অনলাইন ডেস্ক
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়া প্রথম দেশগুলোর একটি ক্যারিবীয় অঞ্চলের হাইতি। তবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কূটচালসহ নানা কারণে দেশটি স্বাধীনতার ২২০ বছর পরও রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। হাইতির এই ছদ্ম পরাধীনতার পেছনের বড় কারণ, পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর সম্মিলিত অপচেষ্টা।
১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ম্যাকিয়াস হাইতির রাজধানী পোর্ট-আ-প্রিন্সের বন্দরে নোঙর করে। সেই যুদ্ধজাহাজ থেকে আট জন সেনা নেমে হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি থেকে সেই সময়ের ৫ লাখ ডলার মূল্যমানের সোনা লুট করে নিয়ে চলে যায়। বর্তমান বাজারে যার মূল্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেই সোনা রাখা হয় নিউইয়র্কের ব্যাংক হলগার্টেন অ্যান্ড কোংয়ের ভল্টে। এই ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
মজার ব্যাপার হলো, বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও এটি একই সঙ্গে ছিল বেসরকারি বিদেশি বিনিয়োগ করপোরেশনও। ১৮৮০ সালে ফরাসি ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের ভিত্তিতে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এই ব্যাংকে মার্কিন লগ্নিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯২০ সাল নাগাদ হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিকানা পুরোটাই চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের হাতে। হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও সরকারকে প্রত্যেক লেনদেনের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করতে হতো। আর এই ব্যাংকের বিপুল লাভের অংশ গেছে প্যারিস অথবা নিউইয়র্কে।
মূলত ১৯১০–এর দশকে হাইতির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় ওয়ালস্ট্রিট স্টক এক্সচেঞ্জ সেখানে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য চাপ দেয়। ওয়াশিংটন বাধ্য হয়ে দেশটিতে সেনা পাঠায়। ১৯১১ সালে মার্কিন মেরিন সেনারা হাইতিতে অবতরণ করে এবং পরবর্তী ১৯ বছর সেখানেই রয়ে যায়।
মার্কিন সেনারা হাইতিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চরম নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন হাইতিতে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া মেজর জেনারেল স্মেডলি বাটলার। ১৯৩৫ সালে এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, ‘ন্যাশনাল সিটি ব্যাংককে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য হাইতিকে একটি উপযুক্ত জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি আমি।’
এগুলো সবই ইতিহাসের পাতার গল্প। তবে সম্প্রতি হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিকে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং অসংখ্য গ্যাংয়ের উত্থান দেশটিকে আবারও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে এনেছে। হাইতির বর্তমান সংকট বুঝতে হলে এর অতীত ইতিহাসটাও ভালো করে বোঝা দরকার।
হাইতির ইতিহাসে দেখা যায়, দেশটির শাসকশ্রেণি সব সময়ই জনগণকে উপেক্ষা–অবজ্ঞা করেছে। সব সময়ই বিদেশি শক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এসবই পরাশক্তিগুলো নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য করেছে। দখল বজায় রাখতে বিদেশিরা কখনো স্থানীয় রাজনীতিকদের ব্যবহার করেছে, আবার কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ফলস্বরূপ, হাইতি এখন আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে গরিব এবং বৈষম্য জর্জরিত দেশগুলোর একটি।
হাইতির ট্র্যাজেডি কেবল জনগণের ওপর নেমে আসা নানামাত্রিক বিপর্যয়ই নয়, দেশটি এখন দুর্নীতি ও আইনের শাসনহীন অবস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, ২০০ বছর আগে হাইতির জনগণ যখন ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করছিল, তখন দেশটি ছিল মানুষের সম্ভাবনা ও মুক্তির প্রতীক।
১৩ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন শেষে ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেনসহ বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি ও দাস ব্যবসায়ীদের কবল থেকে ১৮০৪ সালে স্বাধীন হয় হাইতি। ওই সময় বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শক্তি বিরোধী আন্দোলনের নতুন নজির স্থাপন করেছিল দেশটি।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রার শুরুতেই হাইতির শাসনব্যবস্থা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় সংহতি থাকলেও সার্বভৌম শাসনব্যবস্থায় শুরুতেই অভিজাতদের আধিপত্য কায়েম হয়। হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা এমনটিই চেয়েছিল। একই সঙ্গে তারা হাইতির অভিজাত শ্রেণির মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব আপাত হাইতি ছেড়ে গেলেও, নিয়ন্ত্রণের লাগাম তাদের হাতেই ছিল।
সে সময় ইউরোপ–আমেরিকার ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ভয় ছিল, হাইতির স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের উপনিবেশগুলোতে চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারে। এ কারণেই তারা হাইতিকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ও দেশটির বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে।
সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স দেশটির কাছে ১৫ কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে। যা আজকের বাজারমূল্যে ৪ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। মূলত ফরাসি স্থাপনা, স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফ্রান্স এই অর্থ দাবি করে। প্যারিস কেবল দাবি করেই ক্ষান্ত থাকেনি, পাওনা আদায়ে বাধ্য করতে হাইতির উপকূলে ১৪টি যুদ্ধজাহাজও পাঠিয়েছিল।
পরে অবশ্য সেই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ৯ কোটি ফ্রাঁতে নেমে আসে। ফ্রান্সের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ১৯১৪ সাল নাগাদ হাইতি সরকারকে জাতীয় বাজেটের ৮০ শতাংশই ব্যয় করতে হতো। বছরের পর বছর হাইতি এই দায় শোধ করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ, এসব অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নে। পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর ভাঁড়ার ভরতে গিয়ে বছরের পর বছর নিজের ভাঁড়ার খালি করে ফেলেছে হাইতি।
পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো হাইতিকে কেবল দরিদ্র দেশেই পরিণত করেনি, একই সঙ্গে দেশটির রাজনীতিতে বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। এমনকি যেসব রাষ্ট্রনায়ক দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সবাইকে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়রের কথা। হাইতিতে ‘পাপা ডক’ নামে পরিচিত এই স্বৈরশাসক ১৯৫৭ সালে হাইতির ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনের পুরোটা সময়ে দেশটিতে ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলেছে। মার্কিন শাসকেরা তাঁর সমালোচনা করলেও তাঁকে কমিউনিজমবিরোধী ঢাল হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিপরীতে জ্যঁ বার্থ এরিস্তিদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও মার্কিনদের তরফ থেকে ভিন্ন আচরণ পেয়েছেন। তিনি ১৯৯০ সালে ও ২০০১ সালে দুইবার ক্ষমতায় আসেন জনগণের ভোটে। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। মার্কিন হস্তক্ষেপে ১৯৯১ ও ২০০৪ সালে দুটি ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে উৎখাত করা হয়।
মজার ব্যাপার হলো, প্রথমবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এরিস্তিদ দ্বিতীয়বার মার্কিন সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যেসব সেনা কর্মকর্তা তাঁকে উৎখাত করে তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ–এর ভাড়াটে। সিআইএ এ বিষয়ে কখনোই রাখঢাক করেনি।
যাই হোক, পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত, অনুচিত হস্তক্ষেপের কারণে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে হাইতির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা থেকে শুরু করে সব বিষয়েই নীতি নির্ধারণ করে একটি সমান্তরাল সরকার। এই সমান্তরাল শক্তিকে গবেষক জন জনস্টন বলছেন, ‘এইড স্টেট’ বা ‘ত্রাণ রাষ্ট্র’। মূলত বিভিন্ন বিদেশি এনজিও, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানির জোট এটি নিয়ন্ত্রণ করে।
হাইতিতে ২০১০ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর থেকেই এই সমান্তরাল সরকার সর্বময় ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছে। দেশটির সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিও তথাকথিত ‘কোর গ্রুপ’–এর সমান্তরাল সরকারেরই নিয়োগপ্রাপ্ত। এই কোর গ্রুপ হলো, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের একটি জোট। এই জোটই মূলত হাইতির ‘কার্যত শাসক’।
এর ফলে যা হয়েছে, হাইতির শাসক এবং শাসিতের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রের এই প্রধান দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার যোগসূত্রহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন, যখন দেখা যায়, রাস্তায় রাস্তায় অস্ত্রধারী গ্যাং সদস্যরা মহড়া দেয় কিন্তু তাদের বলার কেউ নেই। ক্ষুধায় কাতর মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় কিন্তু প্রতিকার করার কেউ নেই।
হাইতির এই দুর্দশা দেখে এরিস্তিদ ১৯৮৭ সালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা আজ নিজেরাই নিজেদের ইতিহাসের অধীনস্থে পরিণত হয়েছি। আমরা সেই ইতিহাসের অংশ হতে অস্বীকার করেছি।’
ট্র্যাজেডি হলো হাইতিতে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। হাইতির জনগণ শাসন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত হাইতির পরিবর্তনের আশা নেই।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত কেনান মালিকের নিবন্ধ, অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়া প্রথম দেশগুলোর একটি ক্যারিবীয় অঞ্চলের হাইতি। তবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কূটচালসহ নানা কারণে দেশটি স্বাধীনতার ২২০ বছর পরও রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। হাইতির এই ছদ্ম পরাধীনতার পেছনের বড় কারণ, পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর সম্মিলিত অপচেষ্টা।
১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ম্যাকিয়াস হাইতির রাজধানী পোর্ট-আ-প্রিন্সের বন্দরে নোঙর করে। সেই যুদ্ধজাহাজ থেকে আট জন সেনা নেমে হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি থেকে সেই সময়ের ৫ লাখ ডলার মূল্যমানের সোনা লুট করে নিয়ে চলে যায়। বর্তমান বাজারে যার মূল্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেই সোনা রাখা হয় নিউইয়র্কের ব্যাংক হলগার্টেন অ্যান্ড কোংয়ের ভল্টে। এই ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
মজার ব্যাপার হলো, বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও এটি একই সঙ্গে ছিল বেসরকারি বিদেশি বিনিয়োগ করপোরেশনও। ১৮৮০ সালে ফরাসি ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের ভিত্তিতে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এই ব্যাংকে মার্কিন লগ্নিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯২০ সাল নাগাদ হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিকানা পুরোটাই চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের হাতে। হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও সরকারকে প্রত্যেক লেনদেনের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করতে হতো। আর এই ব্যাংকের বিপুল লাভের অংশ গেছে প্যারিস অথবা নিউইয়র্কে।
মূলত ১৯১০–এর দশকে হাইতির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় ওয়ালস্ট্রিট স্টক এক্সচেঞ্জ সেখানে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য চাপ দেয়। ওয়াশিংটন বাধ্য হয়ে দেশটিতে সেনা পাঠায়। ১৯১১ সালে মার্কিন মেরিন সেনারা হাইতিতে অবতরণ করে এবং পরবর্তী ১৯ বছর সেখানেই রয়ে যায়।
মার্কিন সেনারা হাইতিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চরম নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন হাইতিতে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া মেজর জেনারেল স্মেডলি বাটলার। ১৯৩৫ সালে এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, ‘ন্যাশনাল সিটি ব্যাংককে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য হাইতিকে একটি উপযুক্ত জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি আমি।’
এগুলো সবই ইতিহাসের পাতার গল্প। তবে সম্প্রতি হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিকে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং অসংখ্য গ্যাংয়ের উত্থান দেশটিকে আবারও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে এনেছে। হাইতির বর্তমান সংকট বুঝতে হলে এর অতীত ইতিহাসটাও ভালো করে বোঝা দরকার।
হাইতির ইতিহাসে দেখা যায়, দেশটির শাসকশ্রেণি সব সময়ই জনগণকে উপেক্ষা–অবজ্ঞা করেছে। সব সময়ই বিদেশি শক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এসবই পরাশক্তিগুলো নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য করেছে। দখল বজায় রাখতে বিদেশিরা কখনো স্থানীয় রাজনীতিকদের ব্যবহার করেছে, আবার কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ফলস্বরূপ, হাইতি এখন আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে গরিব এবং বৈষম্য জর্জরিত দেশগুলোর একটি।
হাইতির ট্র্যাজেডি কেবল জনগণের ওপর নেমে আসা নানামাত্রিক বিপর্যয়ই নয়, দেশটি এখন দুর্নীতি ও আইনের শাসনহীন অবস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, ২০০ বছর আগে হাইতির জনগণ যখন ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করছিল, তখন দেশটি ছিল মানুষের সম্ভাবনা ও মুক্তির প্রতীক।
১৩ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন শেষে ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেনসহ বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি ও দাস ব্যবসায়ীদের কবল থেকে ১৮০৪ সালে স্বাধীন হয় হাইতি। ওই সময় বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শক্তি বিরোধী আন্দোলনের নতুন নজির স্থাপন করেছিল দেশটি।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রার শুরুতেই হাইতির শাসনব্যবস্থা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় সংহতি থাকলেও সার্বভৌম শাসনব্যবস্থায় শুরুতেই অভিজাতদের আধিপত্য কায়েম হয়। হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা এমনটিই চেয়েছিল। একই সঙ্গে তারা হাইতির অভিজাত শ্রেণির মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব আপাত হাইতি ছেড়ে গেলেও, নিয়ন্ত্রণের লাগাম তাদের হাতেই ছিল।
সে সময় ইউরোপ–আমেরিকার ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ভয় ছিল, হাইতির স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের উপনিবেশগুলোতে চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারে। এ কারণেই তারা হাইতিকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ও দেশটির বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে।
সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স দেশটির কাছে ১৫ কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে। যা আজকের বাজারমূল্যে ৪ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। মূলত ফরাসি স্থাপনা, স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফ্রান্স এই অর্থ দাবি করে। প্যারিস কেবল দাবি করেই ক্ষান্ত থাকেনি, পাওনা আদায়ে বাধ্য করতে হাইতির উপকূলে ১৪টি যুদ্ধজাহাজও পাঠিয়েছিল।
পরে অবশ্য সেই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ৯ কোটি ফ্রাঁতে নেমে আসে। ফ্রান্সের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ১৯১৪ সাল নাগাদ হাইতি সরকারকে জাতীয় বাজেটের ৮০ শতাংশই ব্যয় করতে হতো। বছরের পর বছর হাইতি এই দায় শোধ করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ, এসব অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নে। পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর ভাঁড়ার ভরতে গিয়ে বছরের পর বছর নিজের ভাঁড়ার খালি করে ফেলেছে হাইতি।
পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো হাইতিকে কেবল দরিদ্র দেশেই পরিণত করেনি, একই সঙ্গে দেশটির রাজনীতিতে বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। এমনকি যেসব রাষ্ট্রনায়ক দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সবাইকে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়রের কথা। হাইতিতে ‘পাপা ডক’ নামে পরিচিত এই স্বৈরশাসক ১৯৫৭ সালে হাইতির ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনের পুরোটা সময়ে দেশটিতে ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলেছে। মার্কিন শাসকেরা তাঁর সমালোচনা করলেও তাঁকে কমিউনিজমবিরোধী ঢাল হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিপরীতে জ্যঁ বার্থ এরিস্তিদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও মার্কিনদের তরফ থেকে ভিন্ন আচরণ পেয়েছেন। তিনি ১৯৯০ সালে ও ২০০১ সালে দুইবার ক্ষমতায় আসেন জনগণের ভোটে। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। মার্কিন হস্তক্ষেপে ১৯৯১ ও ২০০৪ সালে দুটি ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে উৎখাত করা হয়।
মজার ব্যাপার হলো, প্রথমবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এরিস্তিদ দ্বিতীয়বার মার্কিন সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যেসব সেনা কর্মকর্তা তাঁকে উৎখাত করে তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ–এর ভাড়াটে। সিআইএ এ বিষয়ে কখনোই রাখঢাক করেনি।
যাই হোক, পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত, অনুচিত হস্তক্ষেপের কারণে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে হাইতির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা থেকে শুরু করে সব বিষয়েই নীতি নির্ধারণ করে একটি সমান্তরাল সরকার। এই সমান্তরাল শক্তিকে গবেষক জন জনস্টন বলছেন, ‘এইড স্টেট’ বা ‘ত্রাণ রাষ্ট্র’। মূলত বিভিন্ন বিদেশি এনজিও, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানির জোট এটি নিয়ন্ত্রণ করে।
হাইতিতে ২০১০ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর থেকেই এই সমান্তরাল সরকার সর্বময় ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছে। দেশটির সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিও তথাকথিত ‘কোর গ্রুপ’–এর সমান্তরাল সরকারেরই নিয়োগপ্রাপ্ত। এই কোর গ্রুপ হলো, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের একটি জোট। এই জোটই মূলত হাইতির ‘কার্যত শাসক’।
এর ফলে যা হয়েছে, হাইতির শাসক এবং শাসিতের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রের এই প্রধান দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার যোগসূত্রহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন, যখন দেখা যায়, রাস্তায় রাস্তায় অস্ত্রধারী গ্যাং সদস্যরা মহড়া দেয় কিন্তু তাদের বলার কেউ নেই। ক্ষুধায় কাতর মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় কিন্তু প্রতিকার করার কেউ নেই।
হাইতির এই দুর্দশা দেখে এরিস্তিদ ১৯৮৭ সালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা আজ নিজেরাই নিজেদের ইতিহাসের অধীনস্থে পরিণত হয়েছি। আমরা সেই ইতিহাসের অংশ হতে অস্বীকার করেছি।’
ট্র্যাজেডি হলো হাইতিতে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। হাইতির জনগণ শাসন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত হাইতির পরিবর্তনের আশা নেই।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত কেনান মালিকের নিবন্ধ, অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১৮ ঘণ্টা আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে