানের উৎপাদন, ক্যাডিলাকে ট্যাংক, ক্রিসলারে মেশিন-গান উৎপাদন। আর বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানি শুরু করে বি-২৪ বোম্বার তৈরি।
আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপটে মার্কিন সরকার ও কারখানাগুলো কি একই বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছে? সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের সক্ষমতা কি চাহিদা বিবেচনায় বেড়েছে বলা যাবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মিত্রদের সহায় হওয়ার একক ক্ষমতা কি যুক্তরাষ্ট্রের আছে, নাকি কোথাও কিছু ক্ষয় হয়েছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্রে এখন কী চলছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আট দশক পর আজকের এই সময়ে রুজভেল্টের সেই চেয়ারে বসে আছেন জো বাইডেন। না পার্ল হারবার এখনো হয়নি, তেমনটা কেউ চায়ও না। কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা ভালো, শুরু থেকেই যুদ্ধের গোড়াটি আগলে বসে আছে যুক্তরাষ্ট্র। না প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষে। হোয়াইট হাউসের ভাষায়, ‘রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে যেকোনো মূল্যে জয়ী দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।’ এই যেকোনো মূল্যটা কী?
একটু পেছনে ফেরা যাক, যুদ্ধের এক সপ্তাহের ভেতরেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আলোচনায় বসার জন্য জেরবার হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেনও সে কথা। কিন্তু বাকি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে সে আলোচনা আর হয়নি, যুদ্ধও থামেনি। দুই মাস পেরিয়ে গেছে। ক্ষয় ও মৃত্যু দেখছে বিশ্ব। কিন্তু জেলেনস্কিকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র অনড়, অনড় রাশিয়াও। এ তাদের দুই দেশের মর্যাদা ও টিকে থাকার লড়াই। রাশিয়া যেমন খোলাখুলি বলছে, যুদ্ধের এই পর্যায় থেকে পিছু হটলে রাশিয়া নামে কিছু আর থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র তেমন খোলাখুলি না বললেও, ঘটনা একই। না, যুদ্ধ কোনো একটি দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে না। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা হবে না নিশ্চিত। কিন্তু পরাশক্তির কাতার থেকে তাদের নাম খসে যেতে পারে পরাজয় বা পিছু হটার সূত্র ধরে। ইউক্রেনের সে ভয় না থাকলেও এ যুদ্ধের ময়দান সে-ই।
এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া। যেকোনোভাবে তারা এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাশিয়া নতি স্বীকার করে। আর রাশিয়া তার যুদ্ধের কারণগুলোর মীমাংসা চায়। যুদ্ধের ময়দানে সে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র তার দাবিগুলো মেনে না নিচ্ছে। দুটি পক্ষই অনড় অবস্থানে দাঁড়িয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২৮ এপ্রিল দেশটির কংগ্রেসের কাছে ইউক্রেন সংকট সামাল দিতে আরও ৩৩ বিলিয়ন (৩ হাজার ৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার চেয়েছেন। বলে রাখা ভালো, চলতি বছরই এই সংকটের প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস ১৩ বিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন দিয়েছিল। এর বাইরে বাড়তি এই টাকা চাওয়া হয়েছে। কোন পথে ব্যয় হবে এই অর্থ, সে হিসাবও দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তারা বলছে, এই তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি ডলার ইউক্রেন ও ইউরোপে মার্কিন মিত্রদের সামরিক সহায়তা খাতে ব্যয় হবে। বাইডেন বলেছেন, ‘এ যুদ্ধ ব্যয়বহুল; কিন্তু এই আগ্রাসনের কাছে নতি স্বীকার আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।’
বাইডেনের এই বক্তব্য কি পার্ল হারবার ঘটনার আগে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায় না? ১৯৪০ সালে বসে যখন রুজভেল্ট সে বক্তব্য দেন, তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আক্রান্ত বা আক্রমণকারীর ভূমিকায় নেই। এবারও নেই। দুবারই যুক্তরাষ্ট্র ঘটনার আগে থেকেই মিত্রদের প্রতি সামরিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ সামনে আসে। আট দশক আগের যুক্তরাষ্ট্রে তা সম্ভব হয়েছিল। এখনকার যুক্তরাষ্ট্র কি একইভাবে সাড়া দিতে পারবে?
এবারের চ্যালেঞ্জটা আরেকটু বড়। এবার যুদ্ধ ময়দান ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম পাঠালেই শুধু চলবে না, সঙ্গে নিজেদের ও ইউরোপের মিত্রদেরও একইভাবে পুনঃসামরিকীকরণ করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলোর সামরিকীকরণের ধরন আর আগের মতো নেই। ফলে পুরো বিষয়টি এখন মার্কিননির্ভর হয়ে আছে। অস্ত্রাগারের মজুত বৃদ্ধির লক্ষ্যে পূর্ণ শক্তি নিয়ে এগোলে আবার রয়েছে অন্য শঙ্কা। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরাসরি পরাশক্তির লড়াইয়ের সংকেত দেবে। যুক্তরাষ্ট্র কি শেষ পর্যন্ত এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে ইউক্রেন সংকটের শুরুর দিনগুলোর দিকে। সে সময় জো বাইডেন বলেছিলেন, তিনি কখনোই সেখানে সেনা পাঠানোর কথা ভাবতে পারেন না। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে আসবে বিশ্বের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি রাশিয়া।
তাহলে কি রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ চায় না যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর—হ্যাঁ এবং না। এই যুদ্ধ চলুক— যুক্তরাষ্ট্র এটা চায়, তা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ক্ষেত্রে তার দ্বিধা রয়েছে। এ কারণেই মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এবং অনেক তরুণ যুদ্ধে যোগ দিতে ইউক্রেন এলেও নিয়মিত বাহিনীর কেউ সেখানে জড়ায়নি। আবার রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, ইউক্রেনকে সহায়তা করে যুদ্ধকে নিজের পছন্দমতো একটি পরিণতির দিকে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, নিজের অস্ত্রীকরণ নিয়েই এখন চিন্তিত ‘গণতন্ত্রের মহত্তম অস্ত্র’ দেশটি।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড বাজেটারি অ্যাসেসমেন্টসের গবেষক থমাস মানকিন ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ‘ইউক্রেনীয়দের বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে পারাটা আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা কে দেবে? কেউ না।’
হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিকে তারা ৫ হাজার ৫০০ জ্যাভেলিন ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র হয় দিয়েছে, নয়তো দেশটির কাছে বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয় এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে জ্যাভেলিন ছাড়াও অন্য ধরনের আরও ১৪ হাজার অ্যান্টি-আর্মার সিস্টেম, একজন সেনার বহনক্ষম ১৪০০ স্টিঙ্গার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র, ৭০০ সুইচব্লেড (ব্যাকপ্যাকে বহনক্ষম একধরনের বোমা, যা ছোড়ার পর নির্দিষ্ট টার্গেটে গিয়ে উড়োজাহাজের মতো ক্র্যাশ করে এবং ভেতরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়), ৯০টি ছোট নলের কামান, ১৫৫ মিলিমিটার ব্যাসের ১ লাখ ৮৩ হাজার কামানের গোলা, ১৬টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, ১৪টি কাউন্টার-আর্টিলারি, চারটি কাউন্টার-মর্টার ও দুটি এয়ার সার্ভেইল্যান্স রাডারসহ আরও অনেক কিছু পাঠিয়েছে।
এই যুদ্ধ যে সমীকরণের প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাতে শুধু ইউক্রেনে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোই আর যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে চালকের আসনে বসতে হলে তার সব মিত্রকেই নিরাপদ রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সে চেষ্টা করছেও। তবে এই চেষ্টা তার করতে হচ্ছে, ট্রাম্প জমানায় আহত ন্যাটো ও ইউরোপকে সঙ্গে নিয়ে। যে কারণে জার্মানিতে যখন দেশটি ৪০টি দেশের বৈঠক ডাকে, তখন তাকে অনেক কিছুই বিবেচনায় নিতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মুখোমুখি বসার সময় তাকে আফগান যুদ্ধ, আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় হওয়া যুদ্ধ, চীন, ভারত-চীন দ্বৈরথ ইত্যাদি অনেক কিছুকেই বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এই সবগুলো অঞ্চলকে নিজের আয়ত্তে রেখে দরকারি পক্ষগুলোর সশস্ত্রীকরণ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের পয়সাতেই করতে হচ্ছে। কারণ, এটি এখন তার ‘মর্যাদার’ আবরণে ‘পরাশক্তি’ পরিচয় টিকিয়ে রাখার লড়াই।
এখন পর্যন্ত এসব অস্ত্র দেশটি তার মজুত থেকেই দিতে পারছে। কিন্তু সামনের চাহিদা পূরণ করতে হলে আট দশক আগের মতো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে হবে। কিন্তু মার্কিন কারখানাগুলো খুব দ্রুতই এমন উৎপাদনে যেতে পারবে না বলে মত দিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটি জ্যাভেলিন আছে, তা জানা নেই। ১৯৯৬ সালে এটি বাজারে আসার পর দেশটির সরকার ৩৪ হাজার ৫০০ জ্যাভেলিন কিনেছে বলে ধারণা করা যায়। এর মধ্যে পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণের কাজে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার জ্যাভেলিন ব্যবহার হয়েছে। এই হিসাব ঠিক ধরলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ২০২১ সাল নাগাদ ১৭ থেকে ২২ হাজার জ্যাভেলিন ছিল। ইউক্রেন সংকটে এই মজুতের এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি বের হয়ে গেল। রইল আর কত? তবে ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এই হিসাবে মার্কিন মেরিনের কেনা ২৪০০ জ্যাভেলিনকে যেমন ধরা হয়নি, তেমনি ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত ৫০০০ জ্যাভেলিনকেও ধরা হয়নি।
সে যাই হোক, জ্যাভেলিন বিবেচনায় নিলেও যুদ্ধ বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ও মিত্রদের অস্ত্রাগার ভরতে রীতিমতো লড়তে হবে। এ কথা যুক্তরাষ্ট্র জানে বলে ৩ মে আলাবামার ট্রয়ে অস্ত্র কারখানা পরিদর্শনে গেছেন স্বয়ং দেশটির প্রেসিডেন্ট। ওই কারখানায় বছরে ২১০০টি জ্যাভেলিন উৎপাদন হয়। ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতেই এই কারখানার তিন-চার বছর লাগবে। আর মিত্রদের নিরাপত্তা বেশি গুরুত্ব পেলে এ সময় আরও বেশি লাগবে। এই কারখানার সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা বছরে সাড়ে ৬ হাজার। কিন্তু এই সর্বোচ্চ সীমায় যেতে হলে এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে লাগবে কাঁচামালের সরবরাহ। কিন্তু এই সরবরাহেই রয়েছে সংকট। একই অবস্থা স্টিঙ্গার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। ১৯৮১ সালে বাজারে আসা এই অস্ত্রের শেষ চালান যুক্তরাষ্ট্র কিনেছিল ২০০৩ সালে। গত বছর এর মার্কিন উৎপাদন বন্ধ হলেও চলতি বছর তা আবার চালু করা হয়। মুশকিল হলো এই অস্ত্র তৈরির কিছু উপকরণ এখন বাজারে পাওয়া কঠিন।
ন্যাটোভুক্ত অন্য দেশগুলোও কিছু কিছু দিকে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু সবার তো উৎপাদন সক্ষমতা নেই। জার্মানির থাকলেও তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় নানা বিধিনিষেধে রুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে সে সক্ষমতা আবার অর্জন করতে চায় জার্মানি। এরই মধ্যে ট্যাংক পাঠানোর কথা জানিয়ে জার্মানি বলেছে, তারা এর চেয়ে বেশি সহায়তা করতে চাইলে কারখানাগুলো চালু করতে হবে।
আকাশ-যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো একটু পিছিয়েই আছে। আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এ ধরনের অস্ত্রগুলোই চাওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি বড় সহায় হতে পারে। ফ্রান্সেরও সে সক্ষমতা আছে। কিন্তু পুরোনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে ফের নিজ পায়ে দাঁড়াতে সম্মতি ও সহায়তা দেওয়ার ঝুঁকি কি যুক্তরাষ্ট্র নেবে? তার অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। আবার আকাশ-যুদ্ধে পশ্চিমের দুর্বলতা লুকানো কিছু নয়। ২০১১ সালে লিবিয়া এবং সিরিয়া যুদ্ধে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার যুক্ত হওয়ার পর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাও প্রকাশ্য হয়েছিল। ফলে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কীভাবে এগোবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে নিজের ও মিত্রদের অস্ত্রীকরণ সক্ষমতা এক বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের। এক-মেরু বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়াত্ব তাকে এদিকে অনেক দিন তাকাতে দেয়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তার দক্ষতা ও সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জোট ন্যাশনাল ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের (এনডিআইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্প ক্ষয়ের পথে। সবচেয়ে বড় সংকট হলো দক্ষ কর্মীর অভাব। রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদানের সরবরাহ সংকট। আছে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও প্রয়োগের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর অভাব। সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে নিজেদের করা জরিপের বরাত দিয়ে এনডিআইএ বলেছে, মোট প্রতিষ্ঠানের ৩০ শতাংশই তাদের বলেছে, পেন্টাগনে সুনির্দিষ্ট কিছু অস্ত্রের একমাত্র জোগানদাতা তারাই। অর্থাৎ, এক কারখানার ঘাটতি অন্যকে দিয়ে মেটানো কঠিন হবে। প্রয়োজনের মুহূর্তে দক্ষ কর্মী ও প্রযুক্তির সংকট বড় হয়ে সামনে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সংকটগুলো থাকলেও নেই সেই একই ভিত ও প্রেক্ষাপট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বৈশ্বিক যুদ্ধে প্রথম যুক্ত হওয়া। তার মন্দাপীড়িত অর্থনীতি এবং কারখানাগুলো যুদ্ধকালীন উৎপাদনের জন্য মুখিয়ে ছিল সে সময়। সে তখনো পরাশক্তি হয়ে ওঠেনি। পরাশক্তি হওয়ার বাসনা তার মধ্যে প্রবল। তার গণমনস্তত্ত্বও তখন এর পক্ষে ছিল। কারণ, যুদ্ধ-পালানো শরণার্থী, অভিবাসী বা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম দিয়ে গড়া যুক্তরাষ্ট্রই ছিল তখনকার দৃশ্যপটে। আর আজকের যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধক্লান্ত এক পরাশক্তি। তারও যুদ্ধস্মৃতি থাকলেও গণমনস্তত্ত্বে এর অভিঘাত ক্লান্তিই শুধু। কোভিড সাময়িক মন্দার সময় তৈরি করলেও বেকারত্ব ও বন্ধ কারখানার সংখ্যা এত উচ্চ নয় যে, চাইলেই হুট করে যুদ্ধকালীন উৎপাদন শুরু করতে পারবে সে। তেমনটি করলে ভেতর থেকেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে তাকে পড়তে হতে পারে।
সব মিলিয়ে রাশিয়া সরাসরি যুক্ত—এমন একটি যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা অপ্রস্তুতই বলতে হবে। প্রশ্ন হলো—এমন পরিস্থিতির জন্য বিশ্বমোড়ল কেন অপ্রস্তুত হলো? এর কারণ কি তার অহমিকার মধ্যে লুকিয়ে আছে তবে? সে ভেবেছিল তার দুই মূল বিরোধী শক্তি রাশিয়া ও চীন কখনোই তার বিরুদ্ধে সরাসরি দাঁড়াবে না বা তার ঘোষিত মিত্র দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তার আশা ছিল, সামরিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধ পক্ষ হিসেবে যুদ্ধ ময়দানে ঢুকতে কেউই চাইবে না। ২০১৯ সালে প্রকাশিত মার্কিন পত্রিকা ফরেন অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষণেও এমন আশাই প্রকাশ করা হয়েছিল। সঙ্গে মিত্রদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়েও সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্নটি জ্যান্ত থাকলেও আশাটি মিইয়ে গেছে। কারণ, ইউক্রেনকে সামনে রেখে সংকটই এখন বাস্তব। আর বাস্তব এ সংকটে শুধু ইউক্রেন নয় উলুখাগড়ার কাতারে এসে দাঁড়াচ্ছে একের পর এক দেশ। বর্তমান বা ভবিষ্যৎ মোড়লের মতো কোনো সুবিধা ভোগ করবে না জানলেও অতীতের মতোই তাকে কাতারে কাতারে উজাড় হতে হচ্ছে। তার ফল কী হবে, সেটা কেউ জানে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, মার্কিন এ অহমিকার মূল্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অজস্র দেশ ও মানুষকে মেটাতে হচ্ছে এবং হবে। দুঃখ এই যে, মার্কিন এই অহমিকা বৈশ্বিক অহমিকা না হলেও তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, সবার জন্যই আজ শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
শত বছর আগে চাণক্য বলে গেছেন, ‘অহংকারের মতো শত্রু আর হয় না।’ অবশ্য চাণক্য এ কথা বিশেষভাবে বলে না গেলেও হতো। এ সত্য তো সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই জানে। ব্যক্তি দিয়ে যেহেতু সমাজ-দেশ ইত্যাদি তৈরি হয়, সেহেতু দেশ বা রাষ্ট্রেরও তো এ কথা জানা থাকার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের কি জানা ছিল না? প্রশ্নটি উঠছে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের অবস্থা বিবেচনা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বৈশ্বিক পরাশক্তি সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ। যুদ্ধে সে সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে আমেরিকা তো বটেই, ইউরোপেরও নেতা হিসেবে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র। এই নেতৃত্ব গোটা বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, যেখানে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই দ্বিমেরু বিশ্ব কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে হাজির হয় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, যাদের শক্তির ভরকেন্দ্র হয়ে এখনো আছে ওয়াশিংটন।
এই হয়ে ওঠা কিন্তু ‘হঠাৎ পাওয়া’ কিছু ছিল না। বলা যায়, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ীই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমোড়লের আসনটিতে বসেছিল। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক রেডিও বার্তায় বলেন, ‘গণতন্ত্রের মহত্তম অস্ত্রে পরিণত হতে হবে আমেরিকাকে’। নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ তো বটেই, নিজেকে রক্ষার জন্যও যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি এই অস্ত্রে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। এর এক বছর পর যখন পার্ল হারবারে হামলা চালাল জাপান, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলো যুদ্ধকালীন উৎপাদনে সম্পূর্ণ নিয়োজিত হয়। আর এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল ডেট্রয়েটের গাড়ি উৎপাদনকারী কারখানাগুলো।
একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। হিস্ট্রি ডটকম ও ন্যাশনালডব্লিউডব্লিউ ২ মিউজিয়াম ডটওআরজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, পার্ল হারবার আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাঁকবদল করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে যায়। তাদের প্রতিটি কারখানা তো বটেই, প্রতিটি কর্মকাণ্ডই তখন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় বেকারত্ব, সামরিক-বেসামরিক মানুষের জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু। সেসব অন্য আলোচনার বিষয়। এখানে শুধু অস্ত্র নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ডেট্রয়েটের গাড়ি তৈরি কারখানাগুলো সে সময় রাতারাতি পরিণত হয় অস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানায়। ডেট্রয়েটের ওল্ডসমোবাইলে শুরু হয় কামানের উৎপাদন, ক্যাডিলাকে ট্যাংক, ক্রিসলারে মেশিন-গান উৎপাদন। আর বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানি শুরু করে বি-২৪ বোম্বার তৈরি।
আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপটে মার্কিন সরকার ও কারখানাগুলো কি একই বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছে? সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের সক্ষমতা কি চাহিদা বিবেচনায় বেড়েছে বলা যাবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মিত্রদের সহায় হওয়ার একক ক্ষমতা কি যুক্তরাষ্ট্রের আছে, নাকি কোথাও কিছু ক্ষয় হয়েছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্রে এখন কী চলছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আট দশক পর আজকের এই সময়ে রুজভেল্টের সেই চেয়ারে বসে আছেন জো বাইডেন। না পার্ল হারবার এখনো হয়নি, তেমনটা কেউ চায়ও না। কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা ভালো, শুরু থেকেই যুদ্ধের গোড়াটি আগলে বসে আছে যুক্তরাষ্ট্র। না প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষে। হোয়াইট হাউসের ভাষায়, ‘রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে যেকোনো মূল্যে জয়ী দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।’ এই যেকোনো মূল্যটা কী?
একটু পেছনে ফেরা যাক, যুদ্ধের এক সপ্তাহের ভেতরেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আলোচনায় বসার জন্য জেরবার হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেনও সে কথা। কিন্তু বাকি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে সে আলোচনা আর হয়নি, যুদ্ধও থামেনি। দুই মাস পেরিয়ে গেছে। ক্ষয় ও মৃত্যু দেখছে বিশ্ব। কিন্তু জেলেনস্কিকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র অনড়, অনড় রাশিয়াও। এ তাদের দুই দেশের মর্যাদা ও টিকে থাকার লড়াই। রাশিয়া যেমন খোলাখুলি বলছে, যুদ্ধের এই পর্যায় থেকে পিছু হটলে রাশিয়া নামে কিছু আর থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র তেমন খোলাখুলি না বললেও, ঘটনা একই। না, যুদ্ধ কোনো একটি দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে না। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা হবে না নিশ্চিত। কিন্তু পরাশক্তির কাতার থেকে তাদের নাম খসে যেতে পারে পরাজয় বা পিছু হটার সূত্র ধরে। ইউক্রেনের সে ভয় না থাকলেও এ যুদ্ধের ময়দান সে-ই।
এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া। যেকোনোভাবে তারা এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাশিয়া নতি স্বীকার করে। আর রাশিয়া তার যুদ্ধের কারণগুলোর মীমাংসা চায়। যুদ্ধের ময়দানে সে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র তার দাবিগুলো মেনে না নিচ্ছে। দুটি পক্ষই অনড় অবস্থানে দাঁড়িয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২৮ এপ্রিল দেশটির কংগ্রেসের কাছে ইউক্রেন সংকট সামাল দিতে আরও ৩৩ বিলিয়ন (৩ হাজার ৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার চেয়েছেন। বলে রাখা ভালো, চলতি বছরই এই সংকটের প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস ১৩ বিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন দিয়েছিল। এর বাইরে বাড়তি এই টাকা চাওয়া হয়েছে। কোন পথে ব্যয় হবে এই অর্থ, সে হিসাবও দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তারা বলছে, এই তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি ডলার ইউক্রেন ও ইউরোপে মার্কিন মিত্রদের সামরিক সহায়তা খাতে ব্যয় হবে। বাইডেন বলেছেন, ‘এ যুদ্ধ ব্যয়বহুল; কিন্তু এই আগ্রাসনের কাছে নতি স্বীকার আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।’
বাইডেনের এই বক্তব্য কি পার্ল হারবার ঘটনার আগে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায় না? ১৯৪০ সালে বসে যখন রুজভেল্ট সে বক্তব্য দেন, তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আক্রান্ত বা আক্রমণকারীর ভূমিকায় নেই। এবারও নেই। দুবারই যুক্তরাষ্ট্র ঘটনার আগে থেকেই মিত্রদের প্রতি সামরিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ সামনে আসে। আট দশক আগের যুক্তরাষ্ট্রে তা সম্ভব হয়েছিল। এখনকার যুক্তরাষ্ট্র কি একইভাবে সাড়া দিতে পারবে?
এবারের চ্যালেঞ্জটা আরেকটু বড়। এবার যুদ্ধ ময়দান ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম পাঠালেই শুধু চলবে না, সঙ্গে নিজেদের ও ইউরোপের মিত্রদেরও একইভাবে পুনঃসামরিকীকরণ করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলোর সামরিকীকরণের ধরন আর আগের মতো নেই। ফলে পুরো বিষয়টি এখন মার্কিননির্ভর হয়ে আছে। অস্ত্রাগারের মজুত বৃদ্ধির লক্ষ্যে পূর্ণ শক্তি নিয়ে এগোলে আবার রয়েছে অন্য শঙ্কা। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরাসরি পরাশক্তির লড়াইয়ের সংকেত দেবে। যুক্তরাষ্ট্র কি শেষ পর্যন্ত এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে ইউক্রেন সংকটের শুরুর দিনগুলোর দিকে। সে সময় জো বাইডেন বলেছিলেন, তিনি কখনোই সেখানে সেনা পাঠানোর কথা ভাবতে পারেন না। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে আসবে বিশ্বের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি রাশিয়া।
তাহলে কি রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ চায় না যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর—হ্যাঁ এবং না। এই যুদ্ধ চলুক— যুক্তরাষ্ট্র এটা চায়, তা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ক্ষেত্রে তার দ্বিধা রয়েছে। এ কারণেই মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এবং অনেক তরুণ যুদ্ধে যোগ দিতে ইউক্রেন এলেও নিয়মিত বাহিনীর কেউ সেখানে জড়ায়নি। আবার রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, ইউক্রেনকে সহায়তা করে যুদ্ধকে নিজের পছন্দমতো একটি পরিণতির দিকে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, নিজের অস্ত্রীকরণ নিয়েই এখন চিন্তিত ‘গণতন্ত্রের মহত্তম অস্ত্র’ দেশটি।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড বাজেটারি অ্যাসেসমেন্টসের গবেষক থমাস মানকিন ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ‘ইউক্রেনীয়দের বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে পারাটা আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা কে দেবে? কেউ না।’
হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিকে তারা ৫ হাজার ৫০০ জ্যাভেলিন ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র হয় দিয়েছে, নয়তো দেশটির কাছে বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয় এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে জ্যাভেলিন ছাড়াও অন্য ধরনের আরও ১৪ হাজার অ্যান্টি-আর্মার সিস্টেম, একজন সেনার বহনক্ষম ১৪০০ স্টিঙ্গার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র, ৭০০ সুইচব্লেড (ব্যাকপ্যাকে বহনক্ষম একধরনের বোমা, যা ছোড়ার পর নির্দিষ্ট টার্গেটে গিয়ে উড়োজাহাজের মতো ক্র্যাশ করে এবং ভেতরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়), ৯০টি ছোট নলের কামান, ১৫৫ মিলিমিটার ব্যাসের ১ লাখ ৮৩ হাজার কামানের গোলা, ১৬টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, ১৪টি কাউন্টার-আর্টিলারি, চারটি কাউন্টার-মর্টার ও দুটি এয়ার সার্ভেইল্যান্স রাডারসহ আরও অনেক কিছু পাঠিয়েছে।
এই যুদ্ধ যে সমীকরণের প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাতে শুধু ইউক্রেনে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোই আর যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে চালকের আসনে বসতে হলে তার সব মিত্রকেই নিরাপদ রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সে চেষ্টা করছেও। তবে এই চেষ্টা তার করতে হচ্ছে, ট্রাম্প জমানায় আহত ন্যাটো ও ইউরোপকে সঙ্গে নিয়ে। যে কারণে জার্মানিতে যখন দেশটি ৪০টি দেশের বৈঠক ডাকে, তখন তাকে অনেক কিছুই বিবেচনায় নিতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মুখোমুখি বসার সময় তাকে আফগান যুদ্ধ, আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় হওয়া যুদ্ধ, চীন, ভারত-চীন দ্বৈরথ ইত্যাদি অনেক কিছুকেই বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এই সবগুলো অঞ্চলকে নিজের আয়ত্তে রেখে দরকারি পক্ষগুলোর সশস্ত্রীকরণ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের পয়সাতেই করতে হচ্ছে। কারণ, এটি এখন তার ‘মর্যাদার’ আবরণে ‘পরাশক্তি’ পরিচয় টিকিয়ে রাখার লড়াই।
এখন পর্যন্ত এসব অস্ত্র দেশটি তার মজুত থেকেই দিতে পারছে। কিন্তু সামনের চাহিদা পূরণ করতে হলে আট দশক আগের মতো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে হবে। কিন্তু মার্কিন কারখানাগুলো খুব দ্রুতই এমন উৎপাদনে যেতে পারবে না বলে মত দিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটি জ্যাভেলিন আছে, তা জানা নেই। ১৯৯৬ সালে এটি বাজারে আসার পর দেশটির সরকার ৩৪ হাজার ৫০০ জ্যাভেলিন কিনেছে বলে ধারণা করা যায়। এর মধ্যে পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণের কাজে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার জ্যাভেলিন ব্যবহার হয়েছে। এই হিসাব ঠিক ধরলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ২০২১ সাল নাগাদ ১৭ থেকে ২২ হাজার জ্যাভেলিন ছিল। ইউক্রেন সংকটে এই মজুতের এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি বের হয়ে গেল। রইল আর কত? তবে ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এই হিসাবে মার্কিন মেরিনের কেনা ২৪০০ জ্যাভেলিনকে যেমন ধরা হয়নি, তেমনি ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত ৫০০০ জ্যাভেলিনকেও ধরা হয়নি।
সে যাই হোক, জ্যাভেলিন বিবেচনায় নিলেও যুদ্ধ বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ও মিত্রদের অস্ত্রাগার ভরতে রীতিমতো লড়তে হবে। এ কথা যুক্তরাষ্ট্র জানে বলে ৩ মে আলাবামার ট্রয়ে অস্ত্র কারখানা পরিদর্শনে গেছেন স্বয়ং দেশটির প্রেসিডেন্ট। ওই কারখানায় বছরে ২১০০টি জ্যাভেলিন উৎপাদন হয়। ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতেই এই কারখানার তিন-চার বছর লাগবে। আর মিত্রদের নিরাপত্তা বেশি গুরুত্ব পেলে এ সময় আরও বেশি লাগবে। এই কারখানার সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা বছরে সাড়ে ৬ হাজার। কিন্তু এই সর্বোচ্চ সীমায় যেতে হলে এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে লাগবে কাঁচামালের সরবরাহ। কিন্তু এই সরবরাহেই রয়েছে সংকট। একই অবস্থা স্টিঙ্গার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। ১৯৮১ সালে বাজারে আসা এই অস্ত্রের শেষ চালান যুক্তরাষ্ট্র কিনেছিল ২০০৩ সালে। গত বছর এর মার্কিন উৎপাদন বন্ধ হলেও চলতি বছর তা আবার চালু করা হয়। মুশকিল হলো এই অস্ত্র তৈরির কিছু উপকরণ এখন বাজারে পাওয়া কঠিন।
ন্যাটোভুক্ত অন্য দেশগুলোও কিছু কিছু দিকে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু সবার তো উৎপাদন সক্ষমতা নেই। জার্মানির থাকলেও তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় নানা বিধিনিষেধে রুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে সে সক্ষমতা আবার অর্জন করতে চায় জার্মানি। এরই মধ্যে ট্যাংক পাঠানোর কথা জানিয়ে জার্মানি বলেছে, তারা এর চেয়ে বেশি সহায়তা করতে চাইলে কারখানাগুলো চালু করতে হবে।
আকাশ-যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো একটু পিছিয়েই আছে। আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এ ধরনের অস্ত্রগুলোই চাওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি বড় সহায় হতে পারে। ফ্রান্সেরও সে সক্ষমতা আছে। কিন্তু পুরোনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে ফের নিজ পায়ে দাঁড়াতে সম্মতি ও সহায়তা দেওয়ার ঝুঁকি কি যুক্তরাষ্ট্র নেবে? তার অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। আবার আকাশ-যুদ্ধে পশ্চিমের দুর্বলতা লুকানো কিছু নয়। ২০১১ সালে লিবিয়া এবং সিরিয়া যুদ্ধে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার যুক্ত হওয়ার পর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাও প্রকাশ্য হয়েছিল। ফলে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কীভাবে এগোবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে নিজের ও মিত্রদের অস্ত্রীকরণ সক্ষমতা এক বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের। এক-মেরু বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়াত্ব তাকে এদিকে অনেক দিন তাকাতে দেয়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তার দক্ষতা ও সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জোট ন্যাশনাল ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের (এনডিআইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্প ক্ষয়ের পথে। সবচেয়ে বড় সংকট হলো দক্ষ কর্মীর অভাব। রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদানের সরবরাহ সংকট। আছে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও প্রয়োগের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর অভাব। সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে নিজেদের করা জরিপের বরাত দিয়ে এনডিআইএ বলেছে, মোট প্রতিষ্ঠানের ৩০ শতাংশই তাদের বলেছে, পেন্টাগনে সুনির্দিষ্ট কিছু অস্ত্রের একমাত্র জোগানদাতা তারাই। অর্থাৎ, এক কারখানার ঘাটতি অন্যকে দিয়ে মেটানো কঠিন হবে। প্রয়োজনের মুহূর্তে দক্ষ কর্মী ও প্রযুক্তির সংকট বড় হয়ে সামনে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সংকটগুলো থাকলেও নেই সেই একই ভিত ও প্রেক্ষাপট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বৈশ্বিক যুদ্ধে প্রথম যুক্ত হওয়া। তার মন্দাপীড়িত অর্থনীতি এবং কারখানাগুলো যুদ্ধকালীন উৎপাদনের জন্য মুখিয়ে ছিল সে সময়। সে তখনো পরাশক্তি হয়ে ওঠেনি। পরাশক্তি হওয়ার বাসনা তার মধ্যে প্রবল। তার গণমনস্তত্ত্বও তখন এর পক্ষে ছিল। কারণ, যুদ্ধ-পালানো শরণার্থী, অভিবাসী বা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম দিয়ে গড়া যুক্তরাষ্ট্রই ছিল তখনকার দৃশ্যপটে। আর আজকের যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধক্লান্ত এক পরাশক্তি। তারও যুদ্ধস্মৃতি থাকলেও গণমনস্তত্ত্বে এর অভিঘাত ক্লান্তিই শুধু। কোভিড সাময়িক মন্দার সময় তৈরি করলেও বেকারত্ব ও বন্ধ কারখানার সংখ্যা এত উচ্চ নয় যে, চাইলেই হুট করে যুদ্ধকালীন উৎপাদন শুরু করতে পারবে সে। তেমনটি করলে ভেতর থেকেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে তাকে পড়তে হতে পারে।
সব মিলিয়ে রাশিয়া সরাসরি যুক্ত—এমন একটি যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা অপ্রস্তুতই বলতে হবে। প্রশ্ন হলো—এমন পরিস্থিতির জন্য বিশ্বমোড়ল কেন অপ্রস্তুত হলো? এর কারণ কি তার অহমিকার মধ্যে লুকিয়ে আছে তবে? সে ভেবেছিল তার দুই মূল বিরোধী শক্তি রাশিয়া ও চীন কখনোই তার বিরুদ্ধে সরাসরি দাঁড়াবে না বা তার ঘোষিত মিত্র দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তার আশা ছিল, সামরিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধ পক্ষ হিসেবে যুদ্ধ ময়দানে ঢুকতে কেউই চাইবে না। ২০১৯ সালে প্রকাশিত মার্কিন পত্রিকা ফরেন অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষণেও এমন আশাই প্রকাশ করা হয়েছিল। সঙ্গে মিত্রদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়েও সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্নটি জ্যান্ত থাকলেও আশাটি মিইয়ে গেছে। কারণ, ইউক্রেনকে সামনে রেখে সংকটই এখন বাস্তব। আর বাস্তব এ সংকটে শুধু ইউক্রেন নয় উলুখাগড়ার কাতারে এসে দাঁড়াচ্ছে একের পর এক দেশ। বর্তমান বা ভবিষ্যৎ মোড়লের মতো কোনো সুবিধা ভোগ করবে না জানলেও অতীতের মতোই তাকে কাতারে কাতারে উজাড় হতে হচ্ছে। তার ফল কী হবে, সেটা কেউ জানে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, মার্কিন এ অহমিকার মূল্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অজস্র দেশ ও মানুষকে মেটাতে হচ্ছে এবং হবে। দুঃখ এই যে, মার্কিন এই অহমিকা বৈশ্বিক অহমিকা না হলেও তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, সবার জন্যই আজ শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৩ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৭ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৯ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
১০ দিন আগে