ফয়সাল হাসান, ঢাকা
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে পররাষ্ট্রনীতির চিরায়ত অবস্থান থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন পদক্ষেপ একরকম বিস্ময়ই ছিল অনেকের কাছে। তবে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন জো বাইডেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তাঁর স্থির অবস্থান একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোতে বাইডেনের নীতি কতটা সফল হবে, তা নিয়ে রয়ে গেছে অনিশ্চয়তা। সবকিছু ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল বাইডেনের প্রথম মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নানান দিক।
ওয়াশিংটন কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বা যোগাযোগ রক্ষা করবে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি এবং মার্কিন স্বার্থ বজায় রেখে বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিস্তৃত পরিকল্পনা নিয়ে গত জানুয়ারির ২০ তারিখে দেশ পরিচালনা শুরু করেন বাইডেন।
২০২১ সাল শেষ হওয়ার আগে প্রকৃতপক্ষেই মূল মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় নিজ অবস্থান দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার রক্ষায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার সম্মুখীনও হয়েছেন বাইডেন, যেখানে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শগত পার্থক্য। তবে এমন এক সময়ে এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যখন বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণবিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিজে ক্রাউলি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২০২১ ছিল রূপান্তরের একটি বছর। ট্রাম্পের উদাসীনতাকে বাস্তববাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এটি একদিকে যেমন বড় কৃতিত্ব, তেমনি ২০২২ সালের জন্য একটি বড় পরীক্ষাও বটে। কারণ, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পুরোনো ধারা ফিরিয়ে আনার পর বাইডেন এর অর্থপূর্ণ ফলাফল বয়ে আনতে পারবেন কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।’
সম্পর্কের টানাপোড়েন
ক্ষমতায় বসার পরপরই বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা ও মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে জোর দিয়েছিলেন বাইডেন। হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করে প্রথম দিনই পুনরায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন জো বাইডেন। এর আগে যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২০ সালে প্যারিস চুক্তি ও ডব্লিউএইচও থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন ট্রাম্প।
এ ছাড়া ন্যাটো মিত্রদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা, উত্তর আমেরিকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করা, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং করোনা মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ওয়াশিংটন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ‘নিরলস মার্কিন কূটনীতির’ নতুন এক যুগের সূচনার কথাও বলেন বাইডেন।
বছরের শেষ দিকে এসে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’-এর আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র, যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি আদায় করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সম্মেলনের অতিথি তালিকা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন বাইডেন।
দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্ররা বিশ্বমঞ্চে বাইডেনের ‘অনুমানযোগ্য’ পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও, ক্ষমতার প্রথম বছরে বিতর্ক বা সমালোচনা এড়াতে পারেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আকস্মিক ঘোষণায় কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ওয়াশিংটনের বিশ্বাসযোগ্যতা। এ ছাড়া সম্প্রতি ইউক্রেন-রুশ সীমান্তে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার আলোচনা ক্ষুব্ধ করেছে ন্যাটো সদস্যদের। ত্রিদেশীয় ‘অকাস’ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেও পুরোনো মিত্র ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় ওয়াশিংটনের।
‘মাথাব্যথা’ যখন চীন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর গত নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ভার্চুয়ালি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন জো বাইডেন। নানা ইস্যুতে দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাকে শীতল করার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হয় এই সম্মেলনকে। যদিও ২০১৮ সাল থেকে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত ওয়াশিংটন ও বেইজিং, যা বাইডেনের শাসনামলেও অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া চীনা প্রভাব মোকাবিলায় ইউরোপীয় ও এশীয় মিত্রদের একত্রিত করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন।
পররাষ্ট্রনীতিতে বেইজিংকে শীর্ষ অগ্রাধিকারমূলক অবস্থানে রাখার বিষয়টি এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে বাইডেন প্রশাসন। গত মার্চে এক সভায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী একমাত্র দেশ হিসেবে চীনের নাম উল্লেখ করেছেন, যারা স্থিতিশীল ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা রাখে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার পরাশক্তি চীনের সঙ্গে ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে বিভিন্ন পক্ষ ইঙ্গিত দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বাইডেন। যদিও নিয়মিতভাবেই এশিয়া অঞ্চলে চীনের ‘জবরদস্তিমূলক এবং ‘দৃঢ় পদক্ষেপের’ বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান, হংকং ও জিনজিয়াং প্রদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে তাইওয়ান ইস্যুতেই সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে। এই ইস্যুতে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতার’ নীতি থেকে সরে এসে সরাসরি তাইওয়ানের পক্ষ নিতেও দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। যদিও সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আলোচনার পর সেই অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটেছেন বাইডেন।
আফগানিস্তানে ‘কৌশলগত ব্যর্থতা’
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মে মাসে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। কিন্তু ওই চুক্তিতে মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারকে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য সে সময় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ট্রাম্প। কারণ, এর মাধ্যমেই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পথ অনেকটা সুগম হয় তালেবানের জন্য।
এরপর ক্ষমতায় এসে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা পিছিয়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়ে যান বাইডেন। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের করা চুক্তিতেই অনড় থাকেন তিনি। আর এর মধ্যেই চলতি বছরের ১৫ আগস্ট চূড়ান্তভাবে কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নেয় তালেবান যোদ্ধারা। এর পরের পরিস্থিতি কারও অজানা নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে নেমে এসেছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়। অনেকে বলে থাকেন, বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে দেশটি। ফলে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ধীরে ধীরে আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পরিবর্তে তাড়াহুড়া করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে আফগানিস্তানকে সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়ার দায় অনেকটাই বর্তেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর। যদিও তা মানতে নারাজ ওয়াশিংটন। তাদের দাবি, মার্কিন সেনাদের জীবন বাঁচাতেই নেওয়া হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত।
এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি ওয়াশিংটন। তবে কাতারকে দেশটিতে কূটনৈতিক দূত হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকেও মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা। আফগানিস্তানের ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট বিবেচনায় সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন জাতিসংঘ এবং বেসরকারি কিছু সংস্থার মাধ্যমে দেশটিতে সাহায্যের অর্থ পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আটকে রাখা সম্পদ ছাড়ের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্ব
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অধীনে শুরু হওয়া এবং ট্রাম্পের অধীনে অব্যাহত থাকা মধ্যপ্রাচ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার নীতিতেই অটল আছে বাইডেন প্রশাসন। গত ৯ ডিসেম্বর ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন। যদিও এই অঞ্চলের শীর্ষ এক মার্কিন কমান্ডার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছেন, ইরাকে আড়াই হাজার মার্কিন সেনা মূলত ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে ‘উপদেষ্টা এবং সহায়তার’ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে, যা অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। একই সঙ্গে খুব শিগগিরই প্রত্যাহার করা হচ্ছে না সিরিয়ায় অবশিষ্ট থাকা প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনাকে।
এদিকে, গত নভেম্বরে প্রথমবারের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ইসরায়েলের সঙ্গে লোহিত সাগরে এক যৌথ নৌ মহড়ার আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে শক্তিশালী অবস্থান না নেওয়ার জন্য সমালোচিতও হয়েছেন। একই সময়ে নতুন মার্কিন প্রশাসন ট্রাম্পের অধীনে ইসরায়েলের প্রতি ‘অনুমতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে সরে আসারও ইঙ্গিত দিয়েছে।
আইনজীবীরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তেমন কোনো অঙ্গীকার করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরও তাঁর ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। যদিও ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের আক্রমণাত্মক অভিযানকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। আর মিসরের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য মার্কিন সুরক্ষা সহায়তার অংশ হিসেবে বড় তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে।
ইরান পরমাণু চুক্তি: সমঝোতা অথবা নিষেধাজ্ঞা
গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত ইরান পরমাণু চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় আলোচনা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর কয়েকটি রাষ্ট্র। এ আলোচনা সফল হলে নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি কমাতে হবে তেহরানকে। তবে আলোচনা ব্যর্থ হলে ‘বিকল্প’ ভাবার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
পরমাণু অস্ত্র না বাড়ানোর শর্তে ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে চুক্তিটি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানি। কিন্তু ওবামার আমলে সম্পাদিত ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে তেহরানের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ই পরমাণু চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করতে আগ্রহী হলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সময়সীমা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে দুই দেশের মধ্যে। ইরানে গত আগস্টের নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
রাশিয়ায় ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’
ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’ নীতি মেনে চলার আশা ছিল বাইডেনের। অগ্রগতিও হয়েছিল বেশ কিছুটা। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই পরিকল্পনা অনেকটাই ভেস্তে গেছে।
গত ৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল এক বৈঠকে ইউক্রেনে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে রাশিয়াকে ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বাইডেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেনে হামলা চালালে রাশিয়াকে এমন কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে, যা তিনি (পুতিন) আগে কখনো দেখেননি।’
তবে পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয় এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার আইনগত ভিত্তি নেই উল্লেখ করে বাইডেন জানিয়েছেন, রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য এখনই একতরফাভাবে শক্তি ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
এদিকে বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’ বজায় রেখে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। আর আগামী জানুয়ারিতে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
আফ্রিকায় সতর্ক পদক্ষেপ
এখন পর্যন্ত আফ্রিকার প্রতি বাইডেন প্রশাসনের কূটনীতি মূলত ইথিওপিয়ায় চলমান সংঘাত এবং সুদানের সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থান পরিস্থিতি শান্ত করা নিয়েই আবর্তিত। পাশাপাশি ট্রাম্পের অধীনে চালু হওয়া একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগকেও সমর্থন জানাচ্ছেন বাইডেন।
গত নভেম্বরে আফ্রিকায় নিজের প্রথম সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ওই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের নীতির একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তন তুলে ধরেন, যেখানে মহাদেশটিকে শুধু চীনা প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্র হিসেবে নয়, আখ্যায়িত করা হয়েছে একটি ‘প্রধান ভূ-রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবেও। পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য আফ্রিকান নেতাদের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনেরও প্রস্তুতি নিয়েছেন বাইডেন। যদিও এর দিনক্ষণ এখনো ঠিক করা হয়নি।
অভিবাসন নীতিতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
ট্রাম্পের কট্টর নীতির পরিবর্তে আরও ‘মানবিক’ অভিবাসন নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে তিনটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সম্প্রতি শরণার্থী সংকটের ‘মূল কারণ’ খুঁজে বের করতে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। আর এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
তবে অভিবাসন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা এবং মেক্সিকো সীমান্ত আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের বিষয়ে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত বাইডেনের প্রতিশ্রুতির (অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কার) সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য করোনা মহামারির মধ্যেও বিতর্কিত ‘টাইটেল ৪২’ আইন অনুসরণ করেছে বাইডেন প্রশাসন।
সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে পররাষ্ট্রনীতির চিরায়ত অবস্থান থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন পদক্ষেপ একরকম বিস্ময়ই ছিল অনেকের কাছে। তবে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন জো বাইডেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তাঁর স্থির অবস্থান একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোতে বাইডেনের নীতি কতটা সফল হবে, তা নিয়ে রয়ে গেছে অনিশ্চয়তা। সবকিছু ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল বাইডেনের প্রথম মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নানান দিক।
ওয়াশিংটন কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বা যোগাযোগ রক্ষা করবে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি এবং মার্কিন স্বার্থ বজায় রেখে বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিস্তৃত পরিকল্পনা নিয়ে গত জানুয়ারির ২০ তারিখে দেশ পরিচালনা শুরু করেন বাইডেন।
২০২১ সাল শেষ হওয়ার আগে প্রকৃতপক্ষেই মূল মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় নিজ অবস্থান দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার রক্ষায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার সম্মুখীনও হয়েছেন বাইডেন, যেখানে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শগত পার্থক্য। তবে এমন এক সময়ে এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যখন বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণবিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিজে ক্রাউলি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২০২১ ছিল রূপান্তরের একটি বছর। ট্রাম্পের উদাসীনতাকে বাস্তববাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এটি একদিকে যেমন বড় কৃতিত্ব, তেমনি ২০২২ সালের জন্য একটি বড় পরীক্ষাও বটে। কারণ, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পুরোনো ধারা ফিরিয়ে আনার পর বাইডেন এর অর্থপূর্ণ ফলাফল বয়ে আনতে পারবেন কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।’
সম্পর্কের টানাপোড়েন
ক্ষমতায় বসার পরপরই বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা ও মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে জোর দিয়েছিলেন বাইডেন। হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করে প্রথম দিনই পুনরায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন জো বাইডেন। এর আগে যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২০ সালে প্যারিস চুক্তি ও ডব্লিউএইচও থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন ট্রাম্প।
এ ছাড়া ন্যাটো মিত্রদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা, উত্তর আমেরিকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করা, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং করোনা মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ওয়াশিংটন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ‘নিরলস মার্কিন কূটনীতির’ নতুন এক যুগের সূচনার কথাও বলেন বাইডেন।
বছরের শেষ দিকে এসে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’-এর আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র, যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি আদায় করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সম্মেলনের অতিথি তালিকা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন বাইডেন।
দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্ররা বিশ্বমঞ্চে বাইডেনের ‘অনুমানযোগ্য’ পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও, ক্ষমতার প্রথম বছরে বিতর্ক বা সমালোচনা এড়াতে পারেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আকস্মিক ঘোষণায় কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ওয়াশিংটনের বিশ্বাসযোগ্যতা। এ ছাড়া সম্প্রতি ইউক্রেন-রুশ সীমান্তে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার আলোচনা ক্ষুব্ধ করেছে ন্যাটো সদস্যদের। ত্রিদেশীয় ‘অকাস’ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেও পুরোনো মিত্র ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় ওয়াশিংটনের।
‘মাথাব্যথা’ যখন চীন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর গত নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ভার্চুয়ালি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন জো বাইডেন। নানা ইস্যুতে দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাকে শীতল করার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হয় এই সম্মেলনকে। যদিও ২০১৮ সাল থেকে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত ওয়াশিংটন ও বেইজিং, যা বাইডেনের শাসনামলেও অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া চীনা প্রভাব মোকাবিলায় ইউরোপীয় ও এশীয় মিত্রদের একত্রিত করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন।
পররাষ্ট্রনীতিতে বেইজিংকে শীর্ষ অগ্রাধিকারমূলক অবস্থানে রাখার বিষয়টি এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে বাইডেন প্রশাসন। গত মার্চে এক সভায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী একমাত্র দেশ হিসেবে চীনের নাম উল্লেখ করেছেন, যারা স্থিতিশীল ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা রাখে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার পরাশক্তি চীনের সঙ্গে ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে বিভিন্ন পক্ষ ইঙ্গিত দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বাইডেন। যদিও নিয়মিতভাবেই এশিয়া অঞ্চলে চীনের ‘জবরদস্তিমূলক এবং ‘দৃঢ় পদক্ষেপের’ বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান, হংকং ও জিনজিয়াং প্রদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে তাইওয়ান ইস্যুতেই সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে। এই ইস্যুতে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতার’ নীতি থেকে সরে এসে সরাসরি তাইওয়ানের পক্ষ নিতেও দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। যদিও সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আলোচনার পর সেই অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটেছেন বাইডেন।
আফগানিস্তানে ‘কৌশলগত ব্যর্থতা’
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মে মাসে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। কিন্তু ওই চুক্তিতে মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারকে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য সে সময় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ট্রাম্প। কারণ, এর মাধ্যমেই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পথ অনেকটা সুগম হয় তালেবানের জন্য।
এরপর ক্ষমতায় এসে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা পিছিয়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়ে যান বাইডেন। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের করা চুক্তিতেই অনড় থাকেন তিনি। আর এর মধ্যেই চলতি বছরের ১৫ আগস্ট চূড়ান্তভাবে কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নেয় তালেবান যোদ্ধারা। এর পরের পরিস্থিতি কারও অজানা নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে নেমে এসেছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়। অনেকে বলে থাকেন, বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে দেশটি। ফলে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ধীরে ধীরে আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পরিবর্তে তাড়াহুড়া করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে আফগানিস্তানকে সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়ার দায় অনেকটাই বর্তেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর। যদিও তা মানতে নারাজ ওয়াশিংটন। তাদের দাবি, মার্কিন সেনাদের জীবন বাঁচাতেই নেওয়া হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত।
এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি ওয়াশিংটন। তবে কাতারকে দেশটিতে কূটনৈতিক দূত হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকেও মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা। আফগানিস্তানের ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট বিবেচনায় সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন জাতিসংঘ এবং বেসরকারি কিছু সংস্থার মাধ্যমে দেশটিতে সাহায্যের অর্থ পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আটকে রাখা সম্পদ ছাড়ের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্ব
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অধীনে শুরু হওয়া এবং ট্রাম্পের অধীনে অব্যাহত থাকা মধ্যপ্রাচ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার নীতিতেই অটল আছে বাইডেন প্রশাসন। গত ৯ ডিসেম্বর ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন। যদিও এই অঞ্চলের শীর্ষ এক মার্কিন কমান্ডার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছেন, ইরাকে আড়াই হাজার মার্কিন সেনা মূলত ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে ‘উপদেষ্টা এবং সহায়তার’ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে, যা অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। একই সঙ্গে খুব শিগগিরই প্রত্যাহার করা হচ্ছে না সিরিয়ায় অবশিষ্ট থাকা প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনাকে।
এদিকে, গত নভেম্বরে প্রথমবারের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ইসরায়েলের সঙ্গে লোহিত সাগরে এক যৌথ নৌ মহড়ার আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে শক্তিশালী অবস্থান না নেওয়ার জন্য সমালোচিতও হয়েছেন। একই সময়ে নতুন মার্কিন প্রশাসন ট্রাম্পের অধীনে ইসরায়েলের প্রতি ‘অনুমতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে সরে আসারও ইঙ্গিত দিয়েছে।
আইনজীবীরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তেমন কোনো অঙ্গীকার করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরও তাঁর ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। যদিও ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের আক্রমণাত্মক অভিযানকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। আর মিসরের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য মার্কিন সুরক্ষা সহায়তার অংশ হিসেবে বড় তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে।
ইরান পরমাণু চুক্তি: সমঝোতা অথবা নিষেধাজ্ঞা
গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত ইরান পরমাণু চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় আলোচনা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর কয়েকটি রাষ্ট্র। এ আলোচনা সফল হলে নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি কমাতে হবে তেহরানকে। তবে আলোচনা ব্যর্থ হলে ‘বিকল্প’ ভাবার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
পরমাণু অস্ত্র না বাড়ানোর শর্তে ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে চুক্তিটি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানি। কিন্তু ওবামার আমলে সম্পাদিত ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে তেহরানের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ই পরমাণু চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করতে আগ্রহী হলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সময়সীমা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে দুই দেশের মধ্যে। ইরানে গত আগস্টের নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
রাশিয়ায় ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’
ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’ নীতি মেনে চলার আশা ছিল বাইডেনের। অগ্রগতিও হয়েছিল বেশ কিছুটা। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই পরিকল্পনা অনেকটাই ভেস্তে গেছে।
গত ৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল এক বৈঠকে ইউক্রেনে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে রাশিয়াকে ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বাইডেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেনে হামলা চালালে রাশিয়াকে এমন কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে, যা তিনি (পুতিন) আগে কখনো দেখেননি।’
তবে পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয় এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার আইনগত ভিত্তি নেই উল্লেখ করে বাইডেন জানিয়েছেন, রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য এখনই একতরফাভাবে শক্তি ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
এদিকে বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’ বজায় রেখে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। আর আগামী জানুয়ারিতে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
আফ্রিকায় সতর্ক পদক্ষেপ
এখন পর্যন্ত আফ্রিকার প্রতি বাইডেন প্রশাসনের কূটনীতি মূলত ইথিওপিয়ায় চলমান সংঘাত এবং সুদানের সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থান পরিস্থিতি শান্ত করা নিয়েই আবর্তিত। পাশাপাশি ট্রাম্পের অধীনে চালু হওয়া একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগকেও সমর্থন জানাচ্ছেন বাইডেন।
গত নভেম্বরে আফ্রিকায় নিজের প্রথম সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ওই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের নীতির একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তন তুলে ধরেন, যেখানে মহাদেশটিকে শুধু চীনা প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্র হিসেবে নয়, আখ্যায়িত করা হয়েছে একটি ‘প্রধান ভূ-রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবেও। পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য আফ্রিকান নেতাদের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনেরও প্রস্তুতি নিয়েছেন বাইডেন। যদিও এর দিনক্ষণ এখনো ঠিক করা হয়নি।
অভিবাসন নীতিতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
ট্রাম্পের কট্টর নীতির পরিবর্তে আরও ‘মানবিক’ অভিবাসন নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে তিনটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সম্প্রতি শরণার্থী সংকটের ‘মূল কারণ’ খুঁজে বের করতে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। আর এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
তবে অভিবাসন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা এবং মেক্সিকো সীমান্ত আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের বিষয়ে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত বাইডেনের প্রতিশ্রুতির (অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কার) সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য করোনা মহামারির মধ্যেও বিতর্কিত ‘টাইটেল ৪২’ আইন অনুসরণ করেছে বাইডেন প্রশাসন।
সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
২১ ঘণ্টা আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে