অনলাইন ডেস্ক
শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে চীনের ভূমিকাকেই অনেকে বড় করে দেখেন। বিপুল ঋণের জালে শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত চীনকে তাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর হাম্বানটোটা ছেড়ে দিয়েছে। ১১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে এই গভীর সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ পায় চীন। এই অর্থ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সাহায্য করবে বলে আশা করেছিল রাজাপক্ষে সরকার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আইএমএফের কাছ থেকে উদ্ধার তহবিল পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার। কিন্তু এর মধ্যে মুদ্রার পতন, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকটে ফুঁসে ওঠে জনগণ। ভেস্তে যায় আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা।
এদিকে সংকটের মধ্যে নতুন করে শ্রীলঙ্কায় মাথা গলানোর চেষ্টা করছে ভারত। চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীরা সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিয়েছে। এর মধ্যে ভারতবিরোধী স্লোগানও শোনা গেছে।
‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশ বিক্রি করবেন না’; ‘ভারত: শ্রীলঙ্কা তোমার আরেক রাজ্য নয়’; ‘ভারত: শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করো না’—এ ধরনের স্লোগান ব্যাপকভাবেই শোনা গেছে।
কিন্তু এ ধরনের ভারতবিরোধী মনোভাব যেখানে এখনো গভীরভাবেই টিকে আছে, তখন এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে শ্রীলঙ্কানরা ভারতকে কীভাবে দেখছেন সেটি কিন্তু ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে।
গভীর ও অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শ্রীলঙ্কা। বিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ছয়বারের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দিনেশ গুনাবর্ধনের পাশাপাশি শপথ নিয়েছেন ১৭ জন মন্ত্রী। বিক্ষোভকারীরা নতুন সরকারকে মেনে নেয়নি। তবে কঠোর অবস্থান নিয়েছে রনিল সরকার। সেনাবাহিনী নামিয়ে বিক্ষোভকারীদের তুলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপক ধরপাকড় চলছে।
বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণের পাহাড় গড়েছে। এখন খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের উপস্থিতিকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে একটি অংশ। কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী দলগুলোর ভারতবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেছে।
কিন্তু কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কা যখন হঠাৎ গভীর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে, তখন দেশটির সরকার ভারতের দিকে ঝুঁকে যায়। দিল্লিতে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার আর্থিক সাহায্যে সাড়া দেয়। যদিও এটি প্রথম ঘটনা নয়। প্রকৃতপক্ষে বিগত বছরে ভারতের মতো অন্য কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কাকে এতটা সাহায্য করেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক সহায়তার জন্য শ্রীলঙ্কা মরিয়া। এই পরিস্থিতি দিল্লিকে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপ দেশটিতে তার প্রভাব পুনরুদ্ধারে সাহায্য করছে, যেখানে চীন ১৫ বছর ধরে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ঋণ এবং অন্যান্য আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে শ্রীলঙ্কার গভীরে প্রবেশ করে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা বিবিসিকে বলেন, ‘ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে এই সংকটময় সময়ে। আমরা একটি দেশ হিসেবে একটি বিশাল সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছি এবং ভারত এগিয়ে এসে আমাদের সমর্থন করেছে।’
ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার সম্পর্ক কিন্তু শত বছরের। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
দিল্লি কলম্বোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। ভারত থেকে প্রচুর পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রী আমদানি করে শ্রীলঙ্কা। দ্বীপরাষ্ট্রটির সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে।
২০০৫ সাল মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে কলম্বো ভারতীয় প্রভাববলয় থেকে দূরে সরে যায়। ধীরে ধীরে চীনের সঙ্গে বহু অবকাঠামো প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয় শ্রীলঙ্কা। সবশেষ আলোচনায় আসে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হাম্বানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর চুক্তি।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চীন এ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে, যা শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ।
কিন্তু শ্রীলঙ্কা তার জ্বালানির ঘাটতি ও খাদ্যের দাম বাড়ানোর পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলায় অতিরিক্ত ঋণ চাওয়া সত্ত্বেও বেইজিং এখনো কোনো নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
অন্যদিকে, ভারত ক্রেডিট ও কারেন্সি সোয়াপ হিসেবে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ক্রেডিট লাইনের অংশ হিসেবে গত কয়েক মাসে শ্রীলঙ্কায় অতিপ্রয়োজনীয় জ্বালানি, খাদ্য ও সারের বেশ কয়েকটি চালান পাঠিয়েছে দিল্লি।
দিল্লির ঋণের পাশাপাশি ডিএমকে দলীয় মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন তামিলনাড়ু সরকারও শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও ওষুধের চালান পাঠিয়েছে। গত ১৯ জুলাই তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেশী দেশের ক্রমবর্ধমান সংকট পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা শ্রীলঙ্কান জনসাধারণের মধ্যকার পূর্বধারণার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
এ নিয়ে বেশ কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে তার সত্যতা পেয়েছে বিবিসি। যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা টাইরোন সেবাস্টিয়ান বলেন, ‘ভারত আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য পাঠিয়ে সময়মতো সাহায্য দিয়েছে। ভারতীয় সাহায্য না থাকলে শ্রীলঙ্কার পক্ষে এটা কঠিন হতো।’
সমাজকর্মী মেলানি গুনাথিলাকে বলেন, ‘সংহতি ও সমর্থনের আশ্চর্যজনক হৃদ্যতা প্রদর্শনের জন্য’ ভারতের জনগণের কাছে শ্রীলঙ্কার মানুষ কৃতজ্ঞ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ভারত এমনি এমনি সিদ্ধান্ত নেয়নি। এমন পদক্ষেপের কৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে। এটি দিল্লিকে তার প্রতিবেশীর ওপর প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করবে।
ভারতের প্রাথমিক ক্রেডিট লাইন ঘোষণার পর গত জানুয়ারিতে উভয় দেশ উত্তর-পূর্ব ত্রিনকোমালি বন্দরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত ৬১টি বিশাল তেল ট্যাংক যৌথভাবে পরিচালনা করতে সম্মত হয়। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত ব্রিটিশ যুগের এই অবকাঠামোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। এটি ভারতের কৌশলগত তেল মজুতের সুযোগ করে দেবে।
একইভাবে গত সেপ্টেম্বরে কৌশলগত কলম্বো বন্দরে ওয়েস্টার্ন কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার চুক্তিতে ভারতীয় জায়ান্ট আদানি গ্রুপকে বেশির ভাগ অংশীদারত্ব দেওয়া হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের ব্যাপারে নাক উঁচু বামপন্থীরাও এখন নরম সুরে কথা বলছেন। বাম দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার অ্যালায়েন্সের এমপি হরিণী অমরাসুরিয়া বিবিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি না যে কোনো দেশ নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আমাদের সাহায্য করবে। ভারত অবশ্যই তাদের স্বার্থ দেখবে।’
অমরাসুরিয়া বলেন, ‘ভারতের মতো শ্রীলঙ্কাকেও তার সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারতের হাতে নিজস্ব অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে কি না, সে বিষয়টিও দেখতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, শ্রীলঙ্কার তামিল সংখ্যালঘু প্রশ্ন এবং তাদের অধিকারের দাবি ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনাকে প্রভাবিত করবে।
১৯৮০-এর দশকে শ্রীলঙ্কার বহু তামিল বিদ্রোহী ভারতে আশ্রয় নেয়। এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ তোলে কলম্বো, যেখানে শ্রীলঙ্কায় তামিলরা নিজেদের আলাদা আবাসভূমির জন্য লড়ছিল।
২০০৯ সালের মে মাসে বিদ্রোহীদের শোচনীয় ও নির্মম পরাজয়ের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ওই সময় রাজাপক্ষে সরকারের বিদ্রোহ দমন উদ্যোগে কিন্তু ভারতও পাশে দাঁড়িয়েছিল।
শ্রীলঙ্কা অবশ্য এখনো ১৯৮৭ সালের ভারত-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এই চুক্তির আওতায় তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠসহ অন্যান্য প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা বলা আছে।
বাম নেত্রী অমরাসুরিয়া বলেন, ‘অতীতে সব সময় একটি উদ্বেগ ছিল যে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করে।’
তবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট আপাতত দুই দেশের মধ্যে এসব রাজনৈতিক উদ্বেগকে অগ্রাহ্য করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে বেশ কিছু শ্রীলঙ্কান বিশেষ করে তামিল অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল থেকে মানুষ অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচতে তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নিয়েছে। দ্বীপদেশটিতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে এই অভিবাসনপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়তে পারে।
নিজ দেশে সমস্যার সম্মুখীন হলে শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু তামিল ও মুসলিম সম্প্রদায় প্রায়ই ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা বরাবরই সরকারের সংখ্যালঘু দমনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। ভারত সম্পর্কে অবিশ্বাস ও সংশয় এই সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেই বেশি।
তবে অতীতের তিক্ততা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন ভারতের আর্থিক সহায়তার প্রশংসা করছেন।
শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে চীনের ভূমিকাকেই অনেকে বড় করে দেখেন। বিপুল ঋণের জালে শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত চীনকে তাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর হাম্বানটোটা ছেড়ে দিয়েছে। ১১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে এই গভীর সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ পায় চীন। এই অর্থ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সাহায্য করবে বলে আশা করেছিল রাজাপক্ষে সরকার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আইএমএফের কাছ থেকে উদ্ধার তহবিল পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার। কিন্তু এর মধ্যে মুদ্রার পতন, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকটে ফুঁসে ওঠে জনগণ। ভেস্তে যায় আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা।
এদিকে সংকটের মধ্যে নতুন করে শ্রীলঙ্কায় মাথা গলানোর চেষ্টা করছে ভারত। চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীরা সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিয়েছে। এর মধ্যে ভারতবিরোধী স্লোগানও শোনা গেছে।
‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশ বিক্রি করবেন না’; ‘ভারত: শ্রীলঙ্কা তোমার আরেক রাজ্য নয়’; ‘ভারত: শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করো না’—এ ধরনের স্লোগান ব্যাপকভাবেই শোনা গেছে।
কিন্তু এ ধরনের ভারতবিরোধী মনোভাব যেখানে এখনো গভীরভাবেই টিকে আছে, তখন এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে শ্রীলঙ্কানরা ভারতকে কীভাবে দেখছেন সেটি কিন্তু ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে।
গভীর ও অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শ্রীলঙ্কা। বিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ছয়বারের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দিনেশ গুনাবর্ধনের পাশাপাশি শপথ নিয়েছেন ১৭ জন মন্ত্রী। বিক্ষোভকারীরা নতুন সরকারকে মেনে নেয়নি। তবে কঠোর অবস্থান নিয়েছে রনিল সরকার। সেনাবাহিনী নামিয়ে বিক্ষোভকারীদের তুলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপক ধরপাকড় চলছে।
বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণের পাহাড় গড়েছে। এখন খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের উপস্থিতিকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে একটি অংশ। কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী দলগুলোর ভারতবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেছে।
কিন্তু কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কা যখন হঠাৎ গভীর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে, তখন দেশটির সরকার ভারতের দিকে ঝুঁকে যায়। দিল্লিতে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার আর্থিক সাহায্যে সাড়া দেয়। যদিও এটি প্রথম ঘটনা নয়। প্রকৃতপক্ষে বিগত বছরে ভারতের মতো অন্য কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কাকে এতটা সাহায্য করেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক সহায়তার জন্য শ্রীলঙ্কা মরিয়া। এই পরিস্থিতি দিল্লিকে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপ দেশটিতে তার প্রভাব পুনরুদ্ধারে সাহায্য করছে, যেখানে চীন ১৫ বছর ধরে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ঋণ এবং অন্যান্য আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে শ্রীলঙ্কার গভীরে প্রবেশ করে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা বিবিসিকে বলেন, ‘ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে এই সংকটময় সময়ে। আমরা একটি দেশ হিসেবে একটি বিশাল সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছি এবং ভারত এগিয়ে এসে আমাদের সমর্থন করেছে।’
ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার সম্পর্ক কিন্তু শত বছরের। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
দিল্লি কলম্বোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। ভারত থেকে প্রচুর পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রী আমদানি করে শ্রীলঙ্কা। দ্বীপরাষ্ট্রটির সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে।
২০০৫ সাল মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে কলম্বো ভারতীয় প্রভাববলয় থেকে দূরে সরে যায়। ধীরে ধীরে চীনের সঙ্গে বহু অবকাঠামো প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয় শ্রীলঙ্কা। সবশেষ আলোচনায় আসে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হাম্বানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর চুক্তি।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চীন এ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে, যা শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ।
কিন্তু শ্রীলঙ্কা তার জ্বালানির ঘাটতি ও খাদ্যের দাম বাড়ানোর পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলায় অতিরিক্ত ঋণ চাওয়া সত্ত্বেও বেইজিং এখনো কোনো নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
অন্যদিকে, ভারত ক্রেডিট ও কারেন্সি সোয়াপ হিসেবে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ক্রেডিট লাইনের অংশ হিসেবে গত কয়েক মাসে শ্রীলঙ্কায় অতিপ্রয়োজনীয় জ্বালানি, খাদ্য ও সারের বেশ কয়েকটি চালান পাঠিয়েছে দিল্লি।
দিল্লির ঋণের পাশাপাশি ডিএমকে দলীয় মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন তামিলনাড়ু সরকারও শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও ওষুধের চালান পাঠিয়েছে। গত ১৯ জুলাই তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেশী দেশের ক্রমবর্ধমান সংকট পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা শ্রীলঙ্কান জনসাধারণের মধ্যকার পূর্বধারণার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
এ নিয়ে বেশ কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে তার সত্যতা পেয়েছে বিবিসি। যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা টাইরোন সেবাস্টিয়ান বলেন, ‘ভারত আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য পাঠিয়ে সময়মতো সাহায্য দিয়েছে। ভারতীয় সাহায্য না থাকলে শ্রীলঙ্কার পক্ষে এটা কঠিন হতো।’
সমাজকর্মী মেলানি গুনাথিলাকে বলেন, ‘সংহতি ও সমর্থনের আশ্চর্যজনক হৃদ্যতা প্রদর্শনের জন্য’ ভারতের জনগণের কাছে শ্রীলঙ্কার মানুষ কৃতজ্ঞ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ভারত এমনি এমনি সিদ্ধান্ত নেয়নি। এমন পদক্ষেপের কৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে। এটি দিল্লিকে তার প্রতিবেশীর ওপর প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করবে।
ভারতের প্রাথমিক ক্রেডিট লাইন ঘোষণার পর গত জানুয়ারিতে উভয় দেশ উত্তর-পূর্ব ত্রিনকোমালি বন্দরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত ৬১টি বিশাল তেল ট্যাংক যৌথভাবে পরিচালনা করতে সম্মত হয়। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত ব্রিটিশ যুগের এই অবকাঠামোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। এটি ভারতের কৌশলগত তেল মজুতের সুযোগ করে দেবে।
একইভাবে গত সেপ্টেম্বরে কৌশলগত কলম্বো বন্দরে ওয়েস্টার্ন কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার চুক্তিতে ভারতীয় জায়ান্ট আদানি গ্রুপকে বেশির ভাগ অংশীদারত্ব দেওয়া হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের ব্যাপারে নাক উঁচু বামপন্থীরাও এখন নরম সুরে কথা বলছেন। বাম দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার অ্যালায়েন্সের এমপি হরিণী অমরাসুরিয়া বিবিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি না যে কোনো দেশ নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আমাদের সাহায্য করবে। ভারত অবশ্যই তাদের স্বার্থ দেখবে।’
অমরাসুরিয়া বলেন, ‘ভারতের মতো শ্রীলঙ্কাকেও তার সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারতের হাতে নিজস্ব অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে কি না, সে বিষয়টিও দেখতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, শ্রীলঙ্কার তামিল সংখ্যালঘু প্রশ্ন এবং তাদের অধিকারের দাবি ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনাকে প্রভাবিত করবে।
১৯৮০-এর দশকে শ্রীলঙ্কার বহু তামিল বিদ্রোহী ভারতে আশ্রয় নেয়। এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ তোলে কলম্বো, যেখানে শ্রীলঙ্কায় তামিলরা নিজেদের আলাদা আবাসভূমির জন্য লড়ছিল।
২০০৯ সালের মে মাসে বিদ্রোহীদের শোচনীয় ও নির্মম পরাজয়ের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ওই সময় রাজাপক্ষে সরকারের বিদ্রোহ দমন উদ্যোগে কিন্তু ভারতও পাশে দাঁড়িয়েছিল।
শ্রীলঙ্কা অবশ্য এখনো ১৯৮৭ সালের ভারত-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এই চুক্তির আওতায় তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠসহ অন্যান্য প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা বলা আছে।
বাম নেত্রী অমরাসুরিয়া বলেন, ‘অতীতে সব সময় একটি উদ্বেগ ছিল যে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করে।’
তবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট আপাতত দুই দেশের মধ্যে এসব রাজনৈতিক উদ্বেগকে অগ্রাহ্য করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে বেশ কিছু শ্রীলঙ্কান বিশেষ করে তামিল অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল থেকে মানুষ অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচতে তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নিয়েছে। দ্বীপদেশটিতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে এই অভিবাসনপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়তে পারে।
নিজ দেশে সমস্যার সম্মুখীন হলে শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু তামিল ও মুসলিম সম্প্রদায় প্রায়ই ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা বরাবরই সরকারের সংখ্যালঘু দমনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। ভারত সম্পর্কে অবিশ্বাস ও সংশয় এই সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেই বেশি।
তবে অতীতের তিক্ততা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন ভারতের আর্থিক সহায়তার প্রশংসা করছেন।
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে